#ডাক্তার সাহেব পর্ব-৩৬
#শারমিন আঁচল নিপা
লজ্জায় যেন দুজনের মাথায় কাটা যাচ্ছিল। সাজেদা খালা সুনীলকে নীল ভেবে মিহুর সাথে দেখে বড় কান্ড বাঁধিয়ে দিয়েছেন। মাকে নালিশ করা হয়ে গেছে নীল চরিত্রহীন মিহুর সাথে যা’তা করছে। যা’তা বলতে উনি বুঝিয়েছেন মিহুর চুল ধরে খামখেয়ালে বশত পেছন থেকে টেনে ধরেছেন। এদিকে মা নীলের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মথা নুইয়ে ফেলল। এত বিভ্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে সেটা হয়তো মায়ের বোধগম্য হয়নি। ঘটনার সারসংক্ষেপ এখানেই শেষ হলে পারত তবে বাবা এসে ঘটনার ছাই ছাপা আগুনটায় আরও জোরে ফু মারল। সাজেদা খালার ভুল ভেঙেছে যে মিহুকে যে ধরেছে সে নীল না সুনীল। তবে বাবা আসার পর সাজেদা খালা ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে লাগলেন
– ভাইজান আপনার মেয়ের জামাইয়ের ভাইয়ের চরিত্র ভালো না। অল্প বয়সী মেয়ে পেয়ে ফষ্টি নষ্টি শুরু করে দিয়েছে।
আরও নানান কথার বাহার। মনে হচ্ছে তিনি ট্রেনের বগির মতো একটা কথার সাথে আরেকটা কথা তাল মিলিয়ে জুড়ে দিয়ে ঝিকঝিক করে বলে যাচ্ছেন সব। সব হয়তো বর্ণণা করাও দুষ্কর। বাবা কী বলবে বুঝতে পারছে না। মিহু আর সুনীলের অবস্থা সমীচীন সেটা তাদের মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। সুনীল মাথাটা নুইয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। মিহুর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে৷ বাবা চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ কী বলবে বুঝার অবকাশ উনার হয়ে উঠছে না। মিহুর কান্না বলে দিচ্ছে মিহু বেশ অনিশ্চয়তায় আছে৷ কারণ সাজেদা খালা এ বাড়ি ও বাড়ি বলে বেড়াবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। মিহুর যা মান সম্মান ছিল সেটাও অবশিষ্ট আর রইবে না সে খুব ভালোই টের পাচ্ছে। মিহু মেয়ে হিসেবে খুব বুঝদার। তার আবেগের চেয়ে বিবেক কাজ করে বেশি। আমাদের ক্লাসের মধ্যে মিহুর বাবায় আর্থিকভাবে সবচেয়ে সচ্ছল। মিহুর সৌন্দর্য কোনো অংশে কম না। মিহুর সৌন্দর্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তার গালের টোল। এ সমস্যা বা পরিস্থিতি সে কীভাবে সামাল দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। নীরবতা বিরাজ করছে এখন। নীরবতা কাটিয়ে বাবা সুনীলের দিকে তাকিয়ে বললেন
– তুমি কী মিহুকে পছন্দ করো? নাকি যা হয়েছে সেটা ভুলবশত।
সুনীল মাথা নুইয়েই জবাব দিল
– জি আংকেল ওর সাথে পরিচয় মাত্র ২০ দিনের তবে ওকে ভালো লাগে আমার। যা হয়েছে সেটা ইচ্ছাকৃতই।
বাবা এবার মিহুর দিকে তাকিয়ে স্থিত গলায় বলল
– তুমি কী সুনীলকে পছন্দ করো মা? নাকি সুনীল যা করেছে তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে? এটা কী কোনো মজা ছিল নাকি পছন্দ করো বলেই এমনটা হয়েছে?
মিহুও মাথা নুইয়ে বেশ কন্না গলায় ফুপাতে ফুপাতে বলল
– আংকেল যা হয়েছে আমার সম্মতিতেই। আমাকে মাফ করে দেবেন। বাবা, মা জানলে আমাকে খুন করে ফেলবে।
বাবা হালকা হেসে বললেন
– সাজেদা তুমি তোমার কাজে যাও। বাকি কী করা লাগবে সেটা আমি বুঝতেছি। বিষয়টা যদি অন্য কারও কানে গিয়ে রটে তোমার বারোটা আমি বাজাব। আর সিঁথির মা নীলের মাকে তুমি বিষয়টা খুলে বলো আমি নীলের বাবাকে বলছি। এক মেয়ের বিয়ে দিতে পেরেছি আরেক মেয়েরও দিব।
বলেই বাবা হাসতে হাসতে ঘরে চলে গেলেন। মা সুনীলের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বলল
– যা হয়েছে সেটার জন্য মনে কিছু নিও না। গ্রামে এগুলো বেশ স্বাভাবিক বিষয়। তুমি বিদেশে থেকে বড় হয়েছো তাই হয়তো তোমার কাছে যেটা সাধারণ সেটা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক। যাইহোক সিঁথির বাবা কী চাচ্ছে সেটা কী তুমি বুঝতে পেরেছো? তাতে তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?
সুনীল শুধু মাথা নেড়ে না বলল। নীল সুনীলের দিকে তাকিয়ে কিছুটা ঝাড়ি দিয়ে বলল
– এত দূর চলে গেছিস আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না?
মা নীলকে থামিয়ে দিয়ে কিছুটা খুঁচা মেরে বলে উঠল
– তোমার ভাই তো…..তোমার মতোই হয়েছে। তুমি যখন সিঁথির সাথে কথা বলতে তখন কী তোমার ভাইকে কিছু বলেছিলে? তখন তো বলোনি বলেছো পরে। এখন নিজের ভাইকে হুংকার দিয়ে লাভ কী?
যাইহোক যা হয়েছে তো হয়েছে। বিয়ে খাওয়ার প্রস্তুতি নাও। আর সিঁথি এবার তো তুই মিহুকেও একবারের জন্য পেয়ে গেলি। এখন দুই জা মিলে সারাদিন যত আলাপ আছে করিস। আর ছেলে মেয়ে বিয়ে দিয়েও উদ্ধার করিস৷
বলেই মা রুমের দিকে গেলেন। আমাদের বিয়েটা বেশ ভালোভাবে হলেও মা এখনও সবকিছু মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। মায়ের ধারণা আমি সুখী হব না। এদিকে নীল আমার হাতে চিমটি কেটে বলল
– তোমার মা সুযোগ পেলে ছাড়ে না। ঠিকেই কথা শুনিয়ে দিল।
আমি বিড়বিড় করে উত্তর দিলাম
– মায়ের কথায় এত ধরো না তো। সব ঠিক হয়ে যাবে। আপাতত বড় আপাদের কল দিয়ে সবটা জানিয়ে রাখি। আপারা ভালো বুঝবেন এ বিষয়ে।
নীল পুনরায় হাতে চিমটি কেটে বললেন
– আজকাল খুব বুঝদার হয়ে গিয়েছো। পাগলামি না করলে কিন্তু আরেকটা বিয়ে করব।
– রুমে চলো ঘাড় মটকিয়ে পাগলামি করছি। তখন উঝা এনেও পাগলামির ভূত নামাতে পারবে না।
নীল হাতটা আরও চেপে ধরে টানতে টানতে রুমে নিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিল। বাইরে মিহু আর সুনীল কী করছে জানা নেই। নীল দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বলল
– একটা কোকাকোলা আনার দরকার আর কয়েকটা আঙ্গুর ফল। কোকাকোলাকে মদ ভেবে খাব আর আঙ্গুরের থোকা হাতে নিয়ে উপরে তুলে হা করে খাব। তারপর আধ কাঁত হয়ে শুয়ে তোমাকে বলব নাচ বাসন্তী নাচ।
নীলের এ কথাটা শুনে রাগে গা টা জ্বলে গেল আমার। তার চুলগুলো টেনে ধরে বললাম
– চুপচাপ হয়ে যাচ্ছি বলে ভেবো না পাগলামি করতে ভুলে গেছি। চুল সব ছিড়ে দিব এসব হাবিজাবি কথা বললে।
– আরে বাবা এমনিই সামনে চুল কম। এভাবে টানলে তো আরও কমে যাবে। ছাড়ো তো। না ছাড়লে চুল সব ছিড়ে টাকলা হয়ে যাব তো। তখন সবাই তোমাকে টাকলার বউ ডাকবে।
– ডাকুক টাকলার বউ। তোমার চুল ছিড়ে আমি তুলোর মতো উড়াব।
নীল আমাকে জড়িয়ে ধরল। জোরে চেপে তার বুকের সাথে মিশিয়ে বলল
– এ আগুনটায় মিস করতেছিলাম। তোমাকে পাগলামি না করলে মানায় না। তোমার ইমম্যাচুরিটিই আমার ভীষণ ভালো লাগে।
বলেই কপালে ঠোঁটগুলো ছুইয়ে দিয়ে বলল
– যাও এবার বড় আপাদের কল দিয়ে সবটা জানাও।
অতঃপর বড় আপাদের কল দিয়ে সবটা জানানো হলো। বাবা মিহুর পরিবারের সাথে কথা বলল। সব মিলিয়ে দুই পরিবার রাজি। আজকেই বিয়ের কাজ সেড়ে ফেলবে এমন সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছে। আমি তো মনে মনে মহাখুশি।
সারাদিন এসব করতে করতেই সময় কেটে গেল। নীল অবশ্য অফিস থেকে ছুটি পায়নি কারণ বিয়ের ব্যপারটা কাউকে জানানো হয়নি । তাই না চাইতেও বাধ্য হয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছে তার। কী করে যেন সারাদিনটা কর্ম ব্যস্তময়তায় সময় পার হয়ে গেল। মিহু বেশ খুশি সে সাথে সুনীলও। নিজের ভালোবাসা পাবার মধ্যে সত্যিই একটা স্বস্তি আছে। আমাদের বাড়িতেই তাদের বিয়ে হবে আজ৷ সাঁঝের আকাশে রক্তিম সূর্য ডুবার মধ্য দিয়ে দিনের অবসান ঘটল।
বিয়ের সব আয়োজন করা শেষ হয়ে গেল তাৎক্ষণিক ভাবে। এর মধ্যেই এক অচেনা রমণীর আগমণ ঘটল। তাকে উপস্থিত কেউ চিনে না। জিজ্ঞেস করা হলে জানায় সে অনীলের কাছে এসেছে অনীলের সাথে বেশ অনেকদিনের সম্পর্ক তার। কথাটা শুনে আমার বুকটা ছেদ করে উঠল অনীল এত বড় ধোঁকা আমাকে দিতে পারল এটা ভেবে । তাহলে কী মায়ের কথায় ঠিক? কিন্তু মেয়েটা অনীলের নাম বলছে কিন্তু বর্নণা দিচ্ছে সুনীলের। এখন বেশ গোলক ধাঁধায় পড়ে গিয়েছি মেয়েটা কী অনীলকে ভালোবাসে নাকি সুনীলকে। প্রেম কী অনীলের সাথে করেছে নাকি সুনীলের সাথে।
এদিকে অনীল, সুনীল দুজনই দাবি জানাচ্ছে তারা মেয়েটাকে চিনে না। তাহলে মেয়েটা তাদের কীভাবে চিনে? আমার বুক কাঁপতে লাগল। আমি কিছুটা রাগ গলায় জিজ্ঞেস করলাম
– আপনি দয়াকরে ক্লিয়ার করে বলুন আপনার কার সাথে স্পম্পর্ক ছিল অনীল নাকি সুনীল? আপনার কথা তো ক্লিয়ার না। আপনার কথায় ইঙ্গিত দিচ্ছে আপনার দুজনের সাথেই প্রেম ছিল। আপনি প্লিজ স্পষ্ট করে বলুন আপনি কার প্রেমিকা অনীল নাকি সুনীল?
এরপর মেয়েটা যা বলল তাতে আরও গোলক ধাঁধায় পরে গেলাম সে সাথে বিশ্বাসের জায়গাটায় যেন চিড় ধরতে শুরু করল।
চলবে?
কপি করা নিষেধ