#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-১৯)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

তানজীব আর ঈশিতা একটি টেবিলে একে অপরের মুখোমুখি বসে আছে। ঈশিতা একটু বিস্ময়ের মধ্যেই আছে। ডক্টর তানজীব দুই বছর আগেই একেবারে আমেরিকায় নাকি সেটেলড হয়েছিল। তাহলে এখানে কী করছে সেটাই ভাবছে। আর তানজীব ঈশিতাকে দেখে বাহিরে কিছুটা বিরক্ত প্রকাশ করলেও ভেতরে ভেতরে তার ব্যাপারটা মন্দও লাগেনি। তানজীব আর ঈশিতার প্রথম পরিচয় তানজীবের বন্ধ সোহানের মাধ্যমে। ঈশিতা তাদের তিন ব্যাচ জুনিয়র ছিল মেডিকেলে। সোহান ঈশিতাকে তখন পছন্দ করত অনেক। একদিন সে তার অনুভূতি ঠিঠিতে লিখে নিচে তানজীবের নাম লিখে ফেলে। তাও অনিচ্ছাকৃত ভাবেই। পাশ থেকে তখন কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, “তোর পাশে কে বসেছে ব্যাগ কার?” সোহান ছোট করে উত্তর দেয়, “তানজীব” ব্যাস! ইতি টেনে সেখানেও তানজীবই লিখে ফেলে। অন্যমনষ্ক হয়ে গিয়েছিল সে তখন। পরে যখন চিঠিটা ঈশিতা পায় তখন সে তানজীবকে যা নয় তা বলে। স্টুডেন্ট অবস্থায় প্রেম ভালোবাসা করলে পড়ালেখা আর হবে না এমনটাই সে আজীবন পোষণ করে এসেছে নিজের মধ্যে এখনও তাই! তবে এখন সে একজনের প্রতি একটু দুর্বল। এটা ভালোবাসা নয় তবে ভালোলাগা বলা যায়। ইরফানকে সে পছন্দ করে। সেদিন ঈশিতাকে রাগের বসে তানজীব থাপ্পড় মারে। ক্যাম্পাসে ভরা মানুষের সামনে সে যেমন তানজীবকে কথা শোনায় তানজীবও তাকে বদলা ফিরিয়ে দেয় একটা চড়ের মাধ্যমে। পরে সেখানে সোহান আসে তখনিই সবটা খোলাসা হয়। তবুও দুজন দুজনের প্রতি একটা রাগ ক্ষোভ রেখে দেয়। তারপর থেকে প্রায় সময় তাদের ঝগড়া লাগে। দিন পেরিয়ে যায় অনেক। তানজীব ইন্টার্নি করা শুরু করে তখন একদিন ঈশিতার সাথে তার দেখা হয় সেদিন ঈশিতা তার কাছে আগের ব্যাপারটা নিয়ে দুঃখীত জানালে সেও ঈশিতাকে চড় মারার জন্য অনুতপ্ত হয়েছে বলে। একটু ভালো কথা হয় তাদের মধ্যে তখন সে জানতে পারে তানজীব আর কিছুদিনের মধ্যেই আমেরিকা চলে যাবে। সেখানে একটা হসপিটালে জয়েন করবে। সেদিন ঈশিতা বিদায় নেওয়ার সময় শুধু বলে, “ভালো থাকবেন ডক্টর তানজীব। আল্লাহ্ হাফেজ।” ঈশিতার মুখে ডক্টর ডাকটা শুনে তানজীব সেদিন শুধুই মৃদু হেসেছিল।

তানজীব ঈশিতার মনের কথা বুঝতে পেরে বলে,

“বিদেশ আর যাওয়া হলো না ডক্টর ঈশিতা। আম্মা আমায় যেতে দেয়নি। তারচেয়ে বড় কথা সরকারি চাকরী পেয়ে গিয়েছিলাম। দেশপ্রেমটাও জাগ্রত হলো বুঝলেন। দেশে পড়েছি তাই দেশের জন্যই কিছু করি। বিদেশে গিয়ে শুধু শুধু তাদের লাভ আর আমাদের ক্ষতি করব কেন বলুন!”

“ভালো সিদ্ধান্ত।”

“আপনি তো ডক্টর হয়ে গেছেন তাইনা!”

“হ্যাঁ! একমাস হলো একটা প্রাইভেট হসপিটালে আছি।”

“যাক! ডক্টর সম্বোধন করাটা বৃথা যায়নি।”

ঈশিতা হেসে ফেলে। তানজীব পুরোনো কথা গুলে ভুলে আছে ভেবে সে কিছুটা খুশি হয়েছে। সংকোচ কাটিয়ে ঈশিতাও তানজীবের সাথে আলাপ জুড়ে। সেই সুবাদে তানজীব জেনে যায় ঈশিতা মেহজার কাজিন আর ঈশিতা জেনে যায় মেহজাদের বিল্ডিং এ তানজীবরাও থাকে।

☆☆☆

মেহজা অনাকে সামলাচ্ছে। মেয়েটা কাঁদছে খুব। সিনানের উপর এই মুহূর্তে খুব রাগ উঠছে তার। অনাকে শত বুঝিয়েও যখন লাভ হয়না তখন সেখানে ইরফান উপস্থিত হয়। ইরফান হেসে বলে,

“তোমার মেকআপ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তো অনা।”

অনা চমকে ইরফানের দিকে তাঁকায়। ইরফানকে দেখে তার সব রাগ, ক্ষোভ যেন নিভে যায়। ইরফানকে এখানে দেখবে সে আশা করেনি। আসলে তখনও সে ইরফানকে লক্ষ্য করেনি যখন সিনানের সাথে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। অনা কান্না থামিয়ে বলে,

“আপনি তো ইরফান ইয়াজিদ তাইনা?”

“জ্বি হ্যাঁ!”

“আমি আপনাকে চিনি ভাইয়া। আমার বড় ভাই অনিক আপনাদের দলের। মানে, কীসের সহ সভাপতি হয় মনে হয়।”

“চিনি আমি। তোমাকেও আমি আগেই দেখেছি।”

“তাই নাকি! কোথায়?”

“একদিন ক্লাবে এসেছিলে অনিকের সাথে।”

“ও… আমি আপনার নজরে পড়েছি?”

“হ্যাঁ পড়েছ তো! তা এখন এমন কাঁদছ কেন? দেখতে ভালো লাগছেনা। এত বড় মেয়ের এমন ভরা লোকের ভেতর কাঁদাটা বড্ড বেমানান। বুঝলে?”

অনা মৃদু হাসে ইরফানের কথা শুনে। মেহজা ক্রুদ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে ইরফানের দিকে। প্রথম সাক্ষাতেই অনাকে সে তুমি করে বলছে, অনা নাকি তার নজরে পড়েছে, আবার অনাকে বড়ও বলছে। তাহলে তাকে কেন বাচ্চা বাচ্চা বলতো? এটা কেমন বিচার! তার ফ্রেন্ডকে বড় বলে আর তাকে বলে বাচ্চা! বৈষম্য করে! না! আসলে লোকটা বদ! লুচ্চা।

মেহজাকে কটমট দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থাকতে দেখে ইরফান ভ্রুঁ কুঁচকায়। মেহজা মুখ বাঁকিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। লোকটা আস্ত অসভ্য!
ইরফান মেহজার যাওয়ার দিকে তাঁকিয়ে থাকে। মেহজা কেন এমন করেছে সেটা তার বুঝতে বেগ পেতে হয়না। তবে এইটুকু ব্যাপারে তার এমন রিয়েক্ট করা বেমানান। ইরফানও মুখ ঘুরিয়েই নিচ্ছিল তখনিই মনে পড়ে গতকাল রাতেই তো সে মেহজাকে দিয়ে ওয়াদা করিয়েছে আজ সারাদিন সে যা বলবে মেহজা বাধ্য হয়ে তা শুনবে এবং পালন করবে। ইরফান দ্রুত কদম ফেলে মেহজার পথ আটকায়। তারপর ভরাট গলায় বলে,

“মেহজা কালকের ওয়াদা ভুলে গিয়েছ?”

মেহজা দাঁত দিয়ে জিভ কাটে। সে সত্যিই ভুলে গেছে। ইরফানটাও ভুলে যেত পারল না! সে ভেবেছিল এখন সে রাগ আর জেদ ধরে একটা পার্ট নিবে। তা আর হলো কোথায়! ইরফান পুনরায় জিজ্ঞেস করতেই মেহজা জবাব দেয়,

“না মনে পড়েছে।”

“না আবার মনে পড়েছে। তারমানে ভুলেই গিয়েছিলে! সে যাই হোক! তুমি ওয়াদা ভঙ্গ করেছ। প্রথমে তো নয়টায় আমার রুমে যাওনি আর দ্বিতীয়ত আমার সাথে করে গাড়িতে আসোনি। বরং তানজীবের সামনে আমায় লজ্জিত করেছ। এখন তুমিই বল শাস্তি হিসেবে কি নিতে চাও!”

“আমি ঠিক নয়টায় আপনার বাসায় গিয়েছিলাম। আর আজ আমার ভাইয়ের বিয়ে! ভাইয়ের বিয়েতে বোন তার ভাইয়ের গাড়িতেই যায়। এটা স্বাভাবিক!”

“তুমি আমার বাসায় গিয়ে আমার সাথে তো আর দেখা করনি। আর তুমি আমাকে লজ্জিত না করে ঠিকভাবে আমার অনুমতি নিয়েও রাদিফের গাড়িতে আসতে পারতে। ছোট্ট করে বড় একটা অপমান করেছ তুমি আমার। শোনো মেয়ে! তুমি এখন কঠিন শাস্তি পেতে চলেছ।”

“যেমন?”

“শাড়ি খুলে দাঁড়িয়ে থাকবে।”

“কিইইইইইই! পাগল হয়ে গেছেন নাকি? কি যা তা বলছেন।”

“হুম সেটাই করব। আমার থার্ড অর্ডার পূরণ না করলে এই শাস্তিটাই পাবে।”

“আচ্ছা আচ্ছা! বলুন আপনার নেক্সট কাজ।”

“দুটো বেজে এসেছে। টাইমলি খাওয়া আমার অভ্যাস। এখন আমি খাব আর তুমি আমার পাশেই বসে থাকবে। আমার কি লাগবে না লাগবে তুমি সব এগিয়ে দিবে।”

“আজব! আপনার খাওয়ার হলে আপনি খান না। আমাকে জড়াচ্ছেন কেন? এতদিন একা কীভাবে খেতেন?”

“বউ ছিল না বিধায় খেতাম একা একা। এখন বউ আছে সাথে একা কেন খাব?”

“বউকেই খান।”

“আচ্ছা চল তাহলে।”

“কোথায়?”

“তোমাকে খেতে হবে তো।”

“আপনি একটা অসভ্য মানুষ তা কী জানেন?”

“এখন জানলাম।”

মেহজা রেগে লাল হয়ে যায়। ইরফান মুঁচকি হেসে তার হাত টেনে নিয়ে যায় খাবার খাওয়ার জায়গাতে। ইরফান সেখানে গিয়ে দেখে সিনান একটা টেবিলে বসে একের পর এক বিয়ার খাচ্ছে। ইরফান সেই টেবিলে গিয়ে বসে।

“মেজর সাহেব? বিয়ার ও খান নাকি!”

সিনান হো হো করে হেসে ওঠে। তারপর বলে,

“এটা বিদেশি ড্রিংক। ড্রিংক মানেই মদ আর বিয়ার নয় বুঝলেন। এটা ফলের জুস এবং এটি সম্পূর্ণ হালাল উপকরণ দিয়ে তৈরি। ক্যানটা এমন যে কেউ দেখলেই বিয়ার বলবে। এটা আমি আর রাদিফ আনিয়েছি। আমরা কয়েকজন খাব বাকিদের জন্য অন্য ড্রিংকস্ এরেন্জ করা। নিন আপনিও দুইটা খান। তিন চারটা খেলেও খারাপ লাগবেনা। রিফ্রেশমেন্ট কাজ করে বুঝলেন।”

ইরফান হাসিমুখে একটা নেয়। মেহজারও খেতে ইচ্ছে হয় তাই সেও একটা নেয়। সিনান বলে,

“তুমি আরো তিন চারটা নিয়ে নাও মেহজা।”

“কেন? আমি একটাই খাব ভাইয়া।”

“না বলছিলাম কি তোমার বান্ধবীদের জন্য নিয়ে নাও।”

“আচ্ছা।”

“মেহজা!”

সিনানের গলায় কিছু একটা ছিল যাতে মেহজা কিছুটা অবাক হয়। সিনান ইরফানের দিকে একবার চেয়ে বলে,

“তোমার সেই বান্ধবীটা কোথায়?”

“কোনটা?”

“ঐ যে তখন …..

“অনা! হুহ, এখন তার খবর নিচ্ছেন কেন? অপমান তো কম করেন নি।”

“তুমি শুধু আমার করা অপমানটাই দেখলে সে যে আমাকে করেছে সেটি দেখলেনা?”

“আপনি একটু বেশিই করেছেন।”

সিনান অসহায় দৃষ্টিতে ইরফানের দিকে তাঁকিয়ে বলে,

“দেখলেন মি. ইয়াজিদ! আমরা ছেলেরা এই সমাজে কতটা অবহেলিত!”

“হ্যাঁ ভয়াবহ রকমের অবহেলিত।”

মেহজা দুজনের দিকে চোখ গরম করে তাঁকিয়ে পুরো একটা বক্স নিয়ে চলে যায়। সিনান নির্বিকার চেয়ে রয় সেদিকে। তারপর মনে পড়ে সেই বক্সে নেশা জাতীয় কিছু ড্রিংকস্ ও আছে যা খেলে ভয়ানক কিছু ঘটতে পারে। ইরফানকে বলবে বলবে করেও বলা হচ্ছেনা। আসলে এই ড্রিংকস্ গুলো স্পেশালি রাদিফ আর তাদের গ্যাং এর কিছু বিবাহিত বন্ধুদের জন্যে এনছিল। নেশা জাতীয় ড্রিংকস্ আছে শুনলে ইরফান হয়তো মাইন্ডে নিতে পারে। তাই সে উঠে গিয়ে মেহজার থেকে বক্স আনতে যাবে তখন ইরফান তাকে ডেকে ইরফানের পাশে বসিয়েই একসাথে খাবার খাওয়ায় জোরপূর্বক। গল্পে মশগুল সিনানও বক্সের কথা বেমালুম ভুলে যায়।

বিয়ে শেষে সবাই যে যার বাসায় ফিরে শুধু অনা, প্রথি আর সিনান ও মেহজার বাকি কাজিনরা মেহজাদের ফ্ল্যাটেই যায়। রাতে সবাই ঘুমালে মেহজা অনা আর প্রথি ব্যাগ থেকে সেই ক্যান গুলো বের করে নিয়ে বারান্দায় বসে। সফট্ মিউজিক ছেড়ে ড্রিংক করতে থাকে। প্রথম চুমুকেই মাথা ভনভন করে উঠে। পরে আর কোনো থামাথামি না করে একে অপরের সাথে কাড়াকাড়ি করে ছয়টা ক্যান খালি করে দেয়।

নেশায় চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে সবার। প্রথি ঘুমিয়ে পড়লেও মেহজা আর অনা বিরাট কান্ড ঘটায়!

#চলবে!

(কেমন হয়েছে বলবেন দয়া করে। ভালো, খারাপ দুটোই বলবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here