তোমাকে
পর্ব 16.1

অনিমা নিজের চোখে কে বিশ্বাস করতে পারছে না I মুনির কি সত্যিই এসেছে না কি ও স্বপ্ন দেখছে I একবার একটু ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে I মুনির হাসছে I অনিমা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল I খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করল ওর সেই পুরনো হাসিটা আবার ফিরে এসেছে I

-তুমি চলে এসেছো আঙ্কেল I আমি এখনই রেডি হচ্ছি

সেজুতির কথায় অনিমা সম্বিত ফিরে পেল I তার মানে কি ওর আগে থেকেই আসার কথা ছিল I অনিমা ই কিছু জানতো না ? ততক্ষণে উপর থেকে আবরার আর সোহানা ও নেমে এসেছে I মনিরকে দেখে ওরা দুজন বেশ অবাক হল I সোহানা অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল

– আরে অনিমা তুমিতো একেবারে আগের মতই আছো I

মুনির একটু অবাক হলো I তার মানে কি এখনই ওদের প্রথম দেখা হল I তাহলে হয়তো রাতের বেলা ওদের ঠিকমতো আদর যত্ন করা হয়নি I মুনির দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল I তারপর আবরারের দিকে তাকিয়ে বলল

– ভাইয়া আমি ওদের নিয়ে যেতে এসেছি I মা ওদের জন্য অপেক্ষা করছে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করবে বলে I আপনারা নিশ্চয় অনেক রকম আয়োজন করেছেন কিন্তু আজকে ওদের ছেড়ে দিতে হবে I আরেকদিন না হয় আপনাদের এখানে এসে খেয়ে যাব I

সোহানা সুযোগটা লুফে নিল I বলল

– হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই I কেন নয়

মুনির একটু ভ্রু কুচকে তাকালো I ওর যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই I এরকম জায়গায় ওদের এক সপ্তাহ ফেলে রাখার কোনো মানেই হয় না I মুনির আবরারের দিকে ফিরে বলল

– ভাইয়া আর একটা জরুরী কথা ছিল I আমি জানি আপনারা ব্যস্ত I আমি বেশি সময় নেবো না I
– না না বল

– আমাদের তো একদিন পরে আসার কথা ছিল I তাই আমরা প্রোগ্রামটা নেক্সট ফ্রাইডেতে করব ঠিক করেছিলাম I এখন যেহেতু একদিন আগেই চলে এসেছি আর আজকে শুক্রবার কাজেই আমি চাইছি বিয়ের আজকেই হোক I

অনিমা চমকে উঠলো I এসব কি বলছে ও I মুনির তখনো কথা চালিয়ে যাচ্ছে

– আর আমরা চাই অনুষ্ঠান টা আমাদের বাড়িতেই হোক I আঙ্কেল বেঁচে থাকলে অন্যরকম কথা ছিল I এখন আমার মা চাইছিলেন বিয়েটা আমাদের বাড়িতেই হোক I আপনারা শুধু একটু কষ্ট করে সন্ধ্যার পরে চলে আসলেই হবে I আপনাদের পক্ষ থেকে যদি আরো কাউকে বলতে চান তাহলে টোটাল কত জন আসবে সেটা আমাকে জানালে হবে I

আবরার একটু গাইগুই করছিল I মিন মিন করে বলল

– তা কেন ? সবটা তো এখান থেকেই হওয়া উচিত

সোহানা ওর পাশে এসে দাড়ালো I এই সুযোগ ও কিছুতেই হাতছাড়া করবে না I এভাবে যদি ঘাড় থেকে ঝামেলা নামানো যায় তাহলে ক্ষতি কি ? ও হাসতে হাসতে বললো

– তাকে কি হয়েছে ? ওখানে ও তো ওরা দুজন একসাথেই থাকতো তাই এখানে বিয়ের আগে থাকলে অসুবিধা কোথায় ?

অনিমা হতভম্ব হয়ে গেল I ওর নিজের বাড়ির মানুষজন যদি এই ধারণা করে তা হলে বাইরের লোক কি কিভাবে ?

মুনির সোহানাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললো

-ভাইয়া , এ ধরনের কথার জন্য কিন্তু আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে I বাইরের লোকেরা এ ধরনের কথা বলবেই I আপনি জানেন অনিমা কেমন ওর সীমারেখা কতটুকু I তাছাড়া লোকজনতো নিজের রুচি অনুযায়ী মন্তব্য করবেই তাই না ? এন্ড অফ দা ডে সবাই নিজেকে দিয়েই অন্যকে বিচার করে I

অনিমা মনে মনে একটু হাসলো I মুনির একদম আগের মতই আছে I কখন ও রেগে যাবে না আবার কেউ ওকে অপমান করলে তাকে ছেড়ে ও দেয়না I অনিমা ঠিক করে ফেলল এখানে আর এক মুহূর্তও নয় I বের হয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিতে হবে I তারপর কোন হোটেলে গিয়ে উঠতে হবে I মুনির কে কি করে বুঝাবে সেটাই বুঝতে পারছে না অনিমা I

সোহানা খোঁচাটা গায়ে মাখলো না I বলল

– আমাদের কোন সমস্যা নেই I আমরা সন্ধার সময় ঠিক পৌঁছে যাব I

– ভাইয়া আপনার ও একেই মত তো ?

আবরার স্ত্রীর দিকে তাকালো I সোহানা চোখের ইশারা করায় বলল

– হ্যাঁ ঠিক আছে I নিয়ে যাও I ইয়ে তোমার জন্য কিছু কেনাকাটা করতে চেয়েছিলাম ..

– সেসবের কোন দরকার নেই I ওইভাবে ফর্মালি তো কিছু হচ্ছে না I আপনারা আসবেন ওটাই যথেষ্ট I

মুনির তাকিয়ে দেখল অনিমা আর সেঁজুতি দুজনেই তৈরি হয়ে গেছে I ও দ্রুত ওদের লাগেজগুলো তুলে নিয়ে বলল

– ঠিক আছে ভাইয়া আসছি তাহলে I সন্ধ্যায় দেখা হবে I
নিচে নেমে অনিমা হতভম্ব হয়ে গেল I মুনির নিজের গাড়ি নিয়ে এসেছে I ঝটপট লাগেজ গুলো তুলে দিয়ে ও বলল
– তোমরা উঠে পড়ো দেরি করো না

অনিমা মহা ঝামেলায় পড়ে গেল I এখন ও মুনির এর কাছ থেকে কি করে পালাবে ?

তোমাকে
পর্ব 16.2

অনিমার কোলে বাচ্চাটা একটু কেঁপে উঠল I মুনির দেখল ওর কান বেয়ে রক্তের ধারা নেমেছে I অনিমা বাচ্চাটাকে আরো শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরল I ওর গালে ঠোট কপালে রক্ত লেগে যাচ্ছে I খেয়াল করলো না অনিমা I বাচ্চাটার একটা হাত নিস্তেজ হয়ে মনিরের কাঁধের উপর পরল I ও টের পেল সেই হাতের উত্তাপ ধীরে ধীরে কমে আসছে I মুনির মনে মনে প্রার্থনা করল আল্লাহ অনিমা যেন কিছু বুঝতে না পারে I

ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সির সামনে প্রচন্ড ভিড় I অনিমা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে অসহায়ের মত এদিক ওদিক তাকালো I কি করবে বুঝতে পারল না I সাবের চাচা বার্ন ইউনিটের সিনিয়র সার্জেন I অনিমার বাবার বন্ধু I অনিমা কে খুব স্নেহ করেন I অনিমা বুঝতে পারছে না তাকে কিভাবে খুজে বের করবে I কিংবা খুঁজে বের করলেও আদৌ কোনো লাভ হবে কিনা I মুনির বলল

– তুমি একটু দাঁড়াও আমি দেখছি

মুনিরদের গ্রামে কোন হাসপাতাল নেই I ওদের সবসময় সদর হাসপাতালে যেতে হয় I মুনির প্রায়ই বিভিন্ন জনকে নিয়ে গেছে সদর হাসপাতালে I তাই এই জায়গাগুলোর চরিত্র ওর জানা I কিছুক্ষণের মধ্যেই ও একজন ইন্টার্ন ডাক্তার যোগাড় করে ফেলল I অনিমা দেয়ালে হেলান দিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল I ডাক্তার সহ মুনির কে আসতে দেখে দৌড়ে গেল I ডাক্তার ছেলেটা এসে বাচ্চাটার হাত তুলে দেখল I ওর চোখ মুখ কেমন যেন শুকিয়ে গেল I ছেলেটা চকিতে একবার মুনীরের দিকে তাকালো I মুনির দুদিকে মাথা নেড়ে কিছু বলতে নিষেধ করল I অনিমা বলল

– কি হয়েছে ওর ? ঠিক হয়ে যাবে তো ? আপনি কিছু বলছেন না কেন ?

– আমাদেরকে একটু দেখতে দিন I

ডাক্তার ছেলেটা বাচ্চাটাকে নিয়ে চলে গেল I মুনির বলল

– চলো এখানে থেকে আর লাভ নেই
– কিছু না জেনেই চলে যাব ?
– আমরা আবার পরে এসে খোঁজ নেব I চলো তোমাকে বাসায় পৌছে দেই
– তুমি চলে যাও I আমি আরো কিছুক্ষণ থাকবো

মুনির কিছু বলল না I স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ অনিমার দিকে তাকিয়ে রইল I অনিমা ওর দিকে তাকাচ্ছে না I অন্যদিকে তাকিয়ে আছে

– আচ্ছা ঠিক আছে I তুমি একটু থাকো আমি আসছি

মুনির গেছে কিছুক্ষণ হবে কিন্তু অনিমার মনে হচ্ছে অনন্ত কাল I খুব অস্থির লাগছে I কান্না পাচ্ছে খুব I কেন যে এমন হচ্ছে বুঝতে পারছে না অনিমা I মুনির এল আরও কিছুক্ষণ পরে I অনিমা তখন দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে ছিল I মুনির এসে ওর মুখোমুখি দাঁড়ালো I

– অনিমা তুমি ঠিক আছো ?

অনিমা চোখ খুলে মাথা নাড়ল অর্থাৎ ও ঠিক আছে I মুনির ওর হাতের ভেজা রুমালটা দিয়ে পরম যত্নে ওর গাল ,কপাল আর ঠোট থেকে রক্তের দাগ গুলো মুছে দিতে লাগলো I অনিমার চোখ ভিজে আসছে I প্রাণপণ চেষ্টা করেও কান্নাটা আটকাতে পারছেনা I মুনির চোখের জলটাও খুব যত্ন করে মুছে দিল I তারপর আস্তে আস্তে বলল

– তোমাকে বাসায় এভাবে দেখলে সবাই ভয় পাবে Iএকটু ঠিক হয়ে নাও I

অনিমা নিজেকে একটু গুছিয়ে নিল I

মুনির বলল

– চলো তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমি যাব

অনিমা এবার আর আপত্তি করল না I মনিরের পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো I তখন রাত হয়ে গেছে I চারিদিকে বেশ অন্ধকার নেমেছে I দূরে কোথাও বোধহয় বৃষ্টি হয়েছে I বাতাসে ঠান্ডা ভাব I অনিমার একটু শীত শীত লাগছে I মুনির বলল

-শীত লাগছে ?

– হুম

– দাঁড়াও রিক্সা নিয়ে নিচ্ছে

রিক্সায় উঠে মুনির ওর ব্যাগ থেকে একটা চাদর বের করে অনিমা কে দিয়ে বলল

– এটা গায়ে দিয়ে নাও

অনিমা একটু অবাক হল তবে কিছু বলল না চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিল

– রিক্সার হুড তুলে দেই ?

– দাও

অনিমার খুব ক্লান্ত লাগছে I এত ধকল ও আর নিতে পারছে না I মুনির দেখল অনিমা একটু একটু কাঁপছে I মুনির অনিমার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল

– খারাপ লাগছে অনিমা ?

-হুম

– ঘুম আসছে ?

– হ্যাঁ

– ঠিক আছে তুমি চোখ বন্ধ করে থাকো I বাসার কাছে আসলে আমি ডেকে দেবে

– আচ্ছা

অনিমা চোখ বন্ধ করলো I তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই মনিরের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরল I মুনিরএকবার পাশ ফিরে অনিমার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকালো I তারপর আস্তে আস্তে বলল

-তুমি কি জানো আমি তোমাকে কতখানি ভালবাসি ?

চলবে….
লেখনীতে
অনিমা হাসান

গত পর্বে সবাই আমার জন্য অনেক দোয়া করেছেন I সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ I সবার দোয়ায় এখন ভালো আছি I গল্পটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে I পর্ব গুলো আসতে একটু সময় লাগছে I সবাই একটু কষ্ট করে ধৈর্য ধরে সঙ্গে থাকবেন I

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here