তবু মনে রেখো
৫ম পর্ব
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ননস্টপ সিগারেট টেনে যাচ্ছে ইফতি, মনে প্রশ্নরা ভিড় করছে তার। কিছু সমীকরণ যার সমাধান খুজে পাচ্ছে না সে। নিকোটিনে নাকি মস্তিষ্কের স্নায়ু শান্ত হয়৷ তার ক্ষেত্রে হচ্ছে না। শিমুল নামের মেয়েটিকে সে যতই দূরে ঠেলতে চাচ্ছে,ততই যেন জড়িয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে, পানি নিতে রান্নাঘরের দিকে যেতে হারুন সাহেব আর শিমুলের কথোপকথন পুরোটাই শুনেছিলো ইফতি। তারপর থেকে একটা প্রশ্ন বারবার মাথায় চড়ে বসছে, ভুল করছে নাকি সে!
খাওয়া দাওয়ার পর রুমে এসে অথৈকে শুইয়ে দেয় শিমুল। আজ ঘুমাতে খুব জ্বালিয়েছে অথৈ, কিছুতেই ঘুমাবে না; শেষমেশ খুব জোর করে ঘুম পাড়াতে হয়েছে তাকে। রুমে ইফতিকে না দেখতে পেরে বারান্দায় উঁকি মারে শিমুল। খাবার টেবিলে খুব চুপচাপ ছিলো ইফতি, যতবার হারুন সাহেব কিছু জিজ্ঞেস করেছেন শুধু হুম,হ্যা তে উত্তর দিয়েছে। শিমুলের ইচ্ছা ছিলো একবার জিজ্ঞেস করার কিন্তু বাবার সামনে কিছুই জিজ্ঞেস করে নি। অথৈকে শুইয়ে বারান্দায় গেলে ইফিতিকে সিগারেট খেতে দেখে শিমুল। ধীর পায়ে পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। পাশে কারো উপস্থিতি টের পেলে ইফতি সিগারেটটা ফেলে দিয়ে শিমুলের দিকে তাকায়।
– কিছু বলবে?
– ঘুমাবেন না? রাত তো অনেক হয়েছে।
– হুম, অথৈ কি করে?
– ঘুমিয়ে গেছে, আজ অবশ্য জ্বালিয়েছে।
– তুমি ঘুমাতে যাও, দেরি হয়ে গেছে এমনিতেও
– হুম যাচ্ছি, আপনিও আসুন।
বলে চলে যেতে নিলে ইফতি কি মনে করে শিমুলকে ডেকে বসে। আজ তার খুব একা একা লাগছে, কষ্টগুলো যেন ঘিরে ধরেছে থাকে।
– শিমুল,
– হুম
– সময় হবে একটু?
– হুম বলুন।
– আ..আচ্ছা, আমি কি খুব খারাপ?
– জ্বী?
ইফতির দৃষ্টি বাহিরের রাস্তার দিকে স্থির। সোডিয়ামের আলোতে তার চোখগুলো চিকচিক করেছে। একটু থেমে আবার বলে,
– আমি মানুষটা কি খুব খারাপ?
– কেনো বলুন তো?
– আমার না খুব দম বন্ধ লাগে শিমুল, খুব দম বন্ধ লাগে। ইচ্ছে করে মরে যেতে। কিন্তু পারি না জানো, যখনই ভাবি এমন কিছু করবো অথৈর মুখটা চোখে ভাসে। বকুল ওকে আমার ভরসায় রেখে গেছে। আমি না সত্যি পারছি না। এই যে এখানটায় (বুকে হাত দিয়ে) খুব কষ্ট হয়। আমিও চাই সুখী থাকতে, আমিও চাই আশেপাশের মানুষগুলোকে সুখী রাখতে। কিন্তু পারি না জানো।
বলতে বলতে গলা ধরে এসেছে ইফতির। আবার বলা শুরু করে,
– আমি এই বিয়েটা মানতে পারছি না, তোমাকে মানতে পারছি না। আমার মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে তোমাকে মেনে নিলে আমার বকুলের প্রতি অন্যায় হবে। আবার মনে হচ্ছে, না মেনে নিলে তোমার প্রতি অন্যায় হবে। আমি আর পারছি না শিমুল। আমি আর পারছি না। এই দ্বিধায় থাকাটা খুব কষ্টের।
হঠাৎ শিমুলের হাত দুটো আঁকড়ে ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে আর বলতে লাগে,
– আচ্ছা আমি কি দোষ করেছিলাম বলো, আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। আমার বকুলকে কেনো কেড়ে নিলেন আমার থেকে। বলতে পারো? সবাই আমাকে অবুঝ ভাবছে, আমাকে বলছে আমি নাকি একটা রেসপন্সেবল বাবা নই। কিন্তু আমি কি করবো বলো অথৈর কাছে গেলেই যেনো বকুলের স্মৃতি আরো চেপে ধরতো আমায়।
বকুল মারা যাবার পর থেকে ইফতিকে কাঁদতে দেখে নি শিমুল। এই প্রথম ইফতি কাঁদছে। বিলাপ করে কাঁদছে। ইফতিকে একটা অবুঝ বাচ্চার মতো লাগছিলো। অজান্তেই শিমুলের চোখে পানি চলে আসে, লোকটা নিজের ভেতর গুমরে গুমরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। ইফতি যে কিনা এক মিনিট বকুলকে চোখের আড়াল হতে দিতো না, আজ তাকে বকুলকে ছাড়া এই দুই মাস থাকতে হচ্ছে এবং সামনেও থাকতে হবে, বাঁচতে হবে।
– আমার বকুলকে এনে দেও শিমুল, প্লিজ ওকে ছাড়া আমি পারছি না। আমার দম বন্ধ লাগে বকুল। প্লিজ
ইফতি কাঁদছে সাথে শিমুল ও। সে নিরুপায়, সেদিন ও ছিলো যেদিন বকুলের শেষ ক্যামো দেবার কথা থাকে। আজ থেকে চার মাস আগে বকুলের শুধু বমি বমি পেতো, মাথা ঘুরাতো,মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমে সবাই ভেবেছিলো বকুল বোধ হয় আবার কন্সিভ করেছে। সবাই খুবই খুশি ছিলো, খুব জলদি আবার আরেকটা বাচ্চা আসবে কারণ অথৈ তখন আড়াই বছর। সিওর হবার জন্য টেস্ট করালে ধরা পরে বকুলের পেটে টিউমার রয়েছে, টিউমারটার কন্ডিশন ভালো নয়। খুব জলদি এটাকে অপারেট করতে হবে। শিমুল তার পরিচিত সকল ডাক্তারের সাথে কথা বলে বেস্ট ডাক্তার দিয়ে অপারেশনের ব্যবস্থা করে। অপারেশন সাক্সেসফুল হলেও কিছু অংশ থেকে যায় যা পরে সেটা ক্যান্সারের রুপ নেয়। ইফতি, শিমুল সকল প্রকার চেষ্টা চালায় বকুলকে ভালো করার। দেড় মাসে ৫ টা ক্যামো দেওয়া হয় বকুলকে। বকুলের সব চুল,পশম পড়ে যায় এতে করে। কিন্তু শেষ রক্ষাটা হলো না। বকুলের শরীর ক্যামোর চাপ নিতে পারে নি। সে ইফতিকে ছেড়ে না ফেরার দুনিয়ায় পাড়ি দেয়। শিমুল এই অল্প সময়ে এতো ক্যামোর ধকল বকুলের শরীর নিতে পারবে না বিধায় বারবার মানা করেছিলো, কিন্তু বাঁচার লোভে বকুল জেদ ধরে বসে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো কই। সেদিন শিমুল নিরুপায় ছিলো বকুলের জেদের কাছে। আজ ইফতির অবস্থাতেও সে নিরুপায়।
ফজরের আযানে ঘুম ভাঙ্গে শিমুলের। চোখ খুলতেই নিজের উপর ভারী কিছু অনুভব করে। ভালো করে লক্ষ করে দেখে ইফতি ওকে জড়িয়ে ওর বুকের কাছে বাচ্চাদের মতো ঘুমাচ্ছে, তারা বারান্দাতেই ফ্লোরে বসে ঘুমোচ্ছিলো। পরক্ষণে রাতের কথাগুলো তার মনে পড়ে গেলো। ইফতিকে সান্ত্বনা দিতে দিতে কখন যে ওকে জড়িয়ে ধরেছিলো খেয়াল ছিলো না শিমুলের। আর ইফতিও কাঁদতে কাঁদতে শিমুলকে জড়িয়ে ধরেছিলো। ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো দুজন। শিমুলের মনে এখন অন্য চিন্তা উদয় হলো। এখন বান্দা না হয় ঘুমোচ্ছে, কিন্তু উঠে যদি দেখে শিমুল তার এতো কাছে তাহলে একটা কুরোক্ষেত্র বাঁধাবেই বাঁধাবে। আস্তে করে ইফতিকে সরিয়ে দিতেই ইফতির ঘুম পাতলা হয়ে গেলো। ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই শিমুল দু হাত দূরে সরে বসলো। কাল রাত ইফতি চরম ঘোরে ছিলো, তার অনেক কিছুই মনে আসছে না। চোখ খুলে ইফতি নিজেকে বারান্দায় দেখে মনে করতে পারছিলো না আসলে হয়েছেটা কি!!
– কালরাত?
– অথৈ উঠে যাবে এখনি। আপনি বেডে যেয়ে ঘুমান। আমি নামায পড়তে গেলাম।
এক নাগারে কথাগুলো বলেই কোনো মতে শিমুল সেখান থেকে কেটে পড়ে, কালরাত যা হয়েছে সেটা নিয়ে কথা বলতে চায় না আর ও। ইফতি ও বেশি না ঘেটে বিছানায় শুতে চলে যায়।
সকাল ৯টা, অথৈকে নাস্তা করিয়ে শিমুল হারুন সাহেব আর লোকমানকে খাবার বেরে দেয়। ইফতি তখনও ঘুমে বিভর। আজ তারা বাড়ি ফিরবে। আফসানা বেগম ফোন করেছিলো খোঁজ নিতে, তখন সিকান্দার সাহেব জানান আজ একটু অফিস আসতে হবে ইফতির। তাই ওদের নাস্তা করেই বের হয়ে যেতে হবে। হারুন সাহেব খাবার খেতে খেতে জিজ্ঞেস করেন,
– ইফতি উঠে নি? ও তো বেশ আরলি রাইজার।
– না বাবা আসলে, এক খাটে তিনজন। ওর ঘুমে ডিস্টার্ব হয়েছিল। ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে।
কাল রাতের কথা জানতে পারলে হারুন সাহেব আবার কষ্ট পাবেন তাই শিমুল কৌশলে চেপে গেছে। চুপচাপ হলেও শিমুলের প্রখর বুদ্ধি। সিচ্যুয়েশন কিভাবে হ্যান্ডেল করতে হয়, সে ভালোই জানে। হারুন সাহেব আর লোকমানের খাওয়া শেষে সব গুছিয়ে ফেলে। এখন ইফতিকে ডাকতে হবে নয়তো সত্যি দেরি হয়ে যাবে। অথৈকে লোকমানের কাছে দিয়ে রুমের দিকে যায় সে। রুমে যেয়ে দেখে ইফতি পুরো বাচ্চাদের মতো ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত ইফতিকে দেখলে খুব মায়া লাগছে শিমুলের। ইফতি রাগী হলেও মুখটা বেশ মায়া মায়া। বিশেষ করে ওর চোখ দুইটো,যেন একটা মায়ার সাগর যার তল পাওয়া দুষ্কর। কপালের উপরে চুল গুলো পড়ে রয়েছে। সত্যি বলতে ইফতিকে দেখতে খারাপ লাগে না শিমুলের। যথেষ্ট সুদর্শন পুরুষ সে, পাঁচ ফিট এগারো হাইট, যেমন লম্বা তেমন দৈহিক গড়ন। যেকোনো মেয়ের ভালো লাগবে। শ্যামলাটে গায়ের রং, মুখে খোচাঁখোচাঁ দাড়ি, কপালে চুল গুলো ফেলে রাখে। মাঝে মাঝে সাউথ ইন্ডিয়ান হিরো লাগে। খাঁড়া নাক রাগ হলে লাল হয়ে যায়। অথচ এখন একদম শান্ত লাগছে। কতক্ষণ এভাবে ইফতিকে দেখছিলো তা জানা নেই শিমুলের। হঠাৎ চোখ খুলতে ইফতি চরম আকারে ধাক্কা খায়। এভাবে নিজের এতো কাছে শিমুলকে দেখবে কল্পনাতেও ছিলো না তার। শিমুল ও সময়ের দ্রুততার কারণে বেশ লজ্জায় পড়ে যায়। এভাবে চোখ খুলবে ইফতি সেটা ভাবে নি। তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে শিমুল।
– আপনি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমাদের বাড়ি যাতে হবে৷
বলেই হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে যায় শিমুল। লজ্জায় এক মূহুর্ত দাঁড়াতে পারছিলো ইফতির সামনে, নিজের উপরই রাগ লাগছে তার; কি করছিলো সে, না জানি ইফতি কি ভাবছে।আর ইফতি এখনো বিছানায় বসে ভেবে যাচ্ছে হলোটা কি ওর সাথে।
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি