#তুমি_আমারই_রবে
পর্ব_২
#Nishat_jahan_Raat (ছদ্মনাম)

এই মুহূর্তে আমি মরে গেলে ও হয়তো হিমু টের পাবে না! কারণ, “সে শুধুই আমার প্রয়োজন, প্রিয়জন না!”

জানি না কতোটা সময় পর আমার জ্ঞান ফিরল। চোখ খুলতেই নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করলাম। মুখে অক্সিজেন মাস্ক আর হাতে স্যালাইনের নল লাগানো আমার৷ মিটিমিটি চোখে আমি আমার চারপাশে শ্বাশুড়ী মা আর শ্বশুড় আব্বুকে দেখতে পেলাম। উনারা খুব উদ্বিগ্ন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে, মুখে যতো রাজ্যের দুশ্চিন্তার ছাপ প্রতীয়মান। বুঝতে পারছি উনারা খুব ঘাবড়ে আছে। আমাকে চোখ খোলা অবস্থায় দেখে উনারা মলিন হেসে আমার বাম হাতটা চেঁপে ধরল। শ্বাশুড়ী মা কেঁদে কেটে আমার পাশে বসে মিনমিনিয়ে কেঁদে বলল,,,

—“আমাদের ক্ষমা করে দে রূপা। আমরা তোর ঠিকঠাক যত্ন নিতে পারছি না। আজ আমাদের অবহেলার জন্যই তোকে এতোটা শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। আমরা পাশে থাকলে হয়তো তোর এতোটা লানত ভোগ করতে হতো না।”

শ্বাশুড়ী মা থামার সাথে সাথেই আমার শ্বশুড় আব্বু খানিক রেগে চেঁচিয়ে বলে উঠল,,

—“দোষ আমাদের না আন্জ্ঞু। দোষ আমাদের কুলাঙ্গার ছেলের। তোমার ছেলের উপর ভরসা করেই কিন্তু আমরা রূপাকে ওর সাথে ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। নয়তো রূপা আমাদের সাথেই কুমিল্লায় থেকে যেতো। আমরা আমাদের বউমাকে যত্নে আগলে রাখতে পারতাম। আমি জাস্ট ভাবতেই পারি নি তোমার ছেলে এতোটা দায়িত্বহীন হয়ে যাবে। এখন তুমিই বলো রূপার পরিবারকে আমি কি জবাব দেবো? উত্তর দাও!”

শ্বশুড় আব্বু আর কিছু বলার আগেই আমি পুরো কেবিনে চোখ বুলিয়ে হিমুকে কেবিনের কোথাও দেখতে না পেয়ে অক্সিজেন মাস্কটা মুখ থেকে সরিয়ে শ্বশুড় আব্বুকে উদ্দেশ্য করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,,

–“হিমু আসে নি বাবা?”

কথাটা শোনার সাথে সাথেই বাবা হুড়মুড়িয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো। আমার শ্বাশুড়ী মা মাথাটা নিচু করে ফেলল। আমি জানি আমার এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই কারো কাছে। তাই আমি ও চুপ হয়ে গেলাম। অক্সিজেন মাস্কটা আবারো মুখে পড়ে নিলাম। চোখ জোড়া বন্ধ করে আমি খুব জোরে এক্টা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। জানি না কাল রাতে কি কি হয়েছে আমার সাথে। আমি কিভাবে হসপিটালে এলাম, কে ই বা আমাকে হসপিটালে নিয়ে এলো! বাঁচার আশা তো আমি ছেড়েই দিয়েছিলাম। তবে কেনই বা আমাকে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আবারো বেঁচে থাকার বীজ বুনতে হলো?

বুকটায় খু্ব কষ্ট হচ্ছিলো। না চাইতে ও চোখ থেকে অনবরত পানি ঝড়ছিলো। শ্বাশুড়ী মা কিছুক্ষন পর পর আমার চোখের কোণে জমে থাকা জল গুলো মুছে দিচ্ছিলো আর বলছিলো,,,

—“কাঁদিস না মা। হিমু আসবে। তুই তো হিমুর বিয়ে করা বৌ বল। বৌ এর টানে হিমুকে আসতেই হবে। আর কিছুটা দিন সময় দে আমার ছেলেটাকে। দেখবি আমার ছেলে ঠিক আস্তে ধীরে তোর সাথে মানিয়ে নিবে।”

চোখ খুলে আমি একবার মায়ের দিকে তাকালাম। মনে মনে বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বললাম,,,

—“আপনার ধারণা ভুল মা। হিমু কখনো এই রূপার কাছে ধরা দিবে না। হিমু তো এই রূপার থেকে পালিয়ে থাকতে চায় মা। বিয়ের এই পাঁচ মাসে আমার তা খুব ভালো করে জানা হয়ে গেছে। কেনো শুধু শুধু আপনারা আমাকে মিথ্যা শান্তনা দিচ্ছেন মা? আমি কি অতোটাই বোকা মা?”

মা মৃদ্যু হেসে আমার কপালে চুমো এঁকে দিচ্ছে। মিথ্যে হাসির আড়ালে কান্নাটা আমি লুকিয়ে নিলাম। এর মাঝেই টের পেলাম আমার শ্বশুড় আব্বু ফোনে কারো সাথে চেঁচিয়ে কথা বলছে। কান দুটো খাঁড়া করে আমি শুনছিলাম শ্বশুড় আব্বু কার সাথে কথা বলছে। কথার আওয়াজ এক্টু এক্টু করে আমার কানে আসছিলো। বুঝতে পারছিলাম শ্বশুড় আব্বু হিমুর সাথে কথা বলছে। আব্বু চেঁচাচ্ছে আর বলছে,,

—“আমি এতোকিছু শুনতে চাই না হিমু। তুই এক্ষনি, এই মুহূর্তে হসপিটালে আসবি। রূপা তোকে দেখতে চাইছে।”

ঐ পাশ থেকে কি বলল জানি না। হয়তো হিমু মুখের উপর না করে দিয়েছে। জানেন, আমি মরে গেলে ও উনার কিছু আসবে যাবে না। আমি উনার নামে মাএ বৌ। উনি আমাকে কখনো বৌ হিসেবে বিন্দু পরিমান স্বীকৃতি ও দেয় নি। এতো অবহেলার কারণ আমার জানা নেই। উনার কোনো অতীত আছে কিনা তা ও আমার কাছে স্পষ্ট না! শুধু এটাই জানি, “আমি উনার কাছে নাথিং। খুব জানতে ইচ্ছে করছে, সত্যিই কি হিমুরা কখনো কারো হাত ধরে না? রূপা কি তবে আজীবনই একা রয়ে যাবে?”

বুকের ব্যাথাটা ক্রমশ বাড়ছিলো আমার। ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে করতে কখন যেনো আমার চোখ জোড়া লেগে গেলো ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না। ঘুমিয়ে পড়লাম আমি চোখ বুজে। সেই ঘুম ভাঙ্গল আমার আম্মুর চেঁচামেচিতে। এইবার চোখ খুলে আমি আমার দুপাশে আমার আম্মু, আব্বুকে দেখতে পেলাম। মেয়ের অসুস্থতার কথা শুনে কুমিল্লা থেকে ছুটে এসেছেন উনারা। দুজনেরই চোখ, মুখ মিইয়ে আছে। অবিশ্বাস্য ভাবেই উনাদের পাশে আমি হিমুকে দেখতে পেলাম। নেতানো শরীর নিয়ে উনি কেবিনের দরজায় ড্যাশ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি উনার নিচের দিকে। আমার দিকে এক্টাবার তাকানোর প্রয়োজন ও বোধ করছে না। আমার জ্ঞান ফিরতে দেখে আম্মু আমাকে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলো। এর মাঝেই কেবিনে দুজন নার্স চলে এলো। নার্স দুটো এসেই আম্মু, আব্বুকে জোর করে কেবিন থেকে বের করে দিলো। শুধু হিমু ছাড়া!

আমি অশ্রুসিক্ত চোখে হিমুর দিকে তাকিয়ে আছি। হিমুর নজর এতক্ষনে আমার দিকে পড়ল। শার্টের কলারে ঝুলে থাকা টাই টা টানতে টানতে উনি বেশ রাগী ভাব নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো। উনার এমন অহেতুক রাগের কারণ আমার জানা নেই। আমার দিকে তেড়ে এসেই উনি কর্কশ কন্ঠে বলে উঠল,,

—“গত রাতে বৃষ্টিতে ভেজার কি দরকার ছিলো রূপা?”

এই প্রথম উনার মুখে আমি আমার নামটা শুনলাম। এতোদিনে নিজের নামটাকে পূর্ণ মনে হচ্ছে! আমি মৃদ্যু হেসে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। আজকাল উনাকে দেখলেই খুব প্রেম প্রেম পায়! হঠাৎ উনি আবারো চেঁচিয়ে বলল,,,

—“তোমার কি মিনিয়াম আক্কেল, জ্ঞান টুকু ও নেই? খুব ভাল্লাগে আমাকে পাগলের মতো এভাবে তোমার পিছু পিছু ঘুড়াতে? তোমরা সবাই মিলে আমাকে পেয়েছ টা কি এক্টু বলবে?”

অক্সিজেন মাস্কের জন্য আমি কথা বলতে পারছি না। মুহূর্তের মধ্যেই উনাকে ভয় পেতে শুরু করলাম। খুব ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি। তবে আমি এটা বুঝতে পেরেছি কাল উনিই আমাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছিলো। হয়তো সেন্সলেস হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষন পরই। ভেজা অবস্থায় উনি আমাকে পেয়েছিলো। নয়তো উনি বুঝতেই পারত না গতকাল রাতে আমি বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম। উনি আবারো রাগে গজগজ করে আমার দিকে এক্টু ঝুঁকে মৃদ্যু আওয়াজে বলল,,,

—“এভাবে চুপ করে না থেকে আমাকে মুক্তি দাও রূপা প্লিজ। আমি তোমাদের সবার কাছ থেকে মুক্তি চাইছি। সংসার করার এই মিথ্যে অভিনয়টা আমি আর চালিয়ে যেতে পারছি না। তুমি চুপিসারে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। ডিভোর্সটা আমি তোমার তরফ থেকে চাইছি। আমি চাই না, আব্বু, আম্মু তোমার জন্য আমাকে ভুল বুঝুক। ডিভোর্সটা তুমি নিজ থেকে দিলে ওরা আমাকে ভুল বুঝার কোনো স্কোপ ই পাবে না।”

চেখের জল গুলোকে আর আটকাতে পারলাম না। বেসামাল হয়ে আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি। শ্বাস, প্রশ্বাস দ্বিগুন বেগে চলছে আমার। শরীরের প্রতিটা লোম দাঁড়িয়ে গেছে। বাকরুদ্ধ হয়ে আমি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। হুট করে উনি আমার মুখের অক্সিজেন মাস্কটা খুলে দিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,,,

–“আগামী এক মাসের মধ্যে আমি ডিভোর্স চাই রূপা। এই এক মাসে নিজেকে ম্যান্টালি প্রিপেয়ার করে নাও। এতক্ষণ আমি যা যা বলেছি এর এক্টা কথা ও যেনো আমাদের পরিবারের কেউ জানতে না পারে। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?”

অক্সিজেন মাস্কটা খোলার সাথে সাথেই আমার জান বের হয়ে আসছিলো। মনে হচ্ছে মৃত্যুকে আমি খুব কাছ থেকে দেখছি। আমি টলমল চোখে উনাকে ইশারা করে বলছিলাম মুখের মাস্ক টা লাগিয়ে দিতে কিন্তু উনি আমার ইশারা না বুঝেই আমার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,,

—“কথা দাও আগামী এক মাসের মধ্যেই তুমি আমাকে ডিভোর্স দিবে!”

শ্বাসকষ্টে উত্তেজিত হয়ে আমি যেই না কিছু বলতে যাবো অমনি একজন নার্স কিছু খাবার নিয়ে আমার কেবিনে ঢুকে পড়ল৷ হিমু চট জলদি মাস্ক টা আমার মুখে লাগিয়ে দিলো। আমি বড় বড় শ্বাস ফেলে হিমুর দিকে তাকিয়ে আছি৷ নার্স মৃদ্যু হেসে খাবারের ট্রে টা হিমুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,,,

–“ধরুন খাবারটা। অক্সিজেন মাস্কটা খুলে দেওয়ার কিছুক্ষন পরই খাবারটা আপনার ওয়াইফকে খাইয়ে দিবেন। এর আগে এক্টা ইনজেকশান পুশ করতে হবে উনাকে। আপনি এক্টু অপেক্ষা করুন।”

হিমু খাবার ট্রে টা হাতে নিয়ে জোর পূর্বক হাসি টেনে নার্সের দিকে তাকিয়ে বলল,,

—“আমার ওয়াইফ ঠিক হয়ে যাবে তো নার্স?”

নার্সটা হাতে এক্টা ইনজেকশান নিয়ে আমার বাম হাতে ইনজেকশানটা পুশ করছে আর বলছে,,,

—“ঠিক হয়ে যাবে। ইনজেকশানটা পুশ করলেই উনি ঠিক হয়ে যাবে৷ কালই উনাকে রিলিজ করে দেওয়া হবে। তবে আপনাকে কথা দিতে হবে যে, আপনার ওয়াইফকে আপনি টাইমলি ঔষধ খাওয়াবেন এবং খুব ভালো করে যত্ন নিবেন। নেক্সট টাইম যেনো উনার এমন খিঁচুনী না আসে।”

হিমু আবারো জোর পূর্বক হাসি টেনে বলল,,

—“তা আর বলতে৷ আমি অবশ্যই আমার ওয়াইফের যত্ন নিবো!”

লোকটা আসলেই বহুরূপী৷ গিরগিটির মতো রঙ্গ বদলাতে পারে। আমি আহত দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নার্স ইনজেকশানটা পুশ করে অক্সিজেন মাস্কটা খুলে দিলো। এবার আমার শ্বাস নিতে কোনো প্রবলেম হচ্ছে না। নার্স উনার কাজ সেরে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো। সাথে সাথেই হিমু খাবারের ট্রে টা কেবিনের পাশে রাখা ডেস্কের উপর সজোরে রাখল৷ বুকটা কেমন কেঁপে উঠল আমার। ভয়ে আমি চোখ জোড়া বুজে নিতেই উনি আমাকে টেনে হেছড়ে বেডের কর্ণারে ড্যাশ দিয়ে বসিয়ে দিলো। আমার এবার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু উনার জন্য ঠিক ভাবে কাঁদতে ও পারছি না। মুখে হাত চেঁপে আমি নিঃশব্দে কাঁদছি। উনার এই ভয়ংকর রূপ আমি দেখতে পারছি না। আচমকাই উনি আমার দু কাঁধ চেঁপে ধরে খুব রাগী স্বরে বলে উঠল,,

—“আমি তোমার কোনো সেবা যত্ন করতে পারব না। বুঝতে পেরেছ তুমি? খাবারটা তুমি নিজ দায়িত্বে খেয়ে নাও। আর আমাকে মুক্তি দাও। আমি তোমাদের সবার থেকে মুক্তি চাইছি। নিজের মতো করে এক্টু একা থাকতে চাইছি। প্লিজ তোমরা আমার এই স্বাধীনতাটা কেড়ে নিয়ো না!”

চোখ তুলে উনার দিকে তাকালাম আমি। এই প্রথম বার লোকটার চোখে আমি জল দেখতে পাচ্ছি। লোকটার চোখ দুটো জলে ছলছল করছে। মন বলছে উনি ভালো নেই। কোনো কারণে উনি খুব আপসেট হয়ে আছে। কারণটা আদৌ জানা নেই আমার। চোখ দেখে মনে হচ্ছে উনি যা বলছে প্রচন্ড জেদ থেকে বলছে। মন থেকে এক্টা কথা ও বলছে না। চোখে জল রেখেই আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,

—“কি হয়েছে আপনার হিমু? আপনি ঠিক আছেন তো?”

—“আমি ঠিক আছি। তবে তোমরা আমাকে ঠিক থাকতে দিচ্ছ না!”

—“আপনি কি বলতে চাইছেন হিমু? আমি আপনাকে ঠিক থাকতে দিচ্ছি না?”

—“হ্যাঁ ঠিক তাই। তুমি আমাকে ঠিক থাকতে দিচ্ছ না।”

—“কেনো বলুন তো? কি করেছি আমি হিমু? আমার দোষ টা কি হিমু?”

উনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে এক নিশ্বাসে বলে উঠল,,

—“আমাকে বিয়ে করা!”

চুপ হয়ে গেলাম আমি। প্রতি উত্তরে উনাকে কি বলব তাই আমার মস্তিষ্কে আসছে না। উনার থেকে চোখ সরিয়ে আমি কান্নাজড়িত কন্ঠে বললাম,,,

—“আপনি কি বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়েটা করেছেন?”

—“হ্যাঁ বাধ্য হয়ে করেছি।”

—“তাহলে সত্যিটা এতো মাস চেঁপে রেখেছেন কেনো? কেনো এর আগে আমাকে কিছু বলেন নি?”

–“আম্মু, আব্বুর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলি নি। পাঁচ মাস অনেক অভিনয় করেছি। এই পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে, এবার অন্তত আমার মনের কথা শোনা উচিত। নিজের মতো করে বাঁচা উচিত। সম্পর্কটাকে এখানেই শেষ করা উচিত।”

চোখের কোণে জমে থাকা জল গুলো মুছে আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,

—“এতো সহজ এক্টা সম্পর্ক শেষ করে দেওয়া?”

—“আমার তরফ থেকে সহজ। তুমি চাইলে হয়তো তোমার তরফ থেকে ও সহজ হয়ে যাবে। কারণ, এই সম্পর্কে আমরা কেউ সুখি থাকব না!”

আগ পাছ না ভেবে আমি হুট করেই বলে দিলাম,,,

—“ভালোবাসেন কাউকে?”

উনি এক ঝটকায় আমাকে ছেড়ে দিয়ে চোখে জল নিয়ে কেবিন থেকে বের হচ্ছে আর বলছে,,,

—“হ্যাঁ বাসি।”

নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। এক দৃষ্টিতে উনার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছি। উনি কেবিন থেকে বের হতেই আমি বেডের কার্ণিশে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে চোখের জল ছাড়তে লাগলাম। বেঁচে থাকার সকল আশা হারিয়ে ফেলেছি আমি। “যার সুখ নয় বছরে হয় না, তার সুখ নাকি নব্বই বছরে ও হয় না।” সমাজে প্রচলিত প্রবাদটা আমার জীবনের সাথে এতোটা মিলে যাবে কখনো ভাবতেই নি! দীর্ঘশ্বাস চওড়া হচ্ছে, সাথে পাল্লা দিয়ে কষ্টের পরিধি ও বাড়ছে। মনে জমিয়ে রাখা কষ্টগুলো কারো কাছে বন্টন করতে না পারার অসুখটা যেনো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এই পৃথিবী আমাকে কখনো বুঝে নি। না বুঝেছে পৃথিবীতে থাকা মানুষ গুলো।

এসব ভাবতেই মনে হলো কেউ আমার কেবিনে ঢুকেছে। কেবিনের দরজার দিকে তাকাতেই অবিশ্বাস্যভাবে হিমুকে দেখতে পেলাম। শো শো বেগে উনি কেবিনে ঢুকেই খাবারের ট্রে টা হাতে নিয়ে আমার পাশে বসে পড়ল। গোছানো চুল গুলো এলো মেলো হয়ে আছে উনার। চোখে, মুখে ক্লান্তি আর অস্থিরতার ছাপ স্পষ্ট৷ শুভ্র মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ফরমাল ড্রেসে ও উনাকে কেমন জনাজীর্ণ লাগছে। ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। কান্নাকাটির এক পর্যায়ে এসে চোখ গুলো খুব জ্বালা করছে আমার। তাই ঠিক ভাবে উনার দিকে তাকাতে পারছি না। খোঁপা করে রাখা চুল গুলো ও বার বার চোখে, মুখে এসে ঠেকছে। খোঁপা থেকে ওরা মুক্ত হতে চাইছে। হিমু আমার দিকে না তাকিয়েই খাবারের প্লেইট থেকে পাউরুটির পিস টা হাতে নিয়ে আমার মুখে পুড়ে দিলো। আমি পাউরুটি মুখে নিয়ে সামনে আসা চুল গুলো বার বার হাত দিয়ে সরাচ্ছি আর অবাক দৃষ্টিতে নয়নে উনাকে দেখছি। আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। উনি এভাবে ফিরে এসে হুট করে আমাকে খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে তা আমি আদৌ ভাবি নি। লোকটাকে বুঝা খুব দায়। মনে হয় না, এই জন্মে উনাকে আমি বুঝতে পারব!

উনি একবার শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলল,,,

–“এক্টু আগে যা যা হলো তার জন্য আ’ম স্যরি। অসুস্থ অবস্থায় তোমাকে এভাবে টর্চার করা আমার ঠিক হয় নি। তুমি সুস্থ হলে ডিভোর্সের ব্যাপারটা নিয়ে আমরা কথা হবে। ওকে?”

আমি জোরপূর্বক হাসি টেনে উনার দু চোখে তাকালাম। ডিভোর্সের ব্যাপারটা উনি এখনো ভুলতে পারছে না। আমার এখনো মনে হচ্ছে আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি। এক্টু পর হয়তো স্বপ্ন টা ভেঙ্গে যাবে। আবারো সব আগের মতো নরমাল হয়ে যাবে। উনি হঠাৎ বসা থেকে উঠে বেডের পেছনটায় গিয়ে পেছন থেকে আমার চুল গুলো খোঁপা করার চেষ্টা করছে আর বলছে,,,

—“খাবারটা এবার তুমি খেয়ে নাও। আমি তোমার চুলটা বেঁধে দিচ্ছি।”

#চলবে,,,,,?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here