#ধারাবাহিক_গল্প_পর্ব৪
#চারুলতা_ভালোবেসেছিল

ভাইয়া খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো, “তোমার আর লতার অংশ মানে? বাবা মারা গেলেন ছয় ঘন্টাও হয়নি, এরমধ্যেই আমার অংশ, তোমার অংশ ভাগাভাগি, চমৎকার চারু। ”

“ভাইয়া, বড়মার কবর এ বাড়িতে, আম্মারও এ বাড়িতে, তাহলে আব্বার কবর কেন অন্য জায়গায় হবে? আমি ভাগাভাগি করছি না, তুমি ভুল বুঝেছ। আমি বলতে চাইছি এটা আব্বার বাড়ি। আর আমরা তিন জনই ওনার সন্তান। তুমি একা সিদ্ধান্ত নিতে পার না।”

ভাইয়া রেগে যাচ্ছেন বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি সত্যি চাই আব্বার নিজের বাড়িতে তার কবর হোক।

“হিল্লোল বাবা, চারু কিন্তু অন্যায় কিছু বলেনি। মসজিদের কবরস্থানে তারাই সাধারণত কবর দেয় যাদের নিজস্ব জায়গা নাই। তোমার আব্বার দুই স্ত্রীর কবরের পাশে তার কবর হওয়াই শোভনীয়।”

উপস্থিত সকলের সায়ে কথা আর আগায় না, ভাইয়া বিরক্ত হলেও মেনে নেয়। আব্বার কবর খোঁড়া হচ্ছে, মেয়েদের সামনে যাওয়ার নিয়ম নেই, তাই দোতলায় আব্বার ঘরের জানালা থেকে আমি আর লতা দেখছি।

“চারু, আরাফ আর আনান এর জন্য কেক আর বিস্কুট আনিয়ে অনেক উপকার করলা। তাড়াহুড়ায় আমি কিছু নিতে পারি নাই ওদের জন্য। বাইরে তো অনেক মানুষ, নাস্তা দিয়ে দেই কী বলো? ”

নীলু ভাবি দুই বাচ্চা কে নিয়ে আজ এই রুমেই আছেন, ভাইয়া সরাসরি লাগেজ এই রুমে উঠিয়েছেন।

“ভাবি অন্যদের জন্য কিছু তো আনাইনি, কী নাস্তা দেবেন?”

“আমার ভাইয়া বাজার থেকে নিয়ে এসেছেন নাস্তা, পরোটা আর সবজি ভাজি। ওটাই দেই। চা এর ঝামেলা এখন আর করা যাবে না।”

ভাবির সাথে লতাও গেলো মেহমানদের নাস্তা দিতে।
দুপুরের খাবার ভাইয়ার মামার বাড়ি থেকে আসবে, রাতে আনু চাচার বাড়ি থেকে। কাল আব্বার বন্ধু হামিদ চাচা আর রাতে রাবেয়া খালার পরিবার দেবেন। রাবেয়া খালা আমাদের প্রতিবেশী। গ্রামের বাড়িতে এমনই হয়। মৃত লোকের বাড়িতে পরিচিত মানুষ, আত্মীয় স্বজন একেকজন একেক বেলায় খাবার পাঠায়। আমার নানা বাড়ির দিকে কেউ খাবার পাঠাতে যোগাযোগ করেনি। অবশ্য করার কথাও না। আশ্চর্যজনক ভাবে মৃতমানুষের বাড়িতে পাঠানো এই খাবার খুবই মজা হয়। বাবুর্চি দিয়ে রান্না করায় সাধারণত। ভাত, গরুর মাংস, বুটের ডাল, সাথে লাউ, এ রকমই থাকে মেনু। যত মানুষ আসে সবাই খেয়ে যায়। মৃত বাড়ির শোক থেকে উৎসবের আমেজ আসে।

“চারু, লতা, আব্বা দোকান বিক্রি করবে ঠিক করেছিলেন জানোই তো। ছাব্বিশ লাখ দাম উঠেছে দোকানের। আমি যেহেতু চাকরি করি দোকান দেখা সম্ভব না, আর তোমরা দু’জন মেয়ে মানুষ এসব বুঝবে না। তাই আমার মনে হয় এখন দোকানটা বিক্রি করাই ঠিক সিদ্ধান্ত।”

রাত সবে সাড়ে আটটা বাজে। ভাইয়ার মামা, খালা খালু, আনোয়ার চাচা, আব্বার ব্যবসায়ী মহলের বন্ধুরা অনেকেই উপস্থিত আছেন। ভাইয়াই থাকতে বলেছেন হয়তো। সবার সামনে কথা বলবেন বলে।

“ভাইয়া তুমি তো দোকান বিক্রির বিরুদ্ধে ছিলে, তাহলে এখন করতে চাও?”

ভাইয়া প্রস্তুতি নিয়েই বসেছেন, তাই উত্তর গোছানো।

“হ্যাঁ, করোনার শুরুর সময় থেকে হার্ড ওয়্যারের ব্যবসা ভালো না যাচ্ছে না। মফস্বলে আরও চলে না। আর আমি চাকরি করি দোকান কে দেখবে? ভাড়াও হবে না বেশি টাকায়। তখন মানা করছি কারণ বাবা না হলে আরেকটা বিয়ে করে টাকা ওড়াতো। ”

‘আরেকটা বিয়ে’ কথাটার মধ্যে কেমন ব্যঙ্গ।
অথচ আব্বা জীবিত থাকতে তার সামনে ভাইয়াকে খুব কমই মুখ খুলতে দেখেছি।

“ঠিক আছে করো তাহলে।”

আমি এত সহজে হ্যাঁ বলবো ভাবেনি ভাইয়া। কিন্তু আসলেই আব্বার অনুপস্থিতিতে দোকান রাখার পক্ষে আমি আর লতাও নেই। ক্যাশ টাকাটাই ভালো, তাছাড়া দোকান দেখার বা চালাবার কেউ নেই।

“ঠিক আছে, তোমার আর লতার জন্য পাঁচ লাখ দেব, বাকি টাকা আমার, রেজিষ্ট্রেশন এর টাকা তোমাদের থেকে কাটবো না।”

“আমাদের পাঁচ লাখ কোন হিসেবে ভাইয়া !! ভাইয়ের তিন ভাগের এক ভাগ বোন পায়, সে হিসেব তুমি যা পাবে,তার তিন ভাগের এক ভাগ লতা আর আমি পাব। তুমি ছাব্বিশ লাখ থেকে থেকে তেরো লাখ পেলে বাকি তেরো লাখের অর্ধেক আমার অর্ধেক লতার।”

ভাইয়ার মামা খালারা হইহই করে উঠলেন, “এটা কি হিসেব হলো?”

“আমরাও আব্বার মেয়ে, আব্বার বৈধ সন্তান,
অবৈধ না যে লাম ছাম একটা দিলেই হলো।”

লতা রেগে বলে উঠলো। লতাটা চিরকাল ঠোঁটকাটা।
আমি ঝগড়া চাই না, ওর হাত চেপে ধরলাম। কিন্তু বসার ঘরের মানুষগুলো দুইভাগ হয়ে গেলো। ভাইয়া উচ্চশিক্ষিত, বড় চাকরি করে, তাই শুরুতে গালাগালিতে গেল না। কিন্তু ভাইয়া স্পষ্ট স্বরে জানিয়ে দিল সে আব্বার প্রথমঘরের সন্তান, একমাত্র উত্তরাধিকারী। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমাদের কিছুই দেবে না, বরং ঘাড় ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় বের করবে।

“বড়মার মতো আম্মাও আব্বার স্ত্রী ছিলেন। ভাইবোনের সঠিক হিসেবেই আমরা পাব, আপনি ধাক্কা দিয়ে বের করার ক্ষমতা রাখেন না।”

আমিও চুপ থাকলাম না।

ভাইয়ার খালা ফুঁসে উঠলেন, “আমার বোইনের সাথে তোমার মায়ের তুলনা আসে ক্যামনে? ফকিন্নির ঝি, না বাপের বাড়ি আছিল না বাপ মা। বারো ভাতারির মাইয়া ছিল তোমার মা, তার লগে আমার বইনের তুলনা! দুলাভাইয়ের মাথা খারাপ হওয়ায় বিয়া করছে, নাইলে আমাগোর বাড়ির কামের বেটির যোগ্য নি তোমার মা।”

পরিপাটি শাড়ি পরা, মার্জিত সাজে বসে থাকা খালার মুখের ভাষা আমাদের দুইবোন কে রক্তাক্ত করে দিয়েছে যেন। না চাইলেও নিজেকে ঠান্ডা রাখতে পারিনি।জবাব, পাল্টা জবাবে বসার ঘর উতপ্ত।
আমি দৃঢ়ভাবে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করলেও, লতার ধৈর্য কম। লতা, ভাইয়ার খালার সাথে সমানে সমান চিৎকার করেই যাচ্ছে, ভাইয়া ও ভদ্রতার মুখোশ খুলে ফেলেছেন।
আমাদের তিনি কোনদিন ও বোন বলে মানেন না, এতদিন নিশ্চয়ই আম্মা তলে তলে বহু টাকা পয়সা সরিয়েছে, আব্বা কে নিঃস্ব করে ব্যাংক ব্যালেন্স নাকি রেখে গিয়েছে , যা মনে আসছে তাই বলছেন।
অথচ তিনি নিজেও জানেন এটা সত্যি নয়। আব্বা সে রকম স্বামী ছিলেনই না যে তার স্ত্রী তার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেতে পারবে। আম্মার হাতে হাত খরচের টাকাটা পর্যন্ত কোনদিন আলাদা করে দেয়নি আব্বা।

কিন্তু ভাইয়ার অভিযোগ যে, আম্মাতো টাকা ঠিকই নিয়েছেন এতদিন, বাকি যেটুকু আছে সেটা ভাইয়ার প্রাপ্য। সেই সম্পদও নাকি আমরা দুই ডাইনি এখন নিয়ে যেতে চাইছি। মফস্বলের এক সাধারণ ব্যবসায়ীর কী এমন সম্পদ ছিল তা সবাই জানে, তাও একপক্ষ দেখলাম সহমত পোষণ করলেন।
ভাইয়ার মামা আর খালা যেভাবে গলাবাজি করছেন, মনে হলো সম্পত্তি ভাইয়ার না, ওনাদের হাতছাড়া হচ্ছে। অথচ ওনাদের দু’টাকার লাভ নেই। বোনের মৃত্যুর পর বোনের ছেলের দ্বায়িত্ব কেউ নেয়নি,
সংসারটা আমার নিরীহ মাই করেছেন, অথচ আজ নাকি তিনি ফকিন্নি, বারো ভাতারি।

সমাজের কিছু মানুষই আছেন এমন। ঝগড়া লাগিয়ে আর ঝগড়া করে মজা পান। সেখানে একজন মহিলা, অপরিচিত আরেকজন মহিলাকে এক মুহূর্তে বারো ভাতারি বলে ফেলেন, পুরুষেরা নোংরা ইঙ্গিত করেন।
যেমন থেকে থেকে ভাইয়ার শালাও সুযোগে অশ্লীল ইঙ্গিত করে চলছে কখনো আমাকে, কখনো লতাকে।
উপস্থিত মুরুব্বীরা থামাতে চেয়ে ও পারছে না।

ভাবিকে দেখলাম এতক্ষণ এককোণে দাঁড়িয়ে ছিলেন, ঝগড়া চরম রূপ নিলে বাচ্চাদের নিয়ে উপরে চলে যান। না স্বামীর পক্ষ নিয়ে আমাদের সাথে ঝগড়া করেছে, না স্বামীকে থামানোর চেষ্টা করেছেন।
অবশেষে হামিদ চাচা আজকের মতো পরিস্থিতি সামলায়। আব্বার মৃত্যুর চব্বিশ ঘন্টাও হয়নি,অথচ আমরা কামড়াকামড়ি শুরু করে দিলাম। ঝগড়া থামার কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি আবার আগের মতো।
সবাই খেতে বসেছেন, গরুর মাংস রান্নাটা জটিল হয়েছে, বুটের ডাল আরেকটু নরম হলে টেস্ট বাড়তো, এগুলোই এখন আলোচনার বিষয়।

সহায় সম্পদ বন্টনের বাকি ঝগড়া কালকের জন্য তোলা থাকলো। প্রকৃতির নিয়মে আমারো ক্ষুদা লাগলো, শুরুতে মনে হয়েছিলো বেশি খেতে পারব না। কিন্তু পরে দেখলাম আসলেই রান্নাটা মজা হয়েছে,
আরো দুবার ভাত নিলাম, সারাদিন ভালো করে খাওয়া হয়নি। ভাবিকে আর নিচে আসতে দেখিনি। খাওয়া যা বাঁচলো ভাইয়ার খালা নিয়ে গেলেন। কাল সকালে তো নতুন খাবার আসবেই, এগুলো নাকি নষ্ট হবে।
কিছু বললাম না। নিলে নেক। এতক্ষণ কষ্ট করে ঝগড়া করলেন, এই বাড়তি খাবার গুলো ওনার প্রাপ্য।

(চলবে)

Rukshat Jahan

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here