#চাঁদ_সুন্দরী

সুরমা
পর্ব : ৬

জুঁই দেখে পরাগ খাবার রেখে তার দিকে কেমন লোভাতুর ভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।জুঁই অনেক ছেলে দেখেছে,কিন্তু পরাগের মতো কোনো ছেলে আজও দেখে নি।ব্লু শার্ট।দুই গাল ভর্তি চাপ দাড়ি।দেখতে বেশ হেন্ডসাম।ভদ্রও লাগছে।বাট,জুঁই বুঝতে পারছে না এভাবে তাকিয়ে থাকার মতো কি ঘটেছে।পরাগের এমন চাহনিতে জুঁই কিছুটা অস্বস্তিবোধ করে।তার মোটেই বিষয়টা ভালো লাগছে না।জুঁই অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে মাথাটা নিচু করে ফেলে।পরাগের চাহনি দেখলে যে কেউ মনে করবে পরাগ হয়তো ভুত দেখেছে নয়তো কোনো জীন দেখে এতো অবাক হয়েছে।আয়েশা বেগম চেয়ার থেকে উঠে জুঁইয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।তিনি জুঁইয়ের থুতনিতে হাত দিয়ে চুমু খায়।আয়েশা বেগম খুব ভালো করে জুঁইকে দেখে বলেন,,
-তুই কোন মায়ের গর্ভে জন্ম নিলি?সেই মা তো তোকে জন্মদিয়ে গর্বিত। মাশ আল্লাহ,মানুষ না।যেন কোনো মায়াবতী অপ্সরী আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।আয়েশা বেগম জুঁইয়ের কপালের চুল গুলো সরিয়ে জুঁইয়ের কপালে একটা চুমু দেয়।আয়েশা বেগমের কাণ্ডে জুঁই ভীষণ লজ্জিত হয়।তখনও পরাগ জুঁইকেই দেখছে।আনিকা বলে,,,
-আম্মু,আমিও ওকে বলছিলাম ও দেখতে পরীর মতো।কিন্তু জুঁই বিশ্বাস করছিল না বলে আমি তোমার কাছে নিয়ে আসলাম।
-হ্যাঁ,জুঁই দেখতে পরীর থেকেও সুন্দর।এবার চল কিছু খাবি।জ্বরে শরীর দুর্বল হয়ে আছে নিশ্চয়।আয়েশা বেগম খেয়াল করলেন,তিনি তখন থেকে জুঁইকে কেমন তুই তুই করে কথা বলছেন।আয়েশা বেগম পড়লেন দুটানায়।জুঁইকে একটা চেয়ার টেনে বসিয়ে বললেন,,,,
-কিছু মনে করো না।আসলে তোমার বয়সটা আনিকার মতোই।আনিকাকে তুই করে বলি বলে তোমাকেও তুই করে বলে ফেলেছি।তুমি কিছু মনে করো না।
-আন্টি আপনি আমাকে তুই করেই বলেন।তুইটা শোনতে আমার খুবই ভালো লাগছে।তাছাড়া আপনিই তো বললেন আমি আপনার মেয়ের মতো।আর মেয়েকে কেউ তুমি বলে?জুঁই একদম পরাগের মুখোমুখি বসেছে।জুঁই দু একবার চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে পরাগ তার দিকে তাকিয়ে আছে।দুজনের চোখে চোখ পড়াতে দুজনেই লজ্জা পেয়ে চোখ নিচে নামিয়ে ফেলে।জুঁই চিন্তা করতে থাকে,,,,
-এই ছেলে তাকে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছে?দেখতে তো ভালোই স্মার্ট। একদম নায়কদের মতো।কিন্তু তার দিকে এভাবে তাকিয়ে রয়েছে কেন?জুঁই নিজের দিকে দেখতে থাকে।আর বারবার ওড়না ঠিক করে।আয়েশা বেগম আনিকা আর জুঁইকে খাবার দেয়।জুঁই আয়েশা বেগমকে উদ্দেশ্য করে করে বলে,,
-আন্টি,আমি একটুপরে চলে যাবো।আপনাদেরকে কি বলবো আমার জানা নেই।আপনারা আমার জন্য যা করেছেন তা আপনজনরাও করে না।জুঁই চলে যাবে শোনে পরাগের হঠাৎ করে কেমন জানি অস্থির লাগতে শুরু করে।মনে হচ্ছে মূল্যবান কিছু তার জীবন থেকে চলে যাবে।কেন এমন হচ্ছে?এর আগে কখনও তার এমন ফিল হয় নি।তাহলে আজ এমন হচ্ছে কেন?পরাগের খুব খারাপ লাগছে।কিছুতেই খাবারটা খেতে ইচ্ছে করছে না।আজ তার অফিসেও যেতে ইচ্ছে করছে না।পরাগের শরীর হালকা কাঁপতে শুরু করে। সত্যি এই মেয়েটা আজ চলে যাবে?আয়েশা বেগম জুঁইয়ের পাশে এসে বলে,,,
-কোথায় যাবি তুই?
-জানি না।শুধু জানি এই ঢাকা শহরে কোথাও না কোথাও আমার জায়গা হবেই।
-তুই কি বাসা থেকে পালিয়ে এসেছিস?
-হুম
-কেন??
-আমি চাচা-চাচীর কাছে থাকতাম।জন্মের পর থেকে তো ওরাই আমাকে লালন পালন করলো।ওরাই আমাকে এতোটুকু বড় করেছে।পড়াশোনা করিয়েছে।এখন বড় হয়েছি।সারা জীবন কারো উপর পড়ে থাকা কি ঠিক?আমার জন্য প্রতিদিন চাচা-চাচী ঝগড়া করতো।ওদের মধ্যে ঝামেলা হতো।এলাকার লোকজন খারাপ ভাববে বলে আমাকে ফেলেও দিতে পারছিল না।তাই গ্রামের একজন বয়স্ক লোকের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছিল।লোকটা আগেও একটা বিয়ে করেছে।কিন্তু টাকা আছে বলে চাচা-চাচী আমার সাথে তার বিয়ে ঠিক করে।আমি কিছুতেই এই বিয়েটা মানতে পারছিলাম না।চাচা চাচীকে অনেকবার বলার পরও তারা আমার কথা শোনে নি।তাই বাধ্য হয়ে আমি পালিয়ে এসেছি।আয়েশা বেগমের খুব খারাপ লাগলো।এই টুকু মেয়েকে কেউ বিয়ে দেয়?তাছাড়া এমন পরীর মতো একটা মেয়ের বিয়ে হবে বিবাহিত লোকের সাথে?জুঁইয়ের মা বাবা বেঁচে থাকলে নিশ্চয় এটা কোনোদিন মেনে নিতো না।এমন একটা মেয়ে,একটু পড়াশোনা করালে রাজপুত্র জোটবে কপালে।আয়েশা বেগম বুঝলেন না জুঁইকে কি বলে শান্তনা দিবেন।কিন্তু পরাগের রাগ লাগছে।তার ইচ্ছে করছে ঐ অমানুষ গুলোকে ধরে ইচ্ছে মতো পিটাতে।মানুষ এতো জঘন্য হয় কি করে।এতো সুন্দর,ফুটফুটে একটা মেয়ের সাথে যারা এমন করে তার কি মানুষ?মনুষ্যত্ব বলতে তাদের মাঝে কিছু আছে?পরাগের এতো রাগ লাগছে যে কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না।রাগে দুঃখে তার চোখ দুটি লাল হয়ে গেছে।কিন্তু কেন?জুঁইয়ের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।এই পানিটা দেখে পরাগের আরো বেশি খারাপ লাগছে।পরাগের হচ্ছে করছে জুঁইয়ের চোখের পানিটা মুছে দিয়ে বলতে,
-প্লীজ আর কান্না করো না।আমি আছি।এখন কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।যে তোমার দিকে চোখ তুলে তাকাবে আমি তার চোখ দুটি তুলে নিবো।আয়েশা বেগম জুঁইয়ের চোখের পানিটা মুছে দিয়ে জুঁইকে নিজের বুকে চেপে ধরলেন।মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,,,
-তুই আমার কাছে থাকবি?আয়েশা বেগমের কথা শোনে জুঁই আয়েশা বেগমকে ছেড়ে মাথা তুলে আয়েশা বেগমের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে।আনিকা বলে,,,
-তুমি থাকনা আমাদের বাসায়।আমার সাথে থাকতে পারবে।তুমি চাইলে আমার সাথে কলেজেও পড়তে পারবে।ভাইয়া তোমাকে ভর্তি করে দিবে।আমাদের বাসায় তো তেমন মানুষও নেই।আব্বু বাহিরে থাকে।থাকো।তোমার কোনো অসুবিধা হবে না।
-থাকবি?থাক,আমার মেয়ে হয়ে থাকবি।তোর যদি সমস্যা না থাকে তাহলে তুই আমাদের বাসায় থাকতে পারিস।সবার কথা শোনে জুঁইয়ের দুটি আবার চোখ জলে ভরপুর হয়ে যায়।চোখের পাতা গুলো বন্ধ করলেই বৃষ্টির মতো পানি পড়তে শুরু করবে।পরাগ জুঁইয়ের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে।জুঁই কি বলবে,এটা শোনার আগ্রহে যেন পরাগ সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যায়।কিন্তু জুঁই কিছু বলতে পারলো না।সে শব্দ করে কান্না করে দিলো।জুঁই নিজেও জানে না কেন তার এতো কান্না পাচ্ছে।আয়েশা বেগম বুঝতে পেরেছেন কেন জুঁই কান্না করছে।তিনি জুঁইয়ের চোখের পানিটা মুছে দিয়ে খাবারের প্লেট টা নিজের কাছে এনে খাবারটা মাখাতে মাখাতে বললেন,,,,,,
-বুঝেছি।আর কাঁদতে হবে না।হা করতো।আমি খাইয়ে দেই।জুঁই ড্যাবড্যাব করে আয়েশা বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।আয়েশা বেগম আবার বলেন,,,
-কি হলো?হা করতে বলছি না?জুঁই হহা করলে আয়েশা বেগম জুঁইয়ের মুখে খাবার তুলে দিয়ে পরাগের দিকে তাকিয়ে বললেন,,,,,,
-পরাগ,তুই জুঁইকে আনিকার সাথে কলেজে ভর্তি করে দিস।আনিকা তুই জুঁইকে নিয়ে মার্কেটে গিয়ে জুঁইয়ের জন্য কিছু ড্রেস কিনে নিয়ে আসিস।আর এইযে,পড়াশোনা করতে ভালো লাগে তো?জুঁই আয়েশা বেগমের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।জুঁইয়ের দুটি চোখ জলে ভেজা।কিন্তু ঠোঁটে এক চিলতে হাসি।বড্ড মিষ্টি লাগছে জুঁইকে।জুঁইকে এভাবে দেখে পরাগেরও খুব ভালো লাগছে।পরাগ তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,,,,
-আজকে ভর্তি করে দিবো?না মানে আজ তেমন ইম্পরট্যান্ট কাজ নেই অফিসে।পরে যদি ব্যস্থ হয়ে যাই তাহলে তো যেতে পারবো না।
-ঠিক আছে।করে দে।তবে এখানে আমার একটা শর্ত আছে।শর্তের কথা শোনে আনিকা,জুঁই পরাগ সবাই আয়েশা বেগমের মুখের দিকে তাকায়।পরাগ বলে,,,
-এখানে আবার কিসের শর্ত?
-আছে।শর্তটা জুঁইয়ের জন্য।জুঁইকে মানতে হবে আমাদের বাসায় থাকতে হলে।এবার জুঁই আকাশ থেকে পড়ে।তার জন্য শর্ত?জুঁই আয়েশা বেগমের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে,,,,
-কি শ,র্ত??
-আমাকে মামুনি বলে ডাকতে হবে।তবেই এই বাসায় থাকতে পারবে।আন্টি ডাকা চলবে না।জুঁই কল্পনাও করেনি আয়েশা বেগম তাকে এমন কিছু বলবেন?? জন্মের পর সে তার মাকে দেখে নি।মায়ের আদর স্নেহ কি জিনিস জুঁই তা জানে না।সে ফিল করেনি কখনও মায়ের মমতা।শুধু প্রতি নিয়ত মায়ের শূন্যতা ফিল করেছে।কাউকে মা ডাকার সৌভাগ্যও তার হয় নি।আজ আয়েশা বেগমের মুখে মা ডাকার প্রস্তাব পেয়ে সে যেন স্বর্গ হাতে পেলো।এই সুখ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখ।জুঁই আয়েশা বেগমের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।আয়েশা বেগম পরম মমতায় জুঁইকে বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়।মেয়েটার অনেক কষ্ট।কিন্তু এখন থেকে এই মেয়েটার সুখের দায়িত্ব তার।আর কষ্ট পেতে দেওয়া যাবে না এই মেয়েটাকে।ওর না পাওয়া সব এখন পূরণ করতে হবে।

চলবে——–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here