তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ২৯

বেশ কিছুদিন কেটেছে। ভার্সিটির বন্ধ কাটিয়ে, দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু। নিয়মিত ক্লাস করছে সায়রা। অল্প কিছুদিনেই পুরোপুরি সংসারী হয়ে উঠেছে। পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারও বেশ দক্ষতার সাথে সামলাচ্ছে। পুত্রবধূকে নিয়ে মুনতাহা আফনাফ সাহেবের গর্বের শেষ নেই। বাবা মায়ের সাথে সায়রার সম্পর্ক এখনো আগের মতই। মাহির আহমেদ মেয়ের এত বড় সিদ্ধান্তে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। ক্ষত ভড়তে এখনো বেশ সময় লাগবে! আরসাল সায়রার সম্পর্কটাও আপনি- তুই- তে আটকে।

ভার্সিটিতে সায়রা আরমিন মুখোমুখি হলেও, কথা হয় না। দুজন দুজনকে বেশ এড়িয়ে চলে। বাবার বাড়িতে যাওয়া হয়না সায়রার। বাবার রুষ্টতার মুখোমুখি হওয়ার বিন্দু মাত্র সাহস নেই তার। সম্পর্ক গুলো এত বেশি এলোমেলো হয়ে গেছে যে, তা পূর্বের রূপে ফিরতে এখনো অনেক সময় লাগবে। কিন্তু আজ পাখি বায়না ধরেছে, সায়রাকে যেতে হবেই হবে! আজ পাখির জন্মদিন। ছোট বোনের আবদার ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্যি কই সায়রার। তাছাড়া বাড়ির সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছে। তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো সায়রা আজ ঐ বাড়িতে যাবে। আর কারো জন্য না হোক, পাখির জন্য যাবে! বিকালবেলা। সূর্যের আলো নরম হয়ে এসেছে। পশ্চিমা আকাশে রক্তিম রঙের ছড়াছড়ি। চারিদিকে শেষ বেলার আলোয় আলোকিত। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল গোছাচ্ছে সায়রা। সেই ফাঁকেফাঁকে নিজেকেও সাবধানী দৃষ্টিতে দেখে নিচ্ছে। শাড়ির ফাঁকে কোথায়ও আবার পেট দেখা যাচ্ছে কিনা! আরসাল বাড়ি নেই। পাখির উপহার আনতে বেরিয়েছে। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল সায়রার। ফোনের দিকে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো। পাখি ফোন করেছে। রিসিভ করে কানে ধরতেই অপর পাশ থেকে পাখির ব্যস্ত আওয়াজ ভেসে এলো,

–” সায়রুপু!! কই তুমি? আমার সব ফ্রেন্ডরা চলে এসেছে। তুমি এখনো আসোনি! তুমি কি আসবে না?”

–” ওহ পাখি শান্ত হয়ে শ্বাস নে তো আগে! আমি কি বলেছি, আসবো না? উনি বেড়িয়েছে বাড়ি ফিরুক! এক সাথে আসছি। ”

–” সত্যি আসছ তো?”

— ” একদম সত্যি!”

শান্ত হলো পাখি। ফোন রাখল সায়রা। নিজেকে বারংবার আয়নায় দেখছে সে। আজকের দিনটা ভীষণ বিশেষ সায়রার কাছে। পাঁচ বছর আগে এই দিনেই আরসালের সাথে তার বাগদান হয়েছে। আরসালের জীবনের সাথে তার জীবন জুড়েছিল। আর আজ পাঁচ বছর পর আজ এই দিনটাকেই নিজের ভালোবাসার স্বীকারোক্তির জন্য বেছে নিয়েছে। আর কতকাল নিজেকে আরসাল থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে? আর কতকাল নিজের অনুভূতি গুলোকে লুকাবে? সত্যি তো এটাই সায়রা আরসালকে ভালোবাসে। প্রচণ্ড ভালোবাসে! এক ঘরে, এক বিছানায় থেকে নিজের অনুভূতি গুলোকে লুকানো দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে সায়রার। মনে মনে অটুট প্রতিজ্ঞা এঁটেছে সে। আজ নিজের মনে সব কথা সকল অনুভূতি জানাবে আরসালকে। নিজেকে উজাড় করে ভালোবাসবে। নিজেদের মাঝে আর কোন বাঁধা, কোন দূরত্ব রাখবে না!
আজ আরসালের পছন্দের শাড়ি পড়েছে, বেশ সুন্দর করে সেজেছে। হাত ভর্তি শুভ্র কাচের চুড়ি। আরসালের পছন্দ মতই চুল খোলা রেখেছে। সায়রাকে এভাবে দেখে মুগ্ধ হবে কি আরসাল! ভেবেই লজ্জায় আয়না থেকে চোখ সরালো সায়রা। অপেক্ষা করতে লাগল আরসালের ফেরার।

রাত আটটা। সন্ধ্যা বাতি জ্বালানো হয়নি। চারিদিক অন্ধকারে ঢেকে। বাড়ির সবাই চলে গেছে। শুধু সায়রাই আরসালের অপেক্ষায় বসে। বিয়ের পর এই প্রথমবার বাবার বাড়ি যাচ্ছে সায়রা। আরসালকে ছাড়া বড্ড বেমানান দেখায়। বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেন, আরসাল সেই বাড়ির জামাই! তাছাড়া আরসাল কাছাকাছি থাকলে নিজেকে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী লাগে সায়রার। নিজের বড্ড আপনজন মনে হয় আরসালকে। এতদিন যেই মানুষটাকে বাগের মত ভয় পেত আজ সেই মানুষটা তার পরম আপনজন! এটাই বুঝি, বিয়ে নামক পবিত্র সম্পর্কের শক্তি!
ঘড়ির কাটা নয়ের দিকে। আরসালকে ফোনের উপর ফোন করছে সায়রা। মোবাইল বাজছে তো বাজছেই। তুলছে না সে! প্রথমদিকে বিরক্ত হলেও, এখন ভীষণ ভয় করছে সায়রার। এর আগে এমন কোনদিন হয়নি। যে সায়রা ফোন করেছে আরসাল তুলেনি! মন বড্ড কু ডাকছে। কোন বিপদ ঘটল না তো আবার?
আরো বিশ মিনিট অপেক্ষা করল। আরসালের কোন খোঁজ না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ল সায়রা। ছুটে চলল গেটের দিকে। দরজার সামনে যেতেই কারো সাথে সজোরে ধাক্কা লাগল সায়রার। মাথা তুলে দেখল- থমথমে মুখে তুর্জয় দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখ অসম্ভব লাল। সেদিকে গুরুত্ব না দিকে চিন্তাভারী আওয়াজে প্রশ্ন করল সায়রা,

–” তুর্জয় ভাই! উনি কোথায় ? আপনি কি জানেন! সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি। উনি এখনো ফিরছে না কেন? একটা গিফট আনতে এত সময় লাগে? আন্দাজ দেখেছেন আপনার ভাইয়ের! ফোনটাও তুলছে না।”

তুর্জয় থম মেরে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সায়রার দিকে। চোখজোড়া টলমল করছে। কন্ঠ বারংবার ভেঙে আসছে। বড় নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো তুর্জয়। ভাঙ্গা আওয়াজে বলল,

–” আরসাল ফোন করেছিল। তোমাকে আমার সাথে যেতে বলেছে সায়রা! বাড়ির সবাই সেখানেই।”

চমকাল সায়রা। ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো। মনে সন্দেহ জাগল। রাত দশটা বাজতে চলছে এই রাতে তাকে কোথায় ডাকছে আরসাল। আজ পাখির জন্মদিন সেখানে না গিয়ে এই রাতে বাহিরে যাবে? আর তাছাড়া আরসাল সায়রা কে ফোন না করে তুর্জয়কেই কেন বলল। আর বাড়ির বাকি সবাই বা কোথায় গেল?
বেশ সন্দেহ জাগলেও প্রশ্ন করল না সায়রা। চুপচাপ তুর্জয়ের গাড়িতে চড়ে বসল। মন বড্ড কু ডাকছে তার। হৃদপিন্ড ধপধপ করছে অচেনা এক ভয়ে। চোখ ঘুরিয়ে একবার তুর্জয়ের দিকে তাকাল সায়রা। বারবার চোখ মুছছে তুর্জয়। কাঁদছে কেন তুর্জয় ভাই! সবাই ঠিক আছে তো! ভাবল সায়রা।
মিনিট বিশেকের ব্যবধানে পৌঁছে গেল তারা। গাড়ি থামল এক ব্রিজের সামনে। সামনের দিকে লোকজনের বিশাল ভিড়। এর সামনে আগানো যাবেনা। ধীর আওয়াজে তুর্জয় বলল,

–“এসে গেছি সায়রা!”

–” এখানে?”

শব্দ করল না তুর্জয়। শুধু মাথা নাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল। সায়রাও দরজা খুলে সামনের দিকে পা বাড়াল। এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন তুর্জয় ভাই? কয়েক কদম সামনে যেতেই মুনতাহা বেগমের চিৎকার কানে এলো সায়রার। কাঁদছে কেন বড় মা? আঁতকে গেল সায়রা। ভিড় ঠেলে ভিতরে ছুটে গেল। সামনে যেতেই দেখল- মাটিতে বসে চিৎকার করে কাঁদছে মুনতাহা বেগম। পাশেই বাড়ির সবাই। সবাই এভাবে কাঁদছে কেন? এখানে কি হয়েছে! ব্যস্ত দৃষ্টিতে দিশেহারা হয়ে আরসালকে খুঁজতে লাগল সায়রা। মিলল না। দেখা মিলল না তার। খানিক দূরেই আরসালের চূর্ণবিচূর্ণ গাড়ি। ব্রিজের রেলিং ভেঙ্গে অর্ধেক গাড়ি ভিতরে বাকি অর্ধেক গাড়ি বাহিরের দিকে। সামনের কাচ ভেঙে সব চুরমার। চারদিকে পুলিশ ঘিরো করে আছে, তবে কি আরসালের…… সায়রা জমে গেছে। পা আর চলছে না তার। সারা শরীর ভেঙে আসছে। কয়েক কদম সামনে যেয়ে মাটিতে ধপ করে বসে পড়ল সায়রা। সায়রাকে দেখা মাত্র মুনতাহা বেগমের কান্নার বেগ বেড়ে গেল। সিন্থিয়া বেগম মেয়ের দিকে এগিয়ে এলো। জড়িয়ে ধরল। সায়রা তখনো শান্ত চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ মুখ ভীষণ রকম শান্ত। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সবাইকে এভাবে কাঁদতে দেখে বেশ ঠান্ডা আওয়াজে প্রশ্ন তুলল সায়রা,

–” সবাই এভাবে কাঁদছে কেন মা? কি হয়েছে। গাড়ি এভাবে ভাঙল কি করে? আরসাল ভাই উনি কই? কখন থেকে ফোন করছি ফোন তুলছে না কেন?”

মেয়ের প্রশ্নে মুখ চেপে কেঁদে উঠলেন সিন্থিয়া। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

–” তোর কপাল পুড়েছে, আরসাল নেই মা। ও নেই!”

মায়ের কথায় ছিটকে দূরে সরে গেল সায়রা। ধমকে চিৎকার করে বলল,

–” পাগল হয়েছ তুমি! এসব কি আবোলতাবোল বকছ। উনি নেই মানে। উনার সাথে আমার দুপুরের পরও কথা হয়েছে। উনি এখানেই আশেপাশে আছেন। দেখবে এখনি চলে আসবে। আরসাল ! আরসাল! কোথায় আপনি !”

বলেই গাড়ির দিকে ছুটে গেল সায়রা। এক পায়ে জুতা আছে অন্য পায়ে নেই। শাড়ি আঁচল এলোমেলো। গাড়ির ভাঙ্গা কাঁচ পায়ে বিঁধে রক্ত ঝরছে। সেই দিকে খেয়াল নেই সায়রার। সামনের দিকে ছুটে যাচ্ছে সে। কাছাকাছি যেতেই পুলিশ আটকায়। চিৎকার করে বলে সায়রা,

–” পথ ছাড়ুন! আমাকে যেতে দিন, আমার আরসাল ভিতরে!”

পথ ছাড়ল না পুলিশ। মাথা নুয়ে পুলিশ ইন্সপেক্টর বললেন,

–” মেডাম, আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তুমৃত্যু চিরন্তন সত্য। সত্যিটা তো মেনে নিতেই হবে। আপনার হাসবেন্ডের বডি গাড়িতে মিলেনি। আনুমান করা যাচ্ছে পিছন থেকে গাড়ির প্রচণ্ড ঢাক্কায় সামনের কাঁচ ভেঙ্গে নিচে পানিতে পড়েছে। ডুবুরিরা খুঁজছে। এখনো কোন সন্ধান মিলেনি। গাড়ি থেকে উনার ফোন আর ওয়ালেট পাওয়া গেছে। ”

কাঁপা কাঁপা হাতে ওয়ালেট আর ফোনটা নিলো সায়রা। ফোনের আলো জ্বালাতেই স্কিনে ভেসে উঠল, সায়রার হাসি উজ্জ্বল ছবি। নোটিফিকেশনে মিস কল ভেসে আছে। ‘পুতুল বউ’। চিৎকার করে কেঁদে উঠল সায়রা। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। দুহাতে মাটিতে প্রচণ্ড আঘাত করছে আর চিৎকার করে কাঁদছে। কাচের চুড়ি ভেঙ্গে রক্তাক্ত হাত। ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে। চিৎকার করে বলছে সায়রা ,

–” সব মিথ্যা! সব মিথ্যা! আপনারা মিথ্যা বলছেন। মিথ্যুক আপনারা। আমার আরসাল আছে। উনি এখানেই আছে”

বুক ফাটা চিৎকার সায়রার। কিছু একটা ভেবে দ্রুত পায়ে উঠে দাঁড়াল সায়রা। ব্রিজের ভাঙা রেলিং- এর দিকে ছুটে গেল। যেই ঝাপ দিতে নিবে পেছন থেকে আরমিন সিন্থিয়া ছুটে গিয়ে আটকাল। ছাড়া পাবার জন্য চাতক পাখির মত ছটফট করছে সায়রা। চিৎকার করে কাঁদছে। ছাড়া পাবার আপ্রাণ চেষ্টা! মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরল সিন্থিয়া। সায়রা কাঁদছে তো কাঁদছেই। অসহায় কণ্ঠে বলল,

–” ছেড়ে দেও মা। আমি চিরকাল উনাকে দূরে ঠেলে এসেছি অন্তত শেষ বেলায় উনার সাথে আমাকে থাকতে দেও। এই জীবনের আর কোন মূল্য নেই। আরসাল ছাড়া এই সায়রা অপূর্ণ। আমার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই মা। কোন অধিকার নেই!”

থেমে যাচ্ছে নিশ্বাস। ক্লান্ত আঁখি মানছে না আর। বুজে আসছে বার বার। নিশ্বাস থেমে আসছে, দুনিয়া গলিয়ে আসছে। আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে সায়রার। ধীরেধীরে সিন্থিয়ার উপর লুটিয়ে পড়ল। গভীর নিদ্রায় ডুবে গেল!

চলবে……

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here