চিলেকোঠায়_সমাপ্তি
চতুর্থ_পর্ব
~মিহি
বাড়িতে ফিরে সিদ্ধিকে আশেপাশে কোথাও দেখতে পেলেন না সায়ন সাহেব। পরক্ষণেই তার মনে হলো এই সময় তো মেয়েটা কলেজে থাকে, নিশ্চিন্ত হলেন। আজকাল সিদ্ধিকে নিয়ে তার প্রচুর ভয়। ৯ বছর আগের ভয়টা এখনো তাড়া করে বেড়ায় তাকে। আনমনে বসে দিনগুলোর কথা ভাবতে লাগলেন তিনি।
_____________
সিদ্ধির বিয়ের পর থেকেই চিন্তার শেষ নেই সায়ন সাহেবের। অতটুকু একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আশেপাশে কত শত্রু, হুট করে কেউ এসব জেনে গেলে বিপদের অন্ত থাকবে না। আশঙ্কাটা শেষ অবধি সত্যিই হলো সায়ন সাহেবের। ব্যবসায়িক শত্রুতার জের ধরে এক ব্যবসায়ী মাঝরাতে তাকে এবং তার পরিবারকে হত্যা করতে একটা গুণ্ডা পাঠায়। সায়ন সাহেব, তার স্ত্রী এবং সন্তান ছাড়া তখন কেউ নেই বাড়িতে। রফিকউদ্দিন সাহেব মাঝে মাঝেই বেড়াতে আসেন। সেদিনও এসেছিলেন, রাত অনেকটা হয়ে যাওয়ায় সায়ন সাহেব আবদার করেন আজ এ বাড়িতেই থেকে যেত। বেশ অনেকবার বারণ করার পরেও শেষমেশ একমাত্র বিয়াই সাহেবের কথা মেনে নিয়ে তিনি থাকতে রাজি হন। সে রাতটাই ছিল সায়ন সাহেবের জীবনের সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত। মাঝরাতের দিকে এক গুণ্ডা দরজার ছিটকিনি ভেঙে বেশ সন্তর্পণে ঘরে ঢোকে। রফিকউদ্দিন সাহেব তখন গভীর ঘুমে। প্রধান দরজার পাশের ঘরেই তিনি ঘুমন্ত অবস্থায়। গুণ্ডাটা সবার প্রথমে তার পেটেই ছুরি চালায়। রান্নাঘরে পানি খেতে আসা ছোট্ট সিদ্ধি দৃশ্যটা দেখে ফেলে। ছুরি নিয়ে ছুটে আসে গুণ্ডাটা। সিদ্ধি হাত-পা ছুঁড়ে গুণ্ডাটার হাত থেকে ছুরি কেড়ে নেয়। গুণ্ডা লোকটা পাশে থাকা ফুলদানি দিয়ে সজোরে আঘাত করে সিদ্ধির মাথায়। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে মেয়েটা। সায়ন সাহেবের ঘুম ভাঙে তৎক্ষণাৎ। কী করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। রফিকউদ্দিন সাহেব ততক্ষণে প্রাণ ত্যাগ করেছেন। এই মুহূর্তে আফসোসের শেষ নেই সায়ন সাহেবের কিন্তু নিজের পরিবারের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চাননা তিনি। সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গুণ্ডাটাকে এক ঘরে বন্দি করে স্ত্রী-অজ্ঞান সন্তানসহ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান রাতের অন্ধকারে। চলে আসেন শহরে, আশ্রয় নেন বন্ধু তারেকের কাছে। সিদ্ধি তখনো অসুস্থ, চিকিৎসা চলছিল তার। দীর্ঘসময় চলে চিকিৎসা। অবশেষে ডাক্তার জানান সিদ্ধি আগের সব কথা ভুলে গেছে। মাথায় গভীর আঘাতের দরুন পুরনো স্মৃতিশক্তির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশও তার কাছে অস্পষ্ট এখন। সায়ন সাহেব ভেঙে পড়েন পুরোপুরি। ভেবেছিলেন আবারো গ্রামে ফিরে যাবেন কিন্তু বন্ধু তারেকের মাধ্যমে জানলেন গ্রামের সবাই সায়ন সাহেবকে খুনী ধরে নিয়েছে, গ্রামে ফেরাটা মোটেও নিরাপদ নয়। রফিকউদ্দিন সাহেবের মৃত্যুর দায়ভার তখনো তার অন্তরকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। সিদ্ধিকে নিয়ে শুরু হয় তার পরিবারের নতুন পথচলা, পুরনো সব স্মৃতি মুছে এক নতুন স্মৃতি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টার মাঝপথে এসে হাত ছেড়ে দিলেন স্ত্রী সুবহা। চিরতরে পৃথিবী ছেড়ে পরলোকে পাড়ি জমালেন। সায়ন সাহেবও চেষ্টা করে চলছিলেন পুরনো সমস্ত স্মৃতি মুছে ফেলার কিন্তু তার এ দীর্ঘ ন’বছরের প্রচেষ্টা বিফলে গেল যখন আয়াশ এসে উপস্থিত হলো তার কাছে, ভালোবাসার দাবি নিয়ে। সায়ন সাহেব ভেবেছিলেন আয়াশ হয়তো নিজের পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চাইবে কিন্তু নাহ! গ্রামবাসী না বুঝলেও আয়াশ ঠিকই বুঝেছিল সেদিনের পরিস্থিতিটা। সব শোনার পর আয়াশ কেবলমাত্র একটু সময় চায় সিদ্ধিকে সব মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। সায়ন সাহেবের তখন আর কিছুই করার নেই। তিনিও চাইতেন সিদ্ধির সব মনে পড়ুক। এতকিছুর মাঝে যে তারেকের ছেলে তাহমিদ সিদ্ধিকে ভালোবাসে উন্মত্ত হয়ে উঠবে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তিনি।
_________________________
-“বাবা শুনছো?”
সিদ্ধির ডাকে ঘোর কাটল সায়ন সাহেবের। কিছুক্ষণের স্মৃতিচারণেই চোখ বেয়ে পানি গড়াতে শুরু করেছে।
-“কি হয়েছে বাবা তোমার?”
-“কিছু না রে মা। তোর মায়ের কথা মনে পড়ছিল।”
মায়ের নাম শুনে সিদ্ধির মুখটাও অনেকখানি মলিন হয়ে যায়। সায়ন সাহেব লক্ষ করলেন সিদ্ধি আয়াশের সাথে এসেছে। ভ্রু কুঁচকে মুখ টিপে হাসলেন তিনি।
-“বাব্বাহ! আজ আদা আর কাঁচকলা দেখি একসাথে? কী খিচুড়ি পাকাচ্ছেন শুনি?”
-“তেমন কিছু না আঙ্কেল, আপনার মেয়েকে বৃষ্টিভেজা রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাওয়া শিখালাম।”
-“তাই নাকি? বেশ তো। ফ্রেশ হও তোমরা। আজকের রান্না আমি করবো ভাবছি।”
আয়াশ মাথা নেড়ে সায় দিল। অতঃপর নিজের ঘরের দিকে এগোলো। সিদ্ধি ঘরে এসে বসতেই বিশ্রি একটা গন্ধে গা গুলিয়ে আসলো তার। পরক্ষণেই মনে পড়লো আয়াশের ঘরে মদ রাখার কথা ছিল। কিন্তু এখন যে তীব্র গন্ধ আর তাছাড়া আয়াশও নিজের ঘরে, এখন বোতলটা চিলেকোঠা ঘরে রাখার কোন উপায় নেই কিন্তু নিজের ঘরেও রাখা যাবে না। সিদ্ধি ওয়াশরুমে ঢুকে বোতলের ভেতরের সমস্ত তরল পানীয় ফেলে দিয়ে বোতলটাকে বেশ ভালোমতো ধুয়ে নিলো। বোতলটা ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখে সামনে সায়ন সাহেব দাঁড়িয়ে। সায়ন সাহেব হা হয়ে সিদ্ধির হাতে থাকা বোতলটা লক্ষ করছেন। বাবার এমন তীক্ষ্ম দৃষ্টি দেখে ভয়ে সিদ্ধির হাত থেকে বোতলটা মেঝেতে পড়ে কয়েক টুকরো হয়ে গেল।
_____________
-“বাবা বিশ্বাস করো আমি এসব ছাইপাশ খাইনা।”
-“তাহলে এই বোতল তোমার ঘরে কোথা থেকে এলো?”
-“বাবা আ..আমার বোতলের ডিজাইনটা ভালো লেগেছিল, ঘরে সাজিয়ে রাখার জন্য এনেছিলাম।”
-“তা হলে বোতলটার গা থেকে বিশ্রি গন্ধ বের হচ্ছিল কেন? আর সাজানোর জন্য আনা বোতল ধুতে হয়? কি এমন ছিল এই বোতলে?”
-“বাবা, তুমি আমায় সন্দেহ করছো?”
-“না, তোমার কীর্তিকলাপে সন্দেহ করছি। যা ইচ্ছে হয় করো। আমার কী! তোমার স্বামী বুঝবে সব।”
বলেই সায়ন সাহেব ঘর ছেড়ে বের হলেন। সিদ্ধি তার বাবার কথার তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো,”আমার স্বামীর কথা বলে গেল কেন বাবা? আমায় বিয়ে দিতে চাচ্ছে নাকি? এর পিছনেও নির্ঘাত ঐ চিলেকোঠার ভাড়াটিয়ার কুমন্ত্রণা আছে। বজ্জাত ব্যাটা! তোকে আমি বাড়ি থেকে বের করতে চাচ্ছি আর তুই কিনা আমায় শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে চাচ্ছিস? নির্ঘাত এই ছেলে আমাদের বাড়ি কব্জা করতে চায়। একে আমি বাড়ি থেকে বের করেই ছাড়বো যাই হয়ে যাক না কেন।”
____________________
ছাদের কিনারা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আয়াশ। সায়ন সাহেব আয়াশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলেন। ছেলেটার উদাসীন মুখ দেখলে বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে তার। যে ছেলেকে তার ঘরে বসিয়ে জামাই-আদর করার কথা, সে ছেলেটা কি না চিলেকোঠায় থাকছে?
-“কিছু বলবেন আঙ্কেল?”
-“না বাবা। এমনিই আসছিলাম।”
-“আপনি কি আমার থেকে কোন বিষয় লুকিয়েছেন?”
-“এমনটা কেন মনে হচ্ছে তোমার?”
-“ভুল বুঝবেন না আঙ্কেল কিন্তু ঐ রাতের পর সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন আপনি কিন্তু কেন? চাইলেই তো আপনারা গ্রামে ফিরতে পারতেন, গুণ্ডাটা তো মরেই গিয়েছিল।”
-“মরে গেছিল মানে? কে মারলো ওকে?”
-“গ্রামবাসী যতদূর ধারণা করেছে গুণ্ডাটা আপনার বাড়িতে ঢুকে আমার বাবাকে মারার পর জঙ্গলের দিকে পালিয়েছে। জঙ্গলের অভিমুখে তার ছিন্ন-বিছিন্ন লাশ দেখে মনে হয়েছিল কয়েকটা নেকড়ে অতর্কিত আক্রমণ করেছিল।”
-“গ্রামবাসী এখনো তোমার বাবার মৃত্যুর জন্য আমাকে দোষারোপ করে, তাই না?”
-“মানে? আপনাকে কেন দোষারোপ করবে?”
-“সবাই তো এটাই ভাবে যে আমি তোমার বাবাকে মরতে দেখে পালিয়ে এসেছি কিংবা এই খুনের সাথে আমার যোগসূত্র আছে।”
-“একদমই না। গ্রামবাসী আপনাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে। আপনি চলে আসার পর সবাই অনেক চেষ্টা করেছে আপনাকে খোঁজার কিন্তু কোন হদিস পাওয়া যায়নি বলে সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছে।”
-“কিন্তু তারেক যে বললো গ্রামবাসী আমায় খুনী ভেবেছে আর গ্রামে যাওয়া মোটেও নিরাপদ না।”
-“তিনি কে?”
-“আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু।”
-“বুঝলাম না তিনি এসব কথা আপনাকে কেন বললেন। এমন কিছুই তো গ্রামে ঘটেনি আর ঘটার কথাও না। বাবার মৃত্যুর পর বেশ কয়েক বছর আমি নিয়মিত যাতায়াত করেছি গ্রামে। মেডিকেলে এডমিশনের পর মা আর নাফছীকে নিয়ে শহরে আসা এবং বাবার রেখে যাওয়া সঞ্চয় আর নিজের সামান্য উপার্জন দিয়ে বাড়ি করা।”
-“নাফছী কেমন আছে আর জোহরা আপা?”
-“মা আর নাফছী ভালোই আছে। ভাবছি সিদ্ধিকে নিয়ে দেখা করে আসবো একদিন।”
-“নিজের বাড়ি রেখে এখানে থাকছো যে? সিদ্ধি সন্দেহ করবে এসব জানলে।”
-“সন্দেহ করে যদি সত্যি জানার চেষ্টা করে আমার জন্য সুবিধা তবে তারেক সাহেবের বিষয়টা কিন্তু ক্লিয়ার না আঙ্কেল।”
-“আমার কাছেও। আমি ভাবছি এটা নিয়ে। তুমি খেতে এসো।”
সায়ন সাহেব খেতে ডাকলেন বেশ সাবলীলভাবে। তারেক সাহেবকে সন্দেহ করছেন না তিনি। তার বিশ্বাস তার বন্ধু বোধহয় পরিস্থিতিটা ভুল বুঝেছে কিন্তু আয়াশ প্রখরভাবে সন্দিহান এই তারেক নামক ব্যক্তিটাকে নিয়ে। কেননা এই ন’বছরে তার কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে সে রাতে যা হয়েছিল তা কোন কাকতালীয় ব্যপার ছিল না, সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের মাস্টারমাইন্ড প্ল্যান ছিল যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল হয় সায়ন সাহেবকে সপরিবারে মেরে ফেলা অথবা গ্রামছাড়া করা। বেশ মনোযোগ দিয়েই বিষয়গুলোর উপর এবার দৃষ্টি দিল আয়াশ। ন’বছর আগের রহস্যের প্যাঁচটা বোধহয় এবার খুলতে সক্ষম হবে সে।
চলবে…
[ অনুগ্রহপূর্বক সকলে গঠনমূলক মন্তব্য করবেন এবং গল্পের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিবেন😊।]