#তিনি_আমার_সৎমা

পর্বঃ৩

আমি আড়চোখে বাবার দিকে তাকালাম। তার চোখমুখ রাগে টকটকে লাল হয়ে আছে। ঠিক কি কারণে রাগ করছে আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারছি। আমার এইরকম লুকের জন্য তিনি মনে হয় রীতিমতো লজ্জা পাচ্ছে এই লোকটার সামনে। আমি বাবার ওই রাগী চোখ উপেক্ষা করে অন্যদিকে তাকালাম। এই রাগী চোখের ভয় দেখিয়ে দিনের পর দিন আমার মা কে দিয়ে তার কার্যসিদ্ধি করিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু আর না! এভাবে চুপ করে থাকলে উনি এবার আমাকে পেয়ে বসবেন। আমি আর ভয় পাবো না এই লোকটাকে। এক অজানা সাহস আমার মধ্যে ভর করেছে। তবে কি আমি ওই ভদ্রমহিলাকেই ভরসা করতে শুরু করেছি?
বাবা থমথমে গলায় বললো,”তোমার এই চেহারা কেনো?”
আমি নির্বিকার হয়ে উনার চোখে চোখ রেখে বললাম,”আমার চেহারা এমনই খারাপ বাবা। কি করবো আমি? মায়ের মতো সুন্দরী আমি নই, যে আমাকে দিয়ে যা খুশি তাই করাবে তুমি।”
শেষের কথাটা একটু জোরের সাথেই বললাম আমি। বাবা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। মনে হয় ভাবতেই পারছে না আমি তার মুখের উপর এভাবে বলতে পারি।
আবারও ভারী কণ্ঠে বাবা বললো,”চুলে এমন বিশ্রী করে তেল দিয়েছো কেনো? আর এসব কি জামা পরেছো? তোমাকে দামী জামাকাপড় আমি কিনে দিই না?”
হ্যা এটা ঠিক। বুঝ হওয়ার পর থেকে দেখেছি বাবা নামের এই লোকটা আমাদের সমস্ত চাহিদা না চাইতেই পূরণ করেছে। হয়তো তার উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্যই।
“মাথা যন্ত্রণা করছিলো, তাই তেল দিয়েছি চুলে। আর এই জামা আমার এখন পরতে ভালো লাগছে তাই পরেছি। বাড়িতে এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কেউ আসেনি যে তার জন্য আমার এখন বেনারসী কাতান পরে আসতে হবে।”
বাবা চোখ গোল গোল করে আমার দিকে তাকালো। আমি তখনও নির্বিকার। এতোক্ষণ ওই লোকটার দিকে আমার চোখ পড়েনি। উনি বেশ আগ্রহের সাথে এতোক্ষণ বাবা মেয়ের ঝগড়া দেখছিলো। কিন্তু আমার শেষ কথাটায় মনে হয় একটু অপমানিত হলেন উনি। দুইবার খুক খুক করে শুকনো কাশি দিলেন শুধু।
বাবা অগ্নিচক্ষু দিয়ে আমার দিকে একবার তাকালো এরপর ওই লোকটার দিকে তাকিয়ে বললো,”ইয়ে মানে হাশেম ভাই, আপনি কিছু মনে করবেন না। আমি বুঝতে পারছি না ও আজ কেনো এমন করে কথা বলছে। ও তো এভাবে কথা বলে না। নীরা, হাশেম আঙ্কেলের কাছে ক্ষমা চাও এক্ষুনি।”
আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম,”আমি কোনো অন্যায় কথা বলিনি যে তার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। কি বলার আছে তোমার তাড়াতাড়ি বলো, আমাকে পড়তে বসতে হবে।”
“নীরা।” বাবার চিৎকারে একটু কেঁপে উঠলাম আমি। কিন্তু তবুও একদম অনড় দাঁড়িয়ে থাকলাম।
বাবা আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওই লোকটা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো,”আরে আরে আফজাল, কি করছো? এতো বড় মেয়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? এসো আঙ্কেল তুমি আমার কাছে এসে বসো।”
আমি অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালাম উনার দিকে, উনি কিছুটা দমে গেলেন।
“ওর মায়েরও এমন তেজ ছিলো শুরুতে। তেজ কীভাবে কমাতে হয় আমার ভালো করে জানা আছে।” বাবার গলায় রাগ, আমি নিশ্চুপ।
“কি যে বলো আফজাল। নীরা ওর মায়ের মতো ভুল করবে না। ও বুদ্ধিমতী মেয়ে। ও খুব ভালো করে জানবে ওর জন্য কি ভালো হবে কি ভালো হবে না। তাই না নীরা?”
আমি মুচকি হাসলাম,”জ্বি ঠিক বলেছেন হাশেম আঙ্কেল। আমি খুব ভালো করে জানি কোনটা আমার জন্য ভালো হবে আর কোনটা হবে না।”
তেলতেলে একটা হাসি দিলো লোকটা। দেখে গা জ্বলে গেলো আমার। তবুও যথেষ্ট শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি।
হঠাৎ করে লোকটা আমার পাশে এসে আমার হাতটা ধরলো। আমি যেনো হাজার ভোল্টের শক খেলাম। হতভম্ব হয়ে গেলাম লোকটার সাহস দেখে। আমার বাবার সামনে একটা পরপুরুষ আমার হাত ধরলো? আমি এক ঝটকায় বাবার দিকে তাকালাম। বাবা না দেখার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আমার চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইলো। কিন্তু না, এখন কান্নাকাটি করা যাবে না। নিজেকে দূর্বল করে ফেললে এই মানুষরূপী পশুগুলো আরো পেয়ে বসবে আমাকে।
আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছি, আর হাশেম নামের লোকটা মনে হলো বেশ মজা পাচ্ছে আমার এই ব্যবহারে।
“কি হচ্ছে কি? আপনি আমার হাত ধরলেন কেনো? আর বাবা? তুমি কিছু বলছো না কেনো? একটা পরপুরুষ কীভাবে তোমার সামনে আমার হাত ধরতে পারে? সেই সাহস সে পায় কীভাবে? উনাকে বলো আমার হাত ছাড়তে।”
বাবা একটু আমতা আমতা করতে থাকে। মিনমিন করে বলে,”ইয়ে মানে হাশেম ভাই, বলছিলাম যে ওর বয়সটা তো বেশি না। সামনে ওর পরীক্ষা। এখন এসব থাক।”
“আরে আফজাল, আমি তো ওর আঙ্কেল। তুমি এতোসব ভেবো না তো। ওর হাতটা একদম ওর মায়ের মতো ফর্সা আর কি নরম। ধরতেই খুব ভালো লাগছে।”
আমি অবাক হয়ে শুধু আমার বাবাকে দেখছি। কীভাবে সে এমন নরমসুরে কথা বলছে?
“দেখুন, আপনি কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছেন। এক্ষুনি আমার হাত ছাড়ুন। নাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।”
“আরেহ আফজাল, মেয়ের দেখি তার মায়ের সবকিছুই পেয়েছে। মায়ের মতো তেজ। বেশ বেশ, যে মেয়ের তেজ বেশী আমার কিন্তু বেশ ভালো লাগে।”
আমি আরো বেশ কয়েকবার নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। শেষের দিকে লোকটা আমার হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরলো, আর মুখে একটা পিশাচের মতো বিশ্রী হাসি। আমি আর থাকতে পারলাম না। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে উনার মুখে থুতু ছুঁড়ে মারলাম।

ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব ওরা দুইজন। আর আমি কাঁপছি থরথর করে। আমার ভিতরের নিয়ন্ত্রণহীন রাগটা হু হু করে বাড়ছে আবার। আমার চোখ জ্বলছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগলাম আমি।
কোথা থেকে যেনো ছুটে এলেন সেই ভদ্রমহিলা। আমাকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরলেন। আমার কম্পন ধারণ করলেন নিজের মধ্যে। আমি শান্ত হতে চাইলাম, কোনোভাবেই পারলাম না।
বাবা যেনো কথা বলতে ভুলে গিয়েছেন। আর ওই অসভ্যটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। চোখে আগুন ঝরছে তার।
“নীরা, কি করলে কি তুমি এটা? তোমার মা পর্যন্ত সাহস করেনি কখনো এই কাজের। তোমার এতো সাহস কীভাবে হয়? এক্ষুনি ক্ষমা চাও হাশেম আঙ্কেলের পা ধরে।”
“নীরা কোনো অন্যায় করেনি যে ক্ষমা চাইবে। ওই লোকটাই নীরার সাথে অসভ্যতা করার চেষ্টা করেছে ও শুধু নিজেকে বাঁচিয়েছে, আর কিছু না। ক্ষমা চাইতে হলে উনি চাইবে নীরার কাছে।”
আমি অবাক হয়ে ভদ্রমহিলার দিকে তাকালাম। কেনো জানি বড্ড মা কে মনে পড়ছে আজ উনার দিকে তাকিয়ে। যদিও মায়ের সাথে উনার কোনো মিল নেই। আমার মা ছিলেন ভূবনভোলানো সুন্দরী, যে সৌন্দর্যই হয়েছিলো তার কাল।
“রুনা, তুমি এতোক্ষণ আড়ি পেতেছিলে? দুইদিন আসতে পারলে না এতো সাহস কে দিয়েছে তোমাকে? এখন আবার ওকে উস্কে দিচ্ছো। ছাড়ো ওকে, ওর ক্ষমা চাইতেই হবে হাশেম ভাইয়ের কাছে।”
“থাক আফজাল, এখন আর ক্ষমা চাওয়ার কোনো দরকার নেই। তোমার মেয়েকে বলবে, তেজ থাকা ভালো। তাই বলে এতোটা নয়। এর শেষ আমি দেখে ছাড়বো, আবার আসবো আমি। আর তোমার মেয়ে সোজা না হলে তোমার অবস্থা কি হবে এটাও ভালো করে জানো তুমি। খুব তাড়াতাড়ি আবার আসবো আমি। হাশেমকে রাগানোর ফল তোমাদের পেতে হবে।”
এই বলে ধুপধাপ করে পা ফেলে অসভ্যটা বেরিয়ে গেলো, বাবা ছুটলো আর পিছু পিছু।
আমি আর থাকতে পারলাম না। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়লাম আমি। আমার সৎমাও মাটিতে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
হঠাৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি। উনিও উঠে দাঁড়ালেন আমার সাথে।
“কি ব্যাপার নীরা? কোথায় যাচ্ছো?”
“দাদীর কাছে।”
“নীরা, সব কথা পরে হবে। তোমার শরীরটা এখন ভালো না। শরীর বেশ গরম, মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। এখন তোমার ঘরে চলো, রেস্ট নিবে। বাকি সব কথা পরে হবে।”
“আমাকে আটকাবেন না। উনার কাছে আমার আজ শোনার আছে, কীভাবে আমার বাবা নিজের রক্তের সাথে এমন করতে পারে? নিজের মেয়েকে একটা জানো*য়ারের হাতে তুলে দিতে পারে? আজ আমাকে শুনতেই হবে।”
“নীরা, এসব পরে জানবে, এখন আমার সাথে ঘরে চলো।”
আমি উনার কোনো কথা শুনলাম না। উনার হাত থেকে নিজেকে দ্রুত ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটলাম দাদীর ঘরের দিকে। উনি না পেরে আমার পিছু পিছু আমাকে ডাকতে ডাকতে ছুটতে লাগলেন।

দাদী ঘর অন্ধকার করে রনিকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিলেন। আমি যেয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। দেখলাম দাদীর চোখ লাল, নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করেছেন।
“দাদী, তোমার সাথে আমার কথা আছে।”
“তোর শরীরটা ভালো না নীরা। ঘরে যেয়ে বিশ্রাম নে।”
“না, আজ আমার কিছু প্রশ্ন আছে তোমার কাছে, যার উত্তর না নিয়ে আমি এই ঘর থেকে কোথাও যাবো না।”
দাদী রনির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন,”যাও তো দাদুভাই, অন্যঘরে যেয়ে খেলা করো।”
রনি একবার আমার দিকে তাকালো, কি বুঝলো কে জানে, খাট থেকে আস্তে করে নেমে চলে গেলো অন্যঘরে।
এবার দাদী নির্লিপ্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,”বল কি জানতে চাস। আজ হোক কাল হোক, তুই যে আমার কাছে এসে প্রশ্ন করবি আমি খুব ভালো করেই জানতাম। মনে হচ্ছে সেই দিন চলে এসেছে।”
ততক্ষণে উনি এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমার হাতটা চেপে ধরলেন শক্ত করে।
“মা একটা কথা বলবো আমি? ও এখনো অনেক ছোট, সামনে ওর পরীক্ষা। তাছাড়া ওর শরীরটাও ভালো না। এমন কিছু ওকে জানাবেন না, যা জেনে ওর মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়ে যায় আর নিজের সত্ত্বাকেই ভুলে যায়।”
আমি অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম উনার দিকে। মাত্র কয়দিন এসে উনি আমার ব্যাপারে কি এমন জানেন যা আমি জানিনা? কে জানিয়েছে উনাকে?
“কি ব্যাপার? কি এমন কথা? আমাকে বলতেই হবে তোমাদের।”
“না বউমা, ওকে জানতে দাও। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে ওকে একা চলতে হবে, নিজেকে শক্ত করুক। ওর জীবন বাকি দশটা মেয়ের মতো সরল নয়, এটা ও বুঝুক। এতোদিন ওর মা ছিলো বুঝতে হয়নি। এখন বুঝতে হবে।”
“আমি কি ওর মা নই, মা?আমি কি ওকে আগলে রাখতে পারবো না?”
দাদী একটু হাসলেন, সেই হাসিতে বিষাদ। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না কি নিয়ে কথা বলছেন উনারা।
“বল বোন, কি জানতে চাস তুই?”
“বাবা কীভাবে পারলো দাদী? নিজের মেয়েকে, নিজের রক্তকে একটা পরপুরুষের হাতে তুলে দিতে? নিজের মেয়ের সম্মান এভাবে কোনো বাবা শেষ করে দিতে চায়? আমার মা এতোদিন সব সহ্য করেছে, তাই বলে আমাকেও? কেনো দাদী?”
দাদী অনেকক্ষণ শুণ্যের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকলেন। আমি অসহিষ্ণু হয়ে একবার দাদীর দিকে আর একবার ওই ভদ্রমহিলার দিকে তাকালাম। এরপর দাদী ভাসা ভাসা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,”নিজের রক্ত না বলেই তোর বাবা পেরেছে রে বোন।”

(চলবে….)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here