#তুমি_আমারই_রবে
পর্ব_২৫
#Nishat_Jahan_Raat (ছদ্মনাম)
“উফফফ রূপা। মই বেয়ে উঠেছি। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এসো।”
আমি এখনো অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। কিছুতেই যেনো বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না উনি সত্যি সত্যিই মই বেয়ে তিন তলা এই উঁচু বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকছেন, নিচে যেতে বলছেন। মনে খচখচানি নিয়ে আমি উনাকে উপেক্ষা করে জানালা দিয়ে নিচে উঁকি দিতেই দেখলাম আসলেই উনি বিশাল মইয়ে দাঁড়িয়ে জানালার থাই ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। ক্লান্ত ভরা মুখ। অস্থির চাহনী উনার। মাঝে মাঝে খানিক নড়ে চড়ে ও উঠছেন। হয়তো রাতের স্নিগ্ধ বাতাসে গাঁয়ে শীত ধরে আসছে। উতলা হয়ে আমি উনার চোখে চোখ রেখে বললাম,,
“কেনো এমন পাগলামী করেন হিমু? কি দরকার ছিলো এতো রিস্ক নিয়ে এতো রাতে এখানে আসার?”
উনি মলিন চাহনীতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,
“তোমায় একটা নজর দেখব বলে!”
“কালই তো আমাদের দেখা হতো হিমু। কেনো এতো ছেলে মানুষি করছেন আপনি?”
“কেনো? তুমি তো এই হিমুকেই দেখতে চেয়েছিলে। যে তোমার জন্য সব ধরনের ছেলে মানুষি করতে পারবে, পাগলামী করতে পারবে, তোমার জন্য মরিয়া হয়ে তোমার পিছনে পিছনে ঘুড়বে।”
“আমি এখনো চাই, আগামীতে ও চাইব হিমু এভাবেই পাগল হয়ে আমার পিছনে ঘুড়ুক। তবে এতোটা ও পাগলামী না করুক, যতোটা পাগলামী করলে এতোটা রিস্ক নিয়ে রাতের আঁধারে তিন তলার জানালায় এসে দাঁড়াতে হবে।”
উনি মলিন হেসে বললেন,,
“আচ্ছা। এতোটা রিস্ক নিয়ে আর কতোক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? একটু বলবেন মিসেস রূপা?”
আমি মাথা নিচু করে হালকা হেসে বললাম,,
“আপনি আগে নিচে নামুন। এরপর আমি আসছি।”
“তুমি এসো। এরপর আমি নিচে নামছি।”
“না। আগে আপনি নামুন। আপনাকে সুস্থভাবে নিচে নামতে দেখেই আমি নিচে নেমে আসব।”
উনি মাথাটা নিচু করে কুর্ণিশ জানিয়ে বললেন,,
“আপনার কথাই শিরধার্য। মিসেস রূপা!”
মইয়ের দুই দিকে শক্ত করে হাত রেখে উনি অস্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। দেখেই বুঝা যাচ্ছে উনার মনে অল্প হলে ও ভয় ভীতি কাজ করছে। আমি উদ্বিগ্ন চোখে উনার দিকে তাকাতেই উনি আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে একদম তলানিতে তাকিয়ে বললেন,,,
“মৃত্যুকে এখন খুব ভয় পাই। জীবনের প্রতি খু্ব মায়া পড়ে গেছে। নিচে পৌঁছাতে পৌঁছাতে যদি কিছু একটা হয়ে যায়…
উনাকে আর কিছু বলতে দিলাম না আমি। একদম উনার মুখ চেঁপে ধরে বেশ রুষ্ট হয়ে বললাম,,
“মুখটা বন্ধ রাখুন আপনি। আল্লাহ্ র উপর ভরসা রেখে এক পা দু পা করে নিচে নামুন।”
উনি মৌণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি সংকুচিত চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। আচমকাই উনি আমার হাতে চুমো খেয়ে দুষ্টুভঙ্গিতে আমার দিকে তাকালেন। তাড়াহুড়ো করে আমি উনার মুখ থেকে হাতটা সরাতেই উনি মলিন হেসে নিচে নামছেন আর ব্যস্ত ভঙ্গিতে আমাকে বলছেন,,
“তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এসো রূপা। বেশিক্ষণ ওয়েট করতে পারব না।”
কিছু বললাম না আমি। কেবল অস্থির দৃষ্টিতে উনার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছি। লোকটা সুস্থভাবে মই বেয়ে নামলেই আমার শান্তি। অল্প সময়ের মধ্যে উনি নিজেকে সামলে ঠিকঠাক ভাবে নিচে নেমে গেলেন। বড় করে একটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে আমি চোখ বুজে বুকে হাত দিয়ে আল্লাহ্ র কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। অমনি উনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে নিচ থেকে জোরে চেঁচিয়ে বললেন,,
“রূপা। নিচে নেমে এসো। তাড়াতাড়ি।”
আমি হাত দিয়ে ইশারা করে বললাম আসছি। জানালার পর্দা গুলো লাগিয়ে আমি পাশ ফিরে তাকাতেই হঠাৎ আতকে উঠলাম। ফ্ল্যাশ লাইট অন করে লামিয়া, নীলা আর লোপা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে অনেক গুলো প্রেতাত্না এক জোট হয়ে লোভাতুর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ে আমি চিৎকার করতে উঠতেই লামিয়া আমার মুখ চেঁপে ধরে বলল,,
“রাত, বিরাতে কি হচ্ছে এসব জানালা দিয়ে হুম? কি ভেবেছিস আমরা কিছু বুঝব না?”
আমি উম উম করে লামিয়ার হাতটা আমার মুখ থেকে সরানোর চেষ্টা করছি৷ অল্প সময় পর লামিয়া আমার মুখ থেকে হাতটা ছাড়িয়ে বেশ ভঙ্গিমা করে বলল,,
“এখন নিশ্চয়ই দৌঁড়ে নিচে যাবি? জিজুর হাত ধরে সারা রাত টো টো করে ঘুড়ে বেড়াবি?”
আমি বসা থেকে উঠে চুলটা খোঁপায় পেঁচিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াচ্ছি আর পিছু ফিরে গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে লামিয়াকে বলছি,,
“ঘুমিয়ে পড় তোরা। কিছুক্ষন পরেই আমি আসছি।”
লামিয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি রুমের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে ধীর পায়ে হেঁটে সদর দরজাটা খুলে সোজা সিঁড়ি বেয়ে নিচ তলার ফ্ল্যাটে চলে এলাম। ফ্ল্যাটের মেইন গেইট থেকে বের হতে যাবো অমনি মনে হলো কেউ আমাকে টেনে গেইটের মাঝে চেঁপে ধরেছেন। চোখে বিস্ময় নিয়ে আমি চোখ তুলে ঐ ব্যক্তিটার দিকে তাকাতেই আবার চোখ দুটো সংকীর্ণ করে নিলাম। হিমু বাঁকা হেসে অতি দুষ্টু ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ডান হাতের অনামিকা আঙ্গুল দিয়ে উনি আমার কপাল থেকে শুরু করে থুতনী অব্দি লম্বভাবে আঙ্গুলটা ছোঁয়াচ্ছেন আর ঘোর লাগা কন্ঠে বলছেন,,
“পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি। এই রাতে ও সেজে গুজে আসতে হলো?”
চোখ, মুখ লাল করে আমি উনাকে জোরে এক ধাক্কা দিয়ে আমার থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে বললাম,,
“সাজি নি ওকে? ঐ সময়ের সাজটা এখনো রয়ে গেছে।”
“ইচ্ছে করে তুলো নি আই নো। তুমি জানতে হিমু ঠিক রাতে আবার আসবে। সো আরো একবার হিমুকে তো পাগল করতেই হবে!”
আমি খুব রুষ্ট হয়ে উনার শার্টের কলার চেঁপে ধরে বললাম,,
“হিমুকে পাগল করতে আমার বয়ে গেছে। আর একবার যদি এসব উদ্ভট কথা বলেছেন তো এবার আপনার গলা চেঁপে ধরব।”
“আমার শ্বাস রুদ্ধ করার মতো পর্যাপ্ত জোর তোমার হাতে এখনো হয় নি। শুধু আমার কলার চেঁপে ধরার ক্ষমতাটাই হয়েছে তোমার।”
কিছু বললাম না আমি। আস্তে করে উনার শার্টের কলারটা ছেড়ে দিলাম। মুখটা ফুলিয়ে আমি বুকের উপর হাত গুজে অন্য পাশ ফিরে উনাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,,
“কানে ধরার কথা ছিলো। ধরেছেন?”
উনি পেছনের চুল গুলো টেনে মাথাটা নিচু করে ছোট আওয়াজে বললেন,,
“শাস্তি কি মওকুফ করা যায় না?’
“না যায় না। পারলে আরো একশ বার বেশি ধরবেন।”
উনি বেশ পেরেশান হয়ে বললেন,,
“নো নো। ২০০ ই ব্যাটার।”
আমি হালকা হেসে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,
“তাহলে শুরু করে দিন।”
উনি মুখটা কালো করে দু কানে দু হাত দিয়ে উঠ বস করা শুরু করলেন। আমি মিটিমিটি হেসে উনার দিকে তাকাচ্ছি। উনি ছোট ছোট আওয়াজে কাউন্ট করছেন আর অসহায় মুখ করে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। আমি ভাবলেসহীন ভাবে এদিক সেদিক তাকিয়ে উনার অসহায় মুখটাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করছি। প্রায় দেড়শ বার কাউন্ট করার পর হিমু হঠাৎ থেমে গেলেন। গাঁ দিয়ে ঘাম ঝড়ছে উনার। মুখটা ও কেমন ফ্যাকাশে হয়ে আছে। শ্বাস দ্বিগুন আওয়াজে বাড়ছে। পা দুটো ও হয়তো চলছে না। দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুব হয়রান হয়ে গেছে। আমি অনেকটা উদ্বিগ্ন হয়ে উনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কান থেকে উনার হাত দুটো ছাড়িয়ে বললাম,,
“হয়েছে। আর কান ধরতে হবে না। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছেন।”
উনি ক্লান্ত চোখে আমার দিকে তাকালেন। শাড়ির আঁচল দিয়ে আমি উনার পুরো মুখটা খুব যত্ন সহকারে মুছে দিলাম। শার্টের প্রথম দুটো বাটন খুলে দিলাম। শার্টের ভেতর বার বার ফুঁ দিচ্ছি আমি। ঠান্ডা বাতাসটা বুকে লাগলে হয়তো ঘামের প্রাদুর্ভাবটা কমে যাবে। ফুঁ দেওয়ার সাথে সাথে আমি উনার কপালে লেপ্টে থাকা চুল গুলো ও সুন্দর করে গুছিয়ে দিচ্ছি। আমার অতি ব্যস্ততা দেখে উনি মলিন হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,
“নিজেই শাস্তি দাও আবার নিজেই পেরেশান হয়ে যাও। ভালোবাসা খুব অদ্ভুত তাই না?”
আমি মাথা উঁচিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,
“ভালোবাসা অদ্ভুত বলেই তো এতে সমস্ত আবেগের মিশ্রণ থাকে। হুটহাট ভালো লাগা, খারাপ লাগা, রাগ, অভিমান, কষ্ট, যন্ত্রণা, যাতনা, প্রফুল্লতা, হাসি, কান্না, অন্তর্দহন, পূর্ণতা, অপূর্ণতা এ সবকিছুর মিশ্রণ থাকে। ভালোবাসার নির্দিষ্ট কোনো মাপকাঠি থাকে না। তাই তো কেউ চাইলেই ভালোবাসার মানুষটার হাত ধরে তাকে নিয়ে যুগ যুগ বেঁচে থাকার স্বপ্নে পূরণে উচ্চাকাঙ্ক্ষি হয়ে উঠে। আবার কেউ চাইলে সেই ভালোবাসার মানুষটার হাত ছেড়েই তাকে সর্বশান্ত করতে পারে। নির্দিষ্ট মাপকাঠি থাকলে হয়তো এমনটা হতো না। সবার ভালোবাসারই নির্দিষ্ট একটা ব্যালেন্স থাকত।”
হুট করেই উনি আমাকে ঝাপটে ধরে আমাকে উনার বুকের সাথে মিশিয়ে বললেন,,
“আমি তোমার হাতটা শক্ত করে ধরেই তোমাকে নিয়ে যুগ যুগ বেঁচে থাকার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই রূপা। আমি ও চাই না আমার ভালোবাসায় কোনো ব্যালেন্স থাকুক। কোনো মাপকাঠি থাকুক। আমার ভালোবাসা পৃথিবীর সমস্ত মাপকাঠির উর্দ্ধে থাকবে। সমস্ত ব্যালেন্সিংয়ের উর্দ্ধে থাকবে। তোমার জায়গা শুধু আমার বুকের বাঁ পাশটায়। যেখানে অতি যত্নে প্রতিবার তোমার নামেরই প্রতিধ্বনি হয়। তুমি আমার আশেপাশে থাকলেই দেহের প্রতিটা শিরা উপশিরা জানান দিয়ে দেয় তোমার অস্তিত্ব। মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি হয়তো আমার রক্তের সাথেই মিশে গেছো। তুমি ছাড়া এই হিমু প্রচন্ড ছন্নছাড়া রূপা। মনে হয় সম্পূর্ণ বৈরাগ্য একটা মানুষ। উদাসীন, নির্বোধ, অগোছালো। তোমাকে দেখলেই আমি সীমাহীন আবেগে ডুবে যাই, জীবনের ছন্দ খুঁজে পাই, হৃদয়ে একটা টাল মাটাল ঝড়ের উৎপত্তি হয়, শিহরিত হয়ে যাই অনুরাগে। তোমাকে ভালোবাসার পর বুঝেছি ভালোবাসার আসল অর্থ। একদিন হয়তো তোমাকে আমি বলেছিলাম, ” দূরত্বে, গুরুত্ব বাড়ে।” আজ কিন্তু আমার মুখ থেকে নিঃসৃত কথাটাই সত্যি হয়ে গেলো। তোমার থেকে অনেকটা দূরত্বে যেয়েই আমি আরো বেশি করে তোমার গুরুত্ব বুঝেছি।”
আমি উনার শার্ট খামচে ধরে উনার বুকের বাঁ পাশটায় মাথা রেখে হার্টবিটের টিউটিউ আওয়াজটা শুনছি। আনমনেই আমি উনার বুকের বাঁ পাশটায় খুব দীর্ঘ করে একটা চুমো এঁকে দিলাম। অমনি হিমু বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন,,
“ইয়েস। বৌয়ের ফার্স্ট চুমো!”
লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে আমি তাড়াহুড়ো করে উনাকে ছেড়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই উনি পেছন থেকে আমার হাতটা টেনে আমাকে থামিয়ে দিলেন। আমি বুকে হাত দিয়ে চোখ বুজে ছোট আওয়াজে উনাকে বললাম,,
“হিমু ছাড়ুন। ঘুম পেয়েছে আমার।”
“আমার চোখের ঘুম হারাম করে দিয়ে, তুমি খুব শান্তিতে ঘুমু্বে তাই না?”
“জাজাজানি না।”
উনি আমার হাতটা ছেড়ে একদম আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন। লজ্জায় আমি মুখ তুলে উনার দিকে তাকাতে পারছি না। হুট করেই হিমু আমায় কোলে তুলে নিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি পুরো নির্বাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনার কাঁধে হাত রাখতেই উনি হালকা হেসে বললেন,,
“তোমার এই নির্বাক চাহনী আমাকে আরো বেশি করে আকৃষ্ট করে রূপা৷ মনে হয় এই নির্বাক চাহনীর মাঝেই কতো শতো আবেগ, ভালো, লাগা, ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। যা হয়তো তুমি প্রকাশ করতে চাও না।”
আমি উনার থেকে চোখ সরিয়ে বললাম,,
“আমাকে নিচে নামিয়ে দিন হিমু৷”
উনি সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠছেন আর মলিন কন্ঠে বলছেন,,
“সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে তোমার কষ্ট হবে রূপা। আমি তোমাকে রুম অব্দি ছেড়ে দিচ্ছি।”
“হিমু, কষ্ট আমার না আপনার হবে। একটু আগেই আপনি অনেকবার কান ধরে উঠ বস করেছেন। পা হয়তো অনেকটাই ব্যাথা হয়ে আছে। প্লিজ নিচে নামান আমাকে।”
উনি আমার নাকে নাক ঘঁষে বললেন,,
“একদম চুপ৷ আর একটা কথা ও বলবে না।”
সত্যিই চুপ হয়ে গেলাম আমি। শুধু পলকহীন চোখে এক ধ্যানে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। তৈলাক্ত চিরুনিতে যেমন কাগজের টুকরো চুম্বরের মতো আকর্ষিত হয়, তেমনি উনার দু চোখে আমার চোখ দুটো চুম্বরের মতোই আকর্ষিত হচ্ছে৷ আচমকাই কানে একটা মিষ্টি গানের আওয়াজ ভেসে আসল। হিমু গুনগুন করে গাইছেন,,
“তুম মিলে তো দিল খিলে,
অর জিনে কো কেয়া চাহিয়ে।”
হঠাৎ উনি গান গাওয়া থামিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,
“সত্যি বলছি রূপা। তোমাকে পাওয়ার পর, বেঁচে থাকার জন্য আমার আর অতিরিক্ত কিছুর প্রয়োজন নেই। বিশ্বস্ত একটা হাত পেলে জীবন এমনিতেই সুন্দর হয়ে উঠে।”
সিঁড়ি বেয়ে উনি তিন তলায় চলে এলেন। আমাদের রুমের দরজার সামনে এসে উনি আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন। শাড়ির কুঁচি ঠিক করে আমি রুমের ভেতর ঢুকে পড়লাম। দরজার লাগানোর আগ মুহূর্তে উনি হঠাৎ দরজায় হাত দিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন,,
“ভালোবাসি রূপা। উওরটা দিয়ে যাও প্লিজ।”
আমি কোনো প্রতিত্তর না করে উনার মুখের উপর দরজাটা আটকে দিলাম। দরজায় খিল লাগিয়ে আমি মনে মনে হাসলাম আর বললাম,,
“থাকুন না একটু অপেক্ষায়। দেখুন না, অপেক্ষা কতোটা তিক্ততার।”
বিছানায় এক সাইড হয়ে শুয়ে পড়লাম আমি। হাঙ্গামা পার্টি গুলো সব ঘুমিয়ে পড়েছে। একেক জন নাক টেনে টেনে ঘুমুচ্ছে। আমি ও চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়লাম। বহুদিন পর ঘুমটা বেশ তৃপ্তির হবে। আগত দিনের সোনালী আলোর হাতছানি নিয়ে এক ঝাঁক খুশি আমাকে অবিরত ডেকে চলছে৷ এবার বুঝি সব ভালো হবে, ঠিক হবে, সবার মঙ্গলের জন্য হবে। হিমুকে পাওয়ার ইচ্ছেটা পূর্ণ হলো আমার৷ ষোল কলায় পূর্ণ হলো। আমার মতো সুখি নারী বুঝি পৃথিবীতে আর দুটো নেই। যে তার স্বামীকে দ্বিতীয় বারের মতো উত্তম স্বামী হিসেবে নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে আবার পেতে চলেছে!
,
,
তপ্ত সকালের তীর্যক রোদের আভা চোখে পড়তেই কাঁচা ঘুমটা মনে হলো চোখ থেকে উবে গেলো আমার। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে আমি নাক, মুখ কুঁচকে পিটপিট চোখে এদিক সেদিক তাকালাম। আশেপাশে কিছুই দেখতে পেলাম না। কেবল উত্তপ্ত রোদের তীব্র ঝলকানি ছাড়া। চোখ দুটো মনে হচ্ছে জ্বলে, পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে আমার। হাত দিয়ে চোখ জোড়া ঢেকে নিলাম আমি। আর অন্য হাত দিয়ে জানালার পর্দাটা টেনে দিলাম। রোদের কড়া রশ্মি পর্দা ভেদ করে রুমে ঢুকার কোনো উৎস ই খুঁজে পাচ্ছে না। হাঁফ ছেড়ে বেঁচে আমি শরীরের আড়ামোড়া ভেঙ্গে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। চোখে ঘুম আর শরীরে অলসতা নিয়ে আমি ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকালাম। অমনি চোখের ঘুমটা মুহূর্তের মধ্যে উবে গেলো। চোখ কচলে ভালো করে ঘড়ির দিকে তাকাতে দেখলাম ঘড়িতে সকাল ১০ টা বাজছে। হুড়মুড়িয়ে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে চুল বাঁধতে বাঁধতে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লাম। অল্প সময়ের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে আমি রুম থেকে বের হয়ে সোজা ড্রইং,রুমে চলে এলাম। ডাইনিং টেবিলে সবাই খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে। সবার মাঝে হিমু, লামিয়া আর নীলা মিসিং। লামিয়া আর নীলা হয়তো এতক্ষনে অফিসে চলে গেছে। আর হিমু…. উনি হয়তো নাক টেনে ঘুমুচ্ছেন।
ডাইনিং টেবিলের দিকে পা বাড়াতেই আন্টি একটা কফির মগ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,,,
“রূপা, মেহুলকে কফিটা দিয়ে এসো। এরপর দুজন একসাথে বসে ব্রেকফাস্ট করবে।”
আমি মাথা নাঁড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালাম। কফির মগটা হাতে নিয়ে আমি হিমুর রুমের দিকে পা বাড়াতেই লোপা পেছন থেকে আমাকে ডেকে দুষ্টুমি ভরা কন্ঠে বলল,,
“আপু দেখিস। সকাল গড়িয়ে না আবার দুপুর হয়ে যায়।”
কটমট চোখে আমি লোপার দিকে তাকালাম। লোপা মুহূর্তের মধ্যে বেলুনের মতো চুপসে গেলো। হনহনিয়ে আমি হিমুর রুমে ঢুকে পড়লাম। উন্মুক্ত শরীরে হিমু বেডের মাঝখানটায় উল্টো হয়ে শুয়ে নাক টেনে ঘুমুচ্ছেন। টাউজারের অর্ধেক অংশ উনার হাঁটুর উপর উঠে আছে। লোকটা আসলেই অদ্ভুত। একটু ও কি টের পাচ্ছেন না, টাউজারটা উনার হাঁটুর উপর উঠে গেছে? বিরক্তি নিয়ে আমি কফির মগটা ডেস্কের উপর রেখে উনার পাশে বসে টাউজারটা হাঁটু থেকে নিচে নামাতে নিলেই উনি ঘুমের মধ্যে কুঁকিয়ে উঠলেন। কৌতুহল নিয়ে আমি উনাকে ঝাঁকিয়ে বললাম,,
“কি হয়েছে হিমু? আপনি হঠাৎ কুঁকিয়ে উঠলেন কেনো? পায়ে ব্যাথা পেয়েছেন?”
উনি ঘুম জাড়ানো কন্ঠে বললেন,,
“হাঁটুতে ব্যাথা রূপা।”
বুঝতে আর দেরি হলো না, কেনো উনার হাঁটুতে ব্যাথা হচ্ছে। আমি খুব ক্ষীপ্ত হয়ে উনাকে বললাম,,
“কি দরকার ছিলো মই বেয়ে তিন তলায় উঠার? নাটক করে আবার আমাকে কোলে তুলে রুম অব্দি ছেড়ে আসার?”
উনি হঠাৎ শোয়া থেকে উঠে আমাকে হেচকা টান দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আমার গাঁয়ের উপর উঠে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললেন,,
“আমার ভালোবাসায় কোনো নাটকের আশ্রয় নেই রূপা। সামান্য হাঁটু ব্যাথা একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে।”
“দেখি ছাড়ুন। কফি নিয়ে এসেছি। কফিটা খেয়ে নিন। এরপর আমি হাঁটুতে মুভ ঘঁষে দিচ্ছি।”
উনি আমাকে খুব জোরে ঝাপটে ধরে আমার বুকে মাথা রেখে তীব্র ঘুমে আচ্ছাদিত হয়ে বললেন,,
“ওসব পড়ে হবে। আগে একটু ঘুমুতে দাও। কতো বছর পর তোমাকে এভাবে কাছে পেলাম।”
#চলবে,,,
(আসসালামু আলাইকুম। যারা আজ একটা বোনাস পর্ব চাইছেন তারা দয়া করে সাড়া দিন।)