#ধারাবাহিকগল্প
#চোরাবালি
পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী
আজকে আর রায়হানের সাথে ঝগড়া করার কোনো মুড নেই। কথায় কথা বাড়ে। এর থেকে এখন কথা না বলাই শ্রেয়। আসলে জুলির শরীরটা ভালো না। আজকে অফিসে কেন যেন মাথাটা চক্কর দিয়েছে। তারপর দিনশেষে অপমান ঝোলায় ভরে বাড়িতে ফিরেছে। আজকে সারাদিন সায়ান একবারও ফোন দেয়নি। ইনবক্সে কোনো ম্যাসেজ পাঠায়নি। জুলি ভাবছে,ওর মায়ের যে আজকে অফিসে আসার কথা এটা কি সায়ান জানতো না? না কি জেনেও না জানার ভান করেছে। হয়ত এই কারনে ফিল্ড ভিজিটে গিয়ে আর অফিসে আসেনি। তবে রুবি ম্যাডাম দেশে থাকলে সায়ান ওর কাছে আসে না। কিন্তু সারাদিন ইনবক্সে ম্যাসেজ পাঠাতো। এবার এসবের ব্যতিক্রম ঘটলো। তারপরও জুলি ওর আজকের অপমানের কথা সায়ানকে ইনবক্সে জানিয়ে দিয়েছে। সায়ান ডেকেছে বলেই তো জুলি ওকে সঙ্গ দিয়েছে। দায়টা জুলির একার হবে কেন?সায়ান মেসেজের উত্তর দেয়নি তবে সিন করেছে। সামনে একটা জুলির কনসেপ্টের প্রেজেনটেশন আছে। তার উপর ভিত্তি করে একটা কট্রাক্ট সাইন হওয়ার কথা আছে। অথচ ওর মা এসে ওকে অপমান করে গেলো। সায়ান যদি এর একটা বিহিত না করে তাহলে জুলিও দেখে নেবে এই প্রজেক্টটা কি করে কোম্পানী পায়? জুলি নিজের রুমে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে ওয়াশরুমে চলে গেল। ফ্রেস হয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। এমন সময় দরজায় মিনারা খালা নক করলো।
—–খালা ভিতরে আসেন।
—–ম্যাডাম ডিনার দিয়ে দিবো।
—–না আমি রাতে কিছু খাবো না। এক গ্লাস আপেলের জুস আর পানি দিয়ে যান। আর ওই টেবিলের কোনায় টাকা রাখা আছে রায়হানকে দিয়ে দিবেন।
মিনারা খালা জুস দিয়ে যাওয়ার পর জুলি দরজাটা লক করে দিলো।
_______
মিনারা খালা রায়হানকে গিয়ে বললো,
—–ম্যাডাম আপনারে এই ট্যাকাটা দিছে। আপনার খাওনডা কি দিয়া যামু।
—-না রাতে কিছু খাবো না। আমি এখন বের হবো।
আপনি দরজাটা লক করে দেন।
রায়হান বাসা থেকে বের হয়ে ভাবছে জুলির কি হল আজ? না চাইতে টাকা হাতে তুলে দিলো। আজ আবার কড়কড়ে একটা একহাজার টাকার নোট দিয়েছে। না কি সায়ান চৌধুরী ওকে ছুঁড়ে ফেলেছে। সায়ান ওকে ছুড়ে ফেললে রায়হানের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সুবিধা হয়।
বুকের ভেতরটা কেন যেন এত বছর পর কি এক জ্বালায় জ্বলে যাচ্ছে। আক্রোশে নিজেকেই যেন ক্ষত বিক্ষত করে ফেলতে মন চায়। এতো বড় লজ্জা আজ দশ বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে। রায়হান জানে, বড় লোকের নচ্ছার ছেলে একদিন জুলিকে আস্তাকুঁড়ের ডাস্টবিনে ফেলে দিবে। সেদিন জুলিকে রায়হানের হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।
রায়হানের ভুল ছিলো ও জুলিকে নিজের সমস্তটা দিয়ে বিশ্বাস করেছে। প্রথম প্রথম ও ধরতে পারেনি জুলির সাথে সায়ান চৌধুরীর সম্পর্কের ব্যাপারটা। যখন অফিসে কানাঘুষা শুরু হলো, রায়হানকে ওর কলিগরা নপুংশক বলে টিটকারী মারত তখন ওর কাছে বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যায়। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। এরপর রায়হান চাকরিটা ছেড়ে দেয়। সেদিন বাসায় এসে জুলিকে ও জিজ্ঞাসা করেছিলো,
—–জুলি কেন তুমি আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করলে?
—–কিসের বিশ্বাস?কে বলেছে তোমায় আমায় বিশ্বাস করতে? মাসের পর মাস যখন বাড়ি ভাড়া দিতে পারতে না,তোমার বাবার ওষুধের টাকা যোগাড় করতে পারতে না তখন ওগুলো আমাকেই ম্যানেজ করতে হয়েছে। সেদিন কেথায় ছিলো তোমার এই বিশ্বাস। সেদিন কি একবার জিজ্ঞাসা করেছিলে টাকাটা জুলি তুমি কোথা থেকে আনলে। সেদিন তোমার জুলির থেকে টাকার দরকার ছিলো বেশী। সুতরাং তোমার ডায়লগ গল্প সিনেমায় শোভা পায়। বাস্তবে বেঁচে থাকতে হলে কড়ির দরকার হয়।
——তাহলে তুমি সায়ানের মক্ষিরানি হয়ে বেঁচে থাকতে চাও?
—–দেখ তোমার না পোষালে তুমি চলে যেতে পারো। আমাকে আমার মত চলতে দাও।
—-জুলি তুমি যেমন আমার সাথে প্রতারনা করলে তেমনি আমিও তোমাকে ছাড়বো না। আমি এর শেষ দেখে নেবো।
সেদিনের পর থেকে রায়হান আর জুলির মধ্যে পাকাপোক্তভাবে দুরত্বের প্রাচীর তৈরী হলো। পুরোনো কথাগুলো মনে হলে রায়হানের সারা শরীরের জ্বালা পোড়াটা বেড়ে যায়। প্রথম প্রথম মাদক নিলে কষ্টগুলো মূহুর্তেই দূর হয়ে যেত। তখন মাদক নিতে ভালো লাগতো। এখন বিরক্ত লাগে। শরীরের অভ্যাসের কারনে নিতে হয়। না নিলে শরীর খারাপ লাগে। আর কষ্টগুলো এখন আর দূর হয় না। অহর্নিশ ওকে পােড়ায়। কিছুক্ষণের মধ্যে নেশাটা করতে না পারলে শরীরের কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যাবে। এখন তো ওই জায়গায় যাওয়ারও শক্তি নাই। রায়হান রাস্তার উপরেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো।
সায়ান আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছে। তারপর ফ্রেস হয়ে সোজা মায়ের রুমে ঢুকে জিনাতুন্নেসাকে বললো,
—–মা, তোমার সাথে আমার কথা আছে।
—-সায়ান এতো অভদ্র কবে হলে? আমার রুমে ঢুকার অনুমতি আমার কাছ থেকে নিয়েছো? এইজন্য মনীষিরা বলে সৎসঙ্গে স্বর্গবাস অসৎসঙ্গে সর্বনাশ।
—-মা তুমি আমার অফিসে গিয়ে আমার স্টাফের সাথে বাজে ব্যবহার করার অধিকার তোমায় কে দিয়েছে?কাগজে কলমে আমি ওনার।
—-মুখ সামলে কথা বলো সায়ান। তোমাকে শুধু পাওয়ার অব এটর্নী দেওয়া হয়েছে। যে কোন মূহুর্তে আমি তোমাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে পাওয়ার অব এটর্নী দিতে পারি। শোন সায়ান তোমার ভালোর জন্য বলছি ছেলে পুলের বাবা হয়েছো। ওরা এখন বড় হচ্ছে। নিজের সম্মান রক্ষার্তে এসব অপকর্ম করা বাদ দাও। আর ঐ নষ্টা মেয়েটাকে অফিস থেকে বের করে দাও।
—–সামনে কোম্পানীর একটা বড় প্রজেক্টের ডিল হওয়ার কথা আছে। আর ঐ প্রজেক্টের কনসেপ্টা মেয়েটা তৈরী করেছে। যেহেতু কনসেপ্টা ঐ মেয়েটার তাই প্রেজেনটেশন ওকেই করতে বলেছি। ওই মেয়েটা যদি মেন্টালি আপসেট থাকে তাহলে আমার অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সামলাবে কিভাবে?
আর ঐ মেয়েটাকে চৌকষ করে তৈরী করেছে এই কোম্পানী। তাই কোম্পানীর স্বার্থে ওকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। তবে তুমি যদি আমাকে ওর মতো চৌকষ এমপ্লয়ী যোগাড় করে দিতে পারো তাহলে ওকে বাদ দিতে আমার কোনো সমস্যা নাই।
—–শোন সায়ান ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয় না। তোমাকে যা বলার আমি বলেছি। এখন আর এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তুমি এখন আসতে পারো।
চলবে