#জলছবি
#পার্ট_২০
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
সন্ধ্যে বেলা।
শহরের আনাচে-কানাচে অন্ধকারের রং গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে ক্রমশ। মাগরিবের আযান দিয়েছে বেশ অনেকক্ষণ!
ঘরের দরজা জানালা সব আটকানো। একে তো সন্ধ্যা, তার-উপর সব বন্ধ! যার ফলে ঘরে আলো প্রবেশ করার উপায় নেই। অন্ধকার রুমে অন্ধকারাচ্ছন্ন মন নিয়ে একপাশ হয়ে শুয়ে রইলো নোলক। বিষন্ন সময়ে আলোর চাইতে অন্ধকারকেই বেশি আপন লাগে।
দরজা চাপানো ছিলো। সেই চাপানো দরজা ঠেলে নবনী রুমে আসলো। অন্ধকার রুম আলোকিত করার জন্য বাতি জ্বালাল। নোলককে এই অবেলায় শুয়ে থাকতে দেখে বলল,
“কিরে? এই অসময়ে শুয়ে আছিস কেন? আযান দিয়েছে সেই কখন! উঠে বস। সন্ধ্যেবেলা শুয়ে থাকতে হয় না।”
নোলকের তরফ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া এলো না। সে আগের মতোই চুপ, নিশ্চুপ।
নবনী অবাক হলো। এক মূহুর্তের জন্য ভেবে নিলো, শরীর খারাপ নয়তো?
নোলক প্রচন্ড মন খারাপ কিংবা শরীর খারাপ হলেই কেবল সে চুপচাপ হয়ে যায়।
যেহেতু নোলক অন্যপাশ হয়ে শুয়েছিলো তাই ওর মুখ দেখতে পায়নি। দেখতে পেলেও অবশ্য বিশেষ কিছু টের পেতো না। নবনী বিছানায় বসলো। পেছন দিক হতেই বোনের বাহুতে হাত রাখলো। চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“শরীর খারাপ, বোন? তুই তো এত চুপচাপ থাকিস না।”
নোলক বোনের দিকে ফিরলো না। বরং যেভাবে ছিল সেভাবে থেকেই অস্বাভাবিক শান্ত স্বরে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
“আমি কি খুব বেশি কথা বলি আপু?”
নবনী ধরে নিলো বোন তার কথায় কষ্ট পেয়েছে। তাই আদরের সহিত মাথায় হাত বুলিয়ে বিশ্লেষণ করার মতন করে বলে,
“ঠিক তা না। উল্টা বুঝছিস। দেখ সবাই তো আর এক না, তাই না? একেক জনের একেক রকম বিশেষত্ব থাকে। খুব চুপচাপ থাকাটাই কারো বিশেষত্ব, আর কারো বিশেষত্ব হলো চঞ্চলতা। তুই তো আমাদের চঞ্চলাবতী। তোরে কি এমন চুপ থাকা মানায়? একদমই মানায় না। কী হয়েছে বোন? শরীর খারাপ, নাকি মন? ঝগড়া হয়েছে কারো সাথে?”
নোলক আরো একটু আড়ষ্ট হয়ে শুয়ে, হাত দুটো মাথার নিচে রেখে জবাব দিল,
“কিছু হয়নি আপু। এখন আমার শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। তুই কি একটু রুমে বাতিটা অফ করে অন্য রুমে যেতে পারবি?”
নবনীর কপাল কুঁচকে এলো। নোলক তো এমন কখনও করেনি! কি হয়েছে মেয়েটার?
নোলক অনুনয়ের স্বরে বলে,
“প্লিজ আপু! একটু একা থাকি! আমার এখন একা থাকতে ইচ্ছে করছে।”
নবনী তার বিস্ময় নিয়েই বাতি বন্ধ করলো। সন্তর্পণে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ভাবনা কিছুই মিলছে না। নবনী ভাবনার অবসান ঘটাতেই বুঝি ফোন বেজে উঠলো। কুঁচকানো ভ্রু নিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই যেন ভ্রু-জোড়া আরো খানিক কুঁচকে এলো। ‘ইশান!’ ইশানের সাধারণত নবনীকে ফোন করে না। করলে নোলককে করে। এখন হঠাৎ ওর ফোন দেখে চিন্তা যেন আরো বাড়ে। নোলকের পাশাপাশি আরমানও যোগ হয় সেই চিন্তায়। আরমানের কিছু হলো নাকি?
চশমাটা এক হাতে ঠিক করে অন্যহাতে ফোন রিসিভ করে। কানের কাছে নিতেই ওপাশ থেকে ব্যাস্ত কন্ঠস্বর,
“আসসালামু আলাইকুম, ভাবি। অগ্নিশর্মা কই? ঠিক আছে ও?”
নবনী মস্তিষ্কের বিরূপ প্রভাব ফেলে প্রশ্নটি। একে তো নোলকের ওমন নিরবতা, তারপর এমন প্রশ্ন! একটু চুপ থেকে, কৌতূহল দমিয়ে রেখে বলে,
“ও তো নিজের রুমেই আছে। কিছু হয়েছে কি?”
ইশান বুঝতে পারে ওর হুট করে এমন করে প্রশ্নটা করা ঠিক হয়নি। কিন্তু না করেও তো উপায় নেই। তখন অমন হুট করে চলে এলো। তারপর ছেলেটা ফোনের উপর ফোন দিচ্ছে কিন্তু ফোন অফ! চিন্তা হবে না?
নিজেকে সামলে নিয়ে ইশান বলে,
“তেমন কিছু হয়নি আপু। আসলে কিছু হয়েছে কিনা বুঝতেও পারছি না। বিকেলে দেখা হওয়ার পর মনে হলো ও অসুস্থ, তাই ফোন দিচ্ছিলাম। কিন্তু ফোন অফ। তাই ভাবলাম কিছু হয়েছে কিনা! অগ্নিশর্মা ঠিক আছে?”
নবনীর বিস্ময় তরতর করে বেড়ে যায়। ‘তার মানে কিছু একটা নিশ্চই হয়েছে। ইশানের সঙ্গে কিছু হয়েছে কি? কিন্তু ওর সঙ্গেই-বা কি হবে? বিশেষ কোনো সম্পর্ক তো নেই ওর সাথে! নাকি আছে?’ মনে মনে ভাবে কথাগুলো নবনী। ফোনে ইশান আছে মনে পড়তেই নিজেকে সামলে নেয়। যথেষ্ট স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে,
“আচ্ছা টেনশন করবেন না। ও ঠিক আছে। ওয়েদার চেইঞ্জ হচ্ছে তো, তাই বোধহয় শরীর একটু খারাপ লাগছে। আমি বলে দিবো পরে ফোন দিতে।”
ইশান স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল,
“না, না। ওকে আর ফোন দিতে বলতে হবে না। রেস্ট নিক। একটু টেনশন হচ্ছিল, এখন ঠিক আছে। রাখছি তবে, আল্লাহ্ হাফেয।”
বলেই ফোন কেটে দেয়। তারপর বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বিছানায় বসে। আদ্র সব শুনলো এবং দেখলো। ইশান রুমে আশার পর থেকে ইশানের অস্থিরতাও দেখেছে। ইশান আদ্রর দিকে তাকাতেই জিজ্ঞেস করলো,
“কী হয়েছে? নোলক অসুস্থ?”
“হুম।”
“তোর সঙ্গে কি ওর দেখা হয়েছিল?”
ইশান দুহাতে নিজের চুলগুলো এলোমেলো করতে করতে বলে,
“হুম, বিকেলে দেখা হয়েছিল। কি বিষন্ন দেখাচ্ছিল মেয়েটাকে!”
আদ্র এক পলক ইশানের দিকে চেয়ে হাতের বইটা টেবিলে রাখলো। আদ্রর নিরবতার মাঝেই ইশান আবার বলে,
“কি যেন বলবে বলেছিল। তা আর বলল কই? শুরুতে মোটামুটি ঠিকই ছিলো, বুঝলি? হঠাৎ কি যে হয়েছিল কে জানে! বলল, রিকশা ডেকে দিতে। ডেকে দিলাম। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলো। এরপর ফোন অফ পেলাম। এখন ভাবিকে কল করে জানলাম, ওয়েদার চেঞ্জ হইলেই নাকি তার শরীর খারাপ হয়। মেয়েটা যেন কেমন। পিচ্চি লাগে আমার কাছে! বাচ্চা বাচ্চা মুখ, বাচ্চা বাচ্চা কাজ-কারবার, আদুরে আদুরে ভাব আদ্যপ্রান্ত।”
আদ্র হাসে। সুন্দর হাসি। বিছানা থেকে নেমে খুলে রাখা ঘড়িটা পুনরায় হাতে পরতে পরতে বলে,
“ও যে বাচ্চা, পুঁচকে, ছুটকিয়া সে ব্যাপারে তোর সন্দেহ আছে? তুরতুর বাচ্চারাই করে, বড়রা না। বয়স বাড়লেও সে ছুটকিয়া-ই রয়ে গিয়েছে।”
ইশান হেসে দিয়ে বলে,
“ছুটকিয়া? হা হা! দারুন বলেছিস। অগ্নিশর্মা ইকোয়েলটু ছুটকিয়া!”
বলেই আরেক দফা হাসে। আদ্র সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে বলে,
“আমি বাহিরে যাচ্ছি। তুই যাবি?”
“না, ঘুম লাগছে দোস্ত! অগ্নিশর্মার চিন্তায় ঘুমের ক্ষুধা লেগে গিয়েছে। একটু ঘুম খাই!”
বলেই সে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। আদ্র বলে,
“অদ্ভুত সব কথাবার্তার জন্য যদি প্রাইজ দেয়া হতো তুই সেখানে ফার্স্ট প্রাইজ পেতি, ড্যাম শিওর। দরজাটা আটকে দে।”
বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। আদ্র বেড়িয়ে যাওয়ার পরও ইশান আগের মতোই শুয়ে রইলো। পরপর দুইবার বিড়বিড় করলো,
“অগ্নিশর্মা, অগ্নিশর্মা। উফফ, পুড়ে যাচ্ছি!”
.
ইশানের সাথে কথা বলা শেষে নবনী পুনরায় রুমে এসে লাইট অন করলো। নোলক আগের ন্যায় শুয়ে ছিলো। এমন কি লাইট জ্বালানোর পরও নড়লো না পর্যন্ত। এবার আর পিছনে বসলো না নবনী। নোলকের সামনে গিয়ে টুল টেনে বসলো। নোলকের চোখ বন্ধ ছিলো। নবনী ভাবল, বোধহয় ঘুমাচ্ছে। আলতো করে কপালে হাত ছোঁয়াতেই চোখ মেলে তাকায় নোলক। তার মানে ঘুমায়নি। কারন ঘুমালে এত অল্পে ঘুম ভাঙে না ওর।
নোলক উঠে বসে। হাঁটু ভাজ করে তা দু’হাতে আঁকড়ে ধরে হেলান দিয়ে বসে।
নবনী খুব আদুরে কন্ঠে বলে,
“আমাকে বলবি না, কী হয়েছে?”
নোলক হাসার চেষ্টা করে বলল,
“কি বলবো? কিছুই হয়নি আপু। অযথা চিন্তা করছো।”
নোলকের এই এক অসুবিধা! সে মন খারাপ ভাবটা কখনোই লুকাতে পারে না। তার অবশ্য একটা কারন আছে। অন্যসময় খুব বেশি পটরপটর করে, একমাত্র মন খারাপ হলেই সে ভয়ানক চুপচাপ হয়ে যায়। যার ফলে তার মন খারাপ ভাবটা সবাই চট করে ধরে ফেলে।
নবনী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আচমকাই বলে,
“ইশানের সঙ্গে কিছু হয়েছে?”
এমন কোনো প্রশ্ন নবনীর তরফ থেকে আসতে পারে তা যেন নোলকের ধারনাতীত ছিলো। এমন প্রশ্ন কেন করলো তাও বুঝতে পারলো না। নোলক ভ্রু সামান্য কুঁচকে উল্টো প্রশ্ন করলো,
“তার সাথে কি হবে?”
“আমার থেকে লুকাচ্ছিস কেন?”
“কী লুকাচ্ছি?”
নবনী আশ্বাস দেয়ার মতো করে বলে,
“আরে বোকা, ইশানকে তো আমিও ভালো জানি। তোকে খুব ভালো মেনটেইনও করতে পারবে। দুজকে মানায়ও দারুন। মান-অভিমান চলছে বুঝি? আরেহ এসব কোনো ব্যাপার না। সম্পর্কের মাঝে এসব হয়-ই। তাই বলে এত্ত মন খারাপ করে থাকতে হবে? আমার থেকে লুকিয়ে গেলি এসব? যাইহোক, ফোন অন কর। ছেলেটা ফোন করছে তোকে। চিন্তা করছে। শেষে বোধহয় বাধ্য হয়েই আমায় ফোন দিল।”
নোলক হতভম্ব, স্তব্ধ। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ। বোন তার এসব কি ভেবে বসে আছে, তা ভেবেই আহত। ডিরেক্ট মেনে নেওয়াতে চলে গিয়েছে! কি সাংঘাতিক! আর ইশান-ই বা কি বলেছে যাতে এমন ভাবনা এলো? হরেক রকম প্রশ্ন ঘুরতে লাগলো নোলকের মাথায়। এক আকাশ বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,
“ধ্যাত আপু! এসব কি বলছো? দেখ এমনিতেই প্রচন্ড মন-মেজাজ খারাপ তার উপর এসব উদ্ভট কথা-টথা বলে আরো খারাপ করে দিও না, প্লিজ।”
নবনী আহত হওয়ার মতো করে বলে,
“এখনও অস্বীকার করছিস? আচ্ছা বলনা, কেমনে কি হলো? কবে থেকে?”
চোখেমুখে তার তুমুল উচ্ছ্বাস নবনীর।
নোলক আর্তনাদ করে বলে,
“আপু……! ভাল্লাগে না প্লিজ যাও তো। ফালতু কথা বলছ কেন?”
নবনী নোলকের একটু কাছে ঝুঁকে বলে,
“আচ্ছা, আচ্ছা! এখন বলতে হবে না। মন ভালো হলে বলিস কেমন? তবুও এমন ‘ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে যাওয়া’ টাইপ মুখ করে থাকিস না। আমি তো আর বাংলা সিনেমার প্রেমে বাধা দেয়া ‘বাপ, ভাই, বোনের’ রোল প্লে করছি না। সো, নো চাপ। ঝগড়া করেছিস এখন আবার ঝগড়া মিটিয়ে ফেল, ব্যাস হয়ে গেল।”
বলেই চট করে উঠে রুমের বাহিরে চলে যায়।
নোলক চেঁচিয়ে বলে,
“তুমি খুবই খারাপ আপু! তোমার সাথে আরমান ভাইয়ের বিয়ে না দিয়ে তার বন্ধুর সাথে বিয়ে দিয়ে, উড়াধুরা ছ্যাঁকা খাওয়ানো উচিত ছিলো।”
নবনী রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেও নোলকের এহেন কথায় পুনরায় দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। অবাক হওয়ার মতো করে বলে,
“এইখানে আরমান আসলো কই থেকে? আর ওর বন্ধুই বা আসলো কই থেকে? কি কইলি বইন? আগামাথা তো ঠাওর করতে পারছি না! একটু বুঝা তো?”
নোলক ঠোঁট উল্টে বলে,
“তুমি বুঝবা না, যাও তো।”
নবনী মিটিমিটি হেসে বলে,
“হুম, বুঝি বুঝি! থাক আর কান্দিস না, ঝগড়াঝাঁটি মিটিয়ে নে।”
নোলক চোখমুখ খিঁচে বিছানা থেকে বালিশ ছুড়ে মেরে বলে,
“নিষ্ঠুর মহিলা! বোনের দুঃখ বোঝে না! উল্টাপাল্টা কথা বলে খালি!”
নবনী হাসতে হাসতে ডাইনিং রুমের দিকে যায়। ইশানকে তার ভালো ছেলেই মনেহয়। তাছাড়া নোলকের সাথেও বেশ ভালই কেমিস্ট্রি। এমনকি শুরুতে আদ্র’র সাথে সাপেনেউলে সম্পর্ক থাকার সময়েও ইশানের সাপোর্টটিভ মনোভাবের কথাও নোলকের কাছেই শুনেছে। মনে মনে কি ভেবে যেন সন্তুষ্ট হয় নবনী। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসির দেখা দেয় খুব গোপনে।……(চলবে)