#জীবনে_তুমি_সেরা_সত্যি

পর্ব – ৩
আস্তে আস্তে নেহালের প্রবাসী জীবনে সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেলো। তবে নেহালের আম্মু এখনো নেহালের পছন্দের কোন খাবার সামনে নিয়ে চোখ মুছেন,ছেলেটা তার কতদূরে! দিশান মোটামুটি পাকাপোক্তভাবেই এখন শ্বশুরবাড়ি থাকে। নেহালের আম্মু ছাড়তে চায়না ওকে, নেহালটা দূরে, দিশানটা কাছে থাকলে শান্তি লাগে আবার নায়রার সাথে মিলে দুটিতে বাসা এমন মাতিয়ে রাখে মন খারাপটাও কম হয়। নেহাল নিয়ম করে প্রতিদিন সকালে ভিডিওকল করে, সবার সাথে কথা বলে , গল্প করে। দিশান সামনে থাকলে কি খবর টাইপের কথাবার্তা তার সাথেও হয়। তবে গত তিনদিন ধরে তেমন কথার সুযোগ হচ্ছে না, জরুরি কনফারেন্সে আছে, একবার আম্মুর সাথে অল্প করে কথা বলেই কাজে ফিরে যেতে হয়। আজ কনফারেন্স শেষ হওয়ায় বেশ গল্পের মুডে ফোন দিলো, মায়ের সাথে গল্প করে নায়রাকে চাইলো,নায়রা পড়ার টেবিলে ছিলো,আম্মু তাকে ফোন ধরিয়ে দিয়ে এলো, কনফারেন্সে এক লোকের কান্ড রসিয়ে রসিয়ে নেহাল বলছিলো আর দুই ভাইবোন খুব হাসছিলো। হঠাৎ নেহালের চোখ পড়লো নায়রার চেয়ারে হেলান দিয়ে রাখা ক্র্যাচের উপর।
-নায়রু,তোর পাশে ক্র্যাচ রাখা কেন?
-ও,দিশান ফেলে গেছে। ও এখন একটাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এতক্ষণ একসাথেই পড়ছিলাম, মাত্রই তোদের রুমে গেলো।
-ওয়েট ওয়েট,মানেটা বুঝলাম না। দিশান…ক্র্যাচ…মানে কি?কি হইছে ওর?
-ও তোকে বলে নাই?
অপ্রস্তুত হয়ে গেলো নেহাল। আসলে একবারও দিশানকে আলাদা করে কল করা হয়নি। কয়বার ম্যাসেজ লিখতে গিয়েও কথা খুঁজে পায়নি। ও এড়িয়ে গিয়ে বলল
-জানলে তোকে জিজ্ঞেস করতাম? আম্মুও তো কিছু বললো না।
-হায় হায়!তোকে বলা নিষেধ ছিলো নাকি?
-নায়রু তুই বলবি?
-ভাবী গত পরশু সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছে। আব্বু আর আঙ্কেল গিয়ে এক্স-রে করিয়ে প্লাস্টার করিয়ে আনছে। ছয় সপ্তাহ রাখতে হবে নাকি এই প্লাস্টার। খুব কষ্ট হচ্ছে রে ওর। এক তো ব্যাথা, তারউপর এত ভারী প্লাস্টার নিয়ে চলা,তার উপর টেস্ট পরীক্ষার চাপ । আন্টি ছুটি নিয়েছিলো এই তিনদিন,ওর সাথেই ছিলো। আজ আবার অফিস জয়েন করতে হইছে উনাকে। আমি আর আম্মু তো আছি,অসুবিধা হবে না। তোমার বউ তো আবার বেশি বুঝনেওয়ালী । কতবার বললাম ভাবীর সাথে আমি শুই,কতই তো আমরা একসাথে ঘুমাইছি আগে, না, তা হবে না,তার জন্য কারো ঘুম নষ্ট হবে এটা সে হতে দিবে না। কাল বলতেছিলাম ওকে, ভাইয়া থাকলে তাকেও কি গেস্টরুমে পাঠায়া দিতি নাকি?
-আমি কি তোর মুখে ভাবি ডাকতে শুনলাম?মনে হয় ভুল শুনছি !
– জ্বি না বিগ ব্রো,একটা মাত্র ভাইয়ের একটা মাত্র বউ,আর কাকে ভাবি ডেকে সাধ মেটাবো বলো। তাই তাকে যথাযথ সম্মানের সাথে ভাবি ডাকি মাঝেমাঝে ।
– তোর থেকে এত সম্মান ওর হজম হলেই হয়!!আচ্ছা শয়তানি বাদ দেই,ওকে ফোনটা দে,কথা বলি।
-ওয়েট দিচ্ছি৷
নায়রা গিয়ে দেখে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে গেছে।
-ভাইয়া রে,ভাবির তো চোখ লেগে গেছে। রাতভর ছটফট করে ঘুমটা ছাড়াছাড়া হয়।ও উঠলে কল করতে বলি তোকে?
-হুম।
ওদের কথায় পিটপিট করে তাকালো দিশান। নায়রা বললো,
-ভাইয়া চাচ্ছিলো তোকে,কথা বলবি?
দিশান ঘুম জড়ানো গলায় বলে,
-কোন ভাইয়া?
-প্রথমত আমার কয়টা ভাই?দ্বিতীয়ত আমার কয়টা ভাই তোকে চাইবে কথা বলার জন্য? মানে তুই ঠিক বলছিস ভাইয়া, এই মহিলা ভাবির সম্মান নেবার জন্য কোনভাবেই এখনও উপযুক্ত না। গাধা একটা।ফোন ধর বেকুব।
বলে ফোনটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। ভ্যাবাচ্যাকা খেলো একটু দিশান। তবু মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
-ভালো আছেন?
-ছিলাম,কিন্তু তোমার পা ভাঙার কথা শুনে খারাপ লাগলো ।
-কি আর করা,ঠিক হয়ে যাবে। কপালে কষ্ট ছিলো।
-ঔষধ খাচ্ছো ঠিকমতো?
-হুম। কবে আসবেন?
বলেই হেসে দিলো,কি গাধার মতো জিজ্ঞেস করেছে। জানেই আপাতত মোটামুটি তিনমাসের জন্য যাওয়া হয়েছে নেহালের। কেবল দেড়মাস হলো।
আসলে কথা খুঁজে না পেয়ে বলে দিয়েছে। নেহালও হেসে উত্তর দিলো,
-এইতো ধরো আগামীকাল না হলেও পরশু!

কিন্তু মিঠা সত্যিটা হলো আসলেই নেহাল পরশু বাংলাদেশ আসছে। বাসায় কিচ্ছুটি জানাবে না। সবাই আনন্দে কি করবে ভাবতেই শিহরিত হচ্ছে সে।

কলিং বেল বাজালে সারপ্রাইজটা নষ্ট হতো,ভাগ্যিস ওর চাবির রিং-এ মেইনডোরের নবের চাবিটা রয়ে গিয়েছিল,সেটা দিয়ে খুলে ঢুকতেই দেখলো দিশান সোফায় বসে প্লাস্টার করা পা টা সেন্টার টেবিলে তুলে দিয়ে পড়াশুনা করছে,দরজার শব্দে তাকাতেই বিশাল চমকে উঠলো ,এমনকি পা এর কথা ভুলে লাফিয়েও উঠতে নিলো,না পেরে ওখান থেকেই চিৎ জুড়লো,
-মা তাত্তাড়ি দেখে যাও,নায়রু দেখ কে এসেছে,দেখ দেখ….
আম্মু কিছু বুঝতে না পেরেও দৌড়ে এলো,নায়রু কলম মুখে নিয়ে বিরক্তি ফুটিয়ে ড্রইং রুমে উঁকি দিলো। দুইজনই পাগলের মতো জড়িয়ে ধরলো। আম্মু তো কেঁদেই দিলো খুশীতে। কপালে চুমু দিচ্ছে ,মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর বলে যাচ্ছে,
-আমার বাবু চলে এসেছে,আমার ছেলেটা মায়ের কাছে এসে গেছে।
আনন্দে আবেগে নেহালেরও চোখ ভিজে গেলো। কী দিন পার করছে প্রবাসে সে। একটু ভালোবাসার স্পর্শের কতটা অভাব যে বোধ হয় প্রতিনিয়ত! দুইহাতে মাকে আর নায়রুকে আঁকড়ে ধরে আছে। কয়েক পা দূরে ক্র্যাচে ভর দিয়ে দিশানও দাঁড়িয়েছে। তার চোখেমুখেও খুশীর ঝিলিক। কিন্তু সেই ঝিলিকটাতে একটু লজ্জার আভা থাকলে বুঝি পূর্ণতা পেতো। চোখে একটা আকুতি থাকতো,একটা গোপন আহ্বান থাকলে তাকে স্ত্রী হিসেবে খুব মানাতো। এখনো তাকে পাশের বাসার দিশানই লাগছে। বউ হিসাবে মনে আসতে আর কত দেরী করবে দিশান?
প্রারম্ভিক রেশ কাটিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো নেহাল ।পুরো অপরিচিত লাগছে তার ঘর। দিশানের পিংক রঙের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন পুরো ঘর জুড়ে। সুন্দর করে গোছানো হলেও মেয়ে মানুষী উপস্থিতি সবখানে। লাগেজটা সাইড করে রেখে বাইরের কাপড়েই গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। খানিকবাদে দিশান আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকলো।
নেহাল হাসতে হাসতে বললো,
-এটা যে আমার রুম আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। পুরা ডলস হাউস টাইপ বানিয়ে ফেলেছো দেখছি!
অপরাধী মুখ নিয়ে দিশান বললো,
-আমি তো আর জানতাম না আপনি আসবেন,জানলে আপনার রুমটাকে আগের চেহারায় ফিরিয়ে নিতাম। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন,আমি এক চুটকিতে সব ঠিক করিয়ে দিচ্ছি।
– তা আগের চেহারায় কিভাবে নিবে?
-এই যে চাদর, পর্দা পাল্টে দিতে বলবো শাবানাকে , আর সাথে ছোটখাটো রি-এরেঞ্জমেন্ট করলেই ঠিক হয়ে যাবে একদম।
– কিন্তু তোমার জিনিসগুলো? ওগুলো তো আগের আমেজ আসতে দিবে না।
-ও এই কথা,সব সরিয়ে গেস্ট রুমে নিয়ে যেতে বলছি তাহলে এক্ষুনি। আপনি এসে সব আপনার মতো পাবেন,ব্যস!
নেহাল এবার শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ালো। ঠিক দিশানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
-রুমটা আমাদের দিশান,তোমার আমার । শুধু আমার মতো কেন হতে হবে? তুমি তো অযাচিতভাবে এই রুমে থাকছো না,তুমি আমার স্ত্রী বলে থাকছো।আমার স্ত্রী হয়ে আমার সকল কিছুর উপর, এই নেহাল চৌধুরীর উপর তোমার পুরোপুরি অধিকার আছে। তোমাকে তো তোমার অধিকার খাটানো জানতে হবে।
এত কঠিন কথা দিশানের মাথায় ঢুকলোই না। সে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। এবার নেহালের মাথায় শয়তানী চাপলো, আরো এক ডোজ বাড়িয়ে বললো ,
– রুমের সাজটা খুব কিউট হয়েছে বুঝলে । মনে হচ্ছে এটা আমাদের মেয়ের রুম হলে মানাবে বেশি! তবে তোমার মন্টুমিয়া বড্ড জায়গা নেয় দুইজনের মাঝে, মেয়ে আসবে কিভাবে কে জানে?!!
দিশান এই কোপে একদম নাজেহাল, চোখ বড় করে হা করে তাকিয়ে আছে নেহালের দিকে, একদম জমে গেছে সে । নেহাল এমন অবস্থায় ওকে রেখেই ওয়াসরুমে চলে গেলো। ঢুকেই নিজের মনে হেসে উঠলো! সে নিশ্চিত বের হয়ে ত্রিসীমানার মাঝে সে দিশানকে পাবে না।

হলোও তাই৷ এক বাসার ভিতরেই রীতিমতো গা ঢাকা দিলো দিশান,একবার সামনে পড়েছিলো অবশ্য,দিশানের মা-বাবা নেহালের আসার খবরে উপরে এসেছিলো একবার তখন তাকে বের হতেই হয়েছিলো কিন্তু নেহালের দিকে ভুলেও তাকায়নি, উল্টো তোতলাচ্ছিলো বেচারি।

সারাদিনের আড্ডা শেষে ঘুমের সময় এসে গেলেও দিশান নায়রার রুমের ভিতরেই ঘাঁটি মেরে পড়তে থাকলো। নায়রা কয়বার তাড়া দিলো শুতে যাবার,সে নড়লো না, এক পর্যায়ে বলেই ফেলল
-আমি না আজ তোর রুমে থাকবো, আমার অনেক পড়া বাকী,রাত জেগে পড়তে হবে, লাইট জ্বালিয়ে রাখলে তোর ভাইয়ের নিশ্চিত অসুবিধা হবে,তারচেয়ে আমরা দুইজন পড়তে পড়তে ঘুমাবো,বেশ হবে!
নায়রা সরু চোখে তাকিয়ে বললো,
-মানেটা বুঝলাম না,তুই রাতে আমার রুমে শুবি?
-সমস্যা কি?আমরা তো কতই একসাথে ঘুমাইছি বল…
-ভাইয়া মানে তোমার জামাই আজ কতদিন পর আসছে আর তুমি এখানে ঘুমাবা? নিজের ভাই বলে আমি এরচেয়ে বেশি আর বলতে চাইছি না।
-আরে ভাইয়ারই তো সমস্যা হবে রাত জেগে লাইট জ্বালিয়ে আমি পড়াশুনা করলে,তাই না বল?আমি তো তার ভালোর জন্যই বলছি৷ এতদিন পর আসছে নিজের বিছানায় আরাম করে ঘুমাক,আমি এখানে শুয়ে যাই,ব্যস!
-তুই রাত জেগে পড়বি?কেন?সারাদিন তো নিজেদের মতো সময়ই পাস নাই তোরা, এখন তোদের একান্ত সময়ে তোর পড়াশোনাই কেন করতে হবে যেখানে তোর পড়া আমার চেয়ে অনেক আগায়া আছে?একটা রাত তুই ভাইয়াকে দিতে পারিস না?দায়িত্ববোধ বলে কিছু নাই তোর?দায়িত্ববোধ থেকে কেন,তোর নিজের ইচ্ছা করছে না তোর জামাইকে কাছে পেতে?আর ভাইয়ার নিজের বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আরাম হবে নাকি তোকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আরাম পাবে সেটা কি আমার তোকে বুঝিয়ে বলার কথা দিশান?
দিশানের আবার কান মাথা গরম হয়ে গেলো। সে রাগে গজগজ করতে বেরিয়ে এলো নায়রার রুম থেকে। -যেমন ভাই তেমন বোন,কি সব বলে!আবার একজন বলে অধিকারবোধ,আরেকজন বলে দায়িত্ববোধ।আমার কোন বোধেরই দরকার নাই। মজায় মজায় বিয়ে করছি,সাজগোজ করছি, অনেক সুন্দর সুন্দর কিছু ছবি আসছে, কাহিনী শেষ। এরা আমাকে খালি পারে উল্টাপাল্টা বলতে!এখন রুমে গিয়ে নেহাল ভাইয়াকে ঘুমন্ত পেলেই হয়!
দুরুদুরু বুকে ক্র্যাচে ভর দিয়ে ঘরে ঢুকলো দিশান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here