#তাহার_আগমন
পর্ব:০৩
সানাউল মির্জা কুলছুমের বাড়ির খোঁজে বেরিয়েছেন।ছদ্মবেশে হাঁটছেন তিনি।উনার ছদ্মবেশে হাঁটতে ভালো লাগে।বিভিন্ন চরিত্রে খুব সহজেই অভিনয় করা যায়।এখন অভিনয় করছেন বৃদ্ধের চরিত্রে।বয়সের ভারে খুব একটা হাঁটাচলা করতে পারেন না।পাশের গ্রামেই উনার বাড়ি।অবসরপ্রাপ্ত স্কুলের শিক্ষক।কাজের জন্য একটি মেয়ে দরকার।সে জন্য কুলছুমকে খোঁজা।গ্রামের মানুষজনও কুলছুমের নাম বলতেই মুখ খিঁচিয়ে বলে,মা মরা মেয়ে রেখে বিয়ে করছে যে হারামজাদা সেলিম মিয়া?তারপর আফসোস করে বলে,”ঠিকমতো মেয়েটাকে খেতেও দেয়না।শুনলাম,শহরের এক সাহেবরা নিয়ে গেছে।তবুও কুলছুমের খোঁজে যখন আসছেন ভালোই হয়েছে।ওইযে তালগাছ দেখা যাচ্ছে,এর সামনে গেলে পশ্চিমে একটা রাস্তা গেছে।ওই রাস্তা দিয়ে একটু সামনে গেলে পূর্বের আমগাছের বাড়িই কুলছুমের বাবার।”
সানাউল মির্জা তাদের সালাম জানিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করেন।এই ব্যাপারে তিনি খুব সাবধান।গ্রামে একটা কথা রটে গেলে সেটা পাশের গ্রামে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনা।তিনি নিশ্চিত হতে চান,সত্যিই কি কুলছুম নিঁখোজ হয়ে গেছে?নাকি রেহানার ভয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়িতে চলে এসেছে?যদি সত্যিই তাই হয়ে থাকে তবে কুলছুমের থেকে কিছু জানতে পারবেন তিনি।গ্রামের মানুষদের দেখানো পথ ধরে পশ্চিমের রাস্তায় ঢুকে পড়লেন।জমিতে কাজে ব্যস্ত থাকা অনেক লোক কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে।গেরস্ত বাড়ির কেউ কেউ শুকনো নারিকেল পাতার পর্দার আড়ালে উঁকি দিয়ে দেখছে।বড় একটা আমগাছের সামনে আসতেই থেমে গেলেন সানাউল মির্জা।আমগাছ দিয়ে ঘেরা বাড়ির কথাই বলেছিল।সানাউল মির্জা একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,বাড়িতে কেউ আছেন?
কিছুক্ষণ পর লুঙ্গি পরিহিত একজন লোক বেরিয়ে এসে বলল,আপনাকে তো চিনতে পারলাম না।গ্রামের লোক বলে তো মনে হয়না।তা কি দরকার?
সানাউল মির্জা বললেন,আমি পাশের গ্রামের বাসিন্দা।অবসরপ্রাপ্ত স্কুলের শিক্ষক।একটা দরকারে আপনার বাড়িতে আসা।
লোকটি এবার বেশ হুলস্তুল হয়ে বললেন,ভেতরে আসেন,স্যার।আমি কিনা আপনাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখলাম!
সানাউল মির্জাকে ঘরের ভেতরে চেয়ারে বসতে দেয়া হলো।পর্দার আড়ালে ছোট্ট একটি মুখ উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আছে।লুঙ্গি পরিহিত লোকটি এবার হেসে বলল,তা কি মনে করে এই গরীবের বাড়িতে?
-আমি বৃদ্ধ মানুষ।হাঁটতে-চলতে খুব কষ্ট হয়।বাড়িতে আবার কেউ নেই।মাসখানেক আগে স্কুল থেকে অবসর নেয়া হয়েছে।এখন আমার দেখাশোনার জন্য একটি মেয়ে দরকার।শুনেছি,আপনার একটি মেয়ে আছে কুলছুম নামে।এতদিন সে শহরে ছিল।আট-দশদিন আগে বাড়িতে ফিরেছে।আমি কুলছুমকে নিয়ে যাবো সঙ্গে করে,শেষের কথাটা আন্দাজে ঢিঁল মারার মতো বললেন সানাউল মির্জা।কুলছুম এখানে চলে এসেছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে।
লোকটি মুখ উল্টিয়ে বলল,বেয়াদব মেয়ে।কোনো কথাই শুনে না।এদিকে তো আসে নাই।খোঁজ নিয়ে দেখেন,কোথাও পালাই গেছে।আমার বাড়ির সামনে পা রাখলে কপালে দুঃখ আছে কুলছুমের।আরও কিছুক্ষণ নিজের মেয়ের নামে গালাগালি করে চুপ করলো লোকটি।
সানাউল মির্জা আর কথা বাড়ালেন না।তাহলে কুলছুম এদিকে আসেনি।সত্যিই নিঁখোজ হয়ে গেছে।তাহলে কি রেহানার হাতে শিকার হয়েছে?তিনি লোকটিকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে আসলেন।রাস্তায় কিছুদূর যেতেই হঠাৎ একটি ছোট্ট মেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে তার পথ আগলে দাঁড়ালো।সানাউল মির্জা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন,তুমি কে?আমার সামনে এসে দাঁড়ালে যে,মা?
মেয়েটি বেশ বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,আমার নাম লতা।আমি কুলছুম আপার খবর দিতে পারি।আসেন আমার সাথে।
ছোট্ট মেয়ে লতার কথায় সানাউল মির্জা চমকে উঠলেন।তাহলে কুলছুম বেঁচে আছে!তিনি মেয়েটির পিছু হাঁটতে শুরু করলেন।গাছের আড়ালে লতা পথ দেখিয়ে একটি ভাঙা টিনের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো।সানাউল মির্জা দেখতে পেলেন,বাইরে থেকে দরজা আটকানো।লতা বলল,দরজাটা খুলেন।
সানাউল মির্জা দরজা খুলতেই ঘরের কোণায় কাউকে দেখতে পেলেন।তিনি আশপাশে একবার তাকিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে কাছে গিয়ে বসলেন।চেহারা দেখে চিনতে পারলেন,এই মেয়েটি হচ্ছে কুলছুম।দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে।সানাউল মির্জা কাছে যেতেই মেয়েটি চিৎকার করে বলল,আমি পাগল না।আমি সত্যিই দেখেছি।
সানাউল মির্জা মেয়েটির মাথায় হাত রেখে বললেন,আমি জানি,তুমি পাগল না।তোমার বাবা তোমাকে এখানে বেঁধে রেখেছে।তুমি আবিদ ভাইয়ার বাসা থেকে পালিয়ে আসলে কেন?কি হয়েছিল তোমার সাথে?
মেয়েটি বেশ ভয়ে বলল,ওই বাসায় আমি আর যাবো না।আমাকে নিয়ে যেতে পারবেন না আপনি।
-আমি তোমাকে নিয়ে যেতে আসিনি।তুমি শুধু বলো,কি এমন হয়েছে যে তুমি পালিয়ে চলে আসলে?
সানাউল মির্জার কথায় বোধহয় কুলছুমের ভয় অনেকটা কেটে গেছে।ওইদিন রাতে আবিদ ভাইয়াকে সব বলার পর আমার কথা তো বিশ্বাস করেনি।কিন্তু আমি ওইদিন রাতে বারান্দায় যাওয়ার পর দেখি,রেহানা আপামনি,বিল্ডিং বেয়ে বেয়ে উপরে উঠতেছে।আপামনির কাঁধে একটা বাচ্চার লাশ।আমার দিকে কড়মড় দৃষ্টিতে তাকাতেই আমি সঙ্গে সঙ্গে বারান্দায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই।ভোর হওয়ার পর আমি পালিয়ে এখানে চলে আসি।এই কথা সবাইকে বলতেই এই ঘরে বেঁধে রাখা হয়েছে।কিছু খেতে দেয় না,কথাগুলো বলে কুলছুম কাঁদছে।
কুলছুমের অবস্থা দেখে সত্যিই খুব খারাপ লাগছে সানাউল মির্জার।বললেন,আচ্ছা সত্যিই কি তোমার আপামনি এই কাজগুলো করছে নাকি অন্যকেউ?কি মনে হয় তোমার?
কুলছুম বলল,আমার আপামনি এমন হতে পারেনা।সবসময় কত আদর করে।শুধু এই কিছুদিন ধরে কেমন যেন আচরণ!
সানাউল মির্জা মাথা নেড়ে বললেন,ঠিক আছে।শুনো,আমি যাওয়ার সময় থানায় কথা বলবো তোমার ব্যাপারে।উনারা আসলে তুমি শুধু বলবে,তোমাকে জোর করে বেঁধে রাখা হয়েছে।আর কিছুই বলার দরকার নেই।আমি এখন তাহলে আসছি।আর তোমার এই ছোট্ট বোনটা খুব ভালো।সে আমাকে না বললে তো আমি জানতেই পারতাম না।সানাউল মির্জা ঘর থেকে বেরিয়ে লতার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,বেশ মিষ্টি মেয়ে।হঠাৎ কি মনে করে আবার ভেতরে ঢুকলেন,কুলছুম একটা কথা মনে পড়ে গেল।
কুলছুম মাথা তুলে তাকিয়ে বলল,কি কথা?
পুলিশের গাড়ির সামনে মানুষের ছোটখাটো ভিড় জমেছে।কনস্টেবল তাহের মিয়া গতকাল রাত থেকে নিঁখোজ।গাড়ির চাবি এখনও লাগানো আছে গাড়িতে।কিন্তু সে নেই।গাড়ির সামনে ছোপছোপ রক্তের দাগ লেগে আছে।রাস্তা পেরিয়ে পাশের জমির ঘাসেও রক্তের ফোঁটা চলে গিয়েছে সুদূরে।ওসি হামিদ শিকদার ঘটনাস্থলে আসার পর থেকে একবারও কথা বলেনি।মানুষজনের মুখের দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে শুধু তাদের কথা শুনেছে।ওসি শিকদার হয়তো ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছে।গ্রামের লোকজনও আজকাল খুব একটা কথা বলতে চায় না।সবার চোখে-মুখেই ভয়।কনস্টেবল তাহের মিয়াকে নিয়ে প্রথমে দু’একজনকে উৎসুক মনে হলেও একটু পর তারাও চুপ হয়ে গিয়েছে।কেউ কেউ ফুসফুস করে বলছে,আর থাকা যাবে না।
কনস্টেবল লতিফ এসে ওসি শিকদারকে সালাম জানিয়ে বলল,স্যার,গাড়ি কি এখান থেকে নিয়ে যাবো থানায়?নাকি তদন্তের জন্য রেখে দিবো?
-লতিফ আমার মাথা কাজ করছে না।আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি,কনস্টেবল তাহের আর বেঁচে নেই।গতকাল সকালেই জমিদার বাড়িতে দুজনে গিয়েছিলাম উনার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে।টেবিলে কয়েক রকমের নাস্তাও দিয়েছিল আমাদের।তাহের হাসিমুখে খাচ্ছে দেখে বললাম,চিন্তায় আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।আর তুমি এত মজা করে নাস্তা করছো?আমার কথায় তাহের বলেছিল,মৃত্যু যখন হবেই তখন খেয়ে নেওয়া সওয়াবের কাজ।অথচ দেখো,কয়েক ঘন্টা পরই তাহেরের মৃত্যু।কি অদ্ভুত তাই না?
কনস্টেবল লতিফ বলল,হ্যাঁ স্যার।এই ঘটনার পর বাকি যারা ছিল তারাও চলে যাবে।কানাঘুষা শুনতে পেলাম,পুলিশের যেখানে জানের নিরাপত্তা নাই,সেখানে আমরা তো পুঁটিমাছ।
-হুম,ঠিকই তো বলেছে।দেখবে,আজ বিকাল হতেই আরও কিছু বাড়ি ফাঁকা হয়ে যাবে।প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকতে পারলে অনেক বাড়ি তৈরি করা যাবে।ওসি শিকদার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,এই গ্রামে অভিশাপ এসে ভর করেছে।শয়তানের কুনজর পড়েছে এখানে।
-স্যার,এর থেকে কি কেউ বাঁচাতে আসবে না?জিজ্ঞেস করল কনস্টেবল লতিফ।
ওসি শিকদার কি যেন ভেবে বলল,হয়তো আসবে।বিপদে পড়লে সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই কাউকে না কাউকে দিয়ে সে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন।
চার.
রেহানা অফিসে ঝিম মেরে বসে আছে।আজ অফিসে জরুরি মিটিং ডেকেছিল তাদের অফিসের প্রধান।প্রায় ঘন্টা দুয়েক পার হয়ে গেছে।মিটিং কয়টা নাগাদ শেষ হবে ঠিক নেই।তবে জরুরি কথাগুলো প্রথমদিকে শেষ হয়ে যাওয়ার কারনে খুব একটা মনোযোগ না দিলেও সমস্যা নেই।এখন শুধু কিছু বিষয় আলোচনা করছে যারা নতুন তাদের জন্য।রেহানার মনে হচ্ছে,হঠাৎ করেই তার শরীর ভার হতে শুরু করেছে।যেন সে ছাড়াও আরও একটি মানুষ তার শরীরে ঢুকে বসে আছে।বেশ অস্বস্তি লাগছে রেহানার।রেহানা খেয়াল করলো,তার চোখ দুটো ধীরে ধীরে লাল হয়ে যাচ্ছে।ভাবছে,জ্বর আসেনি তো?কিন্তু জ্বর আসলে তো মাথাও ব্যাথা করতো?সঙ্গে শরীরে একটা দুর্বলতা কাজ করতো?কিন্তু তেমন কিছুই মনে হচ্ছে না।তাহলে হঠাৎ এমন লাগছে কেন?রেহানা তার পাশে বসা সায়মাকে বলল,সায়মা,আমার কপালে হাত দিয়ে দেখো তো জ্বর এসেছে কিনা?
সায়মা কপালে হাত দিয়ে বলল,কই শরীর তো গরম নেই।কেন তোমার শরীর খারাপ লাগছে?
-হ্যাঁ,একটু ভারি লাগছে শরীর,বলল রেহানা।
সায়মা বলল,স্যার,একটু পরেই মিটিং শেষ করে দিবে।সন্ধ্যাও প্রায় হয়ে আসছে।আমরা দুজনে কেবিনে গিয়ে একটু বসে রিলেক্সে কথা বলবো।দেখবে এই ভাব কেটে যাবে।আসলে সারাদিনে কাজ শেষের পর আবার এখানে দুইঘন্টা বসে বকবক শুনছো তো তাই খারাপ লাগছে।ওইযে,স্যার চলে যাচ্ছে।তার মানে মিটিং আজকের মতো এখানেই শেষ।
সায়মা রেহানাকে নিয়ে একটি কেবিনে এসে বসে পড়লো।ব্যাগ থেকে একটা সিগারেট রেহানার দিকে এগিয়ে বলল,খাবে নাকি?রেহানা “না” বলতেই বলল,এমনটাই আশা করেছিলাম।ভার্সিটি লাইফে খারাপ ছেলে-মেয়ের পাল্লায় পড়েছিলাম।তারপর শত চেষ্টা করেও আর ছাড়তে পারিনি।সিগারেটে টান দিয়ে বলল,এটা আমার নিত্য দিনের সঙ্গী।
রেহানার এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে,চারপাশ কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে।সামনে একটি ছোট্ট প্রাণী আগুনে পুড়ছে।রেহানা বলল,সায়মা,আমার এমন লাগছে কেন?
সায়মা বলল,কেমন লাগছে?এখনও খারাপ লাগছে?এসি একটু বাড়িয়ে দিবো,রেহানা?
-লাইটটা বন্ধ করে দাও।অন্ধকারে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে।
সায়মা রেহানার কথায় লাইট বন্ধ করে দিয়ে বলল,সিগারেট যেকোনো অবস্থায় খাওয়া যায়।আমার অন্ধকারে বসতে সমস্যা নেই।তোমার ভালো লাগলেই হয়েছে।
-আচ্ছা,তোমার কাছে মৃত্যু জিনিসটা কেমন লাগে?ধরো,হুট করে এখন তুমি মারা গেলে। তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে?
রেহানার কথায় হঠাৎ সায়মার কেমন যেন ভয় লাগলো।রুম তো অন্ধকার,তার উপরে হঠাৎ মৃত্যু নিয়ে কথা!রেহানার কন্ঠও সায়মার কাছে কেমন যেন অপরিচিত লাগছে।সায়মা সিগারেট ফেলে বলল,রেহানা,আমার মনে হচ্ছে তুমি অসুস্থ।তোমার কন্ঠ কেমন যেন অপরিচিত লাগছে আমার কাছে।তোমার বাসায় যাওয়া দরকার এই মুহূর্তে।
সায়মার অন্ধকারে মনে হলো,রেহানা উঠে দাঁড়িয়েছে।একটু একটু করে সায়মার দিকে এগিয়ে আসছে।সায়মার ভয়ে শরীর কাঁপছে।রেহানা,তুমি এমন করছো কেন?কি হয়েছে তোমার?রেহানাআআ…
পশ্চিমে সূর্য ডুবেছে অনেকক্ষণ হয়েছে।টং দোকানের ভিতরে বসে আছেন সানাউল মির্জা।রাস্তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছেন তিনি।প্রতিটা মানুষের গতিবিধি নজর রাখছেন।মাথায় কালো টুপি পড়েছেন ছদ্মবেশ ধারন করার জন্য।চা এর কাপে শেষ চুমুক দিয়ে দোকানে বসা কমবয়সী ছেলেটাকে বললেন,আরেক কাপ চা দেয়ার জন্য।চায়ের কাপ হাতে নিবে এমন সময়ে দেখতে পেলেন,শাড়ি পরিহিত রেহানার মতো একটি মেয়ে রাস্তা ধরে হেঁটে আসছে।সানাউল মির্জা চায়ের দাম মিটিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে একটু আড়ালে দাঁড়ালেন।দেখতে পেলেন,তার আন্দাজই ঠিক।রেহানার মতো নয়,বরং রেহানাই হাঁটছে।সানাউল মির্জার মনে হলো,রেহানা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই।কোনোদিকে তাকিয়ে হাঁটছে না সে।শরীর ঘেঁষে ছুটে যাওয়া গাড়িগুলো সমানে সাইরেন বাজালেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার।হেঁটেই চলেছে একমনে।চুলগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে আছে।সানাউল মির্জা আর দেরি না করে রেহানার পিছু নিলেন।কিছুক্ষণ হাঁটার পর হঠাৎ আবিদের কথা মাথায় আসলো,”রেহানার পিছু নিলেই কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তা হারিয়ে ফেলতো সে।কখনো নিজেকে পেয়েছে খোলা মাঠে,কখনো বা পরিত্যক্ত গাড়ির গ্যারেজে।”সানাউল মির্জা সঙ্গে সঙ্গে রেহানার পিছন থেকে সরে আসলেন।যারা এই পিছু নিতে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলে তার কারন হলো ত্রিনয়ন।একধরনের সম্মোহনের মতো ব্যাপারটা।অশরীরী ব্যক্তিটি তার ত্রিনয়ন দিয়ে পিছু নেয়া লোকটির রাস্তা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়।এজন্য পাশ থেকেই তাদের পিছু নিতে হয়।সানাউল মির্জা আড়ালে পাশে থেকে রেহানাকে অনুসরণ করে হাঁটতে শুরু করলেন।
যত এগিয়ে যাচ্ছেন ততই মানুষের উপস্থিতি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে।বেশ কিছুক্ষন হাঁটার পর সানাউল মির্জা দেখলেন,রেহানা একটা খালি মাঠে এসে থেমেছে।আশেপাশে বাড়িঘর নেই বললেই চলে।অন্ধকারে আশপাশে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না।রেহানাকে অনুসরণ করে হাঁটতে হাঁটতে মাঠের এককোণে এসে থামলেন তিনি।রেহানা একটা টিনের ঘরে ঢুকে পড়ল।এই শুনশান অন্ধকার জায়গায় যেখানে উনার নিজেরই কেমন অস্বস্তি লাগছে,সেখানে একটা মেয়ে হয়ে কিভাবে রেহানা একা আসে সানাউল মির্জার মাথায় ঢুকলো না ব্যাপারটা।তিনি টিনের ঘরের পাশে একটি গাছের আড়ালে গিয়ে বসে পড়লেন।
সানাউল মির্জা হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন,তিনি এসেছেন ঘন্টাখানেক পার হয়ে গেছে।অথচ ভেতর থেকে রেহানার কোনো সাড়াশব্দ নেই।ভাবলেন,একবার ভেতরে গিয়ে দেখে আসলে মন্দ হয় না।তবে পরিস্থিতি দেখে মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছে না তার কাছে।ব্যাপারটা আন্দাজ করে আরও কিছুক্ষন অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।
মিনিট বিশ সময় পেরিয়ে ঘড়িতে তখন রাত দশটা ছুঁইছুঁই।আর অপেক্ষা না করে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসলেন সানাউল মির্জা।ধীর পায়ে আস্তে আস্তে টিনসেড ঘরের দিকে পা বাড়ালেন তিনি।দরজার সামনে এসে আর দেরি না করে ভিতরে উঁকি দিলেন।কিন্তু অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখতে পেলেন না তিনি।দরজা আস্তে করে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে পকেট থেকে মোবাইল বের করে লাইট জ্বালালেন।অল্প আলোর উপর ভর করে আন্দাজে হাঁটতে শুরু করলেন।কিন্তু ভোটকা গন্ধে পেটের নাঁড়িভুড়ি বেরিয়ে আসার অবস্থা সানাউল মির্জার।দীর্ঘদিন কোনো প্রানী মরে পঁচে একজায়গায় থাকলে যেমন বাজে গন্ধ বের হয় ঠিক তেমন।সানাউল মির্জার পা যত সামনে এগিয়ে চলছে,গন্ধটার তীব্রতা ততই বাড়ছে।হঠাৎ কারো গোঙানোর শব্দে চমকে উঠলেন সানাউল মির্জা।সাথে কিছুটা ভয়ও এসে জমাট বাঁধছে উনার ভিতরে।মোবাইলের আলো ফেলে বললেন,কে ওখানে?কে কাঁতরাচ্ছে?
পুরো ঘর তখন নিরব।শুধু ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ কানে আসছে।সানাউল মির্জা মনের ভুল ভেবে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন।কিন্তু এবার আর ভুল শুনতে পাননি।সত্যি কেউ একজন গোঙানোর শব্দ করছে।আর শব্দটা এই টিনশেড ঘরের ভেতর থেকেই আসছে।
বেশ হন্ন হয়ে খুঁজতে শুরু করলেন তিনি।কিন্তু চারপাশে পুরানো বস্তার স্তুপ ছাড়া কিছুই চোখে পড়লো না।একসময় পায়ের নিচে ঠকঠক কাঠের আওয়াজ অনুভব করলেন।ভালো করে খেয়াল করে দেখলেন,মাটির নিচে আরও একটি সুড়ঙ্গ কেউ খুঁড়েছিল কোনো কাজে।কাঠ সরাতেই ভোটকা গন্ধটা আরও নাকে এসে বাজল।ভেতরে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে।সানাউল মির্জা আর দেরি না করে সুরঙ্গের ভেতরে ঢুকে হাঁটতে শুরু করলেন।কিন্তু একসময় চিৎকার করে উঠলেন,”ইয়া আল্লাহ।এই ঘরের মধ্যে এগুলো কি?”মোবাইলের আলোতে দেখতে পেলেন,পুরো ঘরজুড়ে মৃতদেহ ছড়িয়ে আছে।মেঝেতে রক্তের ছোঁপছোঁপ দাগ।কোনো মৃতদেহের মাথা নেই,কোনোটার আবার অর্ধগলিত।একটা জায়গায় এসে সানাউল মির্জার চোখ স্থির হয়ে যায়।ঘরের কোণায় দুটো চোখ ওনার দিকে তাকিয়ে আছে।গোঙানোর শব্দটা ওদিক থেকেই আসছে।লোকটি এখনও বেঁচে আছে মনে হচ্ছে।একটু আগে হয়তো রেহানার হাতেই এই লোকটি শিকার হয়েছে।
-কি হয়েছে আপনার?এই অবস্থা কে করেছে?বলল সানাউল মির্জা।
-আপনি এখানে কেন এসেছেন?ওই পিশাচের হাত থেকে বাঁচতে চাইলে এখান থেকে পালিয়ে যান,লোকটির নিঃশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।
-এখানে তো দেখছি,অনেক মৃতদেহ।কিন্তু ওই পিশাচ আপনাদের মারতে চায় কেন,জিজ্ঞেস করলেন সানাউল মির্জা।
-এখানে যারা মৃত সবাইকে একই জায়গা থেকে নিয়ে আসা হয়েছে।আজ আমাকে সেই পিশাচের হাতে শিকার হতে হয়েছে।কাল হয়তো অন্য কেউ এখানে নিজের জীবন দিবে।আমাদের মৃত্যু কেউ আটকাতে পারবে না।পালিয়ে গেলেই হয়তো বেঁচে যেতাম,কাঁদতে কাঁদতে বলল লোকটি।
-একই জায়গা থেকে মানে,বেশ অবাক হয়ে বললেন সানাউল মির্জা।
-আপনি তাড়াতাড়ি এই ঘর থেকে পালিয়ে নিজেকে রক্ষা করুন।আর পারলে আমার কথাটা নি..বলার আগেই লোকটি চোখ বন্ধ করে শেষ নিঃশ্বাস নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।
সানাউল মির্জা বুঝতে পারলেন,বড় কোনো বিপদে তিনি পা দিতে চলেছেন।কিন্তু আগে এই জায়গা থেকে নিরাপদে বাইরে বেরিয়ে তারপর যা করার করতে হবে।আশেপাশে এত মৃতদেহ আর রক্তের গন্ধ যেন ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে।হাত দিয়ে নাক চেপে কতক্ষন সামলে রাখা যায়?কাঠের তক্তা বেয়ে উপরে উঠে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি।তাড়াতাড়ি টিনসেড ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তা ধরে দৌঁড়াতে শুরু করলেন।বেশ কিছুক্ষন পর একটা দোকান চোখে পড়ল সানাউল মির্জার।পকেট থেকে ফোন বের করে আবিদের নাম্বারে কল দিলেন তিনি।আবিদের কন্ঠ শুনতে পেয়ে বললেন,
-আমি সানাউল মির্জা বলছি।যতটা সহজ ব্যাপার মনে করেছি ততটা সহজ ব্যাপার নয়।আজকে আমার প্রাণ চলে যেতো।ভাগ্য সঙ্গে ছিল বলে রক্ষা পেয়েছি।আপনার স্ত্রী রেহানা কোথায়?
-রেহানা তো ঘুমাচ্ছে।আজকে খাবে না বলে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল,বলল আবির।
-এত তাড়াতাড়ি বাসায় গিয়ে ঘুমিয়েও পড়েছে!আচ্ছা আমি এখন তাহলে রাখছি,সানাউল মির্জা ফোন কেটে দিলেন।হঠাৎ উনার কুলছুমের কথা মনে হতেই বললেন,লোকটি মৃত্যুর আগে একটি শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন।আর কুলছুমও আমাকে একটি কথা শেষে বলেছিল।তাহলে কি সব রহস্য লুকিয়ে আছে নিতাইপুরে?
………..চলবে………..