#চাঁদ_সুন্দরী
সুরমা
পর্ব : ৩
পরাগ রাস্তায় এসে এদিক ওদিক দেখতে থাকে।হাঁটতে হাঁটতে বাসস্ট্যান্ড,রেলস্টেশন সব জায়গা খুঁজে দেখে।কিন্তু কোথাও জুঁইয়ের অস্তিত্ব দেখা গেলো না ।পরাগ বুঝতে পারছে না জুঁই কোথায় যেতে পারে।
যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই জুঁইয়ের।পরাগ জুঁইয়ের বান্ধবীদের সাথে কথা বলে।কারো কাছেই যায় নি।পরাগ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত ৩টা।আশে পাশে যা ছিল সব জায়গায় জুঁইকে খুঁজেছে।কোথাও পায়নি তাকে।পরাগের খুব খারাপ লাগছে।ইচ্ছে করছে কান্না করতে।
রাস্তার পাশে থাকা একটা বেঞ্চে পরাগ বসে পড়ে।নিজেই নিজের চুল গুলো টানতে থাকে।পরাগের খুব ভয় করছে।জুঁই কোথায় আছে।কেমন আছে?কোনো বিপদ হলো কিনা,হাজার টেনশন মাথার উপর ঘুরতে থাকে।পরাগ বুঝতে পারেনি তার কথায় জুঁই কোথাও চলে যাবে।
কথা গুলো যতই কঠিন থাকুক না কেন,এভাবে কাউকে কিছু না বলে চলে যাওয়া জুঁইয়ের উচিত হয় নি।আর এতোটা রাগ সে নিজেও না দেখালে পারতো।পরাগের চোখ দিয়ে টপটপ করে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।একবার জুঁই পরাগকে বোঝতে চাইলো না।
জুঁইকে যে এতদিন এতো ভালোবাসা দিল তা কি মিথ্যা ছিল?সামান্য একটা ব্যাপারে সে পরাগকে এতো কষ্ট দিতে পারলে?।এই মুহূর্তে পরাগের সেই প্রথম দিনের কথা মনে পড়ছে।যেদিন জুঁইয়ের সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিল।প্রায় চার বছর আগের ঘটনা।পরাগ তখন পড়াশোনা করে দেশে ফিরে এসেছিল।
নিজেকে কাজের মধ্যে আবদ্ধ করার আগে পরাগ নিজের সব আত্মীয় সজনের বাড়িতে ঘুরে দেখছিল।একদিন রাতে পরাগ মামার বাড়ি থেকে ঢাকায় আসছিল।সেদিন পরাগের খুব তাড়া ছিল।অফিসের একটা ইম্পরট্যান্ট কাজ পড়ে গেছিল।যা পরাগ ছাড়া হেন্ডেল করা সম্ভব হচ্ছিল না।
পরাগের বাবা কল করে আর্জেন্ট আসার কথা বলেছিল।কিন্তু রাতের বেলায় পরাগ গাড়ি পাচ্ছিল না।নিজেও গাড়ি নিয়ে যায় নি।অনেক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকেও গাড়ি পেলো না সে।বাধ্য হয়ে লোকাল বাসে উঠলো।সারা বাসে মাত্র একটা সিট খালি ছিল।পাশের সিটেই বসে ছিল জুঁই।যদিও জুঁইয়ের চেহারা তখন স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল না।
একদম গুটিসুটি মেরে পা সিটের উপর তুলে জানালায় হেলান দিয়ে বসে আছে।জেগে আছে না ঘুমিয়ে আছে বুঝা যাচ্ছে না।একটুকুও নাড়াচাড়া করছে না।পরাগ নিজের ব্যাগপ্যাগটা উপরে রেখে জুঁইয়ের পাশে খালি সিটটায় বসে যায়।কানে এয়ারফোন গুজে দিয়ে সেও সিটে হেলান দিয়ে গান শুনতে থাকে।
বাস স্পিডলাইন ক্রস করলে পরাগ একটু সামনের দিকে হেলে যায়।গাড়ি ঝাকুনিটা এতো জোরে ছিল যে,জুঁই বসা থেকে একদম পরাগের কোলে এসে পড়ে।পরাগ তাড়াতাড়ি জুঁইকে জড়িয়ে ধরে।আর জুঁইও পরাগের শার্ট কামছে ধরে।পরাগ ফিল করলো জুঁইয়ের শরীর অনেক গরম।সে বুঝতে পারছে তার সারা গা জ্বরে পুরে যাচ্ছে।
পরাগ নিজের কাছ থেকে জুঁইকে সরাতে চাইলে জুঁই পরাগকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।জুঁইয়ের শরীরের উত্তাপে পরাগের শরীর প্রায় সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল।পরাগ অনেকবার জুঁইকে ডেকেছিল।কিন্তু জুঁই টু শব্দটিও করে নি।
পরাগ জুঁইয়ের মুখটাও দেখতে পাচ্ছিল না।কারন,জুঁই পরাগের গলার নিচে নিজের মুখ গুজে রেখে ছিল।জুঁইয়ের গরম নিঃশ্বাস পরাগের গলায় লাগছি।এতে পরাগের অন্য রকম ফিলিংস লাগছিল।অচেনা অজানা একটা মেয়ে এভাবে জড়িয়ে থাকতে দেখে পরাগের খারাপও লাগছিল।
পরাগ যেন অস্থির হয়ে গেছিল।না পারছিল নিজের বুকের সাথে মেয়েটাকে জড়িয়ে রাখতে না পারছিল সরিয়ে দিতে।আবার কেন জানি মেয়েটার উপর রাগও করতে পারছিল না।কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর পরাগ অনেকটা জোর করে জুঁইকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে জুঁইয়ের সিটে বসিয়ে দেয়।তারপর গাড়ির কন্টাক্টরকে ডাক দিলে কন্টাক্টর লাইট জ্বালিয়ে দেয়।
লাইটের আলোতে জুঁইয়ের মুখটা স্পষ্ট হয়েছিল।জুঁইকে দেখে পরাগের মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল।এতো সুন্দর কি কোনো মেয়ে আছে??এর আগে কখনও পরাগ দেখে নি।রূপে ভরপুর একটা মেয়ে।পরাগের মুখ থেকে অটোমেটিকলি বের হয়ে আসে,,,”চাঁদ সুন্দরী”
পরাগ মেয়েটার উপর থেকে চোখ সরাতে পারছিল না।
এতো মায়াবতী, এতোটা আকর্ষণীয় চেহারা,যেন,মুখে একগুচ্ছ সিগ্ধতার আভা মিশে আছে।যার রূপের তুলনা একমাত্র চাঁদের সাথেই করা যায়।জানালের মৃদু বাতাসে জুঁই কিছুটা কোঁকড়ে যাচ্ছিল।পরাগ অপলকে জুঁইকে দেখছিল।এমন সময় কন্ট্রাক্টর এসে বলে,,,
-আমাকে ডাকছিলেন আপনি??
-হু,আসলে এই মেয়েটার সাথে কেউ আসে নি?মেয়েটার তো জ্বরে সারা গা পুরে যাচ্ছে।
-না,এই মেয়ে একাই আসছে। গাড়িতে উঠার সময় জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় নামবেন?তখন বলে এই গাড়ি যেখানে গিয়ে থামবে সেখানেই নামবো।
-অহ,,উনারতো সেন্স নাই।তাছাড়া একা একটা মেয়ে রাতের বেলায় কোথায় যাবে??
-আমরা কি বলুম বলেন। গাড়িতে প্রতিনিয়ত কতো রকম লোক উঠে।সবাইকে কি আর দেখা সম্ভব।কতো মেয়েরা বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে। আমার মনে হয় এই মেয়েও পালিয়ে এসেছে।না হলে রাতের বেলায় একা আসবে কেন?আর আসলেও ঠিকানা বলবে না কেন?আর আপনার যদি মায়া লাগে তাহলে নিজের সাথে নিয়ে যান।সুস্থ করে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েন।
কন্ট্রাক্টর একদমে কথা কথা গুলো বলে চলে যায়।পরাগও আর কিছু বলে নি।সে চুপ করে জুঁইকে দেখছিল।যতই দেখে না কেন।এদেখার স্বাদ হয়তো কখনই মিটবে না।চাঁদ যেমন রাতের আকাশে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে দেয়,ঠিক তেমন করেই জুঁইয়ের মুখ থেকে অপার সুন্দর্য ঝরে পড়ছিল।পরাগের ইচ্ছে করছিল সেখান থেকে কিছু জ্যোৎস্না কুড়িয়ে নিতে।
পরাগের বারবার একটা কথাই মনে হচ্ছিল,একটা মেয়ে কি করে এতো সুন্দর হতে পারে?এ কি সত্যি কোনো মেয়ে নাকি কোনো পরী?ভোরের আলো ফুটে উঠার সাথে সাথে কি তার দেখা এই পরী বিলিন হয়ে যাবে?এই মেয়ের উপর থেকে চোখ সরছিল না পরাগের।মনে হচ্ছিল পরাগের চোখ দুটি এখানে আটকে গেছে।জুঁইয়ের গায়ে ছিল একদম সিম্পল একটা থ্রি-পিছ।
সারা গায়ে সাজের কোনো চিহ্ন ছিল না।এতেই যদি সুন্দর্য ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়ে তাহলে সাজলে তাকে কেমন লাগবে?হয়তো তখন তার জায়গা মাটিতে হবে না।পরাগ কল্পনায় হারিয়ে যায়।প্রথম দেখাতেই হৃদয়ে হৃদয় আটকে গেলো।বাকি রাস্তাটা পরাগ জুঁইয়ের দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দেয়।সে বুঝতেই পারে নি কখন নিজের গন্তব্যে চলে এসেছে।তার মনে হচ্ছে সময় তার সাথে খেলা করেছে।
অনেক তাড়াতাড়ি ঘড়ির কাটা ঘুরেছে।নাহলে এতো অল্পতেই কি করে চলে আসলো।জুঁই তখনও ঘুমিয়ে ছিল।পরাগকে এবার নেমে যেতে হবে।কিন্তু কেন জানি নামতে ইচ্ছে করছে না পরাগের।একটা মেয়েকে এভাবে রেখে যেতেও তার খারাপ লাগছিল।কিন্তু এছাড়াতো কিছু করারও ছিল না।পরাগ উপর থেকে নিজের ব্যাগপ্যাগটা নামিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়।সিটের সাথে দাঁড়িয়েও জুঁইকে দেখছিল।
পরাগের এতো কষ্ট লাগছিল যে সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিল না।কেন,কি কারনে পরাগ জানে না। পরাগ গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির বিপরীত দিকে হাঁটতে শুরু করে।পরাগ মাথা তুলে জানালা দিয়ে আবার জুঁইয়ের মুখটা দেখে নিলো।এবার বুকের ভেতরে ব্যথা হতে শুরু করলো।খুব খারাপ লাগছিল সামনে এগিয়ে যেতে।ঘড়িতে তখন রাত ৩.২২।একটু পর বাস একদম ফাঁকা হয়ে যাবে।
জুঁই তখন বাসে একা।কতো রকম মানুষের বসবাস এই ঢাকা শহরে।এতরাতে কোথায় যাবে মেয়েটা?যদি কোনো নরপশুর কবলে পড়ে?এমনি বাসেও তো কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।মেয়েটাতো কারো সাথে ফাইটও করতে পারবে না।নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টাটুকুও করতে পারবে না।চিন্তাগুলো মাথায় আসতেই পরাগ দাঁড়িয়ে যায়।পেছনে ফিরে দেখে বাস অনেকটা এগিয়ে গেছে।পরাগ আর কিছু চিন্তা না করে বাসের পেছনে দৌঁড়াতে শুরু করে।এভাবে একটা মেয়েকে বিপদে ফেলে যাওয়া সম্ভব হবে না তার পক্ষে।এখন না হয় বাসায় নিয়ে যাওয়া যাক। সুস্থ হলে না হয় তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া যাবে।
চলবে———