তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ৩১
যাবেনা, যাবেনা বলেও শেষ অবধি যেতে হলো সায়রাকে। অন্যসবার কথা ফেলতে পারলেও মুনতাহার কথা এড়াতে পারেনি সে। অনিচ্ছাকৃত ভাবেই আসতে হলো। মুনতাহা বেগম আহনাফ সাহেব আসেননি। আহনাফ সাহেবের জরুরী অফিসিয়াল কাজের কারণে শেষ মুহূর্তে এসে ক্যান্সেল করতে হয়েছে তাদের। সায়রাকে জোর করেই পাঠিয়েছেন তারা।
জানালার কাচে হেলান দিয়ে দূর অদূরে চেয়ে আছে সায়রা। এলোমেলো অগোছালো হাওয়ায় চুল উড়ছে তার। গাড়ি চলছে নিরুদ্দেশ অচিন পথে। দুপাশে চা বাগান মাঝবরাবর রাস্তা। দূরে পাহাড় ভেসে আছে। চোখের পলকেই সবকিছু মিলিয়ে যাচ্ছে। এই দেড় বছরে প্রথম এত বড় জার্নি করছে সে। সবার মাঝে থেকেও যেন এখানে নেই সায়রা। নিজেকে বড্ড একা অসহায় লাগছে। বারবার শুরু আরসালের কথা মনে পড়ছে। চোখজোড়া ভরে আসছে। মনে অদ্ভুত এক অস্থিরতা কাজ করছে। যেন কোন বড় এক ঝড় আসতে চলছে।
ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে আবিরের দিকে ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে চাইল নিপা বেগম। মায়ের ক্রুদ্ধতার কারণ আবিরের জানা। আবিরদের হোটেল বিজনেস। আবিরের বাবা মারা যাবার পর এই হোটেল বিজনেস তিনি একা হাতে সামলেছে। ভীষণ সময়নিষ্ঠ তিনি। সময়কে অবহেলাকারী লোকজন উনার একদম পছন্দ না। অতীত জেনে সায়রাকে খুব একটা পছন্দ করেননি তিনি। শুধু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা সুযোগ দিচ্ছেন। নিপা বেগম ক্রুদ্ধ আওয়াজে বললেন,
–” কেমন মেয়ে পছন্দ করেছ আবির? উনাদের কি নিম্নতম কমনসেন্স নেই! বিকালের কথা বলে সন্ধ্যা হতে চলল এখনো পৌঁছায়নি। এই মেয়ে নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই, শুধু তোমার কথা ভেবে একটা সুযোগ দিচ্ছি, এখানে এসেছি! ”
চুপ রইল আবির। মনে মনে নিজেকে শখানেক গালি দিলো। আজ সায়রারা আসছে, আজই মায়ের সাথে দেখা করানোর পরিকল্পনা করাটা একদম উচিত হয়নি তার। গাড়িঘোড়ার রাস্তা সময় লাগতেই পারে। তার বুঝা উচিত ছিল ব্যাপারটা। মায়ের পাশের চেয়ারটায় বসে। মাকে শান্ত করার চেষ্টায় বলল আবির,
–” গাড়িঘোড়ার রাস্তা এতটা পথ একটু তো সময় লাগবেই। ট্রাস্ট মি মা! তুমি যখন সায়রাকে দেখবে তুমি সব ভুলে যাবে। তোমার সব রাগ জেদ ভ্যানিস হয়ে যাবে!”
নিপা বেগম কিড়মিড় করে উঠল। ছেলেটার মাথা গেছে। একদম পাগল হয়েছে ছেলেটা। না হয় এমন বিধবা মেয়েকে বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগে! প্রত্যুত্তর করল না নিপা বেগম চুপ করে রাগী তপ্ত নিশ্বাস ফেলল শুধু।
চা বাগানের মাঝে বিশাল বিস্তৃত রিসোর্ট। বড় চওড়া গেট। কার্ড দেখাতেই গেট ছাড়ল দারোয়ান। শুঁ করে ভিতরে ঢুকল গাড়ি। গাড়ি থেকে নামতেই আবিরকে দেখতে পেল সায়ন। আবির চওড়া হেসে এগিয়ে এলো। স্টাফরা এগিয়ে এসে ব্যাগপত্র গাড়ি থেকে নামিয়ে নিলো। সবাই একে অপরের সাথে কুশল বিনিময় করছে। শুধু সায়রাই দূরে দাঁড়িয়ে। নিপা বেগম দূর থেকে সাবধানী চাহনিতে সবটা দেখছিলেন। এত মানুষের মাঝে সায়রার দিকে উনার দৃষ্টি আটকায়। অবশ্য ছবিতে একবার দেখেছিলেন তিনি। তাই চিনতে খুব একটা ভুল হলো না উনার। মেয়েটা ছবি থেকে বাস্তবে বেশি সুন্দরী। চেহারায় অন্যরকম আদুরে স্নিগ্ধ ভাব আছে। চোখজোড়া ভীষণ সরল নিষ্পাপ। এত বছরের মানুষ চেনার অভিজ্ঞতা আছে উনার। মুখশ্রী দেখলেই ছককাটা হিসাব করে তার চরিত্র ধরে ফেলতে পারেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছে, সায়রা মেয়েটা ভীষণ সরল। মেয়েটার মাঝে কৃত্রিম, ছলচাতুরী ,মিথ্যাচারের বিন্দুমাত্র ছিটাফোঁটা নেই! এমন মেয়ের হাজার কমতি থাকলেও পুত্রবধূ করতে কোন আপত্তি নেই উনার। বরং হেসে হেসে সম্পর্কটা মেনে নিবেন উনি!
এক কথার মানুষ নিপা বেগম। যা বলবেন সরাসরি বলতেই পছন্দ করেন তিনি। সায়রার দিকে এগিয়ে আসতেই ম্লান হেসে সালাম জানায় সায়রা। সালামের উত্তর নিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন নিপা বেগম,
–” আমার তোমাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে সায়রা। তোমাদের বাড়ি থেকে কোন আপত্তি না থাকলে আগামীকালই পাকা কথা সারতে চাই! ”
নিপা বেগমের কথায় হতভম্ব সায়রা। কিছুতেই তার বিস্ময় কাটছে না। কিংকত্র্তব্যবিমূঢ় মুখে রিদ্ধির দিকে তাকাল। রিদ্ধির করুন চাহনি। সায়রার বুঝতে বাকি রইল না এসব তার পরিবারের প্রি- প্লান। মিথ্যা বলে ট্রিপের কথা বলে সায়রাকে সিলেটে এনেছে তারা। তাই- ই গাড়িতে আবির নামক লোকটার এত প্রশংসা করছিল? ক্রোধে সায়রার চোখ টলমল করছে। আশেপাশে লোকজন দেখে চুপ রইল সায়রা। রাস্তায় সবার সামনে কোন তামাসা করে চাইছে না সে।
.
রুমে পৌঁছিয়ে চিৎকার করে চেঁচিয়ে উঠল সায়রা। ক্রোধিত আওয়াজে প্রশ্ন ছুঁড়ল রিদ্ধির দিকে,
–” কেন এমন করলে দি? এই বিশ্বাসঘাতকতার কোন মানে ছিল? আমি স্পষ্ট বলেছিলাম বিয়ে করব না আমি! তোমরা সবাই আমাকে কি পেয়েছ? খেলনাপুতুল! বিয়ে দিয়ে দিলেই আমি ভালো থাকবো। তোমরা কেন বুঝো না আমার কাউকে প্রয়োজন নেই। আমি ভালো আছি। ”
সিন্থিয়া বেগম বিরক্তি ভারী ধমক দিয়ে বললেন,
–” কোন কিছু আমাদের চোখে পড়ে না! তোর কি মনে হয় আমরা অন্ধ সায়রা? তোর এই ছন্নছাড়া জীবন দেখতে আমাদের ভালো লাগে? আমি তোর মা। আমি চাই আমার মেয়ের একটা সাজানো গোছানো সুন্দর জীবন হোক। আর কতকাল এভাবে পড়ে থাকবি তুই? একাকী বাঁচা যায়না!”
–” মা তুমি এমন বলছ? তুমি? দেড়বছর কি অনেক সময়? যদি আরসাল কোনদিন ফিরে আসে তখন উনাকে কি বলবে মা? তোমরা কেন বুঝো না আমি আরসালের জায়গা কাউকে দিতে পারবো না। কাউকে না। যদি এরপরও আমাকে জোর করো তাহলে এর ফল খারাপ হবে মা!”
— ” আরসাল আর কোন দিন ফিরবে না সায়রা। ও নেই ! কেন মানছিস না তুই? ওর জন্য বসে থাকা বোকামি! ”
চিৎকার করে বলল সিন্থিয়া বেগম। সায়রা এবার কেঁদেই ফেলল। নিজেকে আর শক্ত রাখতে পারছেনা সে। নিজের কাছের মানুষ গুলো এমন আচরণ করলে কোথায় যাবে সে? কার কাছে যেয়ে মুখ গুজবে? তারা কেন বুঝেনা, সায়রার আরসাল ছাড়া কাউকে চাইনা! কাউকে না!
কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে ছুটে গেল সায়রা। আরমিন পেছন পেছন যেতে চাইলে আটকাল তুর্জয়। গম্ভীর আওয়াজে বলল,
— ” ওকে ওর মত থাকতে দেও”
.
বাগানের লেকের উপর কাঠের সিড়ি বেয়ে ওপারে চলে গেল সায়রা। ওই আলো ওই লোকালয় অসহ্য লাগছে তার। সব কিছু বিরক্তিকর। সব! অন্ধকারে কারো সাথে সজোরে ধাক্কা লাগল সায়রার। মাটিতে ছিটকে পড়ল দুজন। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্ধকারে সবকিছু অস্পষ্ট। মাটি থেকে উঠতে উঠতে চোখ মুছতে মুছতে মৃদু আওয়াজে বলল “সরি”
ছুটে চলে গেল বাগানের শেষ দিকে। পেছনের মানুষটা পেছন থেকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে। দিক অনুসরণ করে চিন্তিত মুখ করে পেছন পেছন গেল সায়রার।
বাগানের শেষ মাথায় বেঞ্চের উপর ধপ করে বসে পড়ল সায়রা। নিরিবিলি জনশূন্য পরিবেশ। সায়রা মুখ চেপে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। এলোমেলো ভাবে নিজের হাত খামচাচ্ছে আর কাঁদছে। কাঁদছে তো কাঁদছেই। পৃথিবী সব কিছু মেনে নিতে পারবে সায়রা। আরসাল আর ফিরবেনা এই একটা কথা মেনে নিতে পারবে না সে। এটা তার জন্য অসম্ভব। এই একটা আশা নিয়েই তো বেঁচে আছে সে! এই আশাটাও ফুরিয়ে গেলে কি নিয়ে বাঁচবে সায়রা?
আকাশ পানে চেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল সায়রা। চিৎকার করে বলল,
–” আপনি কোথায় আছেন আরসাল? কেন ফিরছেন না! প্রতিদিন একটু একটু করে ভাঙছি আমি, আমি আর পারছি না আরসাল। আর পারছিনা! নিজেকে আর শক্ত রাখছে পারছিনা। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে প্রতিনিয়ত আমার!”
বাহিরে ঝড়ো হাওয়া বইছে। হালকা শীত শীত লাগছে সায়রার। কান্না করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে ধ্যান নেই তার। মাথাটা প্রচণ্ড ভারী হয়ে আছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা করছে। নাকে চিরপরিচিত সেই চেনা মিষ্টি ঘ্রাণ। আমতাআমতা করে চোখ খুলল সে। কারো বুকে গভীর ভাবে ল্যাপটে আছে। হুশ ফিরতেই ছিটকে দূরে সরে যেয়ে চাইল সে। পারল না। পাশের মানুষটা কোমর চেপে গভীর ভাবে মিশিয়ে নিলো বুকে। মাথা তুলে পিটপিট দৃষ্টি মেলে উপর দিকে চাইল সায়রা। দূরের আলোয় আবছা স্পষ্ট চারিদিক। বিস্ময়ে থম মেরে রইল। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো ‘আরসাল’।আঁখি জোড়া জলে ভরে এলো। টলমল দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে রইল।কিছু বলতে চাইল। গলা থেকে আওয়াজ এলো না। আরসাল কপালে চুমু এঁকে বলল,
–” আমি আছি পুতুলবউ ! তোর কাছেই আছি!”
সায়রা ফ্যালফ্যাল চেয়ে রইল। এটা কি স্বপ্ন! এতটা বাস্তবানুগ স্বপ্নও হয়? যদি এটা স্বপ্ন হয় তবে এই ঘুম কাটাতে চায়না সায়রা। চিরতরে এই স্বপ্নেই রয়ে যেতে চায়।
চলবে…….