#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-4)
লেখনীতে—ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

বিলাশ বহুল এই ফ্ল্যাটটির সবকিছুতেই আভিজাত্যের ছোঁয়া। চারিদিকেই দেশি বিদেশি আসবাবপত্রে ভরা। যতটুকু বোঝা যাচ্ছে এই বাসার মানুষগুলো খুবই শৌখিন। একটি বিষয় মেহজার চোখে বারবার ধরা খাচ্ছে। সেটি হলো আয়না। হ্যাঁ! আয়না। প্রতেকটি দেওয়ালে নানান রকম কারুকার্যের আয়না। মেহজার হুট করেই হাসি পেল এটা ভেবে ইরফান কি সারাক্ষণ এই আয়নায় নিজের রূপ দেখে! ভাবতেই কেমন একটা লাগছে। মেহজা ইরফানদের হল রুমের সবচেয়ে বড় সোফাটির এক কোণায় বসে আছে। তাকে একা বসে থাকতে দেখে ইরা তার কাছে এগিয়ে যায়। হালকা হেসে বলে

“খারাপ লাগছে নাকি মেহজা!”

“না না আপু ঠিক আছি অমি।”

“দেখে মনে হচ্ছে না। এখানে একা বসে না থেকে আমার সাথে উপরে চল আমার দুই বোন এসেছে। তাদের সাথেও দেখা করবে। ইকরা খুবই মজার মানুষ। আশা করি ওর সাথে কথা বলতে তোমার ভালোই লাগবে। যাবে!”

“কেন নয়! চলুন আপু।”

ইরারও মেহজাকে খুব ভালো লেগেছে। তখন বাসায় এসেই তার মা তাকে ইরফানের জন্য মেহজার কথা বলে। প্রথমে ছোট ভেবে দ্বিমত পোষণ করলেও এখন তাকে দেখে তার ভালোই লেগেছে। মেহজা ফর্সা, লম্বা, স্বাস্থ্যও ভালো। বেশি চিকন নয় আবার বেশি মোটাও নয় একেবারেই পার্ফেক্ট। সব দিক দিয়ে বিবেচনা করলে ইরফানের সাথে ওর বয়সেই যা পার্থক্য। আবার অন্যদিকে সে এটাও ভাবে আজকাল বয়স কোনো ব্যাপারই না। তার স্বামীও তার থেকে বয়সের দিকে দিয়ে খুব বড়। তাতে তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না তাদের। তারা সুখী দম্পতি নামেই সমাজের চোখে পরিচিত।

দোতলায় উঠলেই একেবারে কর্ণারে একটি রুম সবার প্রথমে চোখে পড়ে। রুমটি ইরফানের। অবশ্য মেহজা জিজ্ঞেস করেনি ইরা নিজে থেকেই বলছে। মেহজা একটা জিনিস লক্ষ্য করছে সেটা হলো এরা মা মেয়ে দুজনেই কোনো কথা বললেই বা কিছু হলেই মেহজার কাছে ইরফানকে বেশি হাইলাইট করে। ব্যাপারটা কিছুটা সন্দেহজনক লাগছে ওর কাছে।

মেহজাকে দেখে ইকরা তো গল্প জুড়েই দিয়েছে। ইকরার ছোট্ট একটি মেয়ে শুধু। নামটা খুবই মিষ্টি। গুণগুণ! মেহজার কোলে গুণগুণ খুব স্বাভাবিক ভাবেই গেল কিন্তু অন্যদের বেলায় গুণগুণ এমন করেনা। কেউ চকলেট দিলেও তার কোলে যেতে চায়না কিন্তু চকলেটটা ঠিকই খেয়ে নেয়। আর মেহজা শুধু মাত্র গুণগুণের মাথায় হাত দিয়েছে ওমনি সে মেহজাকে জড়িয়ে ধরে ইশারা ইঙ্গিতে কোলে নিতে বোঝায়। মেয়ের এহেন কান্ডে ইকরা হেসে ফেলে। মেয়ের স্বভাব বাবার মত। সচরাচর তারা কাউকে পছন্দ করেই না আর যদি একবার করে ফেলে তাহলে তাকে দূরে যেতেই দেয় না। উদাহরণ সরূপ ইকরা নিজেই।

“তোমরা কয় ভাই বোন মেহজা?”

“আমার বড় এক ভাই আর ছোট এক ভাই। মাঝখান দিয়ে আমি আমার কোনো বোন নেই।”

“বড় ভাই কীসে পড়ে!”

“ভাইয়া চাকরী করে। একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে আছে।”

“কি বলছো! তাহলে তো তোমার ভাই খুব বড়।”

“ওতোটাও না তবে আমার আর আমার ছোট ভাইয়ের কারণে তাকে খুব বড় কথাটি শুনতে হয়।”

সবাই মেহজার কথায় হেসে দেয়। ইমা বলে

“পরীক্ষা কেমন হয়েছে? কি আশা করছো!”

“আল্লাহর রহমতে ভালোই হয়েছে। রেজাল্ট তো সবাই ভালো আশা করে এখন দেখা যাক কি হয়।”

ইমা আবার বলে
“পড়ালেখা করছো তো মন দিয়ে? হলিক্রসে অবশ্যই পরীক্ষা দিবে। বিজ্ঞান বিভাগের নাকি!”

“জ্বি আপু।”

ইরা কিছুটা বিরক্তির সুরে ইমাকে বলে

“প্রফেসর ইমা! আপনি প্লিজ এখন এখানেও নিজের ক্লাস শুরু করে দিবেন না।”

মেহজার খুবই ভালো লাগছে। এরা তিন বোনই খুবই মিশুক। এরা মেহজার থেকে বয়সে কত বড় কিন্তু কি সুন্দর করেই না তার সাথে মিশছে। এমন ভাবে কথা বলছে যেন মেহজা ওদের নিজের বোন। কথার প্রসঙ্গে মেহজা জানতে পারে তাদের আরো একটি বোন আছেন। তার নাম ইনায়া। তিনি সেজো জন। বর্তমানে স্বামী সন্তান নিয়ে চট্টগ্রাম আছেন। কালকে তিনিও আসবে। আরেকটি ব্যপারে সে অবাক না হয়েই পারলো না। তারা চার বোনই উচ্চশিক্ষিত এবং চাকরীজীবি। ইরা বিদেশেই একটি নামি কোম্পানির সাথে যুক্ত আছেন, ইমা একটি সরকারি কলেজের প্রফেসর, ইনায়া একজন ব্যাংকার এবং ইকরা ডাক্তার। চার বোনের মধ্যে ইকরা সবচেয়ে মেধাবী। মেহজার তো এখন ইনায়ার সাথেও দেখা করতে মন চাইছে। আর তাদের বাবা মাকে স্যালুট করতে ইচ্ছে হচ্ছে। তাদের মা মাহিমা বেগম নিঃসন্দেহে একজন রত্ন গর্ভা। এই চারটি মেয়ের থেকে সে খুব করে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। এক নারীকে দেখেই তো আরেক নারী শিখবে। এরা চারজনেই এই মুহূর্ত থেকে মেহজার অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে। মেহজারও তো বুয়েটে পড়ার খুব ইচ্ছা। সেও চায় একজন নাম করা প্রকৌশলী হতে।

তাদের কথার মাঝেই ইরফান রুমে প্রবেশ করে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে

“ইট অলমোস্ট টেন পি এম গাইজ! ডিনার করবে কখন?”

“ওহ হ্যাঁ! দেখেছিস গল্প করতে করতে তো আমি ভুলেই গেছি। মেহজা সেই কখন থেকে না খাওয়া।”

ইরার কথাতে মেহজা টাস্কি খেল। মাত্রই তো সেই জুস খেল, পাকোড়া খেল, কিছুটা ফ্রুটস কাস্টার্ড খেল। তাছাড়া আরো কত কি এনেছে খেতেই পারেনি। এত খাবার একসাথে খাওয়ার অভ্যাসও তার নেই। তাছাড়া এখন এসব খেলে পরে তো ভাতই খেতে পারবেনা। মেহজাকে লজ্জিত করে ইরফান চট করেই বলে ফেলে

“কখন থেকে না খাওয়া মানে এইতো ওর সামনে খাবার হাতে জুস। এখনো তো খেয়েই চলেছে।”

ইরা, ইমা, ইকরা তাদের এত বড় ভাইয়ের এমন বোকা কথাতে খুব লজ্জা পায়। ইশ! মেয়েটা হয়তো আরো বেশিই লজ্জা পেয়েছে। ইরা রেগে বলল

“ইয়াজ! দিন দিন তুমি যত বড় হচ্ছো তোমার কথা বার্তা ঠিক ততটাই নিকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভদ্রতা ভুলে গেলে নাকি! শি ইজ আওয়ার গেস্ট।”

“জানি আমি। তাও আবার ছোট….

ব্যাস! এই একটা কথাতেই মেহজা রেগে বোম। আবারো ছোট! খাবার নিয়ে অপমান করেছে ঠিক আছে কিন্তু বারবার ছোট ছোট বলবে কেন? মেহজার মনে হয় ইরফান ইচ্ছে করেই মেহজাকে বারবার ছোট ছোট বলে কিছু কথা কড়াভাবে বুঝিয়ে দিতে চাইছে। মেহজা এবার হাতে থাকা গ্লাসের বাকি জুস গুলো এক নিমিষে শেষ করলো। তারপর ফ্রুট কাস্টার্ডটা খেতে লাগলো দ্রুত। দুইবার গলায় বেজে গিয়েছে তাও হালকা কেঁশে পানি পান করে আবারো খাচ্ছে। ইরফান ভ্রুঁ বাঁকিয়ে মেহজার কান্ড ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। গুণগুণও এখন মেহজার সাথে যোগ দিয়েছে। গুণগুণও পাকোড়া খাচ্ছে। খাচ্ছে তো খাচ্ছেই সেও থামছেনা। মেহজাকে অনুকরণ করছে খুব করে। মেহজাও এবার চামচে করে একটু ফ্রুট কাস্টার্ড গুণগুণের দিকেও এগিয়ে দিল। গুণগুণ খেল। এবার মেহজা নিজে একটু খাচ্ছে গুণগুণকে একটু খাওয়াচ্ছে। ইকরা তো পুরোই অবাক! যেই মেয়েকে অনেক বার বলেও ফ্রুট কাস্টার্ড খাওয়া পারেনি সে আজ মেহজার সাথে বসে বেতালে খেয়েই যাচ্ছে। আজব তো!

ইরফান হুট করেই হো হো করে হেসে দিল। তারপর মেহজার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল

“খাওয়ার সময় তোমাকে কেমন একটা লাগে মেহজা! আমার তো ইচ্ছা করছে তোমাকেই খেয়ে ফেলি।”

কথাটা নিতান্তই মেহজাকে লজ্জায় ফেলতে বলেছে ইরফান। তার পেছনে উপস্থিত তারই তিন বোন যে ব্যাপারটা অন্যভাবে নিতে পারে তা সে একদমই ভাবেনি। এদিকে মেহজার হাত কাঁপছে, পা কাঁপছে, খাবার গুলো গলাতেই আটকে গেছে। না পারছে গিলতে না পারছে বের করে আনতে। কাঁশি শুরু হয়ে যায় তার। ইরফান দ্রুত পানি এগিয়ে বলে

“ধীরে ধীরে খাও। আমরা তো জানিই তুমি কয়েক দিনের অভূক্ত। আহ! বাচ্চা মেয়েটা।”

“রাখুন আপনার সিমপ্যাথি! সরুন এখনো তো চকলেটের বরফিই খাইনি।”

ইরফান চকলেটের বরফি হাতে নিয়ে বলে

“তুমি কষ্ট করে নিবে আবার ধরে খাবে তার থেকে ভালো আমিই খাইয়ে দেই। কি বল !”

মেহজা কিছু বলার আগেই মুখে বরফি ঠুসে দিল ইরফান। মেহজা কোনো মতে গিলে আবার কিছু বলবে ইরফান আবারো তার মুখে বরফি ঠুসে দেয়। এক প্রকার জোর করেই সে সাতটি বরফি খাওয়ায় মেহজাকে। এক সময় মেহজা কেঁদেই দেয়। ইমাও খুব বকে দেয় ইরফানকে। মেহজার গা গুলাচ্ছে সে দ্রুত সামনে থাকা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। বমি করছে মেহজা। এবার ইরফানের সত্যিই মেহজার প্রতি মায়া হয়। খুব মায়া হয়।

————————–

ইরফানকে তার বাবা মা ও বোনেরা ভালো ভাবে বকে দেয়। এমন কুৎসিত আচরণ কেউই তার থেকে আশা করেনি। বাচ্চা একটি মেয়ে! তার সাথে এমনটা না করলেই কি হতো না! মেহজাকে ওনারা আজ রেখে দিয়েছেন। ইরা ও মাহিমা বেগম মেহজার বাবাকে খুব করে অনুরোধ করলেন আজকে রাতটা তাকে এখানে থাকতে দেওয়ার জন্য। প্রথমে রাজি হলেন না পরে ইরফানের মায়ের অনুরোধটিও আর ফেললেন না। তাদের কারণেই ওনাদের মেয়েটা অসুস্থ হয়েছে তাই তারা নিজ দায়িত্বে মেহজাকে সুস্থ করে বাসায় পাঠাতে চাইছে।

রাতে মেহজা যখন শুয়ে পড়ে তখন কেউ একজন দরজায় টোকা দেয়। ভাবে ইকরা এসেছে। ডক্টর মানুষ রোগীকে কিছুক্ষণ পর পরই সে দেখে গেছে। এখনো হয়তো ইরা এসেছে তাই জোর গলায় বলে

“দরজা খোলা আছে আপু ভেতরে আসো।”

কেউ একজন ভেতরে ঢুকে। তারপর দরজাটায় ছিটকিনি এটে দেয়। ইকরা দরজা লাগাবে কেন তা বোধ গম্য হয় না মেহজার। পেছনে তাঁকালেই সে একটি পুরুষ অভয়ব দেখে ভয় পেয়ে যায়। এত রাতে এই রুমে কে আসতে পারে। তাও একজন পুরুষ। তার জানামতে এই মুহূর্তে বাসাতে পাঁচ জন পুরুষই অবস্থান করছে। তার মধ্যে কাউকেই তো সন্দেহে করা যায়না। কে এই লোকটা! মেহজার বুক ধক করে উঠে। বিছানা থেকে নেমে পড়ে, ঘরটা অন্ধকার শুধুই ডিম লাইট জ্বলছে। তাতে লোকটির চেহারা বোঝা যাচ্ছেই না। মেহজাকে ভয় পেতে দেখে ইরফান তাকে বলে

“দুঃখীত মেহজা!”

হঠাৎ চেনা একটি কন্ঠ শুনে মেহজার হৃদয় ঠান্ডা হয়ে যায়। শুধু হৃদয় নয়, পুরো শরীরই!

#চলবে।

(দয়া করে রেসপন্স করবেন। দিন দিন রেসপন্স কমে যাচ্ছে। তাছাড়া আপনারা গঠনমূলক মন্তব্যও করছেন না। গল্পটি হয়তো ভালো লাগছেনা আপনাদের।)

বি:দ্র: আপনাদের থেকে আশানুরূপ মন্তব্য না পেয়ে হতাশ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here