#জলছবি
#পার্ট_১১(শেষ অংশ)
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
সূর্যের তেজ কমে তেজহীন দ্যুতি ছড়াচ্ছে চমৎকার পাহাড়টির গায়! আঁকাবাঁকা হয়ে বয়ে চলা ঝর্ণাধারা চিকচিক করে উঠছে ক্ষণে। পাহারে গা থেকে ভেসে আসে স্বচ্ছ বাতাস।
কেউ ঘুরে ঘুরে এই অপার সৌন্দর্য উপভোগ করছে, কেউ কেউ ঝর্ণার পানিতে পা ভিজিয়ে বসে আছে, ছুঁয়ে দিচ্ছে পানি।
দ্বীপ দূর হতে হাঁক ছেড়ে বলে,
“এখন আমাদের বের হতে হবে। সবাই প্রস্তুত হও।”
যারা ঝর্ণার উপরে উঠেছিল তারা নিচে নেমে আসতে শুরু করলো। নোলক আর শ্রেয়া পা ভিজিয়ে বসে ছিলো। তারাও উঠে দাঁড়াল। নোলক পাশ থেকে একটা ছোট্ট ডাল জাতীয় কিছু একটা নিয়ে মাটির ভিটার উপর গোটা গোটা অক্ষরে লিখল,”নোলক!”
সে তার কাজ সাধন করে বিস্তর হাসলো। যেন খুব মহৎকর্ম সাধন করেছে।
শ্রেয়া প্রথমে হাসলেও পরে কি মনে করে মুখ মলিন করে ফেললো। নোলককে নিজের মনের শংকা জানালো,
“দোস্ত? আমার যেন কেমন লাগছে! মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে!”
নোলক আশ্বাস দিয়ে বলল,
“আল্লাহ্‌ ভরসা। অযথা কিছু নিয়ে টেনশন করিস না তো।”

সুপ্তধারায় ঘন্টা খানিক ঘুরে সবাই চন্দ্রনাথ মন্দিরের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো। পাহারের উপর মন্দির শুনে সবার আগ্রহ দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। চোখেমুখে খুশির ঝলক একে শ্রেয়া জানালো, তার খুব ইচ্ছে ছিলো চন্দ্রনাথের মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করার। অবশেষে তার সুপ্ত ইচ্ছে পূরণ হতে যাওয়ায় তার আগ্রহ-ই বোধহয় সবচাইতে বেশি। সৃজন জানালো, তার মায়ের খুব ইচ্ছে। নেক্সট টাইম মাকে নিয়ে সে আসবে।

প্রায় ঘন্টা খানিকের মাঝেই তারা তাদের গন্তব্য স্থানে এসে পৌঁছাল। বিশাল পাহারের মাথায় অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দির। এত উপরে উঠতে হবে ভেবে আগেই হাঁপিয়ে উঠলো সবাই। সহায়ক হিসেবে সবাই মাঝারি সাইজের বাশ কিংবা লাঠি নিয়ে নিলো সাথে। যাতে পথ চলতে সুবিধা হয়।
দ্বীপ বলল,
“এই মেয়ের দল আগে চলো। আমরা পেছনে আছি।”
প্রখর উৎসাহের কাছে ক্লান্তি মহাশয় বিশেষ পাত্তা পেলো না। সবাই এডভেঞ্চারের মজা পেতেই বেশি আগ্রহী। অনেক মানুষ এসেছে পাহার এবং মন্দির একত্রে দর্শন করতে। বেশিরভাগই সনাতন ধর্মাবলম্বী। কেউ হয়তো পূজা দিতে এসেছে, কেউ-বা মানত করেছে তাই, আর বেশিরভাগই প্রাকৃতিক রূপ দর্শন করতে এসেছে।
দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে পাহাড়ের পথে খানিক বাদে বাদে সিড়ির মতো করে মাটির সিঁড়িপথ তৈরি করা হয়েছে। প্রায় মিনিট বিশেক হাঁটার পর নোলক বসে পড়লো। ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে বলল,
“আর উঠতে পাড়ছি না। পা ব্যথা করছে।”
নোলকের পাশে লুবনাও বসে পড়ে বলল,
“আমিও পাড়ছি না।”
নিষাদ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“এইটুকুতেই? আরো অনেক পথ বাকি।”
দ্বীপ জিজ্ঞেস করলো,
“বেশি খারাপ লাগছে?”
নোলক ফ্যাকাসে মুখ করে বলল,
“না।”
ইশান বলল,
“বেশি খারাপ লাগলে বাদ দেই?”
নোলক উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“না, পারবো যেতে।”
বলে সিড়ি ভাঙতে সুরু করে। লুবনাকে তখনও বসে থাকতে দেখে ফয়সাল বলে,
“তুই বইসা রইছিস ক্যা? এইখানে আপনার কোনো হিরো নাই যে আপনারে কোলে কইরা নিয়ে যাবে। উঠে হাঁটা ধরেন। ঢং-ফং বাদ।”
লুবনা মলিন মুখে উঠে দাঁড়ায়। হাঁটা শুরু করতে লাগলে ফয়সাল ডেকে বলে,
“এই দাঁড়া।”
একরাশ বিরক্তি নিয়ে লুবনা দাঁড়ায়। ফয়সাল বলে,
“হাত ধর।”
লুবনা হাঁটতে হাঁটতে বলে,
“লাগবে না। এত ঢং নাই মনে। তোর ঐ রোবোট মার্কা হাত ধরতে যামু কোন দুঃখে?”
ফয়সাল এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
“দিমু এক থাপ্পড়, ফাজিল। সব কথায় ত্যাড়ামি স্বভাব।”
লুবনা ঠিক বুঝতে পারে না ছেলেটা এমন ক্যান! এই ভালো, এই খারাপ! খারাপ না ঠিক, কিন্তু খুব রুক্ষ। কোনো রসকষ নেই কথার মাঝে। ভালো করে কথা বলা যেন তার ধাতের বাহিরে!

প্রায় ঘন্টা খানিক হাঁটার পর বেশ অনেক খানি উপরে উঠে যায় সকলে। একপাশে বসে একটু জিরিয়ে নেয়। পানি পান করে সবাই। আদ্র’র পানি শেষ হয়ে যাওয়ায় খেতে পারে না। নোলক লক্ষ্য করে তা। নিজের বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে,
“নিন। এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন।”
আদ্র তার গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলে,
“ধন্যবাদ। কিন্তু প্রয়োজন নেই।”
নোলকের খুব ইগোতে লাগে। সাধলো বলে ভাব বেড়ে গেলো নাকি? মনে মনে বেশ কিছু বকাঝকা দিয়ে বলে,
“প্রয়োজন নেই মানে? আমি যখন সেধেছি, প্রয়োজন না হলেও খেতে হবে।”
“আচ্ছা পাগলের জ্বালায় পড়লাম দেখি!”
কথাটা অবশ্য মনে মনে বলে আদ্র। নোলক খ্যাট করে বলে,
“কি হলো, নিন? নাহলে কিন্তু মাথায় ঢেলে দিবো।”
আদ্র হেসে দিয়ে বোতলটা নিলো। নোলক ভ্রু কুঁচকে আদ্র’র দিকে তকিয়ে মনেমনে বলে,’হাসলে তো ভালোই দেখায়। না হেসে সারাক্ষণ অমন হুতুম পেঁচার মতো মুখে করে রাখতে হবে ক্যান? আজব!’
আদ্র পানি খাওয়ার সময় নোলক এক প্রকার শোধ নেয়ার মতন করে বলে,
“কেউ একজন নিজের জিনিস শেয়ার কিংবা এক্সচেঞ্জ করতে অভ্যস্ত নন। তবে অন্যের থেকে শেয়ার করতে বোধহয় অভ্যস্ত!”
দুই ঢোক গিলে আদ্র বোতলটা নোলকের কোলের উপর রেখে বলে,
“জোর করে খাইয়ে খোঁচা মারলেন?”
নোলক মুখ বাঁকিয়ে বলে,
“খোঁচা কেন মারবো? কেউ একজন কটকট করে তার এই মহান বানি শুনিয়েছিলেন তাই একটু স্মরণ করিয়ে দিলাম জাস্ট।”
আদ্র অসস্থিতে পড়ে গেলো যেন। সরল দৃষ্টি ফেলে তাকালো নোলকের দিকে। নোলক খুব মজার পাওয়ার মতো খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।
দ্বীপ হাঁক ছেড়ে বলল,
“সবার বিশ্রাম হলে আবার শুরু করো। সন্ধ্যার আগেই আবার নামতে হবে কিন্তু।”
নোলক হাসি হাসি মুখ নিয়েই উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে পড়ে একটু নিচু হয়ে মৃদু স্বরে বলে,
“ডাজেন্ট ম্যাটার। আমি আমার জিনিস অন্যদের সঙ্গে শেয়ারে অভ্যস্ত।”
এটুকু বলেই চলে গেলো। আদ্র বিস্ময় নিয়ে নোলকের চলে যাওয়ার দিলে তাকিয়ে স্বল্প আওয়াজে বলে,”ডেঞ্জারাস!”

সকলে যখন মন্দিরের কাছে এসে পৌঁছালো তখন পুরাদস্তুর বিকেলের ছায়া। সৃজন, শ্রেয়া আর দ্বীপ মন্দিরের ভেতরে চলে যায় প্রথমে। প্রণাম করে। দু’হাত মিলিয়ে প্রার্থনা করে চোখ বুজে।
বাকিরা অন্যপাশে চলে আসে। ঘোর লাগানো সৌন্দর্যের মায়ায় হারিয়ে যায়। পাহারের চূড়ায় উঠতে পেরে সকলেই বিমুগ্ধ। দূর-দূরান্তের সুবুজ গাছগাছালি কিছুটা ঘোলাটে দেখাচ্ছে। সূর্যের দেখা মিললো না এখানে এসে। মনে হচ্ছে যেন, হাত বাড়ালেই মেঘ ছোঁয়া যাবে! স্বচ্ছ মেঘ। একবারের জন্য মনে হলো শুন্যে ভাসছে সকলে!

পাহারের অনেক অনেক উপরে তারা। ইশান চুপিসারে মুগ্ধ নোলকের বেশ কিছু ছবি ক্যাপচার করে। অন্যদেরও করে।
নোলক বাকরুদ্ধ প্রায়। অস্ফুট স্বরে বলে,
“এত বেশি সুন্দর! আমরা কত উপরে?”
নিষাদ বলে,
“মনে তো হচ্ছে অনেক উপরে।”
উচ্ছ্বাসে পাগল প্রায় নোলক উদগ্রীব হয়ে বলে,
“এই আমার এখান থেকে লাফ দিতে ইচ্ছে হচ্ছে!”
আদ্র এতক্ষণ অন্যদিকে ফিরে থাকলেও নোলকের এই অদ্ভুত কথা কানে যেতেই চমকে উঠে। ওর ধারনামতে এই মেয়ে যা খুশি করতে পারে! দুনিয়ার যত আজব কর্মকান্ড সাধনের কারণেই তার জন্ম। আদ্র কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইশান নোলকের হাত টেনে দূরে সরিয়ে আনে। নোলক খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলে,
“আরেহ! মজা করে বলেছি। সত্যি সত্যি লাফ দিবো মনে হলো নাকি? আমি অতো গাধা নই, ওকে?”
আদ্র বাকা হেসে নিজে নিজেই বিড়বিড় করে বলে,
“গাধা হলে তো হতো-ই। আধ পাগল হয়েই তো যন্ত্রনা!”
ইশান বলে,
“না, তোমার অতো কিনারে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। খুব রিস্ক এখানে। বাইনোকুলার আছে না তোমার? দূর থেকেই দেখ। অনেক দূর্ঘটনা ঘটে এখানে।”
ফয়সাল কাটকাট কন্ঠে বলে,
“এই মাইয়াডারে সারাক্ষণ ‘সুখে থাকতে ভূতে কিলায়’।”
বলেই আবার নিষাদের সঙ্গে নানান আঙ্গিকের ছবিতে বন্দি করতে লাগল নিজেদের।

লুবনা ওদের পাশ কাটিয়ে একটু কিনারে যেতে লাগলেই ফয়সাল ছবি তোলা বন্ধ করে হাত টেনে ওদের সামনে নিয়ে আসে লুবনাকে। ধমকের সুরে বলে,
“মরতে যাচ্ছিস? এক চড়ে গাল লাল করে দিবো, ফাজিল। কিছুক্ষণ আগে নোলককে নিষেধ করা হলো শুনিস নি? বাচ্চাদের মতো একেকটার কর্মকান্ড! মেজাজ খারাপ করে দিচ্ছে।”
লুবনা ফয়সালের বকাঝকায় যতটা না কষ্ট পেয়েছে তার থেকে বেশি কষ্ট পেয়েছে আশেপাশে কিছু লোক আড়চোখে তাকানোর ফলে। নিষাদ হাত চেপে ফয়সালকে শান্ত হতে বলে। ইশানও ইশারায় থামতে বলে। ফয়সাল নিজেও বুঝতে পারে সে ওভার-রিয়েক্ট করে ফেলেছে। লুবনা ভীষণ মনঃক্ষোভ নিয়ে অন্যপ্রান্তে চলে গেলো। নোলক কাছে এসে তেজী স্বরে বলে,
“তুই ওর সাথে একটু বেশি করিস। আশ্চর্য! ঘুরতে এসে তোদের জন্য স্বাধীন ভাবে ঘুরা যাচ্ছে না। ডিসগাস্টিং!”
নোলক আর দাঁড়াল না। শ্রেয়ার কাছে গেলো।
আদ্র চুপচাপ দাঁড়িয়ে সবটা দেখে। কিন্তু কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া করে না।

ফয়সাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লুবনার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। লুবনা চলে আসতে লাগলে শক্ত করে হাত টেনে নিজের সঙ্গে দাঁড় করায়। লুবনার দিকে ফিরে বলে,
“বেশি বকে ফেলেছি, না? আচ্ছা, স্যরি। আর বকবো না।”
লুবনা রাগ এবং অনুরাগের চোখে তাকায়। চাপা ক্ষোভ নিয়ে বলে,
“কই, অন্যদের তো এমন বকিস না! তোর সব শাসন কি শুধু আমাকে ঘিরেই, ফয়সাল? কেন সহ্য করতে পারিস না আমায়? কেন অন্যদের সামনে এভাবে ছোট করিস সবসময়? আমি কোনো প্রতিবাদ করি না তাই? নাকি আমায় এতোই অপছন্দ যে অপমান করে সুখ পাস।”
তীব্র আক্রোশ লুবনার প্রতিটা কথায়। ফয়সাল মাথা পেতে নেয় প্রতিটা শব্দ, বাক্য, কথা! নত স্বীকার করে বলে,
“স্যরি!”
লুবনা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
“তোর আছেই এই একটা সম্বল। যা ইচ্ছে হয় তাই করবি, তারপর স্যরি! কত সহজ! হাত ছাড়।”
ফয়সাল ছেড়ে দেয় হাত। ধরে রাখার সাধ্য তার নেই। তার অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বলতে পারে না। কোথায় যেন কিসের একটা দ্বিধা, বাধা!
“বলে দাও। যা বলার বলে দাও। এত দ্বিধাদন্দে থেকো না ছোট ভাই!”
লুবনা চলে যেতেই ক্যামেরা হাতে ফয়সালের সামনে এসে দাঁড়ায় ইশান। ক্যামেরা দৃষ্টি রেখে কিছু উলোট-পালোট করতে করতেই কথাটা বলে সে।

ফয়সাল ঘার ঘুরিয়ে তাকায় ইশানের দিকে। খুব একটা চমকেছে তেমন নয়। ইশান ক্যামেরা থেকে মুখ তুলে ফয়সালের দিকে চায়। রহস্যজনক হেসে বলে,
“না বললে এই বোকা মেয়ে উল্টো ভুলই বুঝবে। সে বুঝবেই না যে, সোহাগ করে যে শাসন করে সে। অনুভূতি বেশিদিন চেপে রাখতে নেই। বলে ফেল। বন্ধু বলে দ্বিধাদন্দে ভুগো না।”
ফয়সাল বিপরীতে একটা অতৃপ্ত হাসি ফিরিয়ে দেয়। ‘ইচ্ছে থাকলেও যে, মানুষ বেশিরভাগ সময় ইচ্ছে সফল করতে পারে না’ সে কথা আর মুখ ফুটে বলে না। সুন্দর প্রকৃতির দিকে চেয়ে তপ্ত এক দীর্ঘশ্বাঃস ফেলার চেয়ে আর বেশি কিছুই করার নেই তার।

হঠাৎ মন্দিরের ভেতর থেকে মৃদু কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। ফয়সাল আর ইশান দুজন দুজনের দিকে চায় অবাক হয়ে। ইশান বলে,
“কাঁদছে কে?”
ফয়সাল আকাশ সমান বিস্ময় নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,
“শ-শ্রেয়া! চলুন তো।”
বলেই দুজন মন্দিরের দিকে ছুটে আসে।
……..(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here