তুমি আমার
পর্বঃ ০৭
লেখকঃ আদ্রিয়ান নাজমুল
আমিঃ আমারও তাই মনে হচ্ছে। হাহা।
নাতাশা ইশার আর আমার কথা শুনে বেশ লজ্জা পায়। তারপর আমরা সারাদিন অনেক মজা করি। নাগরদোলায় উঠি। নাতাশা ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ছিল। ইশা আর নাতাশা আজ অনেক মজা করে। এরপর আমরা সবাই বাসায় ফিরে আসি। আসার সময় মায়ের জন্য শাড়ী, বাবার আর নাতাশার বাবার জন্য পাঞ্জাবি লুঙ্গি কিনে আনি। এছাড়া হরেকরকমের মিষ্টি আর খাবার কিনে আনি।
রাত ৯.৫০ মিনিট,
সবার খাওয়া দাওয়া শেষ। আমি আর বাবা কথা বলছিলাম। এর মধ্যে নাতাশার বাবা এসে পরে।
বাবাঃ বসেন ভাই।
নাতাশার বাবাঃ ভাইজান সবাইকে যদি একটু ডাক দিতেন তাহলে কথাটা বলতাম।
বাবাঃ ও হ্যাঁ হ্যাঁ। নাজমুল সবাইকে ডেকে নিয়ে আয়তো বাবা।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। হঠাৎ কি হলো। আমি ভিতরে গিয়ে মা, নাতাশা আর ইশাকে ডেকে নিয়ে আসলাম।
মাঃ কি ভাইজান ডাকেছেন নাকি??
নাতাশার বাবাঃ জি ভাবি। ভাই কথাটা তাহলে বলি কি বলেন??
বাবাঃ জি বলেন।
নাতাশার বাবাঃ নাতাশা মা এদিকে আয়।
নাতাশা চমকে যায়। আস্তে করে ওর বাবার কাছে গিয়ে বসে। নাতাশার আর আমার হৃদস্পন্দন ক্রমশ বেড়েই চলছে। বুঝতে পারছি না কি হতে চলছে।
নাতাশার বাবাঃ ভাবি, কয়েকদিন আগে যে ওপাড়ে গেলাম না..
মাঃ জি ভাই।
নাতাশার বাবাঃ সেখানে নাতাশার জন্য একটা ছেলে দেখে আসছি। খুব ভালো আর বড় পরিবারের। আমি আর ভাইজান এতোদিন সেই ছেলের যাবতীয় সব খবর নিচ্ছিলাম। ছেলেটা খুব ভালো আর ভদ্র। ওপাড়ে ভালো ব্যবসা করে। ভালো নামও আছে তার। নাতাশার ছবিও দেখিয়েছি। তারা ওকে পছন্দও করেছে। বলেছে কাল ওকে দেখতে আসবে।
নাতাশার বাবার কথা শুনে সেখানে উপস্থিত তিনটি মানুষ স্তব্ধ হয়ে যাই। আমি, নাতাশা আর ইশা। আমি পাথর হয়ে গিয়েছি। ইশা ছটফট করছে। আর নাতাশার মুখখানা নিমিষেই মলিন হয়ে গিয়েছে। যেন রাতের সব আঁধার ওর মুখে নেমে এসেছে।
আমার হৃদয়ে এখন আগুন জ্বলছে। হাত-পা সব অসর হয়ে আসছে৷ কোনো কিছুই ভাবতে পারছি না।
বাবাঃ বুঝলে নাজমুলের মা ছেলেটা কিন্তু আসলেই ভালো। আমি নিজে খবর নিয়েছি। নাতাশা ভালো থাকবে সেখানে।
মাঃ আমাকে তো তুমি কিছু বললেই না। এতো কিছু করলে কখন??
বাবাঃ আরে এসব কথা বলতে নাই। পাঁচ কান হলে সমস্যা।
মাঃ আমি এতো কিছু বুঝিনা। আমার নাতাশা মা যেখানে খুশী থাকবে আমিও সেখানে খুশী।
নাতাশার বাবাঃ জি ভাবি। কাল যদি তাদের পছন্দ হয় তাহলে একেবারে আংটি পরিয়ে যাবে। আমার মা মরা মেয়েটা এবার সংসার করবে। মা তুই অনেক সুখে থাকবি দেখিস৷
নাতাশার চোখ অশ্রুতে ভরে গিয়েছে। আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এতোগুলো বড় মানুষের সামনে বেয়াদবি করার সাহস আমার নেই। কারণ নাতাশার বাবা ওই ছেলেটাকে পছন্দ করেছে। আমি নিজেকে আর সামলে রাখতে পারছিনা। তাই,
আমিঃ বাবা আমি একটু আসছি। ফোনটা বাজছে মনে হয়।
বাবাঃ আচ্ছা।
মাঃ ইশা, নাতাশাকে নিয়ে ভিতরে যা। আমরা বড়রা কথা বলি।
ইশাঃ জি মা। আপু চলো।
নাতাশা ইশার সাথে ওর রুমে চলে আসে। এসেই ইশাকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না। ইশাও নাতাশাকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্না করছে। কিন্তু নিশ্চুপ ভাবে।
ইশাঃ আপু আমি বাবাকে বলে আসি তুমি ভাইয়াকে ভালোবাসো। তুমি শুধু ভাইয়াকেই বিয়ে করবে।
নাতাশাঃ না ইশা। আমাদের সম্পর্ক ওনারা কখনো মেনে নিবে না। কখনো না।
ইশাঃ আপু…
নাতাশা আর ইশা কান্না করছে। অন্যদিকে আমি সেই পুকুর পাড়ে পাকাতে গিয়ে বসে কান্নায় ভেঙে পরি। ভাবতেই পারি নি এমন কিছু হয়ে যাবে। সবটা কেমন জানি ধোঁয়া ধোঁয়া লাগছে। চোখের সামনে অন্ধকার দেখছি। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। আমার নাতাশাকে আমি পাবো না?? ও অন্যকারো হয়ে যাবে?? এইতো সেদিন আমরা এক হলাম। আজ এতো তাড়াতাড়ি সব শেষ হয়ে যাবে। আমি যে বাবাকে কিছু বলবো তাও পারছি না। কারণ আমার এখনো পড়া শেষ হয়নি আর চাকরীও পাইনি। আমার এখন কোনো যোগ্যতা নেই। আর বাবাও হয়তো চায় না আমাদের বিয়ে হোক। নাহলে সে আমার সাথেই ওকে বিয়ে দিত। এখন কি করবো আমি?? নাতাশাকে কি হারিয়ে ফেলবো?? এখানেই কি সব শেষ??
পরের দিন,
সকাল থেকেই খুব জোরালো ভাবে ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা শুরু করে সবাই। বাবা আর নাতাশার বাবা দুজনেই সেই সকাল বেলায় বাজার করতে বের হয়ে গিয়েছেন। আমি আমার রুমে বুক ভরা কষ্ট নিয়ে শুয়ে আছি। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। নাতাশা মলিন মুখ নিয়ে মায়ের সাথে কাজ করছে সাথে ইশাও৷
মাঃ কিরে তোদের দুজনের মুখ এমন ফ্যাকাসে হয়ে আছে কেন??
ইশাঃ কই না তো।
মাঃ নাতাশাকে তো আগের মতো মনে হচ্ছে না। কেমন মলিন হয়ে আছে ওর মুখখানা।
নাতাশাঃ না খালা অমন কিছু না। (আস্তে করে।)
মা নাতাশার কাছে গিয়ে বলে,
মাঃ শ্বশুর বাড়ি যাবি বলে বুঝি এই অবস্থা?? শোন, তোর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা অনেক ভালো বুঝলি। তোকে সবসময় মাথায় করে রাখবে। তুই একটুও কষ্ট পাবিনা।
নাতাশাঃ স্বপ্নে যে শ্বাশুড়িকে চেয়ে ছিলাম সে শুধু স্বপ্নই রয়ে গেল। এরকম মায়ের মতো শ্বাশুড়ি কখনোই পাবো না। (মনে মনে।)
মাঃ কিরে তোর চোখে পানি কেন মা??
ইশা পাশ থেকে আনমনে কাজ করতে করতে বলে, আমাদের ছেড়ে চলে যাবে যে তাই।
মাঃ ধুর বোকা। মেয়েদের সবসময় বাপেরবাড়ি ছেড়ে যেতেই হয়। কান্না করিস না। তুই সুখে থাকবি দেখিস।
নাতাশা মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। মাও সাথে কেঁদে দেয়। ইশাতো মনে মনে গতকাল থেকেই কাঁদছে।
মাঃ হয়েছে অার কাঁদিস নাহ। তোরা কাজ কর। দেখি নাজমুল কি করে। আজ ওকে দেখছি না যে।
মা আমার রুমে এসে দেখে আমি বিছানায় পরে আছি।
মাঃ কিরে নাজমুল, তোর আবার কি হয়েছে?? এই সকালে বিছানায় পরে আছিস কেন?? শরীর খারাপ বাবা??
আমিঃ শরীর আর কি খারাপ হবে মা। মনটাই তো শেষ। (মনে মনে)
মাঃ কিরে উঠ। আমাদের কাজে সাহায্য কর। আজ না নাতাশাকে দেখতে আসবে।
আমি অন্যদিকে ফিরেছিলাম। সেভাবেই বললাম,
আমিঃ আসলে আসুক। আমার কি!! আমি কিছু করতে পারবো না। ভালো লাগছে না যাও।
মাঃ ধুর তোর যে আবার কি হলো। এখন সব আমারই করতে হবে। থাক শুয়ে।
মা চলে গেল। আমি সেভাবেই বিছানায় পরে রইলাম। খুব কষ্ট হচ্ছে৷ কিছুই করতে পারছিনা। হয়তো আমি বাবা-মার সাথে খারাপ ব্যবহার করে বলতে পারি, আমি নাতাশাকে ভালোবাসি। কিন্তু এতে করে দুই পরিবারেরই ক্ষতি হবে। ঝগড়া মারামারি এসব কিছুই কোনো সমস্যার সমাধান না। বড়দের উপর কখনো কথা বলতে নাই। কিন্তু খুব ইচ্ছে হচ্ছে সবাইকে গিয়ে বলে দেই আমি নাতাশাকে ভালোবাসি। ও শুধু আমার। কিন্তু আমার পরিবারই হয়তো চায়না আমাদের বিয়ে হোক। নাহলে কেন এই অন্য পাড়ার ছেলেকে আনতে হবে৷ খুব অসহায় হয়ে পরেছি। মনটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে৷ এসব ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পরি। ঘুমতো আসবেই, চোখের আশপাশটা ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছে। অশ্রুগুলোও এখন শুকিয়ে গিয়েছে।
ঘুম ভাঙে দুপুরে। ঘুম ভাঙতেই নাকে ভেসে আসে মুখরোচক খাবারের ঘ্রাণ। আস্তে করে উঠে বসি। নিজের কি বেহাল অবস্থা হয়েছে একবার দেখে নি। এরপর জামা কাপড় নিয়ে গোসল করতে চলে যাই। নাতাশার সামনেও আর যেতে চাই না। ওর মুখোমুখি হওয়ার সাহস আমার নেই। ভালোবাসাগুলো বুঝি এভাবেই মাটি চাপা পরে আজ বুঝতে পারছি। নাতাশা হয়তো আমার ভাগ্যে নাই।
খাবার টেবিলে মাথা নিচু করে খাচ্ছি। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি নাতাশা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ওর দিকে তাকানোর শক্তি আমি পাচ্ছি না। হঠাৎ বাবা গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
বাবাঃ বিকেলে আমার সাথে থাকিস।
আমি বুক ভরা কষ্ট নিয়ে বলি,
আমিঃ জি বাবা।
নাতাশার বাবাঃ ভাইজান মেয়েটা আমার সুখেই থাকবে। আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। অনেক কিছু করলেন আমার মেয়েটার জন্য। সত্যিই আপনাদের মতো ভালো আর কেউ হয় না।
মাঃ কি যে বলেন ভাইজান, নাতাশা আমাদের মেয়েরই মতো। আর ও সবসময় আমাদের মেয়ের মতোই থাকবে।
নাতাশার বাবাঃ যাক। মেয়েটাকে এত্তো ভালো পরিবারে বিয়ে দিতে পারবো ভেবেই খুব আনন্দ হচ্ছে৷ আজ ওর মা থাকলে খুব খুশী হত।
আমি আড় চোখে দেখলাম নাতাশার চোখের কোণায় অশ্রুতে ভরে গিয়েছে। খুব মলিন লাগছে ওকে। সারারাত কেঁদেছে। চোখ দেখলেই বুঝা যায়। এরপর আমরা সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে ফেলি। আমি খেয়ে চুপচাপ আমার রুমে চলে যাই। সিদ্ধান্ত নিয়েছি কালই চলে যাবো ঢাকাতে। কিছু মধুর স্মৃতি নিয়ে শূন্য হৃদয়ে ফিরতে হবে সেই যান্ত্রিক শহরে। হয়তো এটাই কপালে ছিল।
ইশাঃ ভাইয়া…ভাইয়া।
আমি কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম টেরই পাইনি। আমি আস্তে করে চোখ মেলে তাকাই।
আমিঃ কি??
ইশাঃ বাবা ৫ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নিচে ডাকছে। মেহমান আসবে।
আমি একলাফে উঠে বসি। শরীর কাঁপছে। চিন্তায় কপালে ঘাম এসে গেছে। নাতাশাকে এভাবে চোখের সামনে হারিয়ে ফেলবো কখনোই ভাবিনি।
ইশাঃ ভাইয়া কিছু কর না। নাতাশা আপুকে ছাড়া থাকতে পারবো না। (অসহায় ভাবে।)
আমিঃ ভাগ্যে নাই রে বোন আমার। বাস্তবতা গুলো এমনই কঠিন হয়ে থাকে। মেনে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। তুই যা আমি আসছি।
বিকেল ৫.৩৫ মিনিট,
আমি একটা পাঞ্জাবি পরে রুম থেকে বের হই। ড্রইং রুমে গিয়ে দেখি খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে রুমটা। আমার বাবা-মা আর নাতাশার বাবা হঠাৎ করে বললো…….
চলবে……….. [ ইনশাআল্লাহ ]