তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ১২
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
প্রত্যেক আঁধার কালো রাতের পর উজ্জ্বল দ্যুতিময় এক ভোরের সূচনা হয়। গত রাতের ঘন বর্ষন চারিদিকে সতেজতার আমেজ ছড়িয়ে গেছে। সোনালি রোদ আর এলোমেলো নিখাদ হাওয়ার উদম এক প্রতিযোগিতা চলছে। সায়রার ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। জ্বর ছেড়েছে কিন্তু দুর্বলতা রয়েই গেছে। বেশ কিছুক্ষণ চোখ বুঝে আধো আধো ঘুম নিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে। গতরাতের কথা মনে করে ধপ করে শোয়া থেকে উঠে বসে। সে তো ছাদে ছিল! ঘরে ফিরল কি করে? একা এসেছে? কিন্তু কিছু মনে পড়ছেনা না কেন? মাথা চেপে মনে করার চেষ্টা করল সায়রা। আবছা আবছা মনে পড়ছে, সম্পূর্ণ মনে করতে পারছেনা। এমন সময় আরমিন ঘরে প্রবেশ করে। সায়রাকে জাগতে দেখে, চওড়া হেসে বলে,
— ” উঠে গেছিস সায়রা? জ্বর ছেড়েছে? এখন কেমন লাগছে?”
সায়রা ভাবলেশহীন আমতা আমতা উত্তর দিলো,
— ” হুম, আপু আগের থেকে কিছুটা ভালো।”
— ” রাতে তোকে অচেতন দেখে যা ভয় পেয়েছিলাম। ভাগ্যিস আরসাল ভাই দেখেছিল!”
সায়রা তড়াক করে মাথা তুলে আরমিনের দিকে তাকায়। চোখে মুখে ভয়ের আভাস। চটুল স্বরে প্রশ্ন করল,
— ” আরসাল ভাই? উনি আমাকে দিতে এসেছিল? এখানে!”
আরমিন সায়রার খর্খরে ভাব দেখে বিছানায় বসে পড়ে। সায়রার মুখপানে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— ” হ্যাঁ, আরসাল ভাই এখানে এসেছিল। তুই এভাবে রিয়েক্ট করছিস কেন?”
— ” না মানে এতকিছুর পর উনি এখানে। সবাই কি ভাবছে কে জানে!”
— ” কেউ কিছু ভাবছে না। আরসাল ভাইকে কেউ দেখেনি। হুট করে রাত চারটার দিকে আরসাল ভাই ফোন করে বললেন, তুই ছাদে সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছিস। আমি দ্রুত ছাদে চলে যাই। দেখি তুই অচেতন হয়ে আরসাল ভাইয়ের কোলে। উনাকে জিজ্ঞাস করলে বললেন, ঘুম ধরছিল না বলে ছাদে ঘুরাঘুরি করছিল এই ছাদে কাউকে পড়ে থাকতে দেখে সাহায্যের জন্য এসেছিলেন। তারপর তোকে কোলে করে চুপিসারে রুম অবধি নিয়ে আসে। চিন্তা করিস না। বাড়ির কেউ কিছু টের পায়নি।”
ফোঁস করে গলায় আটকে থাকা নিশ্বাস ছাড়ল সায়রা। ভাগ্যিস আরসাল ভাই মিথ্যা বলে সব সামলেছে। ধরা পড়লে কি কাণ্ডটাই না হয়ে যেত! সায়রার ভাবনায় ছেদ পড়ল আরমিনের ডাকে। অনাস্থার স্বরে জিজ্ঞেস করে,
— ” এত রাতে জ্বর নিয়ে ছাদে গেলি কেন?”
সায়রা জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
–” রাতে হ্ঠাৎ ঘুম ভেঙেগেছিল। মনে পড়ল, ছাদে কাপড় দিয়েছিলাম আনা হয়েছে কিনা তা দেখতেই ছাদে গিয়েছিলাম।”
–” তুইও না সায়রা! পারিসও বটে। যদি কোন অঘটন ঘটত? ভাগ্যিস আরসাল ভাই দেখেছিল নাহয় কি হতো ভাবতে পারছিস? !”
সায়রা মৃদু হাসল। মনে মনে বলল,” তুমি উনাকে চিনো না আপু! উনি- ই যত নষ্টের মূল। উনার কারণেই তো ছাদে গিয়েছিলাম। নয়তো আমার কি শখ জেগেছিল নিশি রাতে ছাদে গিয়ে ভূতেদের সাথে লুডু খেলার?
আরমিন প্রশস্ত হেসে সায়রার গালে হাত ছুঁয়ে বলল,
–” রুটি ভেজে দিচ্ছি। তুই ফ্রেশ হয়ে নে!”
–” আচ্ছা আপু।”
আরমিন চলে যেতেই ফোন হাতে নিলো সায়রা। আটটা মিসকল! কে করল? আরসাল ভাই। সকাল সকাল কেন? কোন জরুরী দরকার কি? সায়রা থমকে রইল। বিস্ময় কাটিয়ে দ্রুত ফোন লাগাল আরসালকে। একবার রিং বাজতেই ফোন তুলল। যেই ফোনের অপেক্ষায়- ই ছিল। অপর পাশ থেকে আরসালের উদ্বিগ্ন আওয়াজ,
–” তুই ঠিক আসিস সায়রা?”
সায়রার মৃদু উত্তর,
–” হুম!
–” জ্বর ছেড়েছে? কয়টা ফোন করেছি। ফোন তুলছিলি না কেন?”
–” ঘুমাচ্ছিলাম! ফোন সাইলেন্ট ছিল আরসাল ভাই।”
অপর পাশের মানুষটার উদ্বিগ্নতা কমে স্নিগ্ধ কন্ঠ ভেসে এলো,
–” মাথা ব্যথা কমেছে?”
–” হুহ”
— ” হঠাৎ এত জ্বর হলো কি করে?”
–” গত সন্ধ্যায় নানুবাড়ি থেকে ফেরার সময় বৃষ্টির খপ্পরে পড়েছিলাম। তাই হয়তো!”
অপর পাশ থেকে আরসালের স্পষ্টবাক্য,
–” একটু বারান্দায় আয় তো সায়রা!”
সায়রার ভ্রুদ্বয় কুঁচকে এলো। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কাটল। গাঢ় স্বরে বলল,
–” এখন?”
–” হুম”
সায়রা আলস্য পায়ে টলতে টলতে বারান্দার দিকে পা বাড়ায়। শরীর এখনো ভীষণ দুর্বল । বারান্দার দরজায় মাথা ঠেকিয়ে ঠেশ দিয়ে দাঁড়ায় সায়রা। সামনের খোলা বারান্দায় আরসালকে দেখা যাচ্ছে। পরনে রাতের সেই পোশাক। ফিনফিনে সাদা শার্ট। উষ্কখুষ্ক এলোমেলো চুল। নিদ্রাজড় রক্তিম চোখ। সায়রা থমকে গেল। রাতে কি আরসাল ভাই ঘুমায়নি? সারারাত কি এখানেই ছিল?
আরসাল নিমিষ দৃষ্টিতে সায়রার দিকে তাকিয়ে। ঘুম জড়ানো আড়ষ্ট চোখ সায়রার। ঘুম ঘুম আমেজটা এখনো কাটেনি। সকালের সোনালি রোদ সায়রার চোখমুখ ছুঁয়ে দিচ্ছে। এলোমেলো নিখাদ হাওয়ায় বারবার অবাধ্য চুল গুলো মুখে এসে পড়ছে। সায়রা আটকাচ্ছেনা। দরজায় মাথা ঠেকিয়ে ঘুম জড়ানো দৃষ্টিতে অপলক আরসালের দিকে তাকিয়ে আছে। জ্বরের প্রখরতায় তার সৌন্দর্য ছাপাতে পাড়েনি। বরং সকালের সতেজতায় ভোরের ফুটন্ত শুভ্র গোলাপের মতই স্নিগ্ধ লাগছে। সচ্ছ সরল আঁখির ড্যাবড্যাব চাহনি বুকে হিমেল তীরের মত লাগল । এর আঘাতে কোন যন্ত্রণা নেই বরং একরাশ শান্তি মোড়ানো। গত রাত থেকে বুকে জ্বলন্ত অগ্নিগিরিতে যেন হিমেল হাওয়া লাগল। বুক জুড়ে এক সজীবতার আভাস। এই মুখখানায় এত শান্তি কেন?
অপরপাশ থেকে সায়রার ডাকে হুশ ফিরল আরসালের। সায়রা বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
–” আপনি সারারাত এখানেই ছিলেন? ঘুমান নাই আরসাল ভাই?”
–” চেষ্টা করেছি, ঘুম হয়নি!”
–” কেন?”
সায়রা চট প্রশ্ন করল। আরসাল কয়েক পলক সায়রার দিকে নিভৃত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। দুজনের দৃষ্টি মিলল। সায়রা লাজুক ভঙ্গিতে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। কয়েক সেকেন্ড পিনপতন নীরবতা। নীরবতা ভেঙে উৎকণ্ঠা স্বরে বলল আরসাল,
–” তুই এই বিয়েটা করবিনা সায়রা!”
বিয়ের কথা শুনে গত রাতের কথা আবছা মনে পড়ল সায়রার। বিরবির স্বরে বলল,
–” কিসের বিয়ে আরসাল ভাই?”
আরসালের রাগ হলো। প্রচণ্ড রাগ। সায়রা জেনেশুনে তার সাথে না বুঝার ভান করছে? ভান? আরসাল ক্ষিপ্ত স্বরে দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠল,
–” কাল তোকে যারা দেখতে এসেছিল। তোর মায়ের কালিগের ছেলে!”
সায়রার টনক নড়ল। বুঝানোর স্বরে বলল,
–” আপনার ভুল হচ্ছে আরসাল ভাই। কাল উনারা আমাকে না আরমিন আপুকে দেখতে এসেছিল। কাল আমি তো বাড়িই ছিলাম না। নানুবাড়ি থেকে সন্ধ্যায় ফিরেছি।”
সায়রার উত্তরে আরসালের ক্ষিপ্ত মেজাজ মুহূতেই ঠাণ্ডা বরফ বনে গেল। মন নেচে উঠল। উৎসাহী স্বরে বলে উঠল,
–” তুই সত্যি বলছিস সায়রা?”
–” মিথ্যা বলে আমার কি লাভ?”
আরসালের মন ভালো হয়ে গেল। গত কাল থেকে মাথায় ঘুরা চিন্তাটা যেন অবসান ঘটল। বড় নিশ্বাস ছাড়ল। কয়েক সেকেন্ড পর বেশ শান্ত স্বর ভেসে এলো,
–” নাস্তা করা হয়েছে? ”
সায়রা এদিকওদিক মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো,
–” উহু! এখনো করা হয়নি। ”
–” যা ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে মেডিসিন নে।”
আরসালের কথায় সায়রা পিছন ঘুরে ঘরের দিকে পা বাড়াতেই , আরসাল থামিয়ে দেয়। সায়রা পিছন ফিরে তাকায়। দেখল- আরসাল কেমন জানো আবেগ মাখানো অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই দৃষ্টি কিছুটা চিন্তা আর অনেকটাই সংমিশ্রিত অনুভূতিতে জড়ানো। আরসাল বলল,
–” শরীর সুস্থ হওয়া অবধি বাড়ি থেকে বের হতে হবিনা। টাইম টু টাইম মেডিসিন নিবি। কোন হেলামি করবি না।”
সায়রা এক পলক আরসালের দিকে তাকাল। মৃদু হেসে ধীর স্বরে বলল,
–” আচ্ছা”
ফোন কাটল। সায়রা ভিতরের চলে গেল। আরসাল ঠাই সায়রার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে। সায়রা চোখের আড়াল হতেই আরসাল নিজের ঘরে চলে গেল।
বিছানায় লম্বালন্বি সটান শুয়ে চোখ বুঝল আরসাল। এবার বুঝি চোখের পাতায় ঘুম নামবে!
চলবে……
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন।