ডাক্তার সাহেব পর্ব -২২
#শারমিন আঁচল নিপা

ভয়ের মাত্রাটা আরও বেড়ে গেল পুলিশের আচমকা প্রশ্নে। পুলিশ অফিসার প্রশ্নটা নীলের দিকে ছুরে না দিয়ে আমার দিকে প্রশ্নের তীর ছুরে দিলেন।

– এ লোক তোমার কী হয়?

ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। কী পরিচয় দিব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। প্রেমিক পরিচয় তো ভুলেও দেওয়া যাবে না। পরিচয় দেওয়ার মতো সম্পর্কই যেন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বেশ নীরব হয়ে বসে থেকে হুট করে জোরেসোরেই বলে উঠলাম

– উনি আমার আপন মামা হয়। আমার মায়ের ছোট ভাই। আমরা নানু বাড়ি যাচ্ছিলাম। আমি পর্দা করি তো তাই বোরকা নিকাব পরে বের হই। আর বাইকে বোরকা সামলাতে পারিনি তাই পড়ে গিয়েছিলাম। মামাও হয়তো বাইক নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। তাই এক্সিডেন্ট টা হয়। এমনিতে মামা বেশ ভালো বাইক চালায়।

কথা গুলো বলে আমি নীচের দিকে তাকালাম। আড়চোখে নীলের দিকে দৃষ্টি দিলাম। নীল আমার দিকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চেয়ে আছে। সে হয়তো ভাবতেও পারেনি আমি এমন উত্তর দিব। তবে সে কী ভাবলো তা দেখার বিষয় এখন না। এ পুলিশের হেফাজত থেকে বের হওয়াটায় এখন মূখ্য বিষয়। বুদ্ধি করে এ সম্পর্ক বলেছি বলেই জটিল বিষয়টা বেশ সরল হয়ে গেল। পুলিশ অফিসার অন্তত সম্পর্ক নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করবেন না। উনিও বিশ্বাস করে নিলেন আমরা মামা ভাগ্নী। এক তো নীলের সাথে আমার বয়সের ফারাক বেশি৷ তার উপর নীলের মাথায় চুল কম কপালটা বেশ ফাঁকা তাকে দেখলে মামা, মামা একটা ভাব লাগেই। অপরদিকে আমার বয়স কম। তাই পুলিশ অফিসার উত্তরটা বেশ সিরিয়াস ভাবেই নিয়েছেন। তেমন জটিল কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো না। তবে বাইক পুলিশ হেফাজত থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিন হাজার টাকা জরিমানা করা হলো। নীল আর কথা বাড়াল না। যথারিতী নিজের পকেট থেকে পাচশ টাকার ৬ টা নোট বের করে পুলিশের হাতে গুজে দিলেন।

অতঃপর সকল ফরমালিটি শেষ করে আমরা দুজন থানা থেকে বের হলাম। দ্রূত বাইকে উঠলাম। নীল ও বাইকটা স্টার্ট দিয়ে মিনেট পাঁচেকের মধ্যে থানার রাস্তাটা পার করল। মিনেট দশেক বাইকটা বেশ জোর গতিতে চলল। আর আমি নিশ্চুপ হয়ে পেছনে বসে আছি। কোনো কথায় আমার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। মিনেট দশেক পর বাইকের গতি মৃদু হয়ে থেমে গেল। বাইকটাকে এক পাশে দাঁড় করিয়ে আমার হাতের বাহু ধরে নামানো হলো। নীলের কর্কশ গলা আমার কানে এসে ধাক্কা দিল।

– আমি তোমার কোন জন্মের মামা হই? আমাকে তোমার মামা লাগে? কী উত্তর দিয়েছো তুমি? ভাই ও তো বানাতে পারতে? এক লাফে মামা বানাতে গেলে কেন? যা সত্যি তাই বলতে, সমস্যা হলে আমি দেখে নিতাম। তাই বলে আমাকে তোমার মামা বানিয়ে দিবে? তখন ওদের সামনে তো কিছু বলতে পারিনি। এখন মন চাচ্ছে তোমার গালে ঠাটিয়ে একটা চড় দিয়ে দাঁত গুলো ফেলে দিই। সম্পর্কের মানে বুঝো?

নীলের কথা শুনে আমার কপালটা আপনাআপনি ভাঁজ হয়ে গেল। রাগটাও হালকা বাড়ল। কিছুটা জোরগতিতেই বলে উঠলাম

– তো কী বলব প্রেমিক? আমি এটা বলি আর তোমাকে আমাকে ধরে থানায় রেখে দিক তাই না? তারপর বাবা, মা কে খবর দিয়ে এনে ধরিয়ে দেয়া হোক। তোমার নামে নাবালক মেয়ে কিডন্যাপের মামলা হোক। এটাই তো চেয়েছিলে তাই না? একজন ডাক্তারের মাথা যে এত গোবর ঠেসা জানা ছিল না। শুনো সব জায়গায় সব কিছু সত্যি বলে হ্যান্ডেল করা যায় না। এ বিষয়টায় আমার উত্তর যথার্থই ছিল। দেখলে না পুলিশ অফিসার ও আমার সব মিথ্যা স্বীকারোক্তি কত সহজে মেনে নিলেন। অন্য উত্তর দিলে কী, তা মানত? একদম আমার সাথে রাগ দেখাবে না। আমি যা করেছি ভালোর জন্য।

নীল চুপ হয়ে গেল। তবে তার রাগটা এখনও কমেনি সেটা তার লাল বর্ণের চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। রাগটা স্থায়ী রেখেই বলে উঠল

– মেনে নিলাম তোমার উত্তর ঠিক আছে। কিন্তু বাইকে বসে না করা সত্ত্বেও কাতুকুত কেন দিলে? এ অকাজটা না করলে আজকে এ ঘটনার সম্মুখীন হতে হত না। তোমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হওয়াটায় আমার ভুল হয়েছে। দিনটাই মাটি করে দিলে। সহজ বিষয়গুলো তোমার জন্য বারবার জটিল হচ্ছে।

বলেই নীল চুপ হয়ে গেল। রাগে সে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল। তার রাগের মাত্রাটা যে প্রখর সেটা তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কী করব বুঝতে পারছি না। দুকান ধরে নীলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চোখগুলো মিটমিট করে বললাম

– আমি তো এমনই তুমি তো জানো তারপরও রেগে কেন যাও। কান ধরে সরি বলতেছি প্লিজ রাগ করো না। এমন ভুল আর হবে না। তাড়াতাড়ি মাফ করে দাও নাহয় বেশিক্ষণ কান ধরে থাকলে আশেপাশের মানুষের নজরে পড়ব।

নীল আমার দিকে তাকাল। আমার চোখে তার চোখে যেতেই যেন সব রাগ তার থেমে গেল। হালকা হেসে বলল

– এটাও একটা অভিজ্ঞতা হলো। রাগ করিনি কান ছাড়ো। নাহয় মানুষ চিড়িয়াখানার বানর ভেবে ধরে সেখানে নিয়ে যাবে। বাইকে বসো একটা জায়গায় নিয়ে যাব।

– কোথায়?

– আগে ঠিক করে বসো আর স্থির হয়ে থাকো। গেলেই তো দেখতে পারবে। এত অস্থির হওয়ার কিছু হয়নি।

নীলের কথার জবাব দিলাম না। তাকে জড়িয়ে ধরে তার পিঠে মাথাটা ঠেকিয়ে বাইকে বসলাম। চোখটা বন্ধ করে তাকে অনুভব করতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল পরম শান্তির কোনো যাত্রায় আমি এগিয়ে যাচ্ছি। যে যাত্রা শেষ করতে ইচ্ছে করছে না। শুধু যাত্রাপথটা সুন্দর করে এগিয়ে নিতে ইচ্ছা করছে। এ যাত্রার শেষ গন্তব্য যেন অজানা। শত শান্তির মাঝেও যেন একটা অস্থিরতা গ্রাস করে এ যাত্রার শেষ কী হবে এটা ভেবে। চোখের কোণে ক্রমশেই শিশির বিন্দু জমাট বাঁধতে শুরু করল। বিন্দুটা কখন গড়িয়ে পড়বে সে অপেক্ষায়। আর কিছু ভালো লাগছে না। কেন জানি না ভালোলাগার সকল জায়গা নীল দখল করে রেখেছে। চোখটা ভিজে আসছে ক্রমশেই। নীলকে হারানোর কথা চিন্তা করলে নিজেকে বেশ ছন্নছাড়া আর অস্থির লাগে।

বাইকটা থেমে গেল। হালকা ব্রেক কষা হলো। আমি নীলকে আরও জোরে চেপে ধরলাম। নীল বাইকটা থামিয়ে আমার হাত দুটো তার বুকে আরও চেপে ধরে বলল

– ছাড়বে না?

– ইচ্ছা করছে না।

– ছেড়ে একটু বাইক থেকে নামো। চারপাশটা দেখো। এখনও চোখ বন্ধ করে আছো?

– হুম। এভাবে থাকতেই ভালো লাগছে ভীষণ।

– তাহলে ৫ মিনিট এভাবেই থাকো। তবে চোখটা খুলো ভালো লাগবে।

– কোথায় এসেছি আমরা?

– চোখ না খুললে বুঝবে কী করে? আমাকে ছেড়ে চোখটা খুলে দেখো।

নীলের হাতটা চেপে ধরলাম আমিও, চোখটা খুলে চারপাশে তাকালাম। নিরিবিলি একটা জায়গা। দুপুর বেলাতেও বেশ শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে৷ খানিক দূরে নদী বয়ে গেছে। চারপাশটায় হাজারো গাছের মেলা। আশেপাশে কেউ নেই। মনে হচ্ছে না এখন ভর দুপুর। এখানের পরিবেশ জানান দিচ্ছে এখন সবে সকালের সূর্য উঁকি দিয়েছে। চারপশটা বেশ শীতল। বাতাস এসে কানে ভালোবাসার সুর তুলছে। নদীর কলকল পানির শব্দও যেন কানে আসছে। নীলের হাতটা ছেড়ে দিলাম। বাইক থেকে নামলাম। মুগ্ধ নয়নে চারপাশটা অবলোকন করলাম। নীল আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার আমিও তার দিকে তাকালাম। উচ্ছাসিত কন্ঠে বলে উঠলাম

– এ জায়গা তুমি চিনো কী করে? আগে কী কখনও এসেছো? এত সুন্দর জায়গা অথচ কখনও নাম শুনলাম না।

– তোমার পছন্দ হয়েছে?

– ভীষণ…। বললে না তো এ জায়গার সন্ধান কোথায় পেলে তুমি?

– মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে এ জায়গায় চলে আসি। একদিন বাইক দিয়ে শহরে যাচ্ছিলাম জায়গাটায় হুট করে চোখ গেল দূর থেকে। কাছে আসার পর মনে হলো এর চেয়ে সুন্দর জায়গা আর কোনোটায় হতে পারে না। সেদিন মন খারাপ ছিল প্রচন্ড। কেন জানি না এ জায়গায় আসার পর মন খারাপের কারণ টা ফিকে হয়ে যায়। সেদিনের পর থেকে জায়গাটা আমার ভীষণ প্রিয়। যখন মন খারাপ হয়ে যায় তখনই এখানে চলে আসি। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকি তারপর আবার বাসায় চলে যাই। এখন তো রোগীর চাপ, সময় তেমন পাই না তাই অনেকদিন আসা হয়নি। আজকে তোমায় নিয়ে আসলাম।

আমার মুখে ইষৎ হাসি। হালকা গলায় বললাম

– ভালোবাসি তোমায়।

নীল আমার হাতটা ধরে তার বুকে চেপে ধরে জবাব দিল

– তোমাকেও বড্ড ভালোবাসি আমি। চলো সামনে যাওয়া যাক।

নীলের হাতটা ধরে সামনের দিকে এগুতে লাগলাম। এ প্রথম নীলের হাতটা ধরে পাশাপাশি হাঁটছি। এ হাঁটার দৃশ্যটায় আমার স্মৃতিতে প্রিয় স্মৃতির তালিকায় থাকবে। মৃদু বাতাস গায়ে লেপ্টে পড়ছে। নীলের হাতে ক্ষণে ক্ষণে চিমটি কাটছি আবার ক্ষণে ক্ষণে চেপে ধরছি। হাঁটতে হাঁটতে নদীর কিনারায় আসলাম। নিস্তব চারপাশ। নদীর পানির কলকল শব্দ ব্যতীত আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। নদীর পাড়ে দুজনেই বসে পড়লাম। পাশাপাশি এভাবে বসার মধ্যেও ভালোবাসার মাতাল সুখ খুঁজে পাচ্ছিলাম। সময়টা এখানে থমকে গেলে কতই না ভালো হত। কত ভাবনা মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। নীলের মোলায়েম সুর কানে আসলো

– এখানে আমরা বিয়ের পরও আসব। তখন সূর্য ডুবা দেখে যাব। এখন তো একসাথে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকা সম্ভব না। যখন আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে তখন এখানে এসে অর্ধরাত পার করব। তুমি আমার কাঁধে হেলান দিয়ে থাকবে আর আমি তোমার মাথায় মাথা ঠেঁকিয়ে রাখব। তারপর মুগ্ধ নয়নে দুজন আকাশের প্রশস্ত চাঁদটা দেখব। দীর্ঘ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলব। তারপর চোখ বন্ধ করে দুজন দুজনকে অনুভব করব।

নীলের কথাগুলো আমি চোখ বন্ধ করেই শুনছিলাম। এ দৃশ্যটা যেন চোখে ভেসে উঠল। কিছু না বলেই নীলের কাঁধে মাথাটা ফেলে দিলাম। কতক্ষণ মাথা ফেলে চুপ ছিলাম জানি না। নীরবতার রেশ কাটে একটা অচেনা মেয়েলী কন্ঠসুরে।

চলবে?

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here