তোমাকে

পর্ব 5.1

দুর্যোগের রাত I বাইরে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে I রাত যতো গভীর হচ্ছে বৃষ্টির বেগ ততোই বাড়ছে সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঝড়ের তীব্রতা I থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে I কিন্তু মনিরের মনের ভেতরে যে ঝড় চলছে তা আজ এই দুর্যোগ কে ও হার মানায় I খবরটা জানার পর থেকে এক মুহূর্তও স্থির থাকতে পারেনি ও I

মনিরের দীর্ঘদিনের অনিদ্রা রোগ I মাঝে মাঝে ওষুধ খেয়েও ঘুমাতে পারে না I আর আজ রাত প্রায় শেষ হতে চলেছে কিন্তু ও ঘুমাতে পারছে না I খবরটা পাওয়ার পর থেকে ওর দু চোখের ঘুম উড়ে গেছে I আজ সোশ্যাল মিডিয়া দেখেছে, তাও ঘটনার প্রায় সপ্তাহখানেক পরI ছোট একটা খবর , দুলাইনের

‘ডিপার্টমেন্টের প্রবাসী ছাত্রী অনিমা হাসানের স্বামী আশিকুজ্জামান সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতI সকলের দোয়াপ্রার্থীI ‘

মনির বুঝতে পারছেনা অনিমা কি করে একা একা এত ধকল সামলাচ্ছেI ও যতদূর জানে অনিমার ওখানে কেউ নেই I ওর ভাই এখন ঢাকায় I ওর শশুর বাড়ির সবাই ও USA তে I তাহলে ও একা কিভাবে ম্যানেজ করবে?

মনির ঘড়ি দেখল I 4: 40 বাজে I তারমানে এখন ওখানে দুপুর প্রায় তিনটা বাজে I মনির সারোয়ার ভাইকে একটা ফোন করলোI

হ্যালো সারোয়ার ভাই আপনি কি ব্যস্ত?
হ্যাঁ মনির বল I
একটু কথা ছিল
আমি আসলে কাজে তোমাকে ঘন্টাখানেক পর ফোন করি ?
হ্যাঁ ঠিক আছে কোন সমস্যা নেই

মনির ফোন নামিয়ে রাখল I মনে করার চেষ্টা করব ওখানে আর কে কে আছে I সজল আছে ওদের এক ব্যাচ জুনিয়ার I মনির সজল কে ফোন করল I

আসসালামু আলাইকুম মনির ভাই কেমন আছেন?
ওয়ালাইকুম আসসালামI তুমি কি বিজি সজল?
না মনির ভাই I আপনার জন্য সব সময় ফ্রি আছি
তোমার সঙ্গে একটু কাজ ছিল
জি ভাই বলেন না
আমাদের ব্যাচের অনিমা কে চেনো
যার হাসবেন্ড মারা গেল কয়দিন আগে ? জি ভাই চিনি
কি অবস্থা ওর জানো?
আসলে আপা তো কারো সাথে যোগাযোগ রাখে না , ওনার হাজবেন্ডের ফ্রেন্ড আমার আত্মীয় তার কাছ থেকে খবর পেলাম I
ও আচ্ছা
আমরা তো একটা গ্রুপ ও করেছিলাম ফান্ড কালেকশনের জন্য কিন্তু আপা ফোন করে মানা করে দিয়েছেI বলেছে কিছু লাগবে না শুধু দোয়া করতে I
মনির চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল I ও জানতো এমন কিছুই হবে I অনিমা কারো সাহায্য নেবে নাI

শোনো সজল I আমরা এখান থেকে কিছু করতে চাচ্ছি ওর জন্য I সরাসরি বললে ও নেবেনা I তাই

একটু অন্যভাবে করতে হবে I তোমার একটু হেল্প লাগবে I

জি বলেন না ভাই I কোন অসুবিধা নাই I

আমি তোমাকে টেক্সট করছিI তুমি সেই ভাবেই করোI

জি আচ্ছা

বহুদিন ধরে মনিরের ইমেইলে একটা পেন্ডিং মেইল পড়েছিল I গতবছর কনফারেন্স এটেন্ড করার পর একটা ছয় মাসের রিসার্চ প্রজেক্ট এর অফার পায় মনির কিন্তু আবার অনিমার মুখোমুখি হতে হবে তাই এতদিন ধরে কোন জবাব দিচ্ছিল না I আজকে অফার টা একসেপ্ট করল I তারপর আপন মনে বলল আমি আসছি অনিমা , আমি আসছি I

পর্ব 5.2

দুটো দিন স্বপ্নের মত কেটে গেল I আজ কক্সবাজারে ওদের শেষ দিন I সকাল থেকেই সবাই বিচেI শেষ মুহূর্তের জলকেলি করে নিচ্ছে I লাঞ্চের পর যে যার মত সময় কাটাবে I রাতে সাগর পাড়ে চন্দ্রবিলাস আর গানের আসর I কাল খুব ভোরে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দেবার কথা I

ব্রেকফাস্ট এর পরেই সবাই সী বিচে চলে গেছে I মেয়েরা সব একসঙ্গে দলবেঁধে গান গাইছে আর জলকেলি করছে I দুজন টিচারি ই ছাতার নিচে বসে গল্প করছেI অনিমা বাকি মেয়েদের সঙ্গে পানিতে নেমেছেI আজ খুব ভালো লাগছে ওরI দুটো দিন মনে হয় চোখের নিমিষে চলে গেল I মনে হচ্ছে আরো যদি কতদিন থাকা যেত বেশ হতI প্রতিদিন রাতেই কখনো হোটেলে কখনো বা সাগর পাড়ে গানের আসর হয়েছেI অনিমা কালকে অনেকগুলি গান গেয়েছেI

আজ এখানে ওদের শেষ রাত I মজার ব্যাপার হলো আজ পূর্ণিমাI সবাই ঠিক করেছে আজকের রাতটা ওরা বিচে থাকবে I জ্যোৎস্নার আলোয় সমুদ্র দেখবে I ওরা মোট 40 জনএসেছে I এর মধ্যে 18 জন মেয়ে I মেয়েরা সব হাত ধরাধরি করে পানিতে নেমেছে I সমুদ্রের গর্জন কে ছাপিয়ে ওদের হাসির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে I

মনির দূর থেকে অনিমাকে দেখল I মেয়েটা খুশিতে কেমন ঝলমল করছে I হাসি খুশি থাকলে ওকে এত ভালো দেখায়, কেন যে ও সব সময় মন খারাপ করে থাকে মনির বুঝতে পারেনা I গতকাল ওরা ইনানী বিচে গিয়েছিলো I অনিমা একটা নীল রংয়ের জামা পড়ে পাথরের উপর বসে ছবি তুলছিল I কিযে অপূর্ব সুন্দর লাগছিলো ওকে দেখতে I মনিরের খুব ইচ্ছা হচ্ছিল ছবিটা দেখতেI কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব না I এই ক্যামেরার রোল ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ওয়াস করে তারপর দেখতে হবে I কার ক্যামেরা সেটাও মনির জানেনা I ওর মনে হলো ওর একটা ক্যামেরা থাকলে বেশ হত I ও ঠিক করে ফেলল এরপর কোথাও যাওয়ার আগেই একটা ক্যামেরা কিনে ফেলবেI আজ সবাই পানিতে নেমেছে তাই আর ছবি তুলতে পারছে না I অনিমা হাসতে হাসতে সবার গায়ে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে I মনির দূর থেকে দেখে হাসলো আপন মনে I

একা একা হাসতেছো কেন মামু? লক্ষণ তো সুবিধার না

হাসিব, থামনা একটু এইবার

আরে বস এইরকম রোমান্টিক ফেস কইরা তাকাইয়া থাকলে তো হবে না অ্যাকশনে যাইতে হবে

তুই কি এসব সিরিয়াসলি বলিস নাকি তোর কাছে সবটাই একটা জোক

আই এম ড্যাম সিরিয়াস I জোক হইবো কেন ? আমার কিন্তু মেলা এক্সপেরিয়েন্স

কিসের এক্সপেরিয়েন্স?

ইন্টারে থাকতে আমি তিনটে প্রেম করছি

দুই বছরে তুই তিনটা প্রেম করছিস? মনির অবাক হয়ে বলল

হI তাই তো বলতেসি টাইম ওয়েস্ট করিস না I দেখিস না মাইয়াটা তোরে দেখলে কেমন ব্লাশ করে

তুই কার কথা বলিস?

তুমি বুঝনা তাই না চান্দু আমি কার কথা বলি

তুই একটা ইম্পসিবল

মুনির কোনমতে ওখান থেকে পালিয়ে বাঁচলো I হাসিবের কোন লাইসেন্স নেই I কখন কার সামনে কি বলে বসে তার কোন ঠিক নেই I

লাঞ্চের পর সবাই বার্মিজ মার্কেটে গেলো I মেয়েরা প্রচুর কেনাকাটা করছে I অনিমা টুকটাক কিছু কিনলো I তারপর বলল

এখানে আর ভালো লাগছে না চল সিবিচ মার্কেটে যাই I

বাকিদের তখনো কেনাকাটা শেষ হয়নিI ওরা এখনই যেতে চাইছে না I একজন বলল

ছেলেরা সিবিচ মার্কেটে যাচ্ছে তুই ওদের সাথে চলে যা না I আমরা পড়ে গিয়ে মিট করছি

আচ্ছা

অনিমা দৌড়ে গিয়ে হাসিব কে বলল

হাসিব তোমরা এখন সিরিজ মার্কেটে যাচ্ছ ? আমি যাব তোমাদের সাথে

অবশ্যই ম্যাডাম

সিবিচ মার্কেটে গিয়ে মনির একটা কাঠের বাক্স কিনলো ওর বোনের জন্য I ভলান্টিয়ার হিসেবে যাওয়াতে ওকে কোন চাঁদা দিতে হয়নি I তাই ওর কাছে কেনাকাটা করার মত কিছু টাকা আছে I

মনির তুমি একটা শঙ্খ কিনতে পারো আমার স্টুডেন্ট এর জন্য

মনির চমকে উঠলো I অনিমা কখন ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ও টের পাইনি

শঙ্খ ? এটার স্পেশালিটি কি?

এটা কানের কাছে ধরলে সমুদ্রের গর্জন শোনা যায়I এই যে দেখোI অনিমা একটা শঙ্খ এগিয়ে দিল

মুনিরের বেশ পছন্দ হলো I ও দুটো শঙ্খ কিনে ফেললI একটা নিজের ব্যাগে রেখে আরেকটা অনিমার হাতে দিয়ে বলল

তুমি এত সুন্দর একটা গিফট কিনতে হেল্প করলে এটা তোমার জন্য I

অনিমার মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে গেল I মনির লক্ষ্য করলো অনিমার চোখে পানি এসে গেছে I এত সামান্য একটা উপহার পেয়ে কেউ এত খুশি হতে পারে I মনির ভেবে পেল না I

অনিমা থ্যাঙ্কস বলে চলে গেল I

মামু কি গিফট করলা ?

মনির অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো I এই ছেলেটা কি করে যে সময় মতো চলে আসে মনির ভেবে পায়না I

একটা শঙ্খ দিলামI প্লিজ এটা নিয়ে কোনো ইস্যু ক্রিয়েট করিস না I

ইসু তো অলরেডি হয়ে গেছে মামু I কিছু লিখা দিসোস

শঙ্খের মধ্যে আবার লেখি কেমনে ?

আরে, আই লাভ ইউ লিখে দিতে পারলি না

উফ I হাসিব প্লিজ I একটা সামান্য ব্যাপার কে কমপ্লিকেটেড করিস না I

চিল ম্যান I আমিতো মজা করতে ছিলাম I আমি আশরাফ ভাইয়ের সাথে কথা বলে নিবো

কিসের আশরাফ ভাই ?

আশরাফ ভাই অনিমার ফ্যান I ফিজিকস ডিপার্টমেন্টের I অনেকদিন থেকে ঝুলে আছে I অনিমা পাত্তা দিতাসে নাI আমি তো ভাবলাম তুই ইন্টারেস্টেড তাই কিছু করতে ছিলাম না

তুই কি ম্যাচ মেকার ? তোকে এত দায়িত্ব কে দিছে ? লিভ হার অ্যালোন I

এহ I লিভ হার অ্যালোন I এসব অন্য জায়গায় গিয়ে দেখাও I তোরে কইতেছি আমার এক্সপেরিয়েন্স রে ছোট করে দেখিস না I আমি স্কুলে থাকতে কয়টা প্রেম করছি জানোস?

না জানি না I জানতে চাইও না I আমার কাছে ক্যালকুলেটর নাইI

দুই বন্ধু হাসতে হাসতে চাঁদের আলোয় সমুদ্রের ধার ঘেঁষে হাঁটতে লাগলো I

চলবে …..
লেখনীতে অনিমা হাসান

/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here