#চিঠি
পর্ব ২(শেষ পর্ব)
শীতের কুয়াশা ভেদ করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। কয়েক সাপ্তাহ হলো পরিক্ষা শেষ হয়েছে। দুইমাস ধরে সোয়েব ভাইকে দেখছিনা। হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেলো কে জানে। উধাও হলেও বা আমার কী? তবে এটা সত্যি হঠাৎ তাকে ভীষণ মনে পড়ছে। এতোদিন পরিক্ষার চিন্তা মাথায় থাকার কারণে তার কথা মনে আসেনি তবে এখন তার কথা বড্ড মনে পড়ছে। ঘরে ঢুকে মাকে জিজ্ঞেস করলাম। মা বললো তিনি এবিষয়ে জানেন না। আমি সোয়েব ভাইদের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঘরের দরজায় তালা লাগানো অর্থাৎ তাদের ঘরে কেউ নেই। একসাথে সবাই হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেলো। বিষয়টা আমাকে ভাবাচ্ছে। মাকে বিষয়টা জানালাম। মা সোয়েব ভাইয়ার মায়ের নাম্বার এ কল দিলো কিন্তু নাম্বার বন্ধ দেখালো। এবার বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম তবে বাইরে প্রকাশ করলাম না।
.
তার দুই সাপ্তাহ পর সোয়েব ভাইদের দরজায় দেখলাম তালা লাগানো নেই এ-র মানে বাসায় মানুষ আছে। এতদিনে এসে আমি শান্তি পেলাম। সোয়েব ভাই বাইরে বের হয়ে আমাকে দেখে মুচকি হেসে বললেন,
“কীরে ইতি! মানুষের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস কেন ভিখারির মতো। তোর বোধ হয় কোনোদিন বুদ্ধি হবেনা।”
আমাকে ভিখারির সাথে তুলনা করার পরে-ও আমার রাগ হলোনা। আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম সোয়েব ভাইয়ের দিকে। চেহারাটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। ফর্সা চেহেরাটা কেন যেন তার লাবন্য হারিয়েছে। আমি সোয়েব ভাইকে প্রশ্ন করলাম,
“কোথায় গিয়েছিলে তুমি? ”
“আমরা আমেরিকা গিয়েছিলাম সবাই মিলে।”
“কেন গিয়েছিলে? আর আমাদের কিছু জানাওনি কেন?
” তুই এতো প্রশ্ন কেন করছিস বলতো? দুই মাসে বেশ পেকে গিয়েছিস দেখছি।”
আমি আর কোনো প্রশ্ন করলাম না। সোয়েব ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলেন।
“কী হয়েছে হাসছো কেন?”
“কিছু না।”
আমি আরও একবার প্রশ্ন করলাম,
“তোমার শরীরের এ অবস্থা কেন হয়েছে? ”
সোয়েব ভাই নিজেকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন,
“আমেরিকা গিয়ে আমার ডায়রিয়া হয়ে গিয়েছিল। আমেরিকার এতো সৌন্দর্য আমার পেট বোধ হয় সহ্য করতে পারেনি।”
কথাটি শেষ করে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। তবে আমার হাসি পেলো না। আমি আবার প্রশ্ন করলাম,
“ডায়রিয়া হলে কেউ এতো শুকিয়ে যায় বুঝি!”
“তুই এমবিবিএস পাশ করেছিস নাকি। এতো আজাইরা প্রশ্ন করছিস কেন?”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর কিছু বললাম না।
.
রুমের ভিতরে হৈ-চৈ এর শব্দ পেয়ে উঠে বসলাম। লাইট অন করতেই দেখলাম বাবা-মা একটি কেক হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ কচলিয়ে প্রশ্ন করলাম,
“কী হয়েছে? ”
“হ্যাপি বার্থডে ইতি!”
আজ আমার বার্থডে অথচ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি ম্লান হেসে উওর দিলাম,
“তোমরা মনে রেখেছ। আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম। তোমাদেরকে অনেক ধন্যবাদ। ”
রাতে কেক কেটে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে দরজা খুলে দেখলাম একটা বাক্স দরজায় পড়ে রয়েছে। বাক্সটা দেখে আমি চমকালাম না কারণ দুই বছর যাবত আমার জন্মদিনে এমন একটা বাক্স কে যেন দরজার সামনে রেখে যায়। তবে কে সেই ব্যাক্তি তা আজও জানতে পারলাম না। অনেক আগ্রহ নিয়ে বাক্সটা খুললাম। বাক্স এর ভিতরের একটা বড়ো পেইন্টিং রাখা। পেইন্টিংটি দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কিন্তু বাক্সটিতে পেইন্টিং ছাড়াও আর-ও একটি জিনিস পেলাম। একটা আংটি। হয়তো ভুলবশত চলে এসেছে। আংটিটি চিনতে আমার ভুল হলোনা। তাহলে আমার সন্দেহ ঠিক প্রমাণ হলো। আমি আংটিটি হাতে নিয়ে মুচকি হাসলাম।
.
সোয়েব ভাইকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম।
“সোয়েব ভাই কেমন আছো?”
“ভালো। ”
“আমাকে জিজ্ঞেস করবেনা আমি কেমন আছি!”
“না পারবোনা। ”
“আজ আমার জন্মদিন সোয়েব ভাই। তুমি আমাকে শুভেচ্ছা দাওনি।”
সোয়েব ভাই মুখ কুঁচকালেন।
“এসব আজাইরা কাজ আমার ধারা সম্ভব না ইতি। জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানোর কী আছে বলতো যত্তসব ঢং!”
আমি মুচকি হাসলাম।
“ঢং তো তুমিও দারুণ করতে জানো।”
“মানে কী?”
“তুমি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছো। ”
সোয়েব ভাই ভ্রু কুঁচকালেন।
“তুই দিনদিন এমন হয়ে যাচ্ছিস কেন বলতো। জ্বিন ভূত ধরেনিতো আবার! ”
আমি এবারও হাসলাম।
“হি হি করছিস কেন শুধু শুধু। ”
আমি আমার ব্যাগ থেকে আংটিটা বের করলাম।
“দেখো তো এটা চিনতে পারো কিনা?”
সোয়েব ভাই আমার হাত থেকে টান মেরে আংটিটা নিয়ে নিলেন।
“তুই আমার আংটি কেন চুরি করেছিস ইতি?এটা কিন্তু খারাপ অভ্যাস।”
“একদম মিথ্যা বলার চেষ্টা করবেনা। আমি সত্যি শুনতে চাই। ”
“ফাজলামি করবিনা একদম আমার সাথে। ”
সোয়েব ভাই কথাটা শেষ করেই উল্টো দিকে হাঁটা ধরলেন। আমি আবারও তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
“সোয়েব ভাই! তুমি কি ভয় পাচ্ছো? আমি কিন্তু তোমাকে ফিরিয়ে দিবোনা বুঝলে।”
সোয়েব ভাই ঢোক গিলে উওর দিলেন,
“কী বলতে চাচ্ছিস তুই? তুই কিন্তু এখন নির্ঘাত আমার হাতের থাপ্পড় খাবি।”
“তুমি আমায় ভালোবাসো আমি জানি। কথা লুকানোর চেষ্টা করবেনা।”
সোয়েব ভাই আমার গালে কষে একটা চড় মারলেন।
“লজ্জা করেনা তোর ভাই ভাই বলে এসব মাথায় নিয়ে ঘুরিস। এজন্য আমি তোদের মতো মেয়েদের সাথে কথা বলতে চাইনা। লজ্জা বলতে কিছু নাই। ”
আমার মুখে আঁধার নেমে আসলো। সোয়েব ভাই সবসময় আমাকে অপমান করতেন তবে তা আমার কোনোদিন খারাপ লাগেনি কিন্তু আজ তিনি যেটা করলেন সেটা আমি আশা করিনি। সোয়েব ভাই পিছনে ফিরে দ্রুতগতিতে হেঁটে চলে গেলেন।
.
কথায় আছে সময় কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। দুইমাস পেরিয়ে গেলো। এই দুই মাস আমি একবারও সোয়েব ভাইয়ের মুখোমুখি হইনি। সবসময় তাকে এড়িয়ে চলেছি। কিছুদিন হলো বাবা-মা আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলছে। কোন ছেলের পরিবার নাকি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। ছেলে ইন্জিনিয়ার। এমন প্রস্তাব কী আর হাতছাড়া করা যায়। মা একবার আমার সাথে এবিষয়ে কথা বলেছিলেন। আমি কোনো উওর দেয়নি কারণ উওর দেওয়ার আমার কোনো ইচ্ছা ছিলনা। ঘর থেকে বের হতেই সোয়েব ভাই দৌড়ে আমার সামনে হাজির হলেন।
“আজকাল তোর দেখা পাইনা কী ব্যাপার!”
আমি কোনো উওর দিলাম না। সোয়েব ভাইয়া আবারও বললেন,
“শুনেছি তোর জন্য লাল টুকটুকে বর খুঁজে এনেছে। ছেলে নাকি ইন্জিনিয়ার। তাহলে অবশেষে পেয়ে গেলি তুই বর।”
আমি ভ্রু কুঁচকে সোয়েব ভাইয়ের দিকে তাকালাম।
“কী দেখছিস এভাবে। আর বিয়ে কখন করছিস সেটা বল?”
“তুমি তাহলে চাও আমি বিয়েটা করি?”
“অবশ্যই! কেন নয়। তুই খুশি থাকবি এর চাইতে বেশি কী হতে পারে। ”
“তুমি কোনোদিন আমায় বুঝলে না সোয়েব ভাই! ”
“তুই এতো ইমোশনাল কেন হচ্ছিস ইতি? বিয়ের আগে তো খুশি থাকতে হয়,ফুর্তি করতে হয়।”
আমার খুব কান্না আসছিল। আমি সেখান থেকে দৌড়ে বাসায় চলে আসলাম। কিছুক্ষণ পর বাবা আমার রুমে আসলো।
“ইতি?”
“বলো বাবা।”
“তুই কী বিয়েতে রাজি আছিস? দেখ ছেলেটা খুব ভালো। আমার বিশ্বাস তুই এই ছেলের সাথে সুখে থাকবি।”
আমি শুধু বললাম,
“হুম রাজি।”
এর চাইতে বেশি কিছু বলতে পারছিলাম না গলা ধরে আসছিল। বাবা খুশিতে হনহন করে বাইরে চলে গেলেন মাকে জানানোর জন্য।
.
প্রকৃতি বড়ো বিচিত্র। আমরা কেমনভাবে দিন কাটাচ্ছি তা তার দেখার বিষয় না সে সবসময় তার নিজ ছন্দে বয়ে চলে। বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। মনটা মানছিল না। কী হতো যদি স্বপ্নের মতো সোয়েব ভাই এসে বলতো,তুই আমাকে ছেড়ে অন্যকাউকে কীভাবে বিয়ে করছিস ইতি। এই যে দেখ আমিতো এখানেই দাঁড়িয়ে আছি। ছুটে চলে আয় আমার কাছে। কিন্তু তা হওয়ার ছিল না। বিয়ের দিন চলে এলো। ঘরোয়াভাবে আয়োজন করা হয়েছে। আমি চুপচাপ বসে আছি মুখে কোনো শব্দ নাই। এক সময় কবুল বলার সময় হলো। আমার কেন যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। মুখ থেকে তিন অক্ষরের একটা শব্দ ‘কবুল’ বের করতে পারছিলাম না। মনে কোনো আমার তা-ও ক্ষীণ আশা ছিল হয়তো সোয়েব ভাই আসবে কিন্তু তা হলোনা। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় কবুল বললাম। বিবাহ সম্পূর্ণ হলো। এ-র কিছুক্ষন পরেই সোয়েব ভাইয়ের মা কোথা থেকে যেন দৌড়ে এসে আমার পায়ের কাছে বসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আমি বসা থেকে উঠে পরলাম। মনটা ধুকধুক করছে। হঠাৎ করেই মনটা অস্থির হয়ে উঠলো।
“ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমার কলিজার টুকরোটা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।”
আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারলাম কিছু একটা ঠিক নেই। কিছু একটা অঘটন ঘটেছে।
আমি সোয়েব ভাইয়ের মাকে বসা থেকে উঠালাম। প্রশ্ন করলাম,
“কী হয়েছে? কে ছেড়ে চলে গিয়েছে? ”
তিনি হাতের মুঠো খুলে একটা চিঠি আমার হাতে দিলেন। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা খুললাম,
“প্রিয় ইতি,
আঁধার ছেয়ে থাকা এক শ্রাবণের দিনে এক রমণীর আগমন ঘটেছিল আমার জীবনে। আঁধার কালো মেঘের মাঝে মেয়েটি আমার নজরে পড়তেই এই শ্রাবণ মাসে আমার মনে প্রদীপ জ্বলে উঠেছিল। ছাতার জন্য তার চেহেরাটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম না। মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল তাকে দেখার জন্য। মনের সাথে পেরে উঠতে পারলাম না। ছুটে গেলাম সিঁড়ির দিকে। মেয়েটি যখন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল তার নুপুরের ছন্দে আমার মন নেচে উঠেছিল সেদিন। পরবর্তীতো জানতে পারলাম এই সুন্দরী রমণীর নাম ইতি। সেখান থেকেই শুরু হয়ে গেলো আমার যেচে পড়ে কথা বলা তার সাথে। ভালো লাগতো তোর সাথে কথা বলতে, ভালো লাগতো তোকে জ্বালাতন করতে। তুই যখন আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করতি বিশ্বাস কর আমার কাছে পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দরী তোকে মনে হতো। কিন্তু কখনো অন্তরে লুকানো কথা তোর কাছে প্রকাশ করতে পারতাম না কেন যেন মনটা অন্তরের ভালোবাসার কথা অপ্রকাশিত রাখতে চেয়েছিল। একদিন মাকে সব জানালাম। মা সেদিন খুশিতে পুরো ঘর মাথায় তুলেছিল যেন তোকে এ ঘরের বউ করা তার বহুদিনের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এই খুশি বেশিদিন থাকলো না শীঘ্রই এক অন্ধকার আমাদের গ্রাস করে নিলো। একদিন সকাল ঘুম থেকে উঠে দেখলাম কাশির সাথে আমার রক্ত বমি হচ্ছে। মা-বাবাকে বলতেই তারা দ্রুত ডাক্তার এর কাছে নিয়ে গেলো। ডাক্তার কিছু পরিক্ষা দিয়েছিল। পরবর্তীতে জানতে পারলাম আমি সেই রোগে আক্রান্ত যে রোগ মুক্তির একমাত্র উপায় মৃত্যু। ছোটকালে যখন শুনতাম কেউ ক্যান্সারে মারা গিয়েছে তখন খারাপ লাগতো কিন্তু তখনও একজন ক্যান্সারে আক্রান্ত রুগীর এবং তার পরিবারের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারিনাই। সেই কষ্ট তখনই বুঝতে পেরেছি যখন একই মরণ ব্যাধী রোগে আমি আক্রান্ত হলাম। ডাক্তার স্পষ্ট বললো আমার কাছে বড়োজোর দুই থেকে আড়াই মাস সময় আছে। মা বিশ্বাস করলোনা। চিকিৎসার জন্য গেলাম আমেরিকায়। তবে আমি জানতাম এই মৃত্যু পথযাত্রীকে যে মৃত্যুর হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা। ভেবেছিলাম জীবনের যে কয়েকটা দিন বাকি আছে তা আমেরিকায় কাটিয়ে দিবো কিন্তু মনের সাথে হেরে গেলাম। তোকে বড্ড মনে পড়ছিল তাই ফিরে আসলাম বাংলাদেশে। এর কিছুদিন পর তুই সব জেনে যাস। দুই বছর ধরে যে দিনটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম সে দিনটা চলে আসলো কিন্তু ভাগ্য যে আমাদের সহায়ক ছিল না এই মৃত্যু পথযাত্রীর সাথে আমি তোকে জড়াতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম তুই আমার থেকে দূরে সরে যা কিন্তু এবারও আমি ব্যার্থ হলাম। পারলাম না আমার শেষ অনুভূতিগুলো তোকে না জানিয়ে থাকতে। সামনাসামনি বলার সাহস ছিল না তাই চিঠি লিখলাম। জানিস! সেদিন ঘরে ঢুকে দেখলাম মা আমার আলমারি থেকে কাপড়গুলো বের করে তা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আমার তখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, মা কাপড় কেন জড়িয়ে ধরে কাঁদছ এখন তো আমি আছি আমাকেই নাহয় জড়িয়ে ধরে কাঁদো কারণ কয়েকদিন পরে হয়তো সেই সুযোগটাও পাবে না কিন্তু সেদিন কেন যেন মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি। ইতি! আমি চাই তুই সুখে থাক,আমি চাই তুই বিয়েটা কর। আমার খুব ইচ্ছা তোর বিয়েটা দেখে যাওয়ার কিন্তু কয়েকদিন যাবত শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে। বিছানা থেকে উঠতে পারছিনা। তোর বিয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়তো আমার হবে না কিন্তু আমার দোয়া রইল তোর সাথে। আমি তোর পাশে না থাকলেও আমার ভালোবাসাগুলো তোর পাশে সারাজীবন থাকবে। ভালো থাকিস!
ইতি তোর
সোয়েব ভাই
আমি কিন্তু শুধু সোয়েব লিখেছি কিন্তু আমি জানি তুই পড়ার সময় ঠিকই সোয়েব ভাই পড়বি। ভাই বলা কোনোদিন ছাড়াবি না তুই তাই না! গাধা মেয়ে।
আমি ধপাস করে ফ্লোরে বসে পড়লাম। কিন্তু আমি কাঁদতে পারছিনা। কথায় আছে, অল্প শোকে কাতর অতি শোকে পাথর। আমার সাথেও বোধ হয় তা ঘটছে। আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু আমি পাড়ছিনা। কান্নাটা গলায় এসে আটকে আছে। আমি ভুলে গিয়েছি কিছুক্ষণ আগে আমার বিয়ে হয়েছে,আমি ভুলে গিয়েছি আমার বর আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীটা বড্ড অচেনা মনে হতে লাগলো। মা আমাকে আগলে ধরলো।
“ছেলেটা খুব ভালো ছিল। ভালো মানুষদের সাথে ভাগ্য কেন যে এমন খেলা খেলে। ”
সোয়েব ভাইয়ের মা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। কাঁদলে হয়তো কষ্ট কিছুটা কমে যাবে।
……(১০ বছর পর)
আমি সোফায় বসে আছি। কে যেন পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আমি পিছু ফিরে মুচকি হাসলাম।
“মা একটা প্রশ্ন করবো?”
“হুম করো।”
“সোয়েব নামের অর্থ কী? পৃথিবীতে এতো নাম থাকতে তুমি আমার নাম সোয়েব কেন রাখলে?”
“সোয়েব নামের অর্থ একরাশ ভালোবাসা। ”
“এটা আবার কেমন অর্থ মা? ”
আমি জানিনা এটা কেমন অর্থ তবে আমার কাছে সোয়েব নামের অর্থ সবসময় একরাশ ভালোবাসা মনে হয়। আমি মুখ কোনো উওর দিলাম না আমি শুধু মুচকি হেসে তাকে জড়িয়ে ধরলাম কারণ এর উওর যে আমি নিজেই আজ-অব্দি পাইনি। আমার ছেলে সোফা থেকে নেমে বাইরে চলে গেল। ছেলেটা যেন পুরোপুরি সোয়েব ভাইয়ার মতো হয়েছে। তার কথাবার্তা, চালচলন সবকিছুতেই আমার সেই আগের সোয়েব ভাইয়ের কথা মনে পরে যায়। আমি শব্দহীন পায়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। রুমের ভিতরে গিয়ে আলমারিটা খুলে সোয়েব ভাইয়ের দেওয়া সেই চিঠিটা বের করলাম। আজ আমার স্বামী আছে, সন্তান আছে। আমিও বেশ সুখে আছি। কিন্তু তা-ও মাঝে মাঝে সোয়েব ভাইকে ভীষণ মনে পড়ে। মনে পড়লে চিঠিটা খুলে পড়ি। চিঠিটা যখনই পড়ি তখনই আমার দুচোখ বেয়ে অশ্রু নেমে আসে। চোখের জলে ভিজতে ভিজতে চিঠি টার নাজেহাল অবস্থা হয়েছে তা-ও চিঠিটা যত্ন করে রেখে দিয়েছি। এটাই যে সোয়েব ভাইয়ের দেওয়া শেষ স্মৃতি। আজও চিঠিটা পড়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। আমি চোখের পানি মুছে বিড়বিড় করে বললাম,
“আমায় একলা রেখে তুমি গেলে বহুদূর হারিয়ে,
তোমার রেখে যাওয়া চিঠি আমি আজও রেখেছি মন জুড়িয়ে। ”
(সমাপ্ত)
#মারিয়া_নূর
বি:দ্র: দয়া করে কেউ কপি করবেন না তবে চাইলে শেয়ার করতে পারেন কারণ শেয়ার করলে ভালোবাসা বাড়ে আর কপি করা সেটা তো একটা জঘন্য অপরাধ।#চিঠি
পর্ব ২(শেষ পর্ব)
শীতের কুয়াশা ভেদ করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। কয়েক সাপ্তাহ হলো পরিক্ষা শেষ হয়েছে। দুইমাস ধরে সোয়েব ভাইকে দেখছিনা। হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেলো কে জানে। উধাও হলেও বা আমার কী? তবে এটা সত্যি হঠাৎ তাকে ভীষণ মনে পড়ছে। এতোদিন পরিক্ষার চিন্তা মাথায় থাকার কারণে তার কথা মনে আসেনি তবে এখন তার কথা বড্ড মনে পড়ছে। ঘরে ঢুকে মাকে জিজ্ঞেস করলাম। মা বললো তিনি এবিষয়ে জানেন না। আমি সোয়েব ভাইদের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঘরের দরজায় তালা লাগানো অর্থাৎ তাদের ঘরে কেউ নেই। একসাথে সবাই হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেলো। বিষয়টা আমাকে ভাবাচ্ছে। মাকে বিষয়টা জানালাম। মা সোয়েব ভাইয়ার মায়ের নাম্বার এ কল দিলো কিন্তু নাম্বার বন্ধ দেখালো। এবার বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম তবে বাইরে প্রকাশ করলাম না।
.
তার দুই সাপ্তাহ পর সোয়েব ভাইদের দরজায় দেখলাম তালা লাগানো নেই এ-র মানে বাসায় মানুষ আছে। এতদিনে এসে আমি শান্তি পেলাম। সোয়েব ভাই বাইরে বের হয়ে আমাকে দেখে মুচকি হেসে বললেন,
“কীরে ইতি! মানুষের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস কেন ভিখারির মতো। তোর বোধ হয় কোনোদিন বুদ্ধি হবেনা।”
আমাকে ভিখারির সাথে তুলনা করার পরে-ও আমার রাগ হলোনা। আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম সোয়েব ভাইয়ের দিকে। চেহারাটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। ফর্সা চেহেরাটা কেন যেন তার লাবন্য হারিয়েছে। আমি সোয়েব ভাইকে প্রশ্ন করলাম,
“কোথায় গিয়েছিলে তুমি? ”
“আমরা আমেরিকা গিয়েছিলাম সবাই মিলে।”
“কেন গিয়েছিলে? আর আমাদের কিছু জানাওনি কেন?
” তুই এতো প্রশ্ন কেন করছিস বলতো? দুই মাসে বেশ পেকে গিয়েছিস দেখছি।”
আমি আর কোনো প্রশ্ন করলাম না। সোয়েব ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলেন।
“কী হয়েছে হাসছো কেন?”
“কিছু না।”
আমি আরও একবার প্রশ্ন করলাম,
“তোমার শরীরের এ অবস্থা কেন হয়েছে? ”
সোয়েব ভাই নিজেকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন,
“আমেরিকা গিয়ে আমার ডায়রিয়া হয়ে গিয়েছিল। আমেরিকার এতো সৌন্দর্য আমার পেট বোধ হয় সহ্য করতে পারেনি।”
কথাটি শেষ করে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। তবে আমার হাসি পেলো না। আমি আবার প্রশ্ন করলাম,
“ডায়রিয়া হলে কেউ এতো শুকিয়ে যায় বুঝি!”
“তুই এমবিবিএস পাশ করেছিস নাকি। এতো আজাইরা প্রশ্ন করছিস কেন?”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর কিছু বললাম না।
.
রুমের ভিতরে হৈ-চৈ এর শব্দ পেয়ে উঠে বসলাম। লাইট অন করতেই দেখলাম বাবা-মা একটি কেক হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ কচলিয়ে প্রশ্ন করলাম,
“কী হয়েছে? ”
“হ্যাপি বার্থডে ইতি!”
আজ আমার বার্থডে অথচ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি ম্লান হেসে উওর দিলাম,
“তোমরা মনে রেখেছ। আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম। তোমাদেরকে অনেক ধন্যবাদ। ”
রাতে কেক কেটে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে দরজা খুলে দেখলাম একটা বাক্স দরজায় পড়ে রয়েছে। বাক্সটা দেখে আমি চমকালাম না কারণ দুই বছর যাবত আমার জন্মদিনে এমন একটা বাক্স কে যেন দরজার সামনে রেখে যায়। তবে কে সেই ব্যাক্তি তা আজও জানতে পারলাম না। অনেক আগ্রহ নিয়ে বাক্সটা খুললাম। বাক্স এর ভিতরের একটা বড়ো পেইন্টিং রাখা। পেইন্টিংটি দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কিন্তু বাক্সটিতে পেইন্টিং ছাড়াও আর-ও একটি জিনিস পেলাম। একটা আংটি। হয়তো ভুলবশত চলে এসেছে। আংটিটি চিনতে আমার ভুল হলোনা। তাহলে আমার সন্দেহ ঠিক প্রমাণ হলো। আমি আংটিটি হাতে নিয়ে মুচকি হাসলাম।
.
সোয়েব ভাইকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম।
“সোয়েব ভাই কেমন আছো?”
“ভালো। ”
“আমাকে জিজ্ঞেস করবেনা আমি কেমন আছি!”
“না পারবোনা। ”
“আজ আমার জন্মদিন সোয়েব ভাই। তুমি আমাকে শুভেচ্ছা দাওনি।”
সোয়েব ভাই মুখ কুঁচকালেন।
“এসব আজাইরা কাজ আমার ধারা সম্ভব না ইতি। জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানোর কী আছে বলতো যত্তসব ঢং!”
আমি মুচকি হাসলাম।
“ঢং তো তুমিও দারুণ করতে জানো।”
“মানে কী?”
“তুমি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছো। ”
সোয়েব ভাই ভ্রু কুঁচকালেন।
“তুই দিনদিন এমন হয়ে যাচ্ছিস কেন বলতো। জ্বিন ভূত ধরেনিতো আবার! ”
আমি এবারও হাসলাম।
“হি হি করছিস কেন শুধু শুধু। ”
আমি আমার ব্যাগ থেকে আংটিটা বের করলাম।
“দেখো তো এটা চিনতে পারো কিনা?”
সোয়েব ভাই আমার হাত থেকে টান মেরে আংটিটা নিয়ে নিলেন।
“তুই আমার আংটি কেন চুরি করেছিস ইতি?এটা কিন্তু খারাপ অভ্যাস।”
“একদম মিথ্যা বলার চেষ্টা করবেনা। আমি সত্যি শুনতে চাই। ”
“ফাজলামি করবিনা একদম আমার সাথে। ”
সোয়েব ভাই কথাটা শেষ করেই উল্টো দিকে হাঁটা ধরলেন। আমি আবারও তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
“সোয়েব ভাই! তুমি কি ভয় পাচ্ছো? আমি কিন্তু তোমাকে ফিরিয়ে দিবোনা বুঝলে।”
সোয়েব ভাই ঢোক গিলে উওর দিলেন,
“কী বলতে চাচ্ছিস তুই? তুই কিন্তু এখন নির্ঘাত আমার হাতের থাপ্পড় খাবি।”
“তুমি আমায় ভালোবাসো আমি জানি। কথা লুকানোর চেষ্টা করবেনা।”
সোয়েব ভাই আমার গালে কষে একটা চড় মারলেন।
“লজ্জা করেনা তোর ভাই ভাই বলে এসব মাথায় নিয়ে ঘুরিস। এজন্য আমি তোদের মতো মেয়েদের সাথে কথা বলতে চাইনা। লজ্জা বলতে কিছু নাই। ”
আমার মুখে আঁধার নেমে আসলো। সোয়েব ভাই সবসময় আমাকে অপমান করতেন তবে তা আমার কোনোদিন খারাপ লাগেনি কিন্তু আজ তিনি যেটা করলেন সেটা আমি আশা করিনি। সোয়েব ভাই পিছনে ফিরে দ্রুতগতিতে হেঁটে চলে গেলেন।
.
কথায় আছে সময় কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। দুইমাস পেরিয়ে গেলো। এই দুই মাস আমি একবারও সোয়েব ভাইয়ের মুখোমুখি হইনি। সবসময় তাকে এড়িয়ে চলেছি। কিছুদিন হলো বাবা-মা আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলছে। কোন ছেলের পরিবার নাকি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। ছেলে ইন্জিনিয়ার। এমন প্রস্তাব কী আর হাতছাড়া করা যায়। মা একবার আমার সাথে এবিষয়ে কথা বলেছিলেন। আমি কোনো উওর দেয়নি কারণ উওর দেওয়ার আমার কোনো ইচ্ছা ছিলনা। ঘর থেকে বের হতেই সোয়েব ভাই দৌড়ে আমার সামনে হাজির হলেন।
“আজকাল তোর দেখা পাইনা কী ব্যাপার!”
আমি কোনো উওর দিলাম না। সোয়েব ভাইয়া আবারও বললেন,
“শুনেছি তোর জন্য লাল টুকটুকে বর খুঁজে এনেছে। ছেলে নাকি ইন্জিনিয়ার। তাহলে অবশেষে পেয়ে গেলি তুই বর।”
আমি ভ্রু কুঁচকে সোয়েব ভাইয়ের দিকে তাকালাম।
“কী দেখছিস এভাবে। আর বিয়ে কখন করছিস সেটা বল?”
“তুমি তাহলে চাও আমি বিয়েটা করি?”
“অবশ্যই! কেন নয়। তুই খুশি থাকবি এর চাইতে বেশি কী হতে পারে। ”
“তুমি কোনোদিন আমায় বুঝলে না সোয়েব ভাই! ”
“তুই এতো ইমোশনাল কেন হচ্ছিস ইতি? বিয়ের আগে তো খুশি থাকতে হয়,ফুর্তি করতে হয়।”
আমার খুব কান্না আসছিল। আমি সেখান থেকে দৌড়ে বাসায় চলে আসলাম। কিছুক্ষণ পর বাবা আমার রুমে আসলো।
“ইতি?”
“বলো বাবা।”
“তুই কী বিয়েতে রাজি আছিস? দেখ ছেলেটা খুব ভালো। আমার বিশ্বাস তুই এই ছেলের সাথে সুখে থাকবি।”
আমি শুধু বললাম,
“হুম রাজি।”
এর চাইতে বেশি কিছু বলতে পারছিলাম না গলা ধরে আসছিল। বাবা খুশিতে হনহন করে বাইরে চলে গেলেন মাকে জানানোর জন্য।
.
প্রকৃতি বড়ো বিচিত্র। আমরা কেমনভাবে দিন কাটাচ্ছি তা তার দেখার বিষয় না সে সবসময় তার নিজ ছন্দে বয়ে চলে। বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। মনটা মানছিল না। কী হতো যদি স্বপ্নের মতো সোয়েব ভাই এসে বলতো,তুই আমাকে ছেড়ে অন্যকাউকে কীভাবে বিয়ে করছিস ইতি। এই যে দেখ আমিতো এখানেই দাঁড়িয়ে আছি। ছুটে চলে আয় আমার কাছে। কিন্তু তা হওয়ার ছিল না। বিয়ের দিন চলে এলো। ঘরোয়াভাবে আয়োজন করা হয়েছে। আমি চুপচাপ বসে আছি মুখে কোনো শব্দ নাই। এক সময় কবুল বলার সময় হলো। আমার কেন যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। মুখ থেকে তিন অক্ষরের একটা শব্দ ‘কবুল’ বের করতে পারছিলাম না। মনে কোনো আমার তা-ও ক্ষীণ আশা ছিল হয়তো সোয়েব ভাই আসবে কিন্তু তা হলোনা। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় কবুল বললাম। বিবাহ সম্পূর্ণ হলো। এ-র কিছুক্ষন পরেই সোয়েব ভাইয়ের মা কোথা থেকে যেন দৌড়ে এসে আমার পায়ের কাছে বসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আমি বসা থেকে উঠে পরলাম। মনটা ধুকধুক করছে। হঠাৎ করেই মনটা অস্থির হয়ে উঠলো।
“ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমার কলিজার টুকরোটা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।”
আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারলাম কিছু একটা ঠিক নেই। কিছু একটা অঘটন ঘটেছে।
আমি সোয়েব ভাইয়ের মাকে বসা থেকে উঠালাম। প্রশ্ন করলাম,
“কী হয়েছে? কে ছেড়ে চলে গিয়েছে? ”
তিনি হাতের মুঠো খুলে একটা চিঠি আমার হাতে দিলেন। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা খুললাম,
“প্রিয় ইতি,
আঁধার ছেয়ে থাকা এক শ্রাবণের দিনে এক রমণীর আগমন ঘটেছিল আমার জীবনে। আঁধার কালো মেঘের মাঝে মেয়েটি আমার নজরে পড়তেই এই শ্রাবণ মাসে আমার মনে প্রদীপ জ্বলে উঠেছিল। ছাতার জন্য তার চেহেরাটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম না। মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল তাকে দেখার জন্য। মনের সাথে পেরে উঠতে পারলাম না। ছুটে গেলাম সিঁড়ির দিকে। মেয়েটি যখন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল তার নুপুরের ছন্দে আমার মন নেচে উঠেছিল সেদিন। পরবর্তীতো জানতে পারলাম এই সুন্দরী রমণীর নাম ইতি। সেখান থেকেই শুরু হয়ে গেলো আমার যেচে পড়ে কথা বলা তার সাথে। ভালো লাগতো তোর সাথে কথা বলতে, ভালো লাগতো তোকে জ্বালাতন করতে। তুই যখন আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করতি বিশ্বাস কর আমার কাছে পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দরী তোকে মনে হতো। কিন্তু কখনো অন্তরে লুকানো কথা তোর কাছে প্রকাশ করতে পারতাম না কেন যেন মনটা অন্তরের ভালোবাসার কথা অপ্রকাশিত রাখতে চেয়েছিল। একদিন মাকে সব জানালাম। মা সেদিন খুশিতে পুরো ঘর মাথায় তুলেছিল যেন তোকে এ ঘরের বউ করা তার বহুদিনের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এই খুশি বেশিদিন থাকলো না শীঘ্রই এক অন্ধকার আমাদের গ্রাস করে নিলো। একদিন সকাল ঘুম থেকে উঠে দেখলাম কাশির সাথে আমার রক্ত বমি হচ্ছে। মা-বাবাকে বলতেই তারা দ্রুত ডাক্তার এর কাছে নিয়ে গেলো। ডাক্তার কিছু পরিক্ষা দিয়েছিল। পরবর্তীতে জানতে পারলাম আমি সেই রোগে আক্রান্ত যে রোগ মুক্তির একমাত্র উপায় মৃত্যু। ছোটকালে যখন শুনতাম কেউ ক্যান্সারে মারা গিয়েছে তখন খারাপ লাগতো কিন্তু তখনও একজন ক্যান্সারে আক্রান্ত রুগীর এবং তার পরিবারের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারিনাই। সেই কষ্ট তখনই বুঝতে পেরেছি যখন একই মরণ ব্যাধী রোগে আমি আক্রান্ত হলাম। ডাক্তার স্পষ্ট বললো আমার কাছে বড়োজোর দুই থেকে আড়াই মাস সময় আছে। মা বিশ্বাস করলোনা। চিকিৎসার জন্য গেলাম আমেরিকায়। তবে আমি জানতাম এই মৃত্যু পথযাত্রীকে যে মৃত্যুর হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা। ভেবেছিলাম জীবনের যে কয়েকটা দিন বাকি আছে তা আমেরিকায় কাটিয়ে দিবো কিন্তু মনের সাথে হেরে গেলাম। তোকে বড্ড মনে পড়ছিল তাই ফিরে আসলাম বাংলাদেশে। এর কিছুদিন পর তুই সব জেনে যাস। দুই বছর ধরে যে দিনটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম সে দিনটা চলে আসলো কিন্তু ভাগ্য যে আমাদের সহায়ক ছিল না এই মৃত্যু পথযাত্রীর সাথে আমি তোকে জড়াতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম তুই আমার থেকে দূরে সরে যা কিন্তু এবারও আমি ব্যার্থ হলাম। পারলাম না আমার শেষ অনুভূতিগুলো তোকে না জানিয়ে থাকতে। সামনাসামনি বলার সাহস ছিল না তাই চিঠি লিখলাম। জানিস! সেদিন ঘরে ঢুকে দেখলাম মা আমার আলমারি থেকে কাপড়গুলো বের করে তা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আমার তখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, মা কাপড় কেন জড়িয়ে ধরে কাঁদছ এখন তো আমি আছি আমাকেই নাহয় জড়িয়ে ধরে কাঁদো কারণ কয়েকদিন পরে হয়তো সেই সুযোগটাও পাবে না কিন্তু সেদিন কেন যেন মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি। ইতি! আমি চাই তুই সুখে থাক,আমি চাই তুই বিয়েটা কর। আমার খুব ইচ্ছা তোর বিয়েটা দেখে যাওয়ার কিন্তু কয়েকদিন যাবত শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে। বিছানা থেকে উঠতে পারছিনা। তোর বিয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়তো আমার হবে না কিন্তু আমার দোয়া রইল তোর সাথে। আমি তোর পাশে না থাকলেও আমার ভালোবাসাগুলো তোর পাশে সারাজীবন থাকবে। ভালো থাকিস!
ইতি তোর
সোয়েব ভাই
আমি কিন্তু শুধু সোয়েব লিখেছি কিন্তু আমি জানি তুই পড়ার সময় ঠিকই সোয়েব ভাই পড়বি। ভাই বলা কোনোদিন ছাড়াবি না তুই তাই না! গাধা মেয়ে।
আমি ধপাস করে ফ্লোরে বসে পড়লাম। কিন্তু আমি কাঁদতে পারছিনা। কথায় আছে, অল্প শোকে কাতর অতি শোকে পাথর। আমার সাথেও বোধ হয় তা ঘটছে। আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু আমি পাড়ছিনা। কান্নাটা গলায় এসে আটকে আছে। আমি ভুলে গিয়েছি কিছুক্ষণ আগে আমার বিয়ে হয়েছে,আমি ভুলে গিয়েছি আমার বর আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীটা বড্ড অচেনা মনে হতে লাগলো। মা আমাকে আগলে ধরলো।
“ছেলেটা খুব ভালো ছিল। ভালো মানুষদের সাথে ভাগ্য কেন যে এমন খেলা খেলে। ”
সোয়েব ভাইয়ের মা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। কাঁদলে হয়তো কষ্ট কিছুটা কমে যাবে।
……(১০ বছর পর)
আমি সোফায় বসে আছি। কে যেন পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আমি পিছু ফিরে মুচকি হাসলাম।
“মা একটা প্রশ্ন করবো?”
“হুম করো।”
“সোয়েব নামের অর্থ কী? পৃথিবীতে এতো নাম থাকতে তুমি আমার নাম সোয়েব কেন রাখলে?”
“সোয়েব নামের অর্থ একরাশ ভালোবাসা। ”
“এটা আবার কেমন অর্থ মা? ”
আমি জানিনা এটা কেমন অর্থ তবে আমার কাছে সোয়েব নামের অর্থ সবসময় একরাশ ভালোবাসা মনে হয়। আমি মুখ কোনো উওর দিলাম না আমি শুধু মুচকি হেসে তাকে জড়িয়ে ধরলাম কারণ এর উওর যে আমি নিজেই আজ-অব্দি পাইনি। আমার ছেলে সোফা থেকে নেমে বাইরে চলে গেল। ছেলেটা যেন পুরোপুরি সোয়েব ভাইয়ার মতো হয়েছে। তার কথাবার্তা, চালচলন সবকিছুতেই আমার সেই আগের সোয়েব ভাইয়ের কথা মনে পরে যায়। আমি শব্দহীন পায়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। রুমের ভিতরে গিয়ে আলমারিটা খুলে সোয়েব ভাইয়ের দেওয়া সেই চিঠিটা বের করলাম। আজ আমার স্বামী আছে, সন্তান আছে। আমিও বেশ সুখে আছি। কিন্তু তা-ও মাঝে মাঝে সোয়েব ভাইকে ভীষণ মনে পড়ে। মনে পড়লে চিঠিটা খুলে পড়ি। চিঠিটা যখনই পড়ি তখনই আমার দুচোখ বেয়ে অশ্রু নেমে আসে। চোখের জলে ভিজতে ভিজতে চিঠি টার নাজেহাল অবস্থা হয়েছে তা-ও চিঠিটা যত্ন করে রেখে দিয়েছি। এটাই যে সোয়েব ভাইয়ের দেওয়া শেষ স্মৃতি। আজও চিঠিটা পড়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। আমি চোখের পানি মুছে বিড়বিড় করে বললাম,
“আমায় একলা রেখে তুমি গেলে বহুদূর হারিয়ে,
তোমার রেখে যাওয়া চিঠি আমি আজও রেখেছি মন জুড়িয়ে। ”
(সমাপ্ত)
#মারিয়া_নূর
বি:দ্র: দয়া করে কেউ কপি করবেন না তবে চাইলে শেয়ার করতে পারেন কারণ শেয়ার করলে ভালোবাসা বাড়ে আর কপি করা সেটা তো একটা জঘন্য অপরাধ।।