ডাক্তার সাহেব পর্ব-৪৭
#শারমিন আঁচল নিপা
(নোট-গল্প নিয়ে আপডেট পেতে কমেন্টে দেওয়া লিংকে ঢুকে গ্রূপে জয়েন করুন।)
রুবাইয়ার দিকে ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকাল।
রুবাইয়া ঢুক গিলতে থাকল। মেঝেতে পড়ে থাকা ডায়রিটা পা দিয়ে খাটের নীচ দিকে ঠেলে দিল। অতঃপর মেঝে থেকে কোনোরকম উঠে দাঁড়াল। মায়ের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করল মায়ের সে লম্বা ঘনচুল গুলো এখন তেমন নেই। চোখের নীচে কালি পড়েছে। শরীরের সে আবিজাত্য যেন ক্রমশেই হারিয়ে গেছে। রুবাইয়ার সাথে তার মায়ের বয়সের তফাত খুব বেশি না। ১৭ বছরের বড় ছোট তারা। মায়ের সাথে তার সম্পর্কটাও বন্ধুর মতো হলেও বাবার বিষয়ে মা কখনও মুখ খুলেনি। কেন জানি না মাকে দেখে রুবাইয়ার চোখ কান্নায় ভরে আসছে। ১৬ টা বছর তার মা তার বাবার শূন্যতা অনুভব করেছে তবুও কখনও ব্যথাটা বুঝতে দেয়নি। সবসময় হাসিমুখে সবটা সামলে নিয়েছে। কে জানত তার ভেতরে এত ব্যথা। কেন জানি না ব্যথাকাতুরে মানুষগুলোই বেশি হাসিমাখা মুখ করে থাকে। সিঁথিও আজ রুবাইয়ার দিকে এক নজরে তাকিয়েই আছে। মেয়ের মধ্যে কী চলছে সেটা বুঝার চেষ্টা করছে৷ কিছুক্ষণ নীরবতা, নিস্তবতা বিরাজ করল। সিঁথি সে নীরবতার ভাঙন ধরিয়ে বলল
– দেখেশুনে চলবে তো। এভাবে কেউ চলাফেরা করে? যেকোনো মুহুর্তে অঘটন ঘটতে পারত। তোমার দাদাভাইকে কী রাতের খাবার দিয়েছিলে?
রুবাইয়া জিহ্বায় কামড় দিয়ে বসলো। ডায়রির ঘোরে থাকতে গিয়ে দাদাকে রাতের খাবার দিতে একদম ভুলে গেছে সে৷ জিহ্বার কামড় ছেড়ে উত্তর দিল
– মা ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি কিছু মনে করো না প্লিজ। আমি এখনই খাবার দিয়ে আসছি।
বলেই ছুট লাগাল সে। সিঁথি পরনের কাপড়টা পাল্টে নিল৷ হাত মুখটা ধুয়ে চেয়ারটা টেনে বসলো। চেয়ারে বসলেই ঘরের জানালা দিয়ে আকাশটা দেখা যায়। আকাশের দিকে যতবার চোখ যায় ততবার তার নীলের কথা মনে পড়ে। দিনের নীল আকাশটা এত নিয়ম করে সিঁথির দেখা হয় না৷ বলা চলে সময় হয়ে উঠে না। তবে রাতের অন্ধকার আকাশটা সে রোজ দেখে। নীলের মতো যেন এ আকাশটাও অন্ধকারে নিমজ্জিত। একটা সময় নীলের কথা মনে হয়ে চোখে অজোরে পানি পড়ত, বুকে অসহনীয় ব্যথা হত, যন্ত্রণায় হাত পা জ্বলত। এখন আর এসব হয় না শুধু একটু দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়। সময়ের সাথে সাথে সব যন্ত্রণাও মলিন, নির্জীব হয়ে যায়।
সিঁথির ভাবনার সূতোয় টান পড়ল রুবাইয়ার কণ্ঠস্বরে।
– মা দাদাভাই নিজেই খেয়ে নিয়েছে। এখন ঘুমুচ্ছে। নানা,নানু এসেছিল। দেরি হবে তাই তুমি আসার আগেই চলে গেছে৷ সিক্ত,রিক্ত আর সোহা কল দিয়েছিল। ওরা নাকি তিনমাস পর বাংলাদেশে আসবে৷
সিক্ত,রিক্ত,সোহা হলো সুনীল আর মিহুর ছেলে মেয়ে। সিঁথি চেয়ার থেকে উঠে মুচকি হেসে বলল
– বাহ ভালো তো। তুমি খাওয়া দাওয়া করেছো?
– তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
– কতবার বলেছি আমার জন্য আপেক্ষা না করে খেয়ে নিতে। আমার তো রোগীর চাপ থাকে কখন আসি সেটার কী নিশ্চয়তা আছে। আর এমন করবে না।
রুবাইয়া মায়ের কাছে এসে জড়িয়ে ধরে গালে কয়েকটা চুমু দিয়ে বলল
– বাদ দাও তো মা। চলো খেতে বসি।
সিঁথির যন্ত্রণার আগুনে এক ফোঁটা বৃষ্টি হলো রুবাইয়ার স্নিগ্ধ স্পর্শ।
দুজনেই খেতে বসলো । রুবাইয়া লুকমা তুলতে তুলতে বলল
– মা একটা কথা জিজ্ঞেস করব।
– বলো কী?
– বাবা কোথায়? সে কী বেঁচে আছে? আমি না চাইতেও তোমার ব্যাক্তিগত ডায়রিটা পড়ে ফেলেছি। সরি মা। আমার মনটা ব্যকুল হয়ে আছে বাবার কথা শুনার জন্য। ষোলোটা বছর তুমি বাবাকে ছাড়া কাটিয়েছো। বাবাকে লেখা তোমার চিঠিগুলো পড়ার পর থেকে মনে হচ্ছে বাবা বেঁচে আছে। হয়তো বাবা তোমার সাথে চরম খারাপ কিছু করেছে। মা আমি সবটা জানতে চাই।
রুবাইয়ার কথা শুনে সিঁথি তার রাগটা দমাতে পারল না। এঁটো হাত দিয়েই রুবাইয়ার গালে চড় কষিয়ে দিল।
– রুবু তুমি খুব খারাপ একটা কাজ করেছো ডায়রিটা অনুমতি ছাড়া পড়ে। এত সাহস তুমি কোথায় পেলে?
রুবাইয়াও বেশ উদ্ধত হয়ে গেল৷ উদ্ধত গলায় বলে উঠল
– আমি শুধু জানতে চাই বাবা কোথায়? বাবা যদি মরে যায় তাহলে বাবার নামের পাশে মরহুম বসাও। আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করে আমার বাবা কী করে। আমি তাদের উত্তর দিতে পারি না। বাবা মৃত নাকি বেঁচে আছে সেটাই তো আমি জানি না৷ মা যথেষ্ঠ বড় আমি হয়েছি। একটু হলেও জানার অধিকার আমার আছে বাবা কোথায়।
সিঁথির রাগটা আরও বেড়ে গেল। চেয়ারটা টেনে উঠে দাঁড়াল। রুবাইয়ার গালে বেশ জোরে এলোপাতারি চড় লাগাতে লাগল৷ ঘটনার বেগতিক অবস্থা টের পেয়ে নীলের বাবা সেখানে এসে রুবাইয়াকে টেনে উনার ঘরে নিয়ে গেলেন। রুবাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন
– তোমার মায়ের জখম অনেকটা তাজা এখনও। এটাকে কেন খুঁচিয়ে জখমটা আরও তাজা করতে গেলে দাদাভাই।
রুবাইয়ার তাতেও মনটা সিক্ত হলো না। হাউমাউ করে কেঁদে বলল
– আমি শুধু জানতে চাই বাবা কোথায়। দাদাভাই তুমি বলো বাবা কোথায়। আমার বাবা কী মারা গেছে? আমার দাদুমনির মৃত্যুর জন্য কী বাবা দায়ী? আমার মায়ের এ অবস্থার জন্য কে দায়ী?
নীলের বাবা চুপ হয়ে গেল। কোনো উত্তরেই তার জানা নেই। কী উত্তর দিবে রুবাইয়াকে সেটাই বুঝতে পারছেন না উনি। তাই নীরব হয়ে রইলেন।
সিঁথি ঘরে এসে কাঁদতে লাগল। সেদিনের নীলের কথাগুলো মনে পড়তে লাগল। ফোন কলটা ধরতেই নীল বলে উঠেছিল
– সিঁথি আমার মনে হচ্ছে আমি আর ভালো থাকব না। আমার পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। কোনো অন্যায় তোমাদের সাথে করে থাকলে ক্ষমা করে দিও। ঘটনার বাইরেও কিছু ঘটনা থাকে যা বলা খুব কঠিন। আমি তোমাকে ঠকাতে চাইনি, আমাকে ক্ষমা করে দিও।
নীলের কথাগুলো এখনও সিঁথির কানে বাজছে। বিশেষ করে শেষ কথাটা “আমি তোমাকে ঠকাতে চাইনি, আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
কলটা তখনই কেটে গেল। সিঁথির মনে তখন ভাবনার তোলপার চলতেছিল। কী হয়েছে নীলের ভেবেই যেন সিঁথি অস্থির হয়ে যাচ্ছিল। এরপরের ঘটনাটা মনে হলে সিঁথির গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। ভুল করেও সে ঘটনাটা পুনরায় মনে করতে চায় না। অতীতের কালো স্মৃতি থেকে নিজেকে বের করে আনতে চায় বরাবরেই। নীলের বাবার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সিঁথি। নিজেকে কিছুটা সামলে নিল।
– আমার মনে হয় রুবাইয়াকে সবটা বলে দেওয়া উচিত।
সিঁথি গলাটা ভার করে জবাব দিল
– সে সহ্য করতে পারবে না বাবা। লড়াইটা শেষ হতে দিন। আর তো কিছু সময় বাকি। জীবনের এই পর্যায়ে এসে হেরে গেলে তো চলবে না বাবা।
– দেখো মা, রুবাইয়ার বয়সটা কাঁচা। এসময় যা ইচ্ছা করে ফেলতে পারে। আমার মনে হয় বলে দেওয়ায় উচিত।
– বাবা একটু চিন্তা করার সময় দিন। আমি বিষয়টা নিয়ে ভাবছি। আজ বেশ ক্লান্ত। রুবুকে একটু বুঝান আপনি।
– সে তো আমি করছি রে মা।
কথাটা বলতে বলতেই তিনি রুম থেকে অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে বের হলেন। সিঁথি বসা থেকে উঠে ড্রয়ার টা খুললো। ডায়রিটা খুঁজতে লাগল। অবশেষে খাটের তলায় ডায়রিটা পেয়ে আবার লিখতে শুরু করল। অনেকদিন যাবত লিখে না ডায়রি। আজকে আবার বসলো।
#প্রিয় ডাক্তার সাহেব
এ সময়টায় বড্ড অসহায় আমি। এ কোন পরীক্ষায় ফেলে গেলে তুমি। আমি রুবুকে কী বলব বলো তো? আমি তো তোমাকে ছোট করতে চাই না। চাই না তোমার বিষয়ে নেতিবাচক কোনো ধারণা রুবুর মনে আসুক। আমি যে তোমায় বড্ড ভালোবাসি। এ ভালোবাসার মাপকাঠি কতটা প্রখর তোমাকে বুঝাতে পারব না। বাবা, মা কত বার বলেছিল আবার বিয়ে করে নতুন করে সংসার করতে। জানো আমি পারিনি। আমি তোমার অনিশ্চিত আপেক্ষায় ১৬ টা বছর পার করেছি। লড়াই করেছি। নিজের যৌবনটা আমি ভালোবাসায় উৎসর্গ করে দিয়েছি। এত বছর পর আমি চাচ্ছি না তোমাকে এভাবে প্রকাশ করতে। আমি চাই সত্যিটা সামনে আসুক, কোনো সত্যকে আড়াল করে মিথ্যাটা যেন সামনে না আসে। তোমার জন্য এক জনম কেন সারা জনম আমি অপেক্ষা করে পার করে দিতে পারব। শুধু শেষ বারের মতো মরার আগে যেন আল্লাহ তোমাকে আমার সন্নিকটে ফিরিয়ে দেন এটাই চাই। এই ভেতরের হাহাকার নিভাতে তোমার শীতল স্পর্শ প্রয়োজন। খুব বেশি প্রয়োজন। আজকাল পাগলামি করা হয়ে উঠে না। ষোলোটা বছর আমি পাগলামি করতে ভুলে গেছি। কপালে তোমার সিক্ত ঠোঁটের স্পর্শ কল্পনা করেই যুগ পার করেছি। তবুও আমার আকুতি তোমাকে একটু কাছে পাবার। মরণের আগে তোমার সান্নিধ্যে মরার। জানি না সৃষ্টিকর্তা এই ইচ্ছা কবে পূরণ করবেন। ষোলোটা বছরে অনেক বার আশার আলো দেখেও নিভে গেছে। এবারও সে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি তবে নিভে যায় কি’না সেই ভয়ে আছি। প্রিয় ভালোবাসি তোমায়। রিদি মারা গেছে বছরখানেক হলো। মেয়েটা শেষ সুখ আর পেল না। ভালোবাসার মানুষটাকে কাকুতি মিনতি করেও পেল না। আমি চাই না রিদির মতো অবস্থা আমার হোক। আমি শুধু আমার শেষ জনমে আমার ডাক্তার সাহেবকে চাই।
ইতি তোমার পাগলি বুড়ি।
ডায়রি বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়েই কাঁদতে লাগল। পরিস্থিতি কতটা বদলে দেয় সবাইকে সেটাই শুধু ভাবছে সে। নীলকে ছাড়া সে একটা মুহুর্ত চিন্তা করতে পারত না আর আজকে নীলকে ছাড়াই তার প্রতিটা মুহুর্ত পার করতে হচ্ছে। নিষ্ঠুর এ সময় কবে শেষ হবে সিঁথির জানা নেই। শুধু একটাই চাওয়া শেষ জনমটা নীলকে নিয়ে সে পার করবে।
চোখ দিয়ে গড়গড়িয়ে পানি পড়ছে তার। চোখটা বন্ধ করে ফেলল। কারও কোমল হাতের স্পর্শ অনুভব করল। চোখটা খুলে দেখল রুবাইয়া। সিঁথি নিজেকে সামলে নিল তাড়াতাড়ি। হালকা গলায় বলল
– রাত হয়েছে ঘুমাও।
রুবাইয়া মেঝেতে বসে মায়ের কোলে মাথাটা রেখে বলল
– মা বলো না বাবা কোথায়?
সিঁথি এবার আর রুবাইয়ার কথা উপেক্ষা করতে পারল না। নিজের বুকে পাথর চাপা দিয়ে সিদ্ধান্ত নিল রুবাইয়াকে সে সবটা বলবে এতে যা হওয়ার হোক। সিঁথি রুবাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল
– তোমার বাবার কথা জানতে চাও?
– হ্যাঁ মা জানতে চাই।
সিঁথি নম্র গলায় বলা শুরু করল। ষোলো বছর আগের যে কাহিনিটা সে মনে করতেও চাইনি এখন সেটা সে বর্ণণা করতে যাচ্ছে। এ বর্ণণা রুবাইয়ার মনে কী প্রভাব ফেলবে সিঁথি জানে না।
চলবে?
কপি করা নিষেধ