তোমাকে
পর্ব 6.1

অনিমার জীবনটা এক লহমায় বদলে গেল I আশিক চলে যাবার পর মৃত্যু শোকের চেয়ে যে জিনিসটা অনিমাকে কাপিয়ে দিলো সেটা হলো বাস্তবতা I আশিক খুব আমুদে স্বভাবের ছিল I বন্ধুবান্ধব নিয়ে হইচই করতে পছন্দ করত I প্রচুর বন্ধু-বান্ধব ছিল তার I অথচ তার মৃত্যুর পর সেই সব বন্ধুরাই পাশে দাঁড়ানোর বদলে কার কার কাছে কত ধারদেনা ছিল সেগুলোর হিসেব নিকেষ শুরু করে দিল I সেঁজুতির দেখাশোনায় যেন কোনো ঘাটতি না থাকে তাই অনিমা কখনো ফুলটাইম জব করেনি I একটা পার্টটাইম জব করতো তাতে যা আসত তা দিয়ে ওর সখ আহলাদ পূরণ হয়ে যেত I বাকিটা ও সঞ্চয় করত সেঁজুতির ভবিষ্যতের জন্য I

আশিক খুব খরুচে স্বভাবের ছিল I দুহাতে টাকা ওরাতো I মাস শেষে ওর হাতে প্রায় কিছুই থাকত না I অনিমা কখনো কিছু বলেনি এগুলি নিয়ে I হাউজ লোন সংসারের খরচ সব আশিকি দিতI অনিমাকে কখনো এগুলো নিয়ে ভাবতে হয়নি I অনিমা যে বাড়িটাতে থাকে এটা ওরা 5 বছর আগে কিনেছে I বাড়িটা ওদের দুজনের নামে I তাই আশিক চলে যাবার পর লোনের সমস্ত তার দায়ভার এখন অনিমার I মাসে মাসে একটা বড় অংকের টাকা ব্যাংকে দিতে হয় I সংসার খরচ যদি বা অনিমা চালিয়ে নিতে পারে কিন্তু এই ব্যাংকের টাকাটা মাসে মাসে পরিশোধ না করলে বাড়িতে থাকবে না I অনিমা দেশে ওর ভাইকে ফোন করেছিলI দেশে ওর সম্পত্তির অংশ আছে সেখান থেকে কিছু পাওয়া যায় কিনা I অনিমার ভাই আবরার পরিষ্কার মানা করে দিয়েছে I ঢাকায় ওদের যা জায়গা জমি ছিল সবি বিল্ডার্সের কাছে দিয়ে ফ্ল্যাট বানানো হয়েছেI গোটা বিশেক ফ্ল্যাট আছে ওদেরI আবরার জানালো সবি ভাড়া দেয়া I এখন কোনটা বিক্রি করা সম্ভব নয় I অনিমা চাইলে দেশে চলে আসতে পারেI একটা ফ্ল্যাটে থেকে আরেকটার ভাড়া তুলে চলতে পারে I অনিমা যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলI তাই আর যোগাযোগ করেনি I ক্যালিফোর্নিয়ায় আশিকের বড় ভাই থাকে I আশিকের বাবা-মাও ওনার সাথেই থাকেন I আশিক এর মৃত্যুর পর ওরা বলেছিল সেজুতিকে নিয়ে এখানে চলে আসতে I ওদের জন্য একটা রুম ছেড়ে দেবে I ওদের কোন সমস্যা হবে না I অনিমা হেসেছিল মনে মনে I কারো গলগ্রহ হয়ে ও কখনই থাকবেনা I নিজের মেয়েকে তো রাখবেই না I অনিমা আর কথা বাড়ায়নি মেয়ের স্পেশাল স্কুলের অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে গেছে I তাতে অবশ্য তারা একটু খুশিই হয়েছে I এমনিতেও শ্বশুরবাড়ির লোকেরা অনিমাকে পছন্দ করেনা I ইনিয়ে বিনিয়ে সেঁজুতি অবস্থার জন্য ওকেই দায়ী করে I

অনিমার বাড়িটা দুতালা I নিচতলায় লিভিং ডাইনিং ওপরে শোবার ঘর I তাই ঠিক ভাড়া দেবার মতো অবস্থা নেইI বেজমেন্ট টাকে আশিক পার্টি হল বানিয়ে রেখেছিল I বন্ধুবান্ধব নিয়ে ওখানেই পার্টি করত I একটা ছোট শোবার ঘরের মতো আছে I বাকিটা পুরাই হল I একপাশে একটা বার ও আছে I এইরকম একটা জায়গা ভাড়া দেয়া মুশকিল I অনিমা ভেবে পাচ্ছে না কি করবে I মাস প্রায় শেষ হয়ে এসেছে I আগামী মাসের শুরুতেই ব্যাংক লোন শোধ করতে হবে I যে করেই হোক একটা ব্যবস্থা করতে হবে I তা না হলে মেয়েটার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে I অনিমা ঠিক করে ফেলল বেজমেন্টে ভাড়া দিয়ে দেবে I ছোট একটা বিজ্ঞাপন ও দিয়ে দিল অনলাইনে I সেদিন ডিপার্টমেন্টের জুনিয়ার একটা ছেলে যোগাযোগ করেছে I তার পরিচিত কেউ একজন ছয় মাসের জন্য ভাড়া নিতে চাইছে I খুবই আর্জেন্ট I অনিমা রাজি হয়ে গেল I রাজি হওয়ার আরেকটা কারণ হলো ওরা আজি 6 মাসের বাড়ি ভাড়া অগ্রিম ই-ট্রানস্ফার করে করে দেবে বলল I এমনটা হলে অনেকটা সময় পাওয়া যাবে I এর মধ্যে একটা ব্যবস্থা ঠিকই করে ফেলবে I যদিও বাড়িতে অচেনা কাউকে রাখার ওর ইচ্ছে না কিন্তু পরে ভেবে দেখল 6 মাসের তো ব্যাপার I এর মধ্যে একটা ফুলটাইম জব হয়ে যাবে I অনিমা টাকা তুলে ব্যাংকে দিয়ে মোটামুটি দুমাসের জন্য নিশ্চিন্ত হয়ে গেল I বেসমেন্টে টাও মোটামুটি গোছগাছ করে ফেলল ও I হলরুমে এমনিতেই একটা টেবিল ছিল ছোট, বেডরুম এও একটা বিছানা পাতাই ছিলI বার থেকে সব ড্রিংস গুলো সরিয়ে অনিমা কতগুলো বই এনে রাখলো I গোছগাছ শেষে মনে হল একেবারে মন্দ হয়নি I যে আসবে তার আজ বিকেলে আসার কথা I সেঁজুতি ড্রয়িং ক্লাসে গেছে I অনিমা অপেক্ষা করছিল যে আসবে তাকে বাড়িঘর দেখিয়ে দিয়ে সেজুতিকে আনতে যাবে I

মনির যখন ট্যাক্সি থেকে নেমে লাগেজটা নিয়ে বাসার ভেতর ঢুকলো অনিমা একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেল I

আরে অনিমা এটা তোমার বাসা নাকি ?
মনিরের অভিনয়টা তেমন জমলো না I অনিমা বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে কোনমতে বলল

সজল তো আমাকে একবারো বললো না যে তুমি ভাড়া নিচ্ছ
আসলে সজল জানতো না I আমি অন্য একজনের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছিলামI যাই হোক এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলব ? আমি 19 ঘণ্টা জার্নি করে এসেছিI
না এসো তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিমা মনিরকে নিচতলায় নিয়ে গেল I অনিমা যদি ধারণাও করত যে মনির এখানে আসছে তাহলেও মানা করে দিত I এখন ওকে অন্য বাসা খুঁজে দিতে পারে কিন্তু টাকাটা তো ফেরত দিতে পারবে না I

অনিমা মনিরকে নিচতলা টা দেখিয়ে দিল I এখানে ঢোকার আলাদা এন্ট্রান্স I পেছনের দরজা দিয়ে বাগানে যাওয়া যায় I অনিমার বাগান টা বেশ সুন্দর I ও যত্নও করে খুব I বেসমেন্ট থেকে মূল বাড়িতে ঢোকার একটা দরজা আছে সেটা সব সময় ভেতর থেকে বন্ধ করে রাখে অনিমা I অনিমা মুনির কে সবটা দেখিয়ে দিল I চাবি ও দিয়ে দিলো একটা I কাজ শেষ করে উপরে চলে গেল I হঠাৎ করেই অনিমার মনে হল এমনিতেই ওর জীবনে সমস্যার শেষ নেই আবার একটা নতুন ঝামেলার কি খুব দরকার ছিল?

পর্ব 6.2

আজ কক্সবাজারে ওদের শেষ রাত I রাতের খাবার শেষ করে সবাই বিচে চলে গেছে I জলের ধারে সুন্দর একটা জায়গা দেখে সবাই গোল হয়ে বসলো I প্রথমে শুরু হল আবৃত্তি I মিজান স্যার একটা আবৃত্তি করে অনুষ্ঠান শুরু করলেন I নীলা দুইটা কবিতা আবৃত্তি করল I এরপর শুরু হলো গান I অনিমা ওর ইউকিলিলি সঙ্গে নিয়ে এসেছিল I সেটা বাজিয়েই গান করল I সবাই ওকে একটার পর একটা গানের অনুরোধ করতে লাগলো I অনিমার খুব ইচ্ছা ছিল একজনের জন্য একটা বিশেষ গান করার I কিন্তু সবার অনুরোধে কারণে সেটা আর হয়ে উঠছে না I অনিমা এদিক ওদিক তাকিয়ে মনির কে খুঁজতে লাগলো I মনির তখন সবাইকে স্নাক্স দিচ্ছিল I অনিমার কাছে এসে দিতে চাইলে অনিমা শুধু পানি নিল I তারপর বলল

তোমার কোন রিকুয়েস্ট নেই ?
না
অনিমার মনটা দপ করে নিভে গেল I মুহূর্তে ওর মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল I
মনির আর কিছু বলল না I সামনে থেকে চলে গেল I একটু পরে গরম চা এনে অনিমার হাতে দিল I তারপর বললI
আজকে অনেক গান করলে তোমার গলা ভেঙে আসছে চা খাও I আমি আজকে তোমাকে কোন রিকোয়েস্ট করব না I আমি যেদিন রিকোয়েষ্ট করবো সেদিন কিন্তু না করতে পারবে না I

অনিমার মন খারাপ ভাবটা চলে গেল I

চায়ের পর আবার গানের আসর বসল I মিজান স্যার হঠাৎ বললেন

অনিমা তুমি নজরুল গীতি গাও ?

জি স্যার

মনে পড়ে আজ গানটা করবে

চেষ্টা করছি স্যার

অনিমা গান শুরু করলো

মনে পড়ে আজ সে কোন্‌ জনমে
বিদায় সন্ধ্যাবেলা-
আমি দাঁড়ায়ে রহিনু এপারে
তুমি ওপারে ভাসালে ভেলা।।

সেই সে বিদায় ক্ষণে
শপথ করিলে বন্ধু আমার
রাখিবে আমারে মনে,
ফিরিয়া আসিবে খেলিবে আবার
সেই পুরাতন খেলা।।

আজো আসিলে না হায়,
মোর অশ্রুর লিপি বনের বিহগী
দিকে দিকে লয়ে যায়,
তোমায়ে খুঁজে না পায়।

মোর গানের পাপিয়া ঝুরে
গহন কাননে তব নাম লয়ে
আজো পিয়া পিয়া সুরে;
গান থেমে যায়, হায় ফিরে আসে পাখী
বুকে বিঁধে অবহেলা।।

জ্যোৎস্নার মন কেমন করা আলো, সমুদ্রের বিশালতা আর অনিমার দরদী কন্ঠ সব মিলেমিশে একরকম বিষাদ ময় পরিবেশ তৈরী হলো I অনেককে ই চোখ মুছতে দেখা গেল I এরকম একটা গানের পর আর কারো কিছু বলার মত মনের অবস্থা থাকলো না I মিজান স্যার বললেন কাল খুব ভোরে রওনা দিতে হবে I সবাই এবার শুতে চলে যাও I

মনির এসে অনিমার পাশে বসলো I অনিমা পাশে তাকিয়ে একটু হাসলোI মনির বলল
তোমার আজকের গানটা এ পর্যন্ত সব গুলির মধ্যে বেস্ট
তুই কালকে ও এই কথা বলেছিলে
তুমি যদি এখন প্রতিদিন নিজেকে ছাড়িয়ে যাও তাহলে আমার কি করার আছে?
অনিমা মুগ্ধ হয়ে শুনলো I এত সুন্দর করে কেউ প্রশংসা করতে পারে ওর জানা ছিল না I

অনিমা মনে মনে বলল আজকে একটা গান শুধু তোমার জন্য গেয়েছি, তুমি কি বুঝতে পেরেছো ?
অনিমা
বল
না কিছুনা I
কি বল
অন্য একদিন বলব

অনিমা কিছু বলল না I একটু হাসলো I
মনিরের হঠাৎ মনে হল অনিমাকে বলে তুমি প্রতিদিন রাতে আমাকে একটা করে গান শোনাবে I নিজের চিন্তায় মনির নিজেই বিস্মিত হয়ে গেল I এটা কি করে সম্ভব I অনিমা কেমন করে ওকে প্রতিরাতে গান শোনাবে ? মনির পাশ ফিরে তাকালো I অনিমা সামনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে I ওর খোলা চুল গুলো বাতাসে উড়ছে I চাঁদের আলোয় কি অদ্ভুত মায়াবী লাগছে ওকে I এই এলোমেলো অভিমানী মেয়েটার জন্য হঠাৎ বুকের ভেতর তীব্র ব্যথা অনুভব করল মনির I এই অনুভুতির সাথে ও পরিচিত নয় I এরই নাম ই কি তবে ভালোবাসা ?

চলবে…..
লেখনীতে
# অনিমা হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here