ঘাস ফড়িং (৪র্থ পর্ব)
————-
শ্রেয়া বাইরে তাকায়। আবার বৃষ্টি হচ্ছে। আজ সারারাত বোধহয় থেমে থেমে বৃষ্টি হবে। রেললাইনের আশপাশের বন্য গাছগুলো মৃদু কাঁপছে। শ্রেয়ার ভেতরেও কি সেরকম ঝড় বয়ে যাচ্ছে? বন্য গাছের মতোন তারও হাত-পা মৃদু কাঁপছে কেন? বুক কাঁপছে কেন? এ কেমন অদ্ভুত অন্যরকম ভয়ংকর অনূভুতি।
শ্রেয়া কাঁপা কাঁপা হাতে ঘন কালো চুলে আঙুল ডোবাল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। খানিক পর শিশুর মতোন ঘুমিয়ে যায় নীলাভ। একমনে চেয়ে থাকে শ্রেয়া। তারপর বাইরে চোখ রাখে। ট্রেন ঝকঝক ঝকঝক শব্দ তুলে এঁকেবেঁকে ফুঁসতে থাকা সাপের মতোন এগুচ্ছে, বাড়ি-ঘর গাছপালা যেন পেছনে সরে যাচ্ছে। মিনিট দশেক যায়। আচমকা পাশ ফিরে নীলাভ। ঘুমের ঘোরে শক্ত করে কোমর জড়িয়ে ধরে। কেঁপে উঠে শ্রেয়া। এখন কি করবে? আশ্চর্য অপরিচিত এক ভয়ংকর অনূভুতির মুখোমুখি সে। ঘুমন্ত নীলাভের প্রতিটি গরম শ্বাস-নিঃশ্বাস শ্রেয়ার কোল জুড়ে আছড়ে পড়ছে। শরীরে যেন কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে। অচেনা অজানা এক অসহ্যকর সুখের ব্যথা। সেই ব্যথার অনূভুতি সহ্য করতে না পেরে নিচের ঠোঁট কামড়ে নীলাভের চুল খামচে ধরে চোখবুঁজে সে।
নীলাভের ঘুম পাতলা। অল্পতে ভেঙে যায়। কেঁপে উঠে সে। চোখ কচলে তাকিয়ে বলে- ‘বিড়ালের মতো খামচি মারলি ক্যান?’
শ্রেয়া কোনো জবাব দিতে পারল না৷ কথা বের হচ্ছে না। শ্বাস-নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে। শুকনো গলা। শাড়ির আঁচল খামচে ধরা। কোনো রকম অস্ফুটে বলল-
— ‘নীলাভ ভাই পানি আনেন তো।’
সে খানিক্ষণ চেয়ে থাকে। সবকিছু কেমন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। চুপচাপ পানি আনতে যায়। কয়েক কামরা পরেই পানিওয়ালাকে পেয়ে পানি নিয়ে আসে। শ্রেয়ার হাতে দেয়। ডগডগ করে পানি খায়। নীলাভ অবাক নয়নে চেয়ে থাকে। পানি খাওয়া শেষে বলে-
— ‘কিরে তোর আবার কি হলো?’
শ্রেয়া পুরোপুরি স্বাভাবিকভাবে হেঁসে বলল-
–‘আরে কি হবে আবার, অনেক পানির পিপাসা পেয়েছিল, কিন্তু তুমি কোলে শুয়ে থাকায় খেতেও পারছিলাম না।’
নীলাভ ভ্রু কুঁচকে বলল-
— ‘কিন্তু তুই আমার চুলে খামচি মারলি কেন?’
শ্রেয়া আঁটকে গেল। এখন সে কি বলবে?
নীলাভ মাথায় গাট্টা মেরে বলল-
– ‘পেত্নী, বেশি পানির পিপাসা পেলে ডাকতে পারতি।’
শ্রেয়া আর কিছু বলল না। নীলাভের শরীর কেমন খারাপ লাগছে। সে শার্টটা আবার পরে নিল। তারপর চুপচাপ একপাশে বসে বাইরে তাকায়। সবুজ গাছপালা আর আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় উঁচু উঁচু পাহাড়।
শ্রেয়া কেন যেন তাকাতে পারছিল না ওর দিকে। সে মোবাইল বের করে ফেইসবুক লগিন করে হোমপেইজ ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে। আচমকা মুখ ঢেকে হাসতে হাসতে বারংবার নুইয়ে পড়ছিল। নীলাভ যেন এবার ভয়ই পেল। মেয়েটার আজ কি হয়েছে! পাগল-টাগল হয়ে যাচ্ছে না তো আবার! চোখ পাকিয়ে তাকায়। তারপর বলে-
— ‘এতো হাসির কিরে পে’ত্নী?’
শ্রেয়া হাসতে হাসতেই বলল-
– কিছু না।’
নীলাভ মোবাইলের দিকে তাকায়৷ কি যেন ভেবে আচমকা শ্রেয়ার হাত থেকে টান দিয়ে মোবাইল নিয়ে আসে। চোখ আঁটকে যায় ফেইসবুকে একটা পোস্টে-
— ‘বালিকা তোমার জন্য আমি হাত কাটতে পারবো না। ছোটবেলায় যা কেটেছি সেটাই যথেষ্ট।’
নীলাভ মুচকি হাসে। এই পোস্টই শ্রেয়ার হাসার কারণ। ফোনটা বাড়িয়ে দেয় শ্রেয়ার দিকে। এখনও মুখ ঢেকে হাসছে শ্রেয়া। কম বয়সী মেয়েরা মাঝেমধ্যে বড্ড অপরিচিত হয়ে যায়। নীলাভ আবার জানালার পাশে এসে চুপচাপ বসে। একটা সেতুর ওপরে ট্রেন উঠেছে। নিচে টলটলে জলের একটা বিল। বিলের মাঝখানে অনেকগুলো রক্ত রঙের শাপলা। শাপলার পাতায় বসে পুঁটি মাছের অপেক্ষায় বেশকিছু ধবধবে সাদা বক। নীলাভ কেমন আনমনা। কানের কাছে ফিসফিসানি শুনে চমকাল। শ্রেয়া বাইরে তাকিয়ে শৈশবের সেই ‘কানা বগীর ছা’ ছড়াটি আবৃত্তি করছে- ‘ঐ দেখা যায় তাল গাছ
ঐ আমাদের গাঁ।
ঐ খানেতে বাস করে
কানা বগীর ছা।
ও বগী তুই খাস কি?
পানতা ভাত চাস কি?
পানতা আমি খাই না
পুঁটি মাছ পাই না
একটা যদি পাই
অমনি ধরে গাপুস গুপুস খাই।
নীলাভ মলিন মুখে প্রশংসার ভঙ্গিতে হাসল। সে আচমকা কেমন আনমনা, মনমরা হয়ে গেছে। মিনুর কথা ভীষণ মনে পড়ছে। তার ঘাস ফড়িংটা এখন কোথায়? কি করছে? কেমন আছে?
নীলাভ বাইরে তাকিয়ে গুনগুন করে- ‘ভালো আছি,
ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
দিও তোমার মালা খানি।।
বাউলের এই মনটারে
ভিতরে বাহিরে আন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।’
স্টেশন থেকে শ্রেয়ার ফুপা তাদেরকে নিতে এসেছিলেন। বাসা চট্টগ্রাম শহর থেকে খানিকটা দূরের একটা গ্রামে। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা মাথায় পড়ে না-কি লম্বা জার্নির কারণে নীলাভের শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এলো সন্ধ্যায়। জ্বরের সঙ্গে শরীর ব্যথা আর সর্দি, কাশি। পাশের একটা ফার্মেসি থেকে ওষুধ-পত্র আনা হয়েছে। শ্রেয়া ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে নীলাভকে ঘিরে৷ মেহমান বাড়ির মানুষজন কী মনে করবে তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। সমাজ-সংসার সবকিছু ভুলে সে একটি যুবক ছেলের রুমেই বন্দী হয়ে পড়েছে। জল পট্টি দিচ্ছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বারকয়েক বমি করল নীলাভ। সে ছোট্ট ডাস্টবিন এগিয়ে দিয়ে পিঠে হাত রাখে। রাতের খাবার আর ওষুধ নিজ হাতেই খাওয়ায়। ফুফু একবার বিরক্ত হয়েই বললেন-
– ‘তুই যা তো আমি দেখব ছেলেটাকে।’
শ্রেয়া ভ্রুক্ষেপ করে না। রাত গভীর হয়। প্রেম-ভালোবাসা আসলে বড় ভয়ানক ব্যাপার। যুগে যুগে এর উদাহরণ পেয়েছে মানুষ। প্রেমে পড়লে বোধহয় মানুষ খড়ায় ফেটে যাওয়া জমির মতন হয়ে যায়। প্রিয় মানুষটি তখন তার কাছে মেঘ। ফেটে যাওয়া শুকনো জমির কাছে মেঘ ভীষণ লোভের। জমির তখন বৃষ্টি বড় প্রয়োজন। অথবা প্রেম হয়তো আরও বেশি ভয়ানক ব্যাপার-স্যাপার। কোনো নিয়ম মানে না, ধর্ম, সমাজ, কালো-সাদা, মান-সম্মান কিছুই মানে না৷ সম্পর্কের ভেদাভেদ তুচ্ছ হয়ে যায়। ছাত্র-শিক্ষক, ছোট-বড়, ধর্ম- বর্ণ কিছুই তাতে প্রাধান্য পায় না। যখন প্রেম আসে, আকাশে বিদ্যুৎ চকমকানোর মতোন গুড়ুম গুড়ুম ডাকে কাল বৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে ধমকা বাতাসের মতো সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে আসে।
শ্রেয়ার প্রেম কি সেরকম ভয়ানক? যার হৃদয় আর জগত মানেই নীলাভ। বাকি সবকিছু বড়োই তুচ্ছ।
শ্রেয়ার আচমকা মনে হলো নীলাভ জ্বরের ঘুরে কিছু একটা বিড়বিড় করে বলছে। সে কান পেতে শুনে,
– ‘ঘাসফড়িং।’
শ্রেয়া কিছুই বুঝতে পারে না। ঘাস ফড়িং আবার কেন বলছে! জ্বরের ঘুরে উল্টাপাল্টা বকছে হয়তো। খানিক পর আবার ফুফু আসেন। একটু শক্তভাবেই বললেন,
– ‘চল অন্য রুমে। সে ওষুধ খেয়েছে এখন ঘুমাক।’
শ্রেয়ার মন যেতে চায় না। মর্মবেদনায় যেন মনটা হু হু করে উঠে। ভেতরকার কান্না কেউ দেখে না। ফুফুও দেখলেন না। শ্রেয়া চুপচাপ উঠে ফুফুর সঙ্গে চলে গেল। বেড়াতে এসে এমন হবে সে ভাবেনি৷ জ্বরটা কাল খানিক কমলেই বাড়িতে চলে যাবে নীলাভকে নিয়ে। বিছানায় শুয়ে কেবল এপাশ-ওপাশ করে রাত কাটে। চাইলেই যেতে পারবে না নীলাভের কাছে। কপালে হাত রেখে দেখতে পারবে না নীলাভের গায়ের তাপমাত্রা। ফুফুর জয়েন ফ্যামিলি। বেচারি ফুফু শশুর-শ্বাশুড়ি, ভাসুর-ভাসুর বউ সবাইকে নিয়ে আছে।
পরেরদিনও জ্বর কমেনি নীলাভের। ওষুধ ডাক্তার সবই ঠিকঠাক চলছে। খাদিজা বেগম শ্রেয়ার ফুফুকে ফোনে বলে দিয়েছেন জ্বর না কমলেও যেন পরশুদিন তাদেরকে ট্রেনে তুলে দেন।
পরশুদিন অবশ্য নীলাভের জ্বর খানিকটা কমেছে। কেবল খেতে পারছে না কিছুই। মুখ তিতা হয়ে আছে। শরীর দূর্বল। তাদেরকে ফুপা সকাল দশটার জয়ন্তীকা ট্রেনে তুলে দিলেন। ট্রেন চলছে। দু’জন চুপচাপ। চা গরম চা গরম। চানাচুর চানাচুর। চারদিকে হৈচৈ। শ্রেয়া দু’কাপ চা নিল। জ্বরের মাঝে চা মন্দ নয়। দু’জন চুপচাপ চায়ে চুমুক দেয়৷ শ্রেয়া নীরবতা ভেঙে বলল,
— ‘তোমাকে এই কয়দিন সিগারেট খেতে দেখলাম না যে?’
— ‘আমি কি সব সময় সিগারেট খাই না-কি? নেশা নেই। মাঝেমধ্যে শখ করে খাই।’
— ‘এখন কী খাবে?’
নীলাভ খানিক অবাক হয়ে বলল-
— ‘সিগারেট খাওয়াতে চাচ্ছিস কেন?’
— ‘ সিগারেট টানা অবস্থায় তোমাকে দেখতে ভালো লাগে৷ কেমন সুখী সুখী দেখায়।’
নীলাভ অসুস্থ ফ্যাকাসে মুখে হাসল। তারপর বলল-
— ‘সিগারেট কোথায় পাবি এখানে?’
— ‘আমার ভ্যানিটি ব্যাগেই আছে। আসার সময়ই দোকান থেকে নিলাম।’
— ‘তাই না-কি। দে তো।’
শ্রেয়া ভ্যানিটি ব্যাগে হাত দিয়ে অজানা একটা ভয়ে আঁটকে গেল। তারপর বলল,
—‘কিন্তু আমি তো সিগারেটের নাম-দাম কিছুই জানি না। তুমি কি সিগারেট পছন্দ করো বা কোন সিগারেট ভালো জানি না।
আমি শুধু দোকানে বলেছি সবাই যে সিগারেট পছন্দ করে সেটা দাও। তাই আমাকে বকাবকি করবা না বলো।’
নীলাভের ভেতরে কেমন একটা অনুভূতি হলো। কেমন মায়া৷ কিন্তু সেটা বাইরে প্রকাশ পেল না। সে নিজের মতোই বলল,
— ‘এতো বকবক করিস ক্যান? দে সিগারেট।’
শ্রেয়া বাধ্য মেয়ের মতোন চুপচাপ লাইটার আর সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দেয়। নীলাভ একটা সিগারেট বের করে ধরায়। ধোঁয়া ছাড়ে। শ্রেয়া চেয়ে থাকে। ট্রেন চলছে ঝকঝক শব্দে। দূরের কোথাও মুয়াজ্জিনের আজান ভেসে আসছে। শ্রেয়ার চোখ অসম্ভব ভালো লাগায় ঝাপসা হয়ে আসে। তারপর মনে পড়ে জ্বরের ঘুরে নীলাভ বিড়বিড় করে ‘ঘাস ফড়িং’ বলছিল।
শ্রেয়া জিজ্ঞেস করে,
— ‘জ্বরের সময় বারংবার “ঘাস ফড়িং” বলছিলা কেন?’
নীলাভ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলে,
— ‘মিনুকে আমি ঘাস ফড়িং ডাকি।’
শ্রেয়া খানিকক্ষণ নীরব হয়ে বসে রইল। তারপর বলল,
— ‘ঘাস ফড়িং কেন? প্রেমিকাকে কেউ বুঝি এমন অদ্ভুত নামে ডাকে?’
— ‘কারণ থাকলে ডাকে।’
শ্রেয়া কেবল বলল-
– ‘ও আচ্ছা।’
তারপর আবার দু’জন নীরব। শ্রেয়া খানিক পর বলল,
— ‘তোমাদের প্রেম কীভাবে হলো আমাকে বলবে না?’
— ‘শুনতে চাস?
— ‘হ্যাঁ সবকিছু শুনতে চাই। প্রথম থেকে বলো।’
নীলাভ সিগারেটে একটা টান দিয়ে বলল,
—‘প্রথম থেকে বলতে ভালো লাগছে না। এখন যা মনে আসছে সেটাই বলি।’
— ‘আচ্ছা তোমার যেভাবে ইচ্ছে হয় বলো।’
তারপর নীলাভ হারিয়ে গেল মিনুর স্মৃতিতে।
সেবার ক্লাসের সব ছেলেরা মিলে ঠিক করে সিলেট ভ্রমণে যাবে। একই সাথে জাফলং, ভোলাগঞ্জ, রাতারগুল। সকাল দশটার আগে রওনা দিলে সেদিনই তারা জাফলং চলে যাবে। সেখান থেকে এসে রাতে হোটেলে থাকবে৷ পরেরদিন ভোরে ভোলাগঞ্জ (সাদাপাথর) আর রাতারগুল (জলাবন) ভ্রমণ করে বাড়ির পথে রওয়ানা দেবে। ছেলেদের প্ল্যান শুনে কয়েকজন মেয়েরাও ভীষণ আগ্রহ দেখাল। সবচেয়ে আগ্রহী মেয়েই ছিল বৃষ্টি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ফ্যামিলি থেকে তো মেয়েদেরকে দেবে না৷ দিনে না হয় ছেলেদের সঙ্গে বেড়াবে৷ কিন্তু রাতে কোনো গার্জিয়ান ছাড়া কে নিজের মেয়েকে হোটেলে থাকতে দিবে। কয়েকজন মেয়ে বললো আমাদের আত্মীয় টাউনে আছে। তাদের বাসায় থাকবো এবং পরিবারও ম্যানেজ করতে পারবো। একে একে দেখা গেল সব মেয়েরাই যাবে। একেকজন একেক বান্ধবীর গলায় ঝুলে এর-ওর আত্মীয়ের বাসায় একরাত থাকার ফন্দি ইতোমধ্যে এঁটে ফেলেছে। কিন্তু মিনুর যাওয়ার একদম ইচ্ছে নেই। শেষপর্যন্ত বৃষ্টির জন্য যেতে বাধ্য হয়। বৃষ্টি ছাড়া তখন কলেজে কারও সঙ্গে তেমন পরিচয়ও নেই। বাকি সবাই একে অন্যের পরিচিত। সেটা খুব ভালো করে মিনু বুঝতে পারে যাবার দিন। কারণ পরিচিত সবাই একসাথে বসেছে। মিনুর পরিচিত কেবল বৃষ্টি। সে লজ্জার মাথামুণ্ডু খেয়ে বসেছে তামিমের পাশে। সবার শেষে বাসে উঠে নীলাভ। সীট খালি নেই। কেবল মিনুর পাশের সীটই খালি। নীলাভ চুপচাপ পাশে বসে। খানিক বাদেই বাস ছাড়ে। সে হেডফোন কানে গুঁজে। মিনিট তিরিশেক বাদেই খেয়াল করে পাশের মেয়েটি ঘুমিয়ে গেছে। হাসল সে। বাচ্চা মেয়েদের আবার ট্যুরেও যেতে মন চায়। ঘন্টা খানেক পর তার মেজাজ পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেল। বিরক্তিকর ক্ষেত একটা মেয়ে। কারণ মেয়েটির মাথা তার কাঁধে এসে পড়েছে। ঠোঁটের এক পাশ দিয়ে পড়ছে লালা। চুলগুলো বাতাসে তার নাকে মুখে ঢুকে যাচ্ছে। কি বলে ডাকবে নামটাও জানে না। শুধু ক্লাসে স্যার একদিন পরিচয় পর্ব নিয়েছিলেন। এই মেয়েটা “ঘাস ফড়িং” নিয়ে কি যেন বলার পর সবাই ‘হু-হু’ করে হেঁসে উঠে।
নীলাভ মেয়েটির মাথায় ধাক্কা দিয়ে বলল,
— ‘এই যে ঘাসফড়িং, উঠুন বলছি উঠুন।’
মিনু চোখ মেলে হকচকিয়ে তাকায়। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে লজ্জায় সে মরে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে বলল,
— সরি, কিছু মনে করবেন না, আমার গাড়িতে উঠলেই ঘুম চলে আসে।’
কালো ফ্রেমের চশমা পরা অত্যন্ত সুপুরুষ ছেলেটি কিছু না বলে কেবল তাচ্ছিল্যের চোখে তাকালো। মিনু দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলে। সব দোষ বৃষ্টির। সে পাশে না বসায় এমন একটা লজ্জায় তাকে আজ পড়তে হয়েছে। তাছাড়া সে বোরখা পরে এতোদিন ক্লাসে পর্যন্ত গিয়েছে৷ বৃষ্টি তাকে আজ জোড়াজুড়ি করে ওড়না ছাড়া এভাবে ড্রেস পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে৷ এখন কি করবে সে? যদি আবার ঘুম আসে?
মিনু সীটে হেলান না দিয়ে বসল। ভালোই কাজ হয়েছে। টেনশন কিংবা হেলান না দেওয়াই সত্যিই ঘুম এলো না আর। বেশ স্বাভাবিকভাবেই তারা জাফলং গিয়ে আবার শহরে ফিরে আসে। যথেষ্ট সময় আছে দেখে রাতারগুল জলাবানও যায়। তারপর সন্ধ্যার দিকে শহরে ফিরে এসে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো মেয়েরা সবাই যার যার আত্মীয়ের বাসায় রাত কাটিয়ে আগামী কাল দশটার আগেই যেন আম্বরখানা পয়েন্টে চলে আসে।
পরেরদিন ঠিকঠাক মতো সবাই পৌঁছায় আম্বরখানা পয়েন্টে।
জাফলং আর রাতারগুল সকলে উপভোগ করলেও মিনু করতে পারেনি। মাথায় বাসের ঘটনাটি গেঁথে গিয়েছিল। তাকে মুগ্ধ করেছে পরেরদিন ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর।
ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে অস্থির বেগে বয়ে চলা সচ্ছ নীল পানির গন্তব্য ধলাই নদীর বুক। সিমান্তের ওপার ভারতের সবুজ ঘাসের চাদরে ঢাকা উঁচু উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় যেন সাদা মেঘ নেমে এসেছে।
ধলাই নদীর রূপ। সবুজ পাহাড় বন্দী এলাকা জুড়ে অজস্র সাদা পাথর। আকাশের নীল ছায়া রেখে যায় পাথরে জমে থাকা স্ফটিক জলে। দূরের পাহাড়গুলোর উপর মেঘের ছড়াছড়ি, সাথে একটা দু’টো ঝর্ণার গড়িয়ে পড়া। নদীর টলমলে হাঁটু পানির তলায় বালুর গালিচা। চিক চিক করা রূপালী বালু আর ছোট বড় সাদা অসংখ্য পাথর মিলে এ যেন এক পাথরের রাজ্য। প্রকৃতির খেয়ালে গড়া নিখুঁত ছবির মতো সুন্দর।
চারদিকে শুধু সাদারঙা পাথর আর পাথর। এতো সাদা পাথর মিনু জীবনে দেখেনি। পাথর তোলার প্রচুর নৌকা দেখতে পায়। নির্জন নৈসর্গিক এই জায়গাটিতে সামনে সবুজ পাহাড়ের সারি, পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া প্রচণ্ড স্রোতের স্বচ্ছ শীতল জলে দু’জন দু’জন করে টিউব নিয়ে নেমে পড়েছে। টিউবগুলো দেখতে গাড়ির চাকার মতো। সেটার ওপর দু’জন করে বসা। প্রচণ্ড স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জীবনের সমস্ত ক্লান্তি-অবসাদ যেন নিমিষেই দূর করে দিয়েছে। মন-প্রাণ হয়ে উঠেছে সতেজ ও প্রাণবন্ত। পানি আর সাদা পাথরের জাদুকরী শীতল স্পর্শে সবাই বিমোহিত। টিউব ছাড়া নামা বড়ো মুশকিল৷ এখানে পাথরে আঘাত পেয়ে মানুষ মরার মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটে৷ মিনুর কেবল ইচ্ছে হলো কেবল পানিতে পা ভেজাবে।
সে এক পাথর থেকে আরেক পাথরে কয়েক কদম যায়। কিন্তু পানির প্রবল স্রোতে পাথরে পা রাখা দায়। আরও দুয়েক কদম এগুতেই পা পিছলে পড়ে গিয়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠে মিনু।
পাশেই একশো টাকা দিয়ে টিউব নিয়ে নামতে যাচ্ছিল নীলাভ। চিৎকার শুনে তাকায়। দেখতে পায় বাসের সেই মেয়েটি পড়ে গেছে৷ পাথর স্রোতের জন্য এক পাথর থেকে আরেক পাথরে ধরে আঁটকে থাকার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। খুব সতর্কে নীলাভ দ্রুত এগিয়ে যায়। টিউব ছাড়া নিজেরও পা ঠেকাতে পারছে না৷ তাড়াতাড়ি মেয়েটির বগলে ধরে টেনে দাঁড় করায় সে। ধীরে ধীরে কিনারায় নিয়ে আসে। পাথরে আঙুল লেগে বাঁ পায়ের নক থেকে গলগল করে র’ক্তে বেরোচ্ছে মিনুর।
কনুইও খানিক থেঁতলে গেছে। পায়ের আঙুল আর কনুই বাঁধা দরকার। কি দিয়ে বাঁধবে ভেবে পাচ্ছিল না। হঠাৎ মনে হলো তার পরনের সাদা সেন্টু গেঞ্জি টেনে ছিঁড়তে পারলেই হয়ে যেত। কিন্তু কীভাবে ছিঁড়বে?
টেনে-টুনে কোনোভাবেই ছিঁড়তে পারছে না৷ দাঁত দিয়েও হলো না। হঠাৎ মাথায় এলো একটা পাথরের ওপর গেঞ্জি রেখে অন্য পাথর দিয়ে আঘাত করলে ছিদ্র হয়ে যাবে৷ তখন আঙুল ঢুকিয়ে টেনে ছেঁড়া সম্ভব৷ বুদ্ধিতে কাজ হলো বটে। নীলাভ গেঞ্জির এক অংশ ছোট করে ছিঁড়ে আঙুলে শক্ত করে বাঁধে। যন্ত্রণায় ঠোঁট কামড়ে ধরে মিনু।
তারপর আরেকটা অংশ দিয়ে শক্ত করে কনুই বেঁধে দেয়। কিন্তু বাঁধার পর সমস্যাটা হলো মিনু আর হাত ভাজ করতে পারছিল না। এতোক্ষণে অন্যরাও চলে এসেছে। সবাই তাকে টেনে-টুনে দাঁড় করায়।
——চলবে…. (গল্প যারা পড়েন একটু বি’বেক থাকা উচিত। ঘন ঘন পর্ব পোস্ট করায় রিচ ডাউন। এরমাঝে গল্প পড়ে ক’মেন্ট না করলে রিচ আসবে কোত্থেকে?)
লেখা: MD Jobrul Islam