#গোধূলী_শেষে_তুমি_আমি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ১১
আমি সদরে করেছি গ্রহণ দুঃখ তোমায়!
সুখকে দিয়েছি বিদায়। জীবন আমার ছোট্ট তীর,বৈঠা ছাড়া চলছে উজান। তবুও তুমি বারবার কেন উঁকি মারো মোর এই ভাঙা তরীর দিকে। আমি যে পারবো না দ্বিতীয়বার নিজেকে গুছিয়ে নিতে।
আর কিছু লেখা নেই সাদা এই কাগজে। যেটা কিনা একটু আগে উড়ে এসে পল্লবের পায়ের কাছে এসে পড়েছে। কাগজটা পড়া শেষ করে উপরের দিকে তাকালো। যেখানে কিনা রজনীর জানালাটা স্পষ্ট। পল্লবের বুঝতে বাকি নেই লেখাটা রজনীই লিখেছে। যতো দিন যাচ্ছে কেমন জানি মেয়েটা নিজের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। কেন এই মেয়েটা তাঁর সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। এই যে সেদিন তাঁর বাবা আসতেই রজনী নিজেকে ঘর বন্দী করেছে আর বের হয়নি। এই নিজেকে ঘর বন্দী করে রাখার মাঝেও পল্লব মুগ্ধতা খুঁজে পেয়েছে। অবশ্য একটু রাগও হয়েছে। আর কতদিন নিজেকে সে আড়াল করে রাখবে। গত দু’দিন দরজার কাছ থেকে অনেকবার ডেকে খালি হাতেই পল্লবকে ফিরে আসতে হয়েছে। বারবার রজনী শুধু বলেছে! সে এখন বের হবে না। কেন হবে না,সেটা সে স্পষ্ট না করলেও পল্লব জানে। রজনী তাঁর বাবাকে ভয় পাচ্ছে। মানুষটা যদি তাঁকে উল্টো পাল্টা কিছু বলে। এটা ঠিক পল্লবের বাবা একটু রাগী,আর একটু বদমেজাজী। অল্পতেই রেগে যায়। সবার প্রতি তার ভালোবাসা আসে না। কিন্তু তাঁর বাবা-র বিপরীতে তাঁর মা। তিনি সবাইকে অল্পদিনের মাঝেই আপন করে নিতে পারে। তেমনটা হয়েছে পল্লব। অবশ্য কিছু বাবা-র স্বভাবও সে পেয়েছে। খুব সহজে কাউকে সে আপন করতে পারে না। কিন্তু কাউকে একবার আপন করতে পারলেই, তাঁকে আর মন থেকে সরাতে পারে না। কিন্তু রজনী তাঁর বাবার বিষয়ে যা ভাবছে! ওতোটাও খারাপ নয় তাঁর বাবা, যতটা রজনী মনে করছে। তাই আজও পল্লব রজনীকে ঘর থেকে বের করতে গিয়েছিল। কিন্তু কি হলো! বরাবরই যা হয় তাই। সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর রজনী ঘর থেকে বের হয়! বেঁচে থাকার তাগিদে কিছু খেয়ে আবারও নিজের ঘরে পা বারায়। কিন্তু সময়টা পল্লব জানে না। অনেক রাত জেগে থেকেও রজনীর দেখা পাওয়া যায়নি। কখন যে রজনী ঘর থেকে বের হয়, আল্লাহ মালুম। আর কতোদিন নিজেকে ঘর বন্দী করে রাখবে রজনী। তাই পল্লব একটা ফন্দি আঁটে। যদি কাজে লাগে,তো কেল্লাফতে। আজ বাবা-মা কেউ থাকবে না বাড়িতে,কারণ দু’দিন পর তাঁদের বিবাহবার্ষিকী। কিছু আত্নীয় স্বজনদের দাওয়াত দিতেই মূলত গেছে। তাই পল্লবের এমন দুষ্ট ফন্দি। অবশেষে সে ঘরে আসে। তাঁদের দারোয়ান চাচার দিকে এগিয়ে যায়।
_ কেমন আছেন চাচা
_ এইতো বাজান,বালা
_ বালা না চাচা,বলেন ভালো।
_ ওই হইলো এক্কান।
_ ওই হইলো এক্কান, না, হলো কিছু একটা।
_ কি কবা কওদি বাজান,আমি এ-র থিক্কা আর বালা ভাসা কইতে পারুম না।
_ আচ্ছা ঠিক আছে বলতে হবে না। এবার মন দিয়ে শুনুন আমি কী বলি। আমাদের বাড়িতে যে মেয়েটা থাকে! ওকে বলবেন আমি এক্সিডেন্ট করেছি! আর খুব গুরুতর অবস্থা আমার। বাড়িতে কেউ নাই,তাই উপায় না পেয়ে আপনি ওর কাছে গেছেন।
_ ছি ছি কি কও বাজান। আমি মিছা কতা কই না। আল্লাহ পাপ দিতো।
_ আরে চাচা দিতো না,সরি দিবে না। মেয়েটা সব সময় মন খারাপ করে বসে থাকে দেখেন না। তাই মন ভালো করার জন্য এইটুকু চেষ্টা। আপনি চান না দুঃখী মেয়েটা একটু হাসুক।
_ হ হেইডা তো চাই। কিন্তু,হেয় যদি রাক করে।
_ আরে চাচা আপনি শুধু এতোটুকু বলে চলে আসবেন। বাকিটা আমি সামলে নিবো।
_ আইচ্ছা
_ হুম তাহলে চলুন।
অগত্যা সোহরাব চাচা আমার সাথেই গেলেন। রজনীর ঘরের দরজা সামনে এসে অসহায় চোখে চেয়ে রইলেন আমার দিকে। ফিসফিস আওয়াজ করে বললো।
_ কি কইতাম
আমি গলার স্বর নিচু করে বললাম।
_ বলেন,রজনী মা পল্লব বাবা এক্সিডেন্ট করেছে। বাড়িতে কেউ নাই,তাই আমি একা কি করবো বুঝতে পারছি না। তুমি আসলে একটু ভালো হতো। আমায় একটু সাহায্য করতে।
_ এইটুকুন কইলেই অইবো।
_ অইবো, না মানে হবে। আপনারা সাথে দুই ঘন্টা কথা বললে চাচা বিশ্বাস করেন,রোগী দেখা ছেড়ে দিয়ে দেখা যাবে! আমি আপনার ভাষা নিয়ে রিসার্চ করছি।
_ ওমনে কইয়ো না বাজান। এইডা আমার মাতৃভাষা।
_ হ্যা বুঝতে পারছি। এবার বলেন।
আমি দরজার কোণে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চাচা দরজায় কড়া নাড়লো। দরজার কড়ার শব্দে ভেতর থেকে রজনী বললো।
_ কে?
_ আমি গো মাইয়া,সোহরাব। তোমাগো দারোয়ান চাচা।
_ কি হয়েছে চাচা।
_ এক্কান কথা আছিলো।
_ বলেন কাকা
_ দরজাডা খুলবা না মা,আসলে একটা অতি জরুরি কতা আছিলো।
_ সমস্যা নাই কাকা বলেন, আমি শুনছি এখান থেকেই।
_ রজনী মা পল্লব বাবায় এক্সিডেন্ট করছে। বাড়িতে তো কেউ নাই। তাই আমি তোমারে ডাকবার আইছি।
সোহরাব চাচা কথা শেষ করতেই আমি ইশারায় বললাম চলে যেতে। আর তখনি দরজা খোলার আওয়াজ হলো। আমি দাঁত বের করে হেঁসে দিলাম। আর রজনী আমার দিকে দৌড়ে এগিয়ে এলো। অস্থির কন্ঠে বলতে রইলো।
_ কি হয়েছে আপনার। কোথায় লেগেছে। আর এক্সিডেন্ট কীভাবে হলো? আল্লাহ আন্টি আঙ্কেল কোথায়। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। চলুন চলুন আমি নিয়ে যাচ্ছি।
_ রজনী তুমি এতটা অস্থিরের জন্য তো ভালো করে আমার দিকে খেয়ালই করলে না। খেয়াল করলে দেখতে আমি একদম সুস্থ। আমার এক্সিডেন্ট কথা শুনে, তুমি তো রীতিমতো ভয় পেয়ে গেছো। ভয়ের জন্য খেয়াল করোনি আমি পুরোই সুস্থ ভাবে তোমার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার এক্সিডেন্টের মিথ্যাটা ছিলো তোমার ঘরের দরজা খোলার টেকনিক।
পল্লবের এক্সিডেন্ট হয়নি, এটা মিথ্যা ছিলো সেটা শুনে অবাক হওয়ার থেকেও অবাক হলো! পল্লবের তুমি সম্মোধন করায়। এদিক ওদিক চোখ টাকে ঘোরাতে রইলো। এতোটা অস্থিরতা দেখানো উচিত হয়নি। এখন কি ভাববে মানুষটা। আল্লাহ আমি বারবার কেন এই মানুষটার সামনে লজ্জায় পরে যাই। সেদিন পিঠার ঝালের জন্য তাঁকে কীভাবে বকা দিলাম। সেটা নিয়েও মানুষটা আমায় খোঁচা দিয়ে কথা বলেছে। বলে কিনা ঝাল তো আমার লেগেছে, আপনি কেন এতো অস্থির হচ্ছেন। ইসস কথাটা পল্লব বলতেই রজনী লজ্জায় শেষ। আর এখন কিনা আবারও সেই লজ্জার মুখোমুখি হতে হলো।
_ কি হলো রজনী কিছু বলো।
পল্লবের কথায় রজনী আবারও থমকে গেলো। কিছু একটা ছিলো পল্লবের কথায়। তাই কোন রকম নিজেকে সামলে বললো।
_ এভাবে মিথ্যা বলার মানে কী?
_ মিথ্যা তো বলিনি,সত্যি বলেছি। আমার সত্যি এক্সিডেন্ট হয়েছে।
_ যদি হয়ে থাকে কোথায়, আমি তো কোথাও ক্ষত দেখতে পাচ্ছি না।
_ ওই শূন্য চোখে আমার ক্ষত দেখা যাবে না তো?
_ মামানে
_ মনের চোখ খানা খুলে আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাও! দেখবে ক্ষতটা কতো গভীর।
_ ফাজলামো হচ্ছে
_ একদম না,আমার বুকে তোমার ওই নরম হাতটা রাখো। দেখো আমার বুকের ধুকপুক কতোটা প্রখর। কীভাবে আমার হৃদয়ে ক্ষতটা ক্ষতি করছে সেই ধুকপুক। কঠিন মনের মেয়েদের হাতের ছোঁয়া সব সময় ক্ষত সারানোর ঔষধ হয়।
এই কথা ব’লেই রজনীর হাত টেনে নিয়ে নিজের বুকের বামপাশে রাখলো পল্লব। এবার রজনীর বুকের মাঝে ঝড় বইতে শুরু করলো। বুকে যেন কেউ ঢোলের কম্বিনেশনে ফিফটি-ফিফটি ধারাম ধারাম করছে। রজনী অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে রইলো। রজনীকে কাঁপতে দেখে পল্লব বললো।
_ ভালোবাসার প্রথম ছোঁয়া কি তবে এভাবে ঝড় তোলে বুকের মাঝে। আমার ভেতরে শুরু হয়েছে প্রবল স্রোতের জলস্রোত। তাহলে কি তুমি কোন ঝড়। যে এসেই আমাকে এলোমেলো করে দিচ্ছো। এই মেয়ে তুমি কি জাদু জানো নাকি? আমি তো পাগল হ’য়ে গেলাম। আমি কিন্তু তোমার প্রেমে পাগল হতে চাই না। পাগল হলে দেখা যাবে, তুমি বাদে সবাইকে ভুলে গেলাম। কিন্তু আমি তো তোমার সাথে এই পৃথিবীর সব কিছুকেই মনে রাখতে চাই। শুনে রাখো কঠিন মনের মেয়ে,আমি থাকতে চাই প্রেমিক পুরুষ হয়ে!পাগল প্রেমিক হয়ে নয়।
“ওহে শ্যামবতী মেয়ে
তোমার ডাগর ডাগর আঁখিখানায়।
আমার নামে আজ থেকে কাজল দিও।”
চলবে,,