#জীবনে_তুমি_সেরা_সত্যি
পর্ব – ৮
আকাশী শার্ট আর অফ হোয়াইট গ্যাভার্ডিন প্যান্টে নেহাল ব্যাকব্রাশ করলো চুলগুলো। দিশান… দিশান… গলা তুলে ডাকলো দুইবার। পারফিউম দিতে দিতেই ক্র্যাচের শব্দ শুনতে পেলো৷
– আগের কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়েছো?
– হুম, শাবানার হাতে করে গাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি।
একটু চুপ করে গেছে মনে হচ্ছে দিশান। সেটা কি নেহালের দুষ্টুমীতে নাকি সামিনের বলা দিশানের সম্পর্কে তার আগের মন্তব্যের কারণে তা বোঝা যাচ্ছে না৷ তাকে উৎফুল্ল করতেই নেহাল বললো,
– সামনের জন হয়তো একটু বেশিই সুন্দর, তাও দয়া করে এই অধমের সাথে একটা ছবি কি তোলা যায়? ভবিষ্যতে নাতি-নাতনীকে দেখাতাম আর কি যে দেখ আমাদের ফার্স্ট ডেটিংএর ছবি। তবে কারো যদি মনে হয় সে আমার সাথে বেমানান তবে আমি পাশে থেকে তার সৌন্দর্যকে ম্লান না করি, তার একারই বরং কয়টা ছবি তুলে রাখি,কি আর করা।
নেহালের বলার ঢং-এ দিশানের স্বাভাবিক মুখভঙ্গি ফিরে এলো৷ বললো,
– আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম ছবি তুলতে। কী সর্বনাশ! আর আপনাকেও অতি সুন্দর লাগছে জনাব। আপনাকে এই শার্টটাতে বরাবরই মানায়।
– ও হো! সুন্দরীর প্রশংসা পেয়ে ধন্য। চলেন সেলফি হয়ে যাক।
কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে নেমে এলো ওরা৷ অনেক দেরি হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। নেহাল দ্রুত পৌঁছানোর চেষ্টার পরও চারটা পেরিয়ে গেলো। নেহাল রিসিপশন ডেস্কে ডাক্তারকে দেবার জন্য তার কার্ডটা বের করে দিলো। মিনিট পাঁচেক পরই ফোন এলো।
– তোমার কার্ড দিয়ে গেলো রিসিপশন থেকে, তুমি UK থেকে বাইরে কিভাবে?
– সিরিয়াস রোগী নিয়ে আসছি। তাড়াতাড়ি ভিতরে ডেকে পাঠান। নতুন বউ এর সামনে কিন্তু মান সম্মান থাকবে না বাইরে বেশিক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলে।
– কিন্তু নতুন বউ নিয়ে তো গাইনি ডিপার্টমেন্টে যাবার কথা, এই অধম অর্থোপেডিক্স সার্জন কি করতে পারবে বলো?
– সেটা তো ভিতরে আসলে দেখতে পারবেন।
– একটু অপেক্ষা করো ভাই৷ ভিতরের রোগী দুটো শেষ করেই ডাকছি।
মিনিট দশেক পর ভিতরে ঢুকতে পারলো ওরা। ক্র্যাচ হাতে বউকে দেখে অবাক।
– হায় হায়! কিভাবে হলো?
– সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে। আপনাকেই কিন্তু দেখিয়ে প্লাস্টার করিয়ে নিয়ে গিয়েছে। দশদিন পর নাকি আসতে বলেছেন আবার৷ তাই নিয়ে এলাম।
– তাই নাকি? আরে পরিচয় দিবে না এসে? বিয়ের এত সাজের মাঝে পরে কি আর চেনা যায়?
– আসলে ও জানেই না ভাইয়া যে আপনি আমার এত কাছের। আম্মু সাথে আসলে তো আপনাকে দেখে চিনতো। কিন্তু আমার আব্বু আর ওর আব্বু নিয়ে এসেছিলো দিশানকে। আমি দেশে ফিরে প্রেসক্রিপশন দেখে বললাম ওকে আপনার কথা।
– সেটা তো না জানারই কথা। বিয়ের দিন এত মানুষের সাথে পরিচয় হয়, মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক। তাও হয়তো তোমাদের আপুকে দেখলে চিনতে পারবে, সে ছবি-টবি তুলে গেছে, আপলোড করেছে। সে অনেক মজা করেছে তোমাদের বিয়েতে। বিয়ে থেকে এসে তোমাদের আপু আমাকে হেসে বলছিলো, পাগলটা আবীর- নাতাশার বিয়ের বেলায় ব্যাচমেট বিয়ের ব্যাপারে কত কি বুঝালো। আমি রাজী হচ্ছিলাম না বলে সমবয়সী বিয়ের কত কি সুবিধা, মেন্টালিটি ম্যাচ নিয়ে কত লেকচার ঝাড়লো আর নিজে বিয়ে করলো এত জুনিয়র মেয়েকে। ওদের মেন্টালিটি ম্যাচ করে দারুন জুটি হোক দুটিতে মিলে,নেহাল গাধাটা ভুল প্রমাণিত হোক।
নেহাল প্রমাদ গুণলো। অস্বস্তিকর একই টপিক একই দিনে আবার উঠে এলো!এবারো নেহাল তাড়াতাড়ি কথা ঘুরালো,
– আরে ভাই আবীর – নাতাশার প্রেমের শুরু থেকে সাক্ষী আমি, বিয়ের সময় সাপোর্ট না দিলে ইনসাফ হতো না। কিন্তু আবীর শালা তো ডুমুরের ফুল হয়ে গেছে এখন, দেখা পাওয়া তার ভার।
– তোমার আপুর এখন নাতাশাই সব কাজের সঙ্গী হয়েছে। বাদ দাও, তারপর সুইট সিক্সটিন,সংসার জীবন কেমন যাচ্ছে?
দিশান সন্তুষ্টির হাসি হেসে বললো
– খুবই ভালো৷
– আর বর টা কেমন ভালো শুনি?
দিশান এবার শুধু হেসেই কাজ সারলো।
– শোন, নেহাল এমন একটা ছেলে যাকে ভরসা করা যায়। তোমার জীবনের ভার ওর উপর ছেড়ে দিয়ে তুমি চোখ বন্ধ করে রাখতে পারবে এই ভরসায় যে সে তোমাকে তার নিজের চেয়েও আগলে রাখবে। তুমি তাকে শুধু ভালোবেসে যেও, সে তোমাকে দুনিয়া উজাড় করে দিবে।
এবারও দিশান কথা না বলে শুধু মাথা নেড়ে সায় দিলো।
এক্স- রে করে দেখা গেলো ফুল প্লাস্টারের দরকার নেই। তবে নড়াচড়াতে আগেরটা ঢিলে হয়ে গেছে বলে নতুন করে আবার প্লাস্টার করে দিলো। নীচে নামতে নামতে নেহাল সিদ্ধান্ত নিলো আর মন ভোলানো নয়,দিশানকে তার আগের মনোভাবের সাথে এখনকার আত্মোপলব্ধির পার্থক্যটা বুঝিয়ে পরিস্কার করে নেবে নিজেকে। সম্পর্কের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির জায়গা৷ নেই, তাদের মাঝে থাকবে শুধু স্বচ্ছতা।
– এখন কোথায় যাবেন ? দিশান জানতে চাইলো।
– যাচ্ছি চলো। সেরকম প্ল্যান করে তো বের হইনি। যেদিকে মন চায় আগাই। তোমার কি মত?
– আমার কেন কিছুতেই আপত্তি নেই। যদি মনে করেন বাসায় ফিরে যাবেন, তাও করতে পারেন।
– ঘুরতে বের হয়ে এখনি বাসায় ফিরবো কেন? কিন্তু তোমার কি পায়ে অসুবিধা লাগছে?
– না,আমার কোন কিছুতেই অসুবিধা লাগছে না।
কেমন আনমনা হয়ে বললো দিশান।তারপর মোবাইলটা বের করে সেখানে মনোযোগ দিলো। নেহাল কথা আগানোর জন্য বললো
– কেমন এসেছে আমাদের ছবিগুলো?
সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী গিয়ে প্রশ্ন করলো দিশান,
– আপনার সমবয়সী জীবনসঙ্গী করার অপশন থাকার পরও…..
কথা শেষ করতে দিলো না নেহাল,
– অপশন মানে?আমার কোন রিলেশন ছিলো না তো কখনো।
– কিন্তু তিনা আপু যে আপনাকে পছন্দ করতো সেটা আপনি বুঝতে পারতেন নিশ্চয়ই।কোন একবার আপনার বন্ধুরা যখন বাসায় এসেছে তখন আমি আর নায়রা শুনে ফেলি আপনাদের দুজনকে নিয়ে ক্ষেপাতে। তারপর থেকে তিনা আপু আসলে নায়রা আমাকে ফোন দিতো,আমরা আপনাদের উপর গোয়েন্দাগিরি করতাম৷ আপনি কয়বার চেয়েছেন উনি কয়বার চেয়েছেন এসব।
– তারপর এভাবেই বুঝে গেলে আমি তিনার সাথে রিলেশনশিপে থাকার পরও তোমাকে বিয়ে করে নিলাম আর এতদিনে তোমাকে সেটা জানালামও না, তাই তো?
– আমি কিন্তু রিলেশনশিপের কথা বলিনি। বলেছি একটা সম্পর্ক তো হতে পারতো। আপনি নিজে আগান নি কেন? আমার সাথে বিয়ের কথা উঠার পর নায়রাকে বলেছিলাম কথাটা যে তিনা আপুর কথা ভাইয়া বলছে না কেন?নায়রা নিজেও আসলে আপনার নীরবতাই অবাক হয়েছিলো। একদিনের কথা বলি,ঐদিন তখনো আপনার বন্ধুদের কেউ আসেনি, সবার আগে তিনা আপু এসেছিলো, আমি আর নায়রা তখন টিভি দেখছিলাম, আপনারা দুজন উঠে আপনার রুমে কি যেন একটা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন,আমরা খুব উঁকি-ঝুঁকি মারার চেষ্টা করছিলাম….
দিশানকে থামিয়ে নেহাল বলল,
– যে আমরা ওখানে রোমান্স করছিলাম,হাতে হাত,চোখে চোখ রেখে, নাকি তারচেয়েও বেশি কিছু দেখেছিলে।
– কিছুই করেন নি। ল্যাপটপে কিসব রিপোর্ট দেখাচ্ছিলেন।
– তা হলে তিনার কথা কেন আসছে দিশান? তিনা আমার শুধুই বন্ধু। আমাদের চিন্তাধারা অনেক মিলে,একে অপরের সাথে বোঝাপড়াটা দারুন, তার মানেই হলো আমরা ভালো বন্ধু। তোমার আমার সম্পর্কে ওকে আনার মানে কি?
– ওনাকে আনার মানে হলো এত ভালো বোঝাপড়া হলে সম্পর্কটা আগালেন না কেন? আমি কেন?
– প্রশ্নটা স্পেসিফিক করো? কি জানতে চাচ্ছো? তিনাকে কেন বিয়ে করিনি নাকি জানতে চাচ্ছো তোমাকে কেন করেছি?
– তিনা আপুকে কেন করেন নি?
– ওকে,তিনা এমন একজন যার সাথে আমার খুব ভালো খাপ খায়। তোমার শুনতে হয়তো খারাপ লাগবে কিন্তু সত্যিটা হলো আমি আমার স্ত্রীর মাঝে যেসব কোয়ালিটি খুঁজতাম তার সব তিনার আছে। কিন্তু শুধু ওর সাথে আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো বলেই বিয়ে করা যায় না। বিয়ে দুইটা পরিবারের ব্যাপার। তোমার পরিবার আর আমার পরিবার কতটা কম্ফোর্টেবল একে অপরের সাথে। তুমি নিজেও জানো না তুমি আম্মুর কতটা আদরের যেখানে তিনাকে মানাতে হলে আমাকে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হতো। এত কিছুর পরও আসলে বিয়ের পর তিনা কতটা মানিয়ে নিতে পারতো জানি না কারণ ও আমাদের চেয়ে অনেকটাই হাই সোসাইটির মানুষ। এসব নিয়ে অশান্তি হতে পারতো। এসবের জন্য আমি কখনোই তিনাকে নিয়ে আগাইনি। তবে শুধু আমার কথা ভাবলে তিনা পারফেক্ট ম্যাচ হতো নিঃসন্দেহে।
দিশান আর কিছু বললো না। ওর মনে কাঁটা হয়ে গেঁথে গেলো কথাটা।
চলবে…..