#ডাক্তার সাহেব পর্ব-২৫
#শারমিন আঁচল নিপা
নীলের এ ডায়লগ কতটা রোমান্টিক ছিল জানি না তবে এ রোমান্টিকতরা মুর্ছনায় সবার হার্ট এটাক হবার উপক্রম। কারণ সেটা রোমান্টিক ডায়লগ ছিল নাকি কোনো জোরালো ভাষণ ছিল কেউ এই সেটার সঠিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে পারছে না। নীলের জোরালো কন্ঠ যেন কান ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে।
– ভালোবাসলে ভালোবাসা দিতে হবে। কথা দিলে কথা রাখতে হবে৷ যদি কথার বরখেলাপ হয় তাহলে খুব বেশি না কয়েকটা ঘুষি দিয়ে নাক ফাটিয়ে মুখ বাঁকিয়ে দিব তাহলে দ্বিতীয় কোনো যুবক সহজে পছন্দ করতে পারবে না। সব সময় সব কাজে পাশে থাকতে হবে৷ যদি তা না পারো তাহলে পা টা মুচরে দিয়ে ভেঙে লোলা করে আমার পাশে বসিয়ে রাখব। এ হাত শুধু আমার হাত ধরবে। আমার হাত ছাড়া অন্য কারও হাত ধরতে চাইলে হাত দুটো আলগা করে দাফন করে দিব৷ এ চোখ শুধু আমার দিকে তাকাবে..
বাকি কথা বলার আগেই আমি তার মুখ চেপে ধরলাম। কারণ যে হারে সে আমাকে লোলা,ল্যাংরা বানিয়ে দিচ্ছে এখন নিশ্চিত কানাও বানিয়ে দিবে। মুখটা চেপে ধরে বললাম
– হয়েছে… আর লাগবে না। এখন আমি আর কানা হতে চাই না। আমি আমার জীবনে এত রোমান্টিক ডায়লগ শুনিনি। বেশি কোনো কিছুই হজম হয় না। তাই এত রোমান্টিকতাও হজম হচ্ছে না।
এদিকে বাকি সবাই বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে অট্টহাসি দিয়ে নীরবতা ভেঙে হাসির শব্দের বিস্ফোরণ ঘটাল। রনক ভাইয়া হাসতে হাসতে বলল
– তোর স্বভাব এখনও ঠিক হলো না। কলেজ জীবনে যেমন ছিলি তেমনই রয়ে গেলি।
নীল তার মুখে চেপে ধরা আমার হাতটা ছাড়িয়ে দিয়ে রনক ভাইকে বলতে লাগল
– তোর কী আর এসব হজম হবে? তুই রোমান্টিকতার বুঝিস টা কী?
আমি কিছুটা রেগে রাগ গলায় বলে উঠলাম
– রনক ভাইয়া বুঝে না! তাই না? এমনি এমনি এক যুগ প্রেম করে বিয়ে করেছে। এক যুগ তো ঘাস খেয়ে প্রেম করেছে। নিজের মাথা তো গোবর ঠাসা বাকিদের ও তাই মনে করো।
আমার কথা শুনে তুষা আপু হাসিতে গড়াগড়ি খেয়ে নীলকে বলে উঠল
– বাচ্চা মেয়ে হলেও তোর থেকেও ভালো বুঝে৷ শুধু শুধু মেয়েটার সাথে মজা নিস। বাবারে বাবারে যে ডায়লগ বলা শুরু করেছিলি আমার তো আরেকটু হলে দম আটকে যেত, ভাগ্যিস সিঁথি মুখ চেপে ধরেছিল।
ঘরটায় বেশ হাসিমাখা পরিবেশ বিরাজ করছে। এর মধ্যেই খাবার চলে আসলো। হাসের মাংস, পালং শাক,ডাল,গরুর মাংস, ভর্তার সমাবেশ ও রয়েছে। খাবারের আইটেম দেখে জিভে জল চলে আসলো।
খাওয়ার পর্ব শুরু হলো ১ টা ৪৫ এ। সবাই মিলে বেশ আরাম করেই খাওয়া, দাওয়া শেষ করলাম। ঘড়ির কাটায় বেলা দুটো। হাতে খুব একটা সময় নেই। এ সময় রওনা দিলেও বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা ৫ টা বেজে যাবে। নীলকে সবাই তাড়া দিতে লাগলাম বের হওয়ার জন্য। নীল ও ব্যপারটা বুঝতে পেরে তেমন দেরি করলো না। সবার কাছ থেকে বিদায় এবং কুশল বিনিময় করে সে বাড়ি থেকে বের হলাম। নীলের হাত ধরে আমি হাঁটছি বাকিরা পেছন পেছন। সবাই একে অপরের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। আমি আর নীল শুধু নিস্তব হয়ে একে অপরকে ধরে অনুভূতির সাথে মিশিয়ে নিয়ে হাঁটছি।
ঘড়ির কাঁটায় বিকেল ৩ টা ৩০। নীল আমার বন্ধুদের সি এন জি করে দিল আর আমি নীলের পেছনে বসলাম। কিন্তু বিপাকে পড়লাম নিকাব নিয়ে। হট্টগোল আর ঝামেলায় নিকাব কোথায় পড়েছে বুঝতে পারছি না। মুখ গোমরা করে নীলের দিকে তাকিয়ে বললাম
– আমি নিকাব ছাড়া যাব কী করে?
নীল ভ্রুটা কুঁচকে বলল
– তোমার মতো পাগলের কোথায় কী থাকে সে খেয়াল তো থাকে না। সেলোয়ারকে উড়না বানিয়ে রাখো। উল্টা,জামা,পাজামা পরো, সেক্ষেত্রে নিকাব হারিয়ে যাওয়াটা খুব বেশি কিছু না। যাইহোক কোনোরকম উড়না দিয়ে মুখ প্যাঁচাও আর সানগ্লাস পরে হ্যালমেটটা পরে নাও।
আমি নীলের কথার প্রতিউত্তর দিলাম না। এ কথার হিসাব পরেও নেওয়া যাবে। আমি নিজেকে সামলে হালকা হেসে মুখটা কোনো রকম ঢেকে বাইকে উঠলাম। বাইকটা চলতে লাগল। হালকা হালকা বাতাস গায়ে এসে ঝাঁপটা দিচ্ছে। মাঝ রাস্তায় যেতেই তুমুল বৃষ্টি পড়া শুরু করল। গরম কালের এ এক মসিবত এই দেখা যাবে গা ফাটিয়ে রোদ পড়ছে আবার এই যেন বৃষ্টিতে সব ছেয়ে নিচ্ছে। নীল তাড়ুহুড়ো করে গাড়িটা এক বন্ধ দোকানের ছাউনি তলে নিয়ে দাঁড় করাল। আমি নিশ্চুপ হয়ে মনের খাতায় নীলকে চিঠি লিখছিলাম।
প্রিয় নীল
বাইরে ঝুপঝুপ বৃষ্টি। বৃষ্টি ফোটা গুলো মাটিতে পড়ে ছাতার মতো বলয় হয়ে মিশে যাচ্ছে। ফুটপাতে গড়ে উঠা একটা দোকানের ছাউনিতলে দাঁড়িয়ে আছি নিশ্চুপ তুমি আর আমি। কিয়ৎক্ষণ পর পর তোমার দিকে তাকাচ্ছি আবার চোখ নামিয়ে নিচ্ছি। তাকালেই যেন ঐ নেশা দ্রব্য মিশ্রিত চোখ গুলো আমাকে নেশার ঘোরে নিয়ে যাচ্ছে। এ ঘোর কাটিয়ে উঠার অসীম সাহস আমার নেই। তাই অপলক দৃষ্টিতে না তাকিয়ে ক্ষণে ক্ষণে পলক ফেলে তোমাকে দেখছি। মাঝে মাঝে হেসে কথা বলছি আবার রসাতলে ডুবে যাওয়ার ভয় পাচ্ছি। আমি জানি আমি বড্ড আবেগী। আমার আবেগের বিস্ফোরণ ঘটাতে গিয়ে তোমাকে এখন ইতস্তত করতে একদম চাচ্ছি না। তুমি বৃষ্টি দেখা উপভোগ করছো আর আমি তোমাকে দেখে বৃষ্টি উপভোগ করছি। ক্ষণে ক্ষণে মনে হচ্ছিল অবাধে ঐ বৃষ্টিতে হাত দুটো মেলে ভিজব। আর ঠিক তখন তুমি আমার পাশে এসে আমার হাত ধরবে। চোখে চোখ রাখব আমি। আর তুমি অপলকভাবে তাকাবে আর আমি চোখের সে নেশায় নেশাগ্রস্ত হয়ে তলিয়ে যাব কোনো এক অজানায়। তুমি কী তখন হাত ধরে আমাকে চেনা শহরটায় ফিরিয়ে আনবে নাকি তলিয়ে যেতে দিবে অজানা সে গন্তব্যে।
ইতি তোমার গন্তব্যহীন পথের এক পথিক
চিঠিটা মনের খাতায় লিখে আবদ্ধ করে ফেললাম। নীল আমার চোখের সামনে হাতটা নাড়াতে নাড়াতে বলল
– কী ব্যপার কোথায় হারালে? এত নিশ্চুপ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছো?
– চিঠি লিখছি।
নীল বিস্ময় কন্ঠে বলে উঠল
– মানে?
– মানে চিঠি লিখছি। তোমাকে এত বুঝতে হবে না। চুপ করো তো। বৃষ্টি কমা পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব না। বাসায় চলো। ভিজেই যেতে হবে নাহয় রাত হয়ে যাবে।
নীল বাইরের দিকে তাকিয়ে, দৃষ্টির এ কোণ ও কোণ করল। তারপর হালকা দম ছেড়ে বলল।
– কী আর করা চলো।
বাইকটা চলতে শুরু করল। বৃষ্টির ফোটা গুলো গায়ে এসে পড়ছে। আমি নীলকে জড়িয়ে ধরে বসে আছি। সারা শরীর আমার থরথর করে কাঁপছে ঠান্ডায়। নীল আমার কাঁপুনি অনুভব করে বলল
– কাঁপছো কেন? ঠান্ডা কী বেশি লাগছে?
– একটু লাগছে।
– আজকে কেমন লাগল বললে না তো?
– ভীষণ ভালো।
– তুমি খুশি তো?
– অনেক খুশি।
গাড়িটা চলতে লাগল আপন গতিতে। বৃষ্টি কখন থেমে গেছে খেয়াল নেই। চোখ বন্ধ করে নীলের কাঁধে মাথা রেখেই ছিলাম এতক্ষণ। এর মধ্যেই নীলের কন্ঠ ভেসে আসলো
– গন্তব্যে চলে এসেছি। বাইক থেকে দ্রূত নামো। অলরোডি ৫ টা ৩০ বাজে। নিশ্চয় আন্টি রেগে আছে। যাওয়ার আগে বোরকা খুলে যেও।
নীলের কথায় কিছুটা ভয় মনে বাসা বাঁধল। বেশ তাড়াহুড়ো করে নেমে এক কোণায় গিয়ে কোনোরকম বোরকাটা খুলে নিলাম। সে বাইক নিয়ে চলে গেল। আর আমি ভেজা কাপড় নিয়ে মূল রাস্তায় কাঁপতে কাঁপতে আসলাম। চারদিকে চোখ বুললাম। চোখের সীমানায় কোনো রিকশা দেখতে পেলাম না। তাই হেঁটেই বাসার পথে রওনা দিলাম। পরিবেশটা শীতল সে সাথে বাতাস ও বইছে। ভেজা শরীরে হাঁটলে যেন বাতাসটা গায়ে আরও বেশি লাগে সে সাথে কাঁপুনি দিয়ে শিহরণ জাগে। পা যেন চলছে না। তবুও শক্তি খাটিয়ে সামনের দিকে এগুচ্ছি।
ঘড়ির কাঁটায় ৬ টা ছুঁই ছুইঁ। বাসার দরজায় ধাক্কা দিতেই নানু দরজা খুলল। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই মায়ের সম্মুখীন হলাম। তাড়াহুড়ো করে আমার রুমে যেতে নিলে মা পেছন ডাকল। মায়ের ডাক শুনে ভেজা কাপড় নিয়ে কুঁকড়ে দাঁড়ালাম মায়ের সামনে। কড়া দৃষ্টিতে মা আমার দিকে তাকিয়ে।
– কোথায় গিয়েছিলে? এত দেরি কেন হলো?
– মা একটা এক্সট্রা ক্লাস ছিল। তাই দেরি হয়ে গেছে। দেখতেছই তো ভিজে গেছি। তাই আরও আসতে দেরি হয়েছে।
– সত্যিই কী ক্লাস ছিল?
– তাহলে কী তোমাকে আমি মিথ্যা বলছি?
– তোমার কলেজ প্রিন্সিপাল কল দিয়েছিল। বেশ কয়েকদিন তুমি কলেজে যাও নি তাই খু্ঁজ নিতে, আমিও অসুস্থ তাই কলটা বেশ গুরুত্ব নিয়েই দিয়েছিল। তিনি বললেন আজকে তুমি কলেজে যাওনি। তাহলে কে মিথ্যা বলছে তিনি নাকি তুমি?
আমার গলা শুকিয়ে আসতে শুরু করল মায়ের কথা শুনে। এমনিতে মা সবসময় আমাকে তুই করে বলে। মায়ের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটা দিক হলো মা যখন কোনো বিষয় নিয়ে আমাকে চরম সন্দেহ করে তখন মা আমাকে তুমি নামক সুন্দর সর্বনামে ডাকতে শুরু করে। আমি চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মা পুনরায় বলে উঠল
– কী হলো চুপ কেন? তুমি কী কলেজে গিয়েছিলে নাকি না? উত্তরটা দাও।
চলবে?
(কপি করা নিষেধ)