#জীবনসঙ্গী_১০
#Chhamina_Begam
লোকাল ট্রেন হলেও এখন ভীড় বেশ কম । অনেক যাত্রী ইতিমধ্যে নেমে গেছে । সেই তুলনায় খুব কম যাত্রী উঠেছে । আদিলাদের কামড়াটায় যাত্রী হাতে গোনা কয়েকজন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই বয়স্ক , কেউ বা পরিবার নিয়ে উঠেছে । দুজন কুড়ি বাইশের ছেলে ফোনে গেম খেলায় ব্যস্ত । মাঝে মাঝে তাদের উচ্চস্বরে কথা বলায় চারপাশের লোকজন বিরক্ত হয়ে তাকাচ্ছে । সেদিকে অবশ্য তাদের কোনো ধ্যান নেই । তারা নিজেদের মধ্যেই ব্যস্ত ।
আজ প্রথমবারের মতো ট্রেন জার্ণিটা অসহ্য লাগছে আদিলার । আগে ট্রেন চলার সময় যে মৃদু দুলুনিটা হয় সেটা বেশ উপভোগ করত সে । কিন্তু আজ কোথাও মন বসছে না । না গান শুনতে ইচ্ছে করছে ,আর না খেতে ভালো লাগছে । চিপসের প্যাকেটটা মুড়িয়ে সাইট ব্যাগটায় ঢুকিয়ে রাখল আদিলা । জানালার বাইরে চোখ রেখে দ্রুত গতিতে হারিয়ে যাওয়া গাছপালা , বাড়িঘর গুলো দেখতে দেখতে মনে হল ঠিক এই ভাবেই ক্ষণিকের জন্য ওর জীবনে এসেছিল রাহাত । আর ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যাই হোক সেও চিরতরে হারিয়ে গেছে । আসলে তাকে সেচ্ছায় হারিয়ে ফেলেছে আদিলা ।
আজ দিনটাও ওরই মতো মনমড়া । সাদা-ধূসর মেঘের আড়ালে সূর্য লুকিয়ে পড়েছে । এই ফেব্রুয়ারিতেও জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস শো শো করে ঢুকে শরীরে হিমের চাদর পড়িয়ে দিচ্ছে । তবুও আদিলার মনে হচ্ছে ভেতরটা শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেছে । ঢকঢক করে অর্ধেক বোতল জল পান করল সে তবুও উশখুশ করতে লাগল । রেহনুমা মেয়েকে অস্থির হতে দেখে বললেন ,
-” মনা , কি হয়েছে ? ঘামছিস কেন ? শরীর ঠিক আছে তোর? ”
মাকে উদ্বিগ্ন দেখে হালকা হাসল আদিলা ।মৃদু স্বরে বলল,
-” আমি ঠিক আছি । আম্মু , আমি একটু ওয়াশরুমে যাচ্ছি ”
রেহনুমাকে একটু চিন্তিত দেখাল । বললেন ,
-“আমি যাই সাথে ? ”
-“না না । দরকার নেই । তুমি বসে থাকো । আমি শুধু একটু চোখে মুখে জল দিয়ে আসি । ”
রেহনুমা কিছু বললেন না । তবে মাথা নাড়িয়ে সায় দিল ।
চোখে মুখে জল দিয়ে অনেকটা ভালো লাগছে আদিলার। চোখ দুটো গরম হয়ে আছে । চোখে জলের ঝাপটা দেওয়ার সময় নোনা জলের ধারাও বয়ে গেছে । বেসিনের আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছির দিকে তাকিয়ে অবাক হয় আদিলা। এত অল্প সময় ও এতটা জড়িয়ে গেল কিভাবে ? কখন রাহাত ওর মনে এত দৃঢ় আসন গেড়ে বসল ? আর বসল যখন আদিলা টের পেল না কেন ? খালাম্মাদের বাড়িতে থাকতেও এই দেয়ানেয়ার খেলাকে শুধু ক্ষনিকের আবেগ বলে মনে হয়েছিল ওর । আর এখন সেই আবেগের জন্যেই কিনা সে চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছে ! আশ্চর্য! বিস্মত হয় আদিলা । এই মুহূর্তে বাবা মায়ের সামনে যাওয়াটা ঠিক হবে না ভেবে আদিলা দরজার কাছে গিয়ে দাড়াবে ঠিক করে । সেখানে গিয়ে আর এক দফা থমকে যায় আদিলা । ওর মনে এই মাত্র কেউ হয়তো ওর হৃদয়ে ইলেকট্রিক শক্ দিল ।মনে মনে’ ইন্নালিল্লাহ’ পড়ে । একবার মনে হয় মনের ভ্রম নয় তো ? হবে হয় তো! না হলে এখানে রাহাত ? সে তো খালাবাড়িতেই ছিল । ওরা যখন বেরচ্ছে তখন রাহাত ঘুমুচ্ছিল । নিজের অলীক কল্পনার বহর দেখে মুচকি হাসে আদিলা । পা ঘুরিয়ে ফেরত আসতে নিলেই এবারের গমগমে কন্ঠস্বরটা ওর ভেতর অবধি কাপিয়ে দেয় ।
-” আবার পালাতে চাইছ ?
থমকে যায় আদিলা ।স্থানুর মতো দাড়িয়ে থাকে চোখে অপার বিস্ময় নিয়ে । চোখের সামনে হেলান দিয়ে গম্ভীর মুখে দাড়িয়ে থাকা রাহাত ওর কল্পনা নয় । এ চরম বাস্তব ! রাহাতের চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আদিলার মনে হয় এই দৃষ্টিতে ঝলসে যাবে সে , পুড়ে ছাই হয়ে যাবে । এখানে দাড়িয়ে থাকা সম্ভব নয় । কিন্তু পা চলছে না । মনে হচ্ছে ফেবিকলের সাথে আটকে গেছে জুতো জোড়া ।
****
আজ রবিবার । সাপ্তাহিক ছুটির দিন । রাহাতের তো এমনিতেই ছুটি চলছে । অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনি ধরে গেছে ওর । সে একটা কেস স্টাডি করছিল । কেসটা কিছুতেই পরিষ্কার হচ্ছে না । কড়া করে এক মগ কফি দরকার । রাহাত ঘরে থেকেই হাক ছাড়ল তিতলিকে । তিতলি ওর এক বন্ধুর সঙ্গে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে কথা বলছিল ।ভাইয়ের ডাক শুনে ওকে পরে কল করবে বলে কল ডিসকানেক্ট করে দেয় । মুচকি হাসে সে । এই অসময়ে ওর তলব কেন পড়েছে সে তা খুব ভালো করেই জানে । চটপট রান্নাঘরে গিয়ে কড়া করে কফি বানিয়ে এনে রাহাতের ঘরের দরজায় টোকা দেয় ।ভেতর থেকে জবাব দেয় রাহাত ,
-“দরজা খোলাই আছে । চলে আয় ,
-“এই নাও তোমার কফি ,
টেবিলের ওপর কফি মগটা রাখতে রাখতে বলে তিতলি । রাহাত মগে চুমুক দিয়েই আবার কেসটায় মন দেয় । তিতলি রাহাতের পাশে বসে পড়ে ।
-“ভাইয়া ? ”
-” কিছু বলবি ? ”
-“আমাকে কিন্তু ছবি গুলো পাঠাওনি তুমি । ”
-“কাল তো যাবি দেখতে । তখন একেবারে সামনাসামনি দেখে নিস । ”
-” সে তো অনেক দেরি । আরো চব্বিশ ঘন্টার মতো দেরি । আর কাল আমার অ্যাসাইনমেন্ট জমা নেবে । কলেজ থেকে ফিরতে দেরি হলে তো আমাকে নিয়ে যাবে না আব্বু আম্মু । ”
-“তাহলে পড়ে দেখে নিস । ” নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জবাব দেয় রাহাত । তিতলি অভিমান করে বসে ।
-“ভাইয়া,,,”
মুচকি হাসে রাহাত । মাহির বিয়ের তোলা ছবির ফোল্ডারটা ওপেন করে ল্যাপটপটা তিতলির দিকে ঘুরিয়ে দেয় । তারপর মগ হাতে চলে আসে ঘর সংলগ্ন বেলকনিতে । বিকেলের শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে । তার সঙ্গে গরম গরম ধোয়া ওঠা কফিতে চুমুক দিয়ে নিকট অতিতের স্মৃতির পাতায় বিচরণ করে । সেদিন ও একদম শেষ মুহুর্তের ও ট্রেনে উঠেছিল । ফাহিম আগেই আদিলাকে ফোন করে জেনে নিয়েছিল কত নম্বর বগিতে উঠেছে ওরা । সেই মতো রাহাতও খুঁজে খুঁজে সেই বগিতে গিয়ে ওঠে । কিন্তু আদিলার মুখোমুখি হতে চায়নি । কারণ তখন ওর বাবামায়ের ও সামনাসামনি হতে হবে । আর রাহাতের মনে হয়েছিল আদিলার বাবার মুখোমুখি হওয়ার আগে আদিলার সঙ্গে কথা বলাটা খুব জরুরি । কিন্তু কথা বলার কোনো উপায় ছিল না বললে ভুল হবে । আদিলার নম্বর ছিল , ফাহিম দিয়েছিল ওকে । কিন্তু কল বা মেসেজ কোনোটাই করা হয়নি । ট্রেন চলার সাথে সাথে অসহ্য এক অবর্ণনীয় কষ্ট হচ্ছিল । যত দ্রুত গতিতে ওরা ওদের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ততই কষ্টটা যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছিল ওকে । আদিলা তো আগেই অস্বীকার করেছে ওকে । তবুও ওর নিজের মুখে শোনার জন্য ছুটে এসেছে রাহাত । এত পাশাপাশি থেকেও কি শেষ বার দেখা হবে না ?
ওয়াশরুমের এদিকের দরজাটায় লোকজন নেই । হঠাৎ হঠাৎ হকাররা কেউ চলে আসলেও তারা ব্যবসার তাগিদে দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে । তখনই একটা পরিচিত কন্ঠস্বরে উকি মেরে দেখে মুখে হাসি ফোটে রাহাতের । হকার লোকটি কামড়ায় চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দাড়িয়ে আছে । আদিলা ওনাকে সরে দাড়াতে বললে লোকটি পথ ছেড়ে সরে দাড়ায় । আদিলা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে । আর রাহাত অধীর আগ্ৰহে অপেক্ষা করে কখন বের হবে আদিলা ?
কিন্তু যার জন্য এত অপেক্ষা সে তাকে দেখেই পালানোর পথ খুজে বেড়াচ্ছে। ভীষণ রাগ হয় রাহাতের । না চাইতেও গলার স্বর গম্ভীর হয়ে যায় । তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখে সামনে দাড়ানো মেয়েটির ফোলা লাল হয়ে যাওয়া চোখ জোড়া ।সে যে এতক্ষণ কান্না করেছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে । কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে আদিলা বলে ওঠে চোখে চোখ রেখে ,
-“পালাব কেন ? ”
-“সে তো তুমি বলবে ? ”
মৃদু হাসে আদিলা বলে ,
-” পালানোর কোনো ইচ্ছে নেই । তবে আমি যেহেতু আমার মতামত পরিষ্কার করে বলে দিয়েছি তাই আর ঝামেলা করতে চাইছি না । ”
-” আচ্ছা ? তুমি ওই একটা বাক্য দিয়ে ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছ ? তুমি আমাকে পছন্দ করো না ? নাকি অন্য কিছু ? ”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আদিলা । ও ঠিক ভেবেছিল এই মানুষটার সামনে দাড়িয়ে তাকে অস্বীকার করা সহজ হবে না । রাহাতের থেকে চোখ ফিরিয়ে বাইরে তাকায় । রাহাত সুক্ষ্ম ভাবে ওকে বিশ্লেষণ করে । এই মেয়েটা যে এত সহজে ধরা দেবে না তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে সে । তবে এতে ভালোই লাগছে । কাঙ্খিত জিনিস খুব সহজে পেয়ে গেলে আমরা দেউলিয়া হয়ে যাই । তার মর্ম বুঝি না । আচ্ছা ,আদিলা কি ওকে টেকেন ফর গ্ৰান্টেট ভাবছে ? চিন্তাটা মাথায় আসতেই নিজেকে কষে ধমক দেয় রাহাত । ছিঃ কি সব চিন্তা ভাবনা ! কিন্তু তার পরেই আদিলার বলা কথাটা ওর সমস্ত ভাবনার ভীত নাড়িয়ে দেয় ।
-” রাহাত , এই ট্রেন টা দেখছেন, কিভাবে দ্রুত গতিতে সব কিছু ছাড়িয়ে ছুটে চলেছে । মনে হচ্ছে ঘরবাড়ি গুলো দৌড়াচ্ছে তাই না ? অথচ দেখুন না , ঘরবাড়ি গুলো সব নিজ নিজ জায়গায় স্থির হয়ে আছে । বরং ট্রেনটাই থেমে নেই । সে একটার পর একটা স্টপেজ পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে । আমাদের জীবনটাও এমনি, জানেন তো । আমরা এই এক জীবনে অনেক লোকের সাথে মিশি , অনেককেই আমাদের ভালোলাগে । কিন্তু সেসব শুধু ক্ষণিকের ভালোলাগা ছাড়া আর কিছু নয় । তাই বলব , দয়া করে এই রকম কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না যার জন্য পরে আফসোস করতে হয় । আর আপনার চাওয়াটা একটা চক্রব্যুহের মতো । একবার ঢুকে গেলে পরে বের হয়ে আসা খুব কষ্টকর হবে । আর আমি চাই না ক্ষণিকের মোহে পড়ে আমি এমন কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি যার জন্য আমাকে সারাজীবন আফসোস করতে হয় ।”
শেষের কথাটা এতটা রুঢ় শোনায় যে রাহাত বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে । মোহ ? তাহলে কি বুঝতে ভুল হয়ে গেল?
-“আশা করি আপনি আমার কথাটা বুঝতে পেরেছেন ? ”
আদিলা স্বপ্রশ্ন তাকায় রাহাতের দিকে । রাহাত কোনো কথা বলতে পারে না । আদিলা স্থান ত্যাগ করে রাহাতকে এক সমুদ্র সমান ভাবনার সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে ।
রাহাত বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে আদিলার যাওয়ার পথে । এই এতটুকু একটা মেয়ে এত কঠিন কঠিন কথা বলে কেন ? ওর অভিজ্ঞতার ঝুলি কি এতটাই ভারী ? কিন্তু তুমি একটা কথা স্কিপ করে গেলে আদিলা । সেই হাজার লোকের ভীড়ে খুব কম সংখ্যক মানুষ থাকে যারা আমাদের সমস্তটা জুড়ে থাকে । তুমি তেমনি একজন । আমি টিনেজ নই । ক্ষনিকের আবেগে ভাসার মতো বয়স নয় এটা । আমি তোমাকে চাই , আমার জীবনসঙ্গী রূপে । এই চাওয়ায় একবিন্দুও খাদ নেই । আমি তা হলফ করে বলতে পারি ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শিলিগুড়ি স্টেশন এসে পড়ে । আদিলা নেমে পড়ে । আরাফাত সাহেব ইতিমধ্যেই বড়ো শ্যালককে জানিয়ে দিয়েছিলেন । তিনি নিতে এসেছেন আদিলাকে । প্লাটফর্মে দাড়িয়ে থেকেই আদিলা দেখে ট্রেনটা হুইসেল বাজিয়ে ঝিকিঝিকি আওয়াজ তুলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছে । সায়ন হাত নেরে বিদায় জানায় । প্রত্যুত্তরে আদিলাও হাত নাড়াতে নাড়াতে একসময় হাত থেমে যায় । রাহাত দরজায় দাড়িয়ে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । আদিলা জোর করে হেসে তাকেও বিদায় জানায় । চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে ওর । চটজলদি ঘুরে দাড়িয়ে মামাকে তাড়া দেয় । রাহাত মুচকি হাসে । আদিলাকে উদ্দেশ্যে করে মনে মনে বলে ,
-“বোকা মেয়ে , আমাকে ভুজুং ভাজু্ং বলে বুঝ দিতে চাইছিলে ।নিজেকে লুকোনোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছ । অথচ ভুলে গেছ যে চোখ হল আমাদের মনের দর্পণ। ওরা কপটতা জানে না আর না জানে ছলনা । ভালোই এগোচ্ছিলে তুমি । আমি অলমোস্ট বিশ্বাস করেই ফেলেছিলাম তোমাকে । ”
-” ভাইয়া , এ তো বাচ্চা মেয়ে ! তুমি কি বাল্যবিবাহ করবে ! ” তিতলির কৌতুকমিশ্রিত স্বরে রাহাতের ধ্যান ভাঙে । ঘরে এসে তিতলির মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলে ,
-” আসছে সর্দারনী আমার স্বপ্নে পানি ঢালতে । যাহ, ভাগ এখান থেকে । ”
তিতলি হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায় । রাহাত ছবি গুলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে ।
****
অসুস্থ নানুমার দেখাশোনা , আরুশি আপার সাথে খোশগল্প সবমিলিয়ে মামাবাড়িতে কয়েকটা দিন বেশ ভালোই কাটলো আদিলার । কিন্তু তবুও অবাধ্য মনকে রাহাতের ভাবনা থেকে বিরত রাখতে পারে না সে । ভুলে যাওয়ার এই খেলায় হারতে হারতে নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা ধরে গেছে আদিলার । এতটা ভাবুক কেন সে ? আসলে আমাদের মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ গুলোই খুব জটিল ধরনের । যাকে ভাবতে চাই না , যার থেকে দূরে সরে যেতে চাই , মনের ভুলে তাকেই সব সময় মনে করি , সব কিছুকে আরো জটিল করে দিয়ে সেই মানুষটার আরো কাছে চলে যাই । মাঝে মাঝে যখন আপা বা মামানি কাছে থাকে না তখন অদ্ভুত ভাবে বিয়ে বাড়ির ওই কয়েকটি দিনে মনপ্রাণ বুদ হয়ে থাকে আদিলার । তখন অন্য কিছু ভাবতে ইচ্ছে করে না । ভাবতে ইচ্ছে করে না যে ওই মানুষটার জন্য ওকে একটা বাচ্চা মেয়ের কাছে অপমানিত হতে হয়েছে । ভাবতে ইচ্ছে করে না যে ওই মানুষটাকে সে ফিরিয়ে দিয়েছে । ইচ্ছে করে এই ধুলো বালি যুক্ত অসুস্থ মানসিকতার মানুষ গুলোকে পিছনে ফেলে ওর হাত ধরে কোনো স্বপ্ন রাজ্যে হারিয়ে যেতে । যেখানে কেউ কাউকে হেয় করে না , যেখানে সবাই সবার সুন্দর অনুভূতি গুলোকে নিয়ে চোখে হাজারো স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে জানে । কিন্তু স্বপ্ন সবসময় সত্যি হয় না । বাস্তবতার সাথে ধাক্কা লেগে যখন মুখ থুবড়ে পড়ে তখন একটা গোটা দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না কারো।
নানুমা এখন অনেকটা সুস্থ । সন্ধ্যায় নামাজের পর মামানি , আরুশি আপা, নানুমা আর আদিলা মিলে চায়ের কাপ সমেত আড্ডা দিচ্ছে ড্রয়িংরুমে। মাহির বিয়েতে যেতে পারেনি বলে তাদের সবার মনখারাপ । আদিলা ওর মামাতো ভাই আরহানের ল্যাপটপে মাহির সব ছবি নিয়ে দেখাতে থাকে । একে একে বর্ণনা দিচ্ছে কোনটা গায়ে হলুদের ছবি ?কোনটা মেহেন্দি নাইটের ? কোনটা কবুল বলার সময় তোলা হয়েছে ?আর কোনটা বিয়ের ছবি ? নানুমা ছবি দেখতে দেখতে প্রান ভরে দোয়া করছেন মাহি আরমানের জন্য । আরুশি হঠাৎ প্রশ্ন করল আদিলাকে ,
-“আদি, এটা কে রে ? ”
-“কোনটা আপা ? ”
-“ওই যে ধূসর রঙের শার্ট পড়া ছেলেটা ? আর এই শাড়ি পরা মেয়েটাকেও অচেনা লাগছে ! আমাদের আত্মিয়ের মধ্যে তো নয় ?কে ওরা? চিনিস ? ”
আরুশির দৃষ্টি অনুসরণ করে স্তব্ধ হয়ে গেল আদিলা ।আপা তো মিতু আপু আর রাহাতের কথা বলছে ! ল্যাপটপের স্ক্রিনে ওপর তখন ওদের স্যাঙ্কচুয়ারি ভ্রমনের ছবি গুলো স্লাইড হচ্ছে। সেদিন ওরা সবাই মিলে গ্ৰুপ ফটো তুলেছিল । রাহাত লম্বা হওয়ার জিসান সেলফি স্টিকটা ওকেই ধরিয়ে দিয়েছিল । আর তাই ওখানকার বেশিরভাগ ছবিতে রাহাতের হাস্যরত উজ্জ্বল ছবি জ্বলজ্বল করছে । সবাই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে দ্রুত নিজের অস্বস্তি গিলে ফেলে আদিলা স্বাভাবিক কন্ঠে বলে ওঠে,
-“ওটা? মেয়েটা তোমার নাতবৌ নানুমা । ফাহিম ভাইয়ার জন্য পছন্দ করেছে খালু-খালাম্মা । কি সুন্দর মানিয়েছে না দুজনকে ? বলো? ”
সবাই অবাক হয়ে তাকায় । আরুশি বিস্ময় নিয়ে বলে ,
-“কি বলিস এসব? সত্যি ? ফাহিম ভাইয়ার জন্য? ”
-“হুম ”
নানুমা খুটিয়ে খুটিয়ে ছবিটা দেখে প্রশ্ন করে আদিলাকে ,
-” মেয়ে তো ভালোই । কিন্তু এদের দেখে তো মনে হচ্ছে এরা অনেকদিন ধরেই চেনে একে অপরকে । ঘটনা কি বলত ? এই ছেলে কি নিজে নিজে পছন্দ করে বৌ নিয়ে বাড়ি আসছে ?”
নানুমার প্রশ্ন শুনে একটু ঘাবড়ে যায় আদিলা । তিনি পুরোনো চিন্তাধারার লোক । ছেলেমেয়েরা নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করবে এই ধারনা তিনি একদম পছন্দ করেন না । আদিলা মনে মনে তাই কিছু কথা সাজিয়ে বলতে যাবে তখনই আরুশির প্রশ্নে স্বস্থি বোধ করলেও পরক্ষণেই বাজ পড়ে মাথায় ।
-“আদি, বললি না তো ছেলেটা কে ? ”
সবার মনোযোগ এবার মিতুর থেকে ঘুরে গিয়ে রাহাতে ঠেকেছে । আদিলা অস্বস্তি লুকাতে ঝটপট উত্তর দেয় ,
–“উনি ফাহিম ভাইয়ার বন্ধু , আলিপুরে বাড়ি । ”
আরুশি ওর মায়ের দিকে তাকায় । বলে,
-“ফুপাজি তাহলে এই ছেলেটার কথাই বলেছে, তাই না মা ? ”
মামানি চোখ পাকিয়ে তাকায় আরুশির দিকে ।আরুশি চুপ করে যায় । তাই দেখে আদিলা ভ্রু কুচকায় ? ফুফাজি ? কার কথা বলছে আপা ? আব্বু নাকি খালু ? আব্বু তো বলবে না , খালু হয়তো বলেছে কিছু ? কিন্তু কি বলেছে রাহাতের নামে ? প্রশ্নটা করতে চেয়েও নিজেকে আটকায় আদিলা । অতিরিক্ত আগ্ৰহ দেখানো মোটেও উচিত নয় । কি জানি কি থেকে কি ভেবে বসবে ? তখন আবার যেন ভয়ে লুকানো তাই বেরিয়ে পড়বে ।
(চলবে)