তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ২০
–” খুব শ্রীঘ্রই আমার বাবা মা তোমাদের বাড়িতে বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে যাবে সায়রা।”
তুর্জয় সায়রা মুখোমুখি।ক্যান্টিনের বাম পাশের শেষের টেবিলটায় বসে চা খাচ্ছিল দুজন। ভার্সিটির ক্যান্টিনের চা বেশ জনপ্রিয়। বেশ কয়েকবার তুর্জয়ের কাছে এ নিয়ে গল্প করেছে সায়রা। আজ পর্যন্ত তাদের ক্যান্টিনের চা খাওয়ানি। তা নিয়ে বার কয়েকবার সায়রাকে খোটা দিয়েছে তুর্জয়। তাই আজ পিঠা উৎসবের সুযোগে সায়রা তুর্জয়কে ক্যান্টিনের চা খাওয়ার নিমন্ত্রণ করেছে।
আচমকা তুর্জয়ের এমন কথা শুনে, মাথা তুলে পিটপিট দৃষ্টি মেলে, তুর্জয়ের দিকে তাকাল সায়রা। খুকখুক করে কেঁশে উঠল। গরম চায়ে জিহ্বা পুড়েছে তার। নিজেকে সামলে নিলো সে, চাওড়া হেসে উৎসাহী উত্তর দিলো,
–” সত্যিই তুর্জয় ভাই! খুব শ্রীঘ্রই আরমিন আপুর হাত চাইতে আমাদের বাড়িতে আসছেন! ”
তুর্জয় মুচকি হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। সায়রা খুশিতে গদগদ করে উঠে। দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলে,
–” আপুকে নিজের মনের কথা কবে জানাচ্ছেন তুর্জয় ভাই! আই কান্ট ওয়েট!”
সায়রার এমন উৎসাহ ,ছেলেমানুষি দেখে তুর্জয় হাসল।সায়রার দিকে টিস্যুর বক্স এগিয়ে দিয়ে বলল,
–” শান্ত হও! সব জানাবো। আগে বিয়েটা ঠিকঠাক হোক তারপর আরমিনকে নিজের মনের কথা জানাবো।”
সায়রার চোখ মুখ চুপসে গেল। চোখ মুখ খিঁচে তুর্জয়কে খোঁচা দিয়ে বলল,
–” তুর্জয় ভাই, আপনি এতটা আনরোমান্টিক! কোথায় আগে প্রপোজ করবেন, প্রেম করবেন তারপর বিয়ে শাদি । তা না করে সরাসরি বাড়িতে বিয়ের প্রপোজাল! বেচারি আমার বোনটা! ”
–” তোমার বোনকে আমার ভীষণ ভয় হয় সায়রা! প্রথম ভালোবাসা তো! প্রপোজ করলে রিজেক্ট না করে দেয়। তাই সরাসরি বাড়িতে বিয়ের প্রপোজাল পাঠাব।”
সায়রা জ্ঞানীদের মত মাথা নাড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
–” ওহ! এবার বুঝেছি আপনি রিজেক্ট হওয়ার ভয় পাচ্ছেন!”
দুজন দুজনের দিকে কোণাকোণি চোখ করে তাকাল। চোখাচোখি হতেই, আচমকা ফিক করে হেসে দিলো দুজন।
.
অঁজিষ্ণু খাড়াখাড়ি মাথার উপর। তার তেজস্বী আলোয় চারিদিক সোনালি। আতপের প্রখরতায় চোখ মেলে তাকান যাচ্ছেনা। পিঠা স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরসাল। পরনে সোনালি সুতার কারুকাজ করা কালো পাঞ্জাবী। হাতা ফোল্ড করে কব্জি পর্যন্ত উঠিয়ে রেখেছে। চুল গুলো জেল দিয়ে বেশ সুশ্রী ভাবে ব্রাশ করা। তেজস্বী আতপ তার মুখশ্রীতে এসে পরছে। ফর্সা মুখশ্রী লাল বর্ণ হয়ে আছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দৃষ্টি খাটো করে চোখ ঘুরিয়ে সায়রাকে খুঁজে যাচ্ছে। আশেপাশের মেয়েদের নজর আরসালের দিকেই। এমন সুঠাম দেহের সুদর্শনের দিকে কার না নজর যাবে? ভার্সিটির কালচারাল ক্লাবের দুজন মেয়ে মেম্বার এসে আরসালের পাশে দাঁড়াল। মেয়ে দুজনের মুখশ্রী দেখে মনে হচ্ছে আরসাল তাদের কতদিনের চেনা। একদম আরসালের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। দূরে সরে ভ্রু কুঁচকে নিলো আরসাল। গম্ভীর আওয়াজ করে বলল,
–” জি কিছু বলবেন।”
লাল শাড়ী পরা মেয়েটা হাত বাড়িয়ে বেশ চওড়া হেসে দুলতে দুলতে বলল,
–” হাই, আমি আইদা, ও আমার বান্ধবী নাহিদা। আপনি?”
আরসাল হাত মিলাল না। অনইচ্ছাকৃত গম্ভীর উত্তর দিলো,
–” আরসাল”
–” ওহ ভীষণ সুন্দর নাম। আপনাকে এর আগে কখন দেখিনি। আপনি আউটসাইডার, মেলা দেখতে এসেছেন?”
আরসাল উত্তর দিলো না, বিরক্তি মুখ করে এড়িয়ে গেল। মেয়েটা আবারো হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
–” আমরা ফ্রেন্ডস হতে পারি?”
আরসাল অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে। প্রচণ্ড অনিচ্ছাকৃত সুরে এড়িয়ে বলল,
–” নট ইন্টারেস্টেড!”
এই ভার্সিটির সুন্দরীদের তালিকায় প্রথম সারিতে পড়ে আইদা। প্রতিদিন এত এত প্রপোজাল আসে তার। কত ছেলেকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরায় সে, অথচ এই লোকটা তার দিকে একবার তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। ফ্রেন্ডশিপের জন্য জিজ্ঞেস করলে বলে কি না ‘ নট ইন্টারেস্টেড! ‘ মুখের উপর অপমান! এত অহংকার! আরসালকে প্রচণ্ড দাম্ভিক অহংকারী মনে হলো আইদার। তার ইগোতে প্রচণ্ড লেগেছে। জিদ চাপল যেই করেই হোক, এই লোকটার সাথে সে বন্ধুত্ব করবেই করবে। কিছু কিছু মানুষ নিজেদের ইগো জিদের তাড়নায় এতটাই বশীভূত হয় যে নিজেদের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে, সামনের মানুষটার কাছে নিজেদের তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ রূপে পরিচয় দেয়। আইদাও সেই শ্রেণীর একজন! আরসালের প্রচণ্ড এড়িয়ে চলার পরও নিজেকে বারবার আরসালের উপর ঠেলে দিচ্ছে। কথায় মানছে না বলে অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গিমা করে তা মানাতে চাইছে। আরসাল ভীষণ ক্ষিপ্ত। বরাবরই এই ধরনের থার্ডক্লাস মেয়েদের তার অপছন্দ। কড়া করে কয়েকটা কথা শুনাতে যাবে আইদা নামক মেয়েটা। এমন সময়ই সায়রা আসে। আরসালের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আইদা মেয়েটার মুখের সামনে মাছি তাড়ানোর মত করে বলে,
–” হুস হুস, বেহায়া , বেলাজা। মধু দেখতে না দেখতেই বেহায়াপনা শুরু করা? লজ্জাশরম আছে? নাকি বিসর্জন দিয়েছিস ?”
আইদা ক্ষেপে গেল। সায়রার দিকে এগিয়ে ক্ষিপ্ত স্বরে প্রশ্ন করল,
–” তোমার এত বড় সাহস তুমি আমাকে অপমান করছ? আমাকে? তুমি জানো আমি কে?”
সায়রা নরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে কৃত্রিম হেসে। বেশ শান্ত স্বরে বলল,
–” আপনি কে আপু? তাছাড়া আমি তো আপনাকে কিছু বলিনি । মাছিকে বলছিলাম। এই দেখুন মধুমাখা পিঠা দেখতে দেরী, এদের বেহায়াপনা করতে দেরি নাই। সুড়সুড় করে ঝেঁকে পড়েছে!”
আরসালের রাগটা মুহূর্তেই পানি হয়ে গেল। সায়রার চোখেমুখে ঈর্ষান্বিত আভা স্পষ্ট। সায়রা পারছেনা চোখ দিয়েই আইদা মেয়েটাকে গিলে খেতে। আরসালের বেশ লাগছে। পাশের টেবিলে দাঁড়িয়ে নিজের জেলা কুচুটে পুতুল বউকে দেখছে। মিটমিটে হাসছে।
সায়রা পেছনের টেবিলের কাছে যেয়ে মাছি তাড়াতে লাগল। আইদা থতমত খেয়ে গেল। গলা ঝেড়ে নিজেকে সামলাল। মৃদু হেসে আবারো বলল সায়রা,
–” আপনার কেন মনে হলো আমি আপনাকেই বলছি আপু? রিলেটেড কিছু বলে ফেলেছি কি?”
আইদা মেয়েটা ধমক দিয়ে উঠল। চোখমুখ কঠোর করার চেষ্টা করল থতমত স্বরে বলল,
–” জুনিয়র জুনিয়রদের মত থাকো। সিনিয়রদের কাছে প্রশ্ন করার সাহস পাও কই! এই নাইদা চলতো। নাফিজ ভাই ডাকছে।”
আইদা মেয়েটা দ্রুত পায়ে চলে গেল। আরসাল ফিক করে হেসে দিলো। গা কাঁপিয়ে হাসছে সে। সায়রা ভ্রু কুঁচকে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে আরসালের দিলে তাকাল। নিজের হাসি থামাল আরসাল।
–” বাহ! এত পজেসিভ! ওয়েল ডান।”
সায়রা ভেঙচি কেটে বলল,
–” পজেসিভ না কচু। আমি আপনার জন্য পজেসিভ হইনি। আমি সত্যি সত্যিই মাছি তাড়াচ্ছিলাম! ”
–” আমি কখন বললাম তুই আমার জন্য পজেসিভ। বাই দ্যা ওয়ে মেয়েটার হাসি খুব সুন্দর তাই না সায়রা?”
সায়রা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। গতরাতে তাকে প্রপোজ করে এখন অন্য মেয়েদের হাসির প্রশংসা করা হচ্ছে? আরসালের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে পিছন ফিরল সায়রা। সামনের দিকে পা বাড়িয়ে তেজি স্বরে আওড়াল,
–” তাহলে ওর কাছেই যান!”
দুকদম বাড়াতেই পেছন থেকে হাত টেনে ধরল আরসাল। নিজের দিক ফিরিয়ে। আলতো করে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে হাতের পল্লব ছুঁয়ে দিচ্ছে সে। সায়রা মুখ ফুলিয়ে মাথা নুয়ে আছে। রাগে ঘন নিশ্বাস পড়ছে তার। সায়রার রুষ্ট মুখশ্রী দেখে মৃদু হাসল আরসাল। গভীর করে সায়রার দিকে চেয়ে আছে সে। রাগে চোখ টলটল করছে সায়রার। এত অবুঝ কেন মেয়েটা? শুধু বড়ই হয়েছে। বুদ্ধি এখনো সেই হাঁটুর নিচে। মজা আর সিরিয়াস কথাবার্তার তফাত এখনো বুঝে না সে। সামান্য এক কথায় চোখ জলে পূর্ণ! এত নরম হলে হয়! টেবিলের উপর থেকে বেলি ফুল আর লাল গোলাপের গাজরা নিয়ে সায়রার বাম হাতের বেধে দিলো। সায়রার দিকে ঝুঁকে গাঢ় গভীর স্বরে,
–” মজা করছিলাম পুতুল বউ! এই চোখ, এই মন শুধু একজনেই মুগ্ধ! আর তা হলো তুই! আমার সকল মুগ্ধতা শুধুই তোকে ঘিরে।”
সায়রা চোখ উঁচু করে চাইল। আরসালের ঠোঁটের কোণে মিটমিট হাসি। চোখে গাঢ় এক নেশা লজ্জা পেল সায়রা। লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নিলো সে। সায়রার লজ্জায় লাল নাকটা ছুঁয়ে দিলো আরসাল।
.
জ্যোত্স্না রাত। আকাশে ইয়া বড় এক চাঁদ। চন্দ্রসুধায় আলোকিত চারিদিক। সায়রা ছাদের কিনারা ঘেষে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি গলির রাস্তায়। বিদ্যুৎ বিহীন গলির রাস্তাটা চাঁদের আলোয় স্পষ্ট। দুঘণ্টা হয়ে এলো লোডশেডিং হয়েছে। শুনেছে সামনের মোরে তার পড়েছে। বিদ্যুৎ অফিস থেকে লোক এসেছে। শুনেছে ঠিক হতে আরো ঘন্টা দু এক সময় লাগবে। গায়ে হালকা শাল মুড়িয়ে খোলা চুলে দাঁড়িয়ে আছে সায়রা। মৃদু মৃদু হাওয়ায় অবদ্ধ চুল গুলো দুলছে। মাঝেমাঝে গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে। এখন বিরক্ত হচ্ছেনা, বেশ লাগছে সায়রার। আরসালের কথা ভেবে মৃদু হাসছে সে। এমন সময় ছাদের দরজা লাগানোর আওয়াজ এলো। ধরফরিয়ে উঠল সায়রা। তড়াক ঘুরে পেছনে তাকাল। আরসাল এসেছে। বুকে হাত দিয়ে নিশ্বাস ফেলল সায়রা। বড় বড় পা ফেলে আরসালের দিকে এগিয়ে গেল। চিন্তিত স্বরে বলল,
–” আপনি এখানে? কি করে! সিড়ি দিয়ে এসেছেন? কেউ দেখেনি তো?”
আরসাল নিমিষ হেসে সায়রাকে কাছে টানল। নিচু হয়ে সায়রার মাথায় হাত গলিয়ে দিলো। মুখ এগিয়ে শান্ত স্বরে জবাব দিলো,
–” কাম ডাউন! কেউ দেখেনি আমাকে । সিড়ির রাস্তা অন্ধকার ছিলো।”
সায়রা শান্ত হলো, ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
–” দরজা বন্ধ করলেন যে!”
–” তোর স্পাই দাদীর ভয়ে। সারাক্ষণ গয়েন্দাগিরি। না জানি কখন আবার ছাদে টপকায়।”
সায়রা চোখ মুখ খিঁচে বলল,
–” দাদী মোটেও গয়েন্দাগিরি করে না। একটু কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ওই যা!”
আরসাল উত্তর দিলো না। সায়রা ছাদের রেলিং ঘেষে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।দৃষ্টি আকাশ পানে। আরসাল তার পাশে যেয়ে দাঁড়াল। চাঁদের উজ্জ্বল চাঁদিনী সায়রার মুখ ছুঁচ্ছে। এই আলোয় সায়রার সৌন্দর্য যেন আরো হাজার গুন বেড়ে গেছে। ঠোঁটের কোণে প্রমত্ত হাসি। গভীর চোখে দেখছে আরসাল। সায়রা চাঁদের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলল,
–” চাঁদটা খুব সুন্দর তাই না?”
উত্তরের আশা করল সায়রা। পাশ থেকে উত্তর এলো না। খানিকক্ষণ কাটল। পাশ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে চাইল সে। আরসাল তার দিকে গভীর নয়নে তাকিয়ে আছে। চোখে অজস্র মায়া তার। কোন এক গভীর তৃষ্ণা! এই তৃষ্ণায় এখনি বুঝি মিশে যাবে সায়রা। বুকটা প্রচণ্ড বেগে কাঁপছে তার। এই দৃষ্টি সহ্য করতে পারছে না সে। মুখ ফিরিয়ে নিলো। চোখ সরিয়ে দূরে চলে গেল সায়রা। আরসাল যেন তাতে অসন্তুষ্ট হলো। আচমকা সায়রার হাত টেনে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করল। আরসালের ঘন নিশ্বাস সায়রার ঘাড় ছুঁইছে। পেছন থেকে কাঁপা হাতে কানের পেছনে চুল গুছিয়ে দিলো আরসাল। সায়রার মেঘবরণ চুলে নাক ডুবাল। চোখ বুজে আবেশে গভীর শ্বাস টেনে নিলো আরসাল।
চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিয়েছে সায়রা। গলা শুকিয়ে কাঠ। শরীর থরথর কাঁপছে। এখনি বুঝি শ্বাসরোধে মরে যাবে সে। আরসালের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলে, পেছন থেকে হাতের বাঁধন আরো শক্ত হলো। আরসালের ফিসফিস প্রমত্ত আওয়াজ ভেসে এলো,
–” ডোন্ট মুভ! তুই তোর চাঁদকে দেখ, আমাকে আমার চাঁদে ডুবে থাকতে দে!”
চলবে…….