ডাক্তার সাহেব
শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-১২
আমি কাহিনি টের পাওয়ার আগেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কারণ নীল আমার উপরে। আচমকা নার্স আসাতে তিনি টাল সামলাতে না পেরে নীলকে ধাক্কা দেয় আর নীল ঝড়ে থুবরে পড়া বড় প্রকান্ড গাছের মতো আমার উপরে এসে থুবরে পড়ে। নীলের ঠোঁট ততক্ষণে আমার থুতনী স্পর্শ করেছে। হুট করে এমন পড়ে যাওয়াতে আমি হালকা ব্যথা পেলেও নীলের উপস্থিতির জন্য টের পাচ্ছি না। শরীরটা স্তব্ধ হয়ে যেন ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাসটা ঘন হলো কয়েকবার। নীল মুখটা তুলে আমার দিকে তাকাল। তারপর আশেপাশে গুন্জণ উঠার আগেই ঝটপট উঠে পড়ল। রিদি ততক্ষণে শুয়া থেকে উঠে হা হয়ে আছে। মাও চোখ মেলে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। সব বিস্ময় কাটিয়ে নার্স কেবিনে প্রবেশ করে নীলকে উদ্দেশ্য করে বলল
– সরি ভাইয়া মেঝেতে জুতাটা কী করে যেন ফসকে গিয়েছিল তাই এমনটা হয়েছে আপনি ব্যথা পাননি তো? আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এমনটা হয়েছে।
নীল কিছু বলে উঠার আগেই রিদি বলে উঠল
– হিল পড়ে এরকম মেঝেতে হাঁটলে তো এমন হবেই। আপনাকে তো এসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে। আপনি নিজেও জানেন আপনি কোন পেশায় আছেন আর হাসপাতালের মেঝের অবস্থাও আপনার থেকে ভালো কারও জানা নেই। তাই জুতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবশ্যই আপনাকে সচেতন হওয়া উচিত ছিল।
– সরি আপু বুঝতে পারিনি। ডিউটি শেষ করে একটা প্রোগ্রামে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কপাল মন্দ বিকেলে ছুটি পেলাম না। আবারও ডিউটি করতে হচ্ছে। প্রোগ্রামে যাওয়ার জন্যই হিলটা পরেছিলাম। তবে কপালটা বেশিই খারাপ তাই একটার পর একটা খারাপ ঘটনা ঘটছে৷ আমি দুঃখিত।
নার্সকে রিদি যা’তা বললেও মনে মনে আমি তাকে অনেক ভালো বলতেছিলাম। কারণ তার এ ভুল যে আমাকে আর নীলকে কতটা কাছে এনেছে সেটা শুধু আমি জানি৷ তাই রিদির এ জাবাবদিহি মোটেও ভালো লাগছে না আমার। রিদিকে থামিয়ে দিয়ে বললাম
– তুই থাম তো। বুঝতে পারেনি হয়তো। আর কারও কিছু হয়নি৷ আমার কোমড়ে ব্যথা পেলেও এতটা পাইনি। ভুল হওয়া অস্বাভাবিক না।
তারপর নার্সের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম
– আপু সমস্যা নেই। আমরা আমরাই তো।
পাশ থেকে নীল ও বলে উঠল
– থাক…যা হয়েছে তো হয়েছেই। এতটা বাড়াবাড়ির দরকার নেই। রিদি আর কিছু বলো না তুমি। ইটস নরমাল।
তারপর নার্সের দিকে তাকিয়ে বলল
– ইটস ওকে। আমি কিছু মনে করিনি। কোনো কাজ থাকলে করে যেতে পারেন।
– হুম ভাইয়া বুঝার জন্য ধন্যবাদ। রোগীর চেক আপের ডাটা নিতে এসেছি।
আর এদিকে মা ভ্যাবলাকন্তের মতো টগবগিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নার্স গিয়ে মায়ের প্রেসার, বিপি,অনুষাঙ্গিক সব দেখে কেবিন থেকে প্রস্থান নিল। মায়ের চোখ এখনও আমার দিকে। মনে হচ্ছে মা আমাকে না আমার মধ্যে থাকা অন্য সত্ত্বাকে দেখছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে মা আবার চোখটা বন্ধ করে ফেলল। এ অপারেশন হওয়ার পর থেকে মা শুধু ঘুমুচ্ছেই বেশি। দিনের ২২ ঘন্টায় মায়ের চোখে ঘুম লেগে থাকে। যদিও ডাক্তার বলেছে এটা স্বাভাবিক। এদিকে রিদিও বেশ নিশ্চুপ। সে মুখে হাই তুলে মায়ের পাশেই শুয়ে পড়ল। কেবিনটার দরজাটা লাগানো। ১৫ মিনিট নিস্তবতায় পার হয়েছে। এদিকে রিদি আর মা বেশ ভালোই ঘুমুচ্ছে। নীল চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মোবাইল টিপছে। আমি আস্তে করে নীলের পাশে গেলাম। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে নীল মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখটা সরিয়ে তার চার চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকাল। লাল মোটা ফ্রেমের একটা চশমা পরে আছে সে। কপালটা ভাঁজ করে আমার দিকে তাকাল। তার মুখের মায়ায় ততক্ষণে আমি ডুবে গেছি।
– কিছু বলবে?
আমি আটকে রাখা দম ছেড়ে বললাম
– তোমার জন্য কালো টিপ পরেছি কোথায় তুমি আমার দিকে তাকাবে তা না…
বলেই মুখটা বাঁকিয়ে অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলাম। নীলের তীক্ষ্ণ কন্ঠে জবাব আসলো
– তখন তোমার দিকে তাকিয়েই ঐ বিপদটা হয়েছে।
মুচকি হেসে জবাব দিলাম
– মাঝে মাঝে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ ঘটা ভালো।
– আরও কিছু?
– হ্যাঁ আরও কিছু। তোমার জন্য কালো টিপ পরেছি কোথায় তুমি প্রশংসা করবে তা’না। আমার প্রশংসা করো। বলো আমাকে হুর পরীর মতো লাগছে৷ এ কালো টিপ আমার সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এ টিপের ঝঁটায় আমি পরী হয়ে গেছি।
নীল মুচকি হাসলো। মুচকি হেসে জবাব দিল
– এ রাত বিরাতে এত মিথ্যা বলা কী ঠিক হবে?
তারপর একটু জোরে হেসে সে হাসির রেশ টেনে বলল
– তোমার টিপ লেপ্টে গিয়ে হুর পরী না হুর পেত্নী লাগছে৷
কথাটা শুনেই আমি আয়নার সামনে গেলাম। এ দস্তাদস্তি আর ধাক্কা ধাক্কির পাল্লায় পড়ে কখন যে কাজল দিয়ে আঁকা টিপটা লেপ্টে গেছে বুঝতে পারিনি। কপালটা ভালো করে মুছে পুনরায় নীলের কাছে আসলাম। তার মায়াভরা চোখের দিকে তাকালাম। তার হাতটা ধরে বললাম
– আমার একটু প্রশংসা করো।
– হুট করে প্রশংসা পাওয়ার জন্য এমন করছো কেন?
– প্রেমিক, প্রেমিকার প্রশংসা করবে এটা তো খুবই সাধারণ বিষয়।
– আমি প্রশংসা করলে তুমি নিতে পারবে তো?
– কেন পারব না?
– এত সুন্দর প্রশংসা এর আগে শুনোনি তাই।
– তুমি বলো প্লিজ। তোমার প্রশংসা শুনার জন্যই আকুল হয়ে আছি।
– তোমাকে দেখতে মনে হয় অনেকটা গোবরে গড়ে উঠা ব্যাঙের ছাতার মতো। এই বুঝি লাফালাফি করে থুবরে পড়ে গোবরে লেপ্টে যাবে। চোখ গুলো তোমার সাপের মতো কারও দিকে রাগ চোখে তাকালে মনে হবে তাকে ফুস করে খেয়ে ফেলবে। গায়ের রঙটা তোমার দুধের মতো ফর্সা। মাঝে মাঝে মনে হয় এটা কী অস্ট্রেলিয়া গরুর দুধে ফর্সা মেয়ে নাকি দেশি গরুর। এ কনফিউশান আমার মধ্যে রয়েই গেছে। তোমার শরীরটা দেখতে অনেকটা কচুর লতার মতো। এই বুঝি একটু ধাক্কা খেয়ে লুটিয়ে পড়বে। ধরলে লকলক করবে। তবে তুমি কচুর লতা হলে মন্দ হত না চিংড়ি মাছ দিয়ে রান্না করে খাওয়া যেত। তোমার চুলগুলো অনেকটা নুডুলসের মতো। তবে ম্যাগি না ককোলা নুডুলসের মতো। কারণ ম্যাগি নুডুলস কোঁকড়া আর ককোলা নুডুলস সোজা। তবে তোমার চুল গুলো সত্যি সত্যি ককোলা নুডুলস হলে অনেক টাকা বিক্রি করা যেত অথবা মিনিমাম ৫০ জন মানুষকে রান্না করে খাওয়ানো যেত।
আরও কিছু বলতে যাবে নীল। তার আগেই আমি তার হাতটা ছেড়ে আমার হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে বললাম
– দোহাই লাগে আর প্রশংসা লাগবে না আমার। অনেক বড় উপকার করলে। বদহজম হয়ে যাবে এবার।
নীল আমার হাত থেকে তার হাতটা সরিয়ে মুচকি হেসে বলল
– আরেকটু…. বাকি। তুমিই তো চাচ্ছিলে যেন প্রশংসা করি। আমার প্রেমিকার প্রশংসা করব না তো কার করব?
আমি নীলের ঠোঁটটা আবারও হাত দিয়ে চেপে ধরে দাঁত কামড়ি দিয়ে বললাম
– তোমার প্রশংসা শুনে আমার বুকে গিট বেঁধে যাচ্ছে। আমার আর প্রশংসা লাগবে না। আনরোমান্টিক একটা।
নীল পুনরায় হাতটা সরিয়ে নিল। রিদি আর মা ঘুমে বিভোর হয়ে আছে। আর এদিকে নীল আমার হাতটা জোর ধরে মুখটা কানের কাছে এনে বলল
– তোমার ঐ…
বুঝতে পারছিলাম এ প্রশংসা আরও ভয়ানক হবে। তাই বুঝে উঠার আগেই আমার কোমল ঠোঁট দিয়ে তার ঠোঁট জোরা আঁকড়ে ধরলাম। কেন ধরেছি জানি না। তবে এ লোভ আমি সামলাতে পারিছিলাম না। ৩০ সেকেন্ডের মতো নীলের ঠোঁটগুলো আমার দখলে ছিল। জোরে কামড়ে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে যাই। নীল চুপ হয়ে বসে আছে। তার ভাবলেষ কী হচ্ছে জানিনা। তবে আমি কী থেকে কী করছি সেটা বুঝে উঠতে পারছি না। কেন এমন করলাম তার কারণটাও আমার অজানা। সারা শরীরটায় কেমন জানি লাগছে। এ অনুভূতির বিচরণ এতদিন কোথায় ছিল? কোথায় ছিল এ ভালোবাসার কোমল আবেগ। আমি চুপ হয়ে আছি। নীলের চোখ আমার দিকে। সে চেয়ারে বসে আছে আর আমি তার থেকে খানিক দূরে কেবিনের মেঝেতে বসে আছি। সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর মেঝেতে আমার পাশে এসেই বসলো। মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল। দেখা গেল মা আর রিদির ঘুম এখনও স্থায়ী। মুখোমুখি নীল আর আমি। তার চোখ আমার চোখ বরাবর আর তার ঠোঁট আমার ঠোঁট বরাবর। সে ঠোঁটটা এগিয়ে দিয়ে আমার কানের কাছে এসে যা বলল তা শুনে আমার শরীরটায় নতুন মাত্রায় রক্তচড়া অনুভূতির জ্বালা ধরে গেল।
চলবে?
(কপি করা নিষেধ)