তোমাকে

পর্ব 15.1

অনিমাদের যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এসেছে I মুনিরের সাথে আজকাল তেমন কথা হয় না I খুব একটা আসে ও না I ফোন করে অথবা টেক্সট করে দেয় প্রয়োজন হলে I টিকেট ও ইমেইল করে দিয়েছে অনিমার ইমেইল এড্রেসে I অনিমার একটু চিন্তা হয় কি খেয়ে আছে I মাঝেমাঝেই খাবার পাঠিয়ে দেয় সেঁজুতির হাত দিয়ে I নিজে আর ডাকে না উপরে I

ফ্লাইটে ও খুব একটা কথা হল না দুজনের I পুরোটা সময় অনিমা চুপ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল অথবা ঘুমিয়ে ছিল I মুনির অবশ্য দিব্যি সেঁজুতির সঙ্গে গল্প করে সময় কাটিয়েছে I মুনির সারাটাক্ষন অনেক যত্ন করেছে ওদের দুজনের I অনেক খেয়াল রেখেছে যেটা আরো মন খারাপ করিয়ে দিয়েছে অনিমার I অনিমা ঠিক করে ফেলেছে দেশে কয়েকটা দিন কাটিয়ে ফিরে আসবে I মুনিরের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখবে না I আবরার কে ও জানিয়ে দেবে I আবরারের অবশ্য ওকে নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই সেটা ও জানে I মুনিরের ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকতে চায় না ও I তাছাড়া সেঁজুতির জন্য ওকে ফিরে আসতেই হবে I আর মুনিরের পক্ষেও সম্ভব না সবকিছু ছেড়েছুড়ে ওর কাছে চলে আসা I কাজেই এভাবে বিয়ে করার কোন মানেই হয়না I মুনিরের জীবনটাকে আর জটিল করতে চায়না অনিমা I

এয়ারপোর্টে যখন ওরা পৌঁছলো তখন রাত হয়ে গেছে I আবরার এসেছে অনিমাদের নিতে I একাই এসেছে সোহানা সঙ্গে আসিনি I অনিমা অবশ্য আশা ও করিনি I ফ্লাইট থেকে নেমে মুনির বলল

– তোমাদের জন্য একটু খাবার আর পানি কিনে দেই
– দরকার নেই
– এখানকার পানি খেলে সমস্যা হতে পারে I দাঁড়াও আমি এনে দিচ্ছি

মনির পানি আর ও কি সব যেন সেঁজুতির ব্যাগে ভরে দিল I আবরারের সঙ্গে দেখা হলে কুশল বিনিময়ের পর মনির বলল

– আমি তাহলে যাই ?
– তোমাকে নামিয়ে দেই আমরা I আবরার ভদ্রতা করে বলল
– না আমি ট্যাক্সি নিয়ে নেব I ওরা টায়ার্ড আপনারা বাসায় চলে যান I

মনির বিদায় নিয়ে চলে গেল I আবরারের ফ্ল্যাটে পৌঁছতে প্রায় দশটা বেজে গেল I বাড়ি যেয়ে অনিমা একটু অবাক হল I সোহানা ঘুমিয়ে পড়েছে I আবরার বলল

– তোরা টায়ার্ড ঘুমিয়ে পড় I নিচে গেস্টরুমে তোদের থাকার ব্যবস্থা করেছি I ইয়ে , আমরা তো রাতে কিছু খাইনা তাই কিছু করা হয়নি I তোরা কিছু খেলে বল অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি I

-না কিছু লাগবেনা I

অনিমা সেজুতিকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল I মুনির কি কিছু বুঝতে পেরেছিল I আশ্চর্য তো I সেজুতিকে ফ্রেশ হতে বলে অনিমা সেজুতির ব্যাগ খুলল I ব্যাগের ভেতর পানির বোতল চিকেন স্যান্ডউইচ আর দুটো কাপ কেক পাওয়া গেল I অনিমার চোখে পানি এসে গেল I হঠাৎ করেই মুনিরের খুব মিস করতে লাগলো I কি অদ্ভুত আগে তো কখনো এমন হয়নি I কি জানি হয়তো একই বাসায় থাকত তাই I কাল সকালেই হোটেলে উঠে যাবে ঠিক করল অনিমা I আর হয়তো দেখা হবে না মুনিরের সাথে I একবার ওকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে I অনিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল I হঠাৎ করেই মনটা কেমন দুর্বল হয়ে গেছে I খুব ইচ্ছা করছে একবার কথা বলতে I দেখা না হোক একবার ওর কন্ঠস্বরটা শুনতে I

রাত অনেক হয়ে গেছে I অনিমার ঘুম আসছে না I পাশেই সেঁজুতি ঘুমিয়ে আছে I অনিমা ফোন বের করে ফেসবুক চেক করছিল আর তখনই ফোনটা এলো

– ঘুমাওনি এখনও ?
– না কি করে বুঝলে ?
– তোমাকে অনলাইনে দেখে I খেয়েছো কিছু ?
– হু I তুমি ঘুমাচ্ছো না যে
– আমার এত সহজে ঘুম আসেনা
– কেন?
– আমার ক্রনিক ইনসম্নিয়া
– কবে থেকে ?
মনিরের খুব বলতে ইচ্ছে হল যখন থেকে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেছো তখন থেকে সেটা আর বলা হল না মুখে বলল
– অনেক বছর ধরে
– গান শুনো ঘুম এসে যাবে
– তুমি শোনাবে ?
– না I আমার গান শুনলে তুমি আবার পালিয়ে যাবে I কথাটা বলে অনিমা নিজেই চমকে উঠলো I
-এবার তুমি পালাতে দিওনা
– আমি কাউকে জোর করে ধরে রাখি না
– মাঝে মাঝে জোর করতে হয় অনিমা
– হয়তো হয় I আমি চাইনা
– অনিমা
– কি বলো
– অন্য সময় বলবো
অনিমা হেসে ফেললো I অনেক বছর আগে ওরা এভাবে কথা বলতো

-ঘুমিয়ে পড়ো মুনির I
-আচ্ছা গুড নাইট I

অনিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল I মনে মনে বলল তুমি ভালো থেকো মুনির I অনেক অনেক ভালো I

অনিমার চোখটা মাত্র লেগে এসেছিল কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল I অনিমা পাশ ফিরে ঘড়ি দেখল I সাড়ে সাতটা বাজে I এত সকালে নিশ্চয়ই পেপারওয়ালা দুধওয়ালা কিছু একটা হবে I উঠতে ইচ্ছা করছে না I যে এসেছে সে বেল বাজিয়েই যাচ্ছে I বিরক্ত হয়ে ওঠে অনিমা গেট খুলল I হঠাৎ মনে হল ও বোধ হয় ঘুমিয়ে ই আছে I আর স্বপ্ন দেখছে এটা সত্যি নয় I

মনির হাসতে হাসতে বলল

-কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে ?
– তুমি এখানে কি করছ ?
– তোমাদের নিতে এসেছি I

পর্ব 15.2

– তুমি এখানে কি করছো অনিমা ?
অনিমা মুনীরকে দেখে একটু অবাক হল I প্রথমে কিছু বলল না I মুনীর আবার জিজ্ঞেস করল
– কোথায় যাচ্ছ তুমি ?
– এখানে কেউ কিছু করছে না I সবাই দাঁড়িয়ে দেখছে I বাচ্চাটাকে নিয়ে গেলে হয়তো বাঁচানো যাবে I
– কোথায় নিয়ে যাবে ?
– ঢাকা মেডিকেলের ইমারজেন্সিতে I তুমি কি কষ্ট করে আমাকে একটা রিকশা ডেকে দিতে পারবে ?

অনিমা খুব ফর্মালি কথা বলছে I আগে কখনো তো এভাবে বলেনি I মুনিরের খুব গায়ে লাগলো I ও কিছু বললো না তবে একটা রিক্সা থামাল I অনিমা বাচ্চাটাকে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসে বলল

– থ্যাঙ্ক ইউ I অনেক কষ্ট করলে

মুনিরের প্রচন্ড রাগ হল I অনিমা ওর সঙ্গে এরকম ব্যবহার করছে কেন ?

-সরে বসো আমি রিক্সায় উঠবো
– তোমাকে যেতে হবে না
– অনিমা আমি সরে বসতে বলেছি I তোমাকে আমি এভাবে একা ছাড়বো না I

অনিমা কিছু বলছে না I সরেও বসছে না I রিক্সাওয়ালা তাড়া দিচ্ছে I ব্যস্ত রাস্তায় এভাবে রিক্সা দাঁড় করিয়ে রাখা যায়না I মুনির অন্যদিক থেকে ঘুরে এসে রিক্সায় উঠল I অনিমা কিছু বলল না I কোনমতে বাচ্চাটাকে ধরে বসে রইল অন্যদিকে চেয়ে I

– হুড তুলে দেবো ?
– না লাগবেনা

মুনিরের মনে হল অনিমার বসতে কষ্ট হচ্ছে I ও বলল

– বাচ্চাটাকে আমার কাছে দাও I তুমি ঠিক হয়ে বস I ধাক্কা লাগলে পড়ে যাবে

– সমস্যা নেই I তুমি নিশ্চয়ই কোন জরুরী কাজে যাচ্ছিলে I সামনে নেমে যেতে পারো I

মুনিরের মাথায় আগুন ধরে গেল I মেয়েটা এতো অভিমানী I সেদিন জরুরী কাজের কথা বলে ওর বাসা থেকে বেরিয়ে ছিল বলে আজকে সেটা শোনাচ্ছে I আশ্চর্য I সামনে স্পিডব্রেকার I মুনির অনিমার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে শক্ত করে ধরে বসলো I অনিমা কিছু বলল না I মুনির তাকিয়ে দেখল অনিমা বাইরের দিকে তাকিয়ে চোখ মুছছে I মনিরের হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল I নরম গলায় বলল

– তোমাকে আমার কিছু বলার ছিল অনিমা I

মুনিরের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল অনিমা হঠাৎ ফিরে তাকাল I ওর চোখ ভেজা I তখন বিকেলের আলো ফিকে হয়ে আসতে শুরু করেছে I অনিমার গভীর কালো চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে মুনির দিশেহারা বোধ করল I ওর মনে হলো এই জীবনে এই মেয়েটাকে ছাড়া ওর চলবে না I

চলবে…..
লেখনীতে
অনিমা হাসান

( ক’দিন ধরে মাইগ্রেনের ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছি I কিছুতেই লিখতে পারছিনা I তাই এই পর্ব টা দিতে দেরী হয়ে গেল I সবাই মুনির আর অনিমা কে ভুলে যাননি আশা করি )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here