#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-১৪)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

সকাল দশটা বেজে তিন মিনিট। মেহজা সোফায় বসে আছে বিরক্তিকর ভাব নিয়ে। ইমা একটু আগেই এখান থেকে কলেজে গেছে সোজা। আর ইরফান ইমাকে এগিয়ে দিয়ে আসছি বলে সে কখন যে বের হলো এখনও ফিরার নাম নেই। একা একা যেন মেহজার সময়টা কাটছেই না। অনা আর প্রথি কলেজে তাই ওদের সাথেও যোগাযোগ করা যাচ্ছেনা। ইকরাকে ইমা যাওয়ার আগে বলেছে সুযোগ পেলে আসতে। এখন দেখা যাক সে আসে কী না! এমনিতেও তো সে মেহজার উপর রাগ করেছে তার রাগ ভাঙানোর সুযোগও মেহজা পায়নি। আজ আসলে মেহজা তার কাছে ক্ষমা চাইবে, রাগ ভাঙাবেও। কলিংবেলের শব্দ পেতেই দৌঁড়ে দরজার কাছে ছুটে যায় সে। দেখে একজন মধ্যবয়সী মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মেহজা তাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই মহিলাটি বলে ওঠে,

“ভাবিজান আইছেন? আমারে তো চিনবেন না আমি কিন্তু চিনি আমনেরে। আমি ওইছি ভাইয়ের রাঁধুনী। ছেফ ছেফ!”

ছেফ কথাটি শুনে মেহজার খুব হাসি পায়। সে হা হা করে হেসে ওঠে। মহিলাটি বলে,

“মাশাআল্লাহ্! খুউব সুন্দর ভাইয়ের পসন্দ আসে বটে।”

মেহজা মৃদু হেসে মহিলাটিকে ভেতরে ঢুকার জায়গা করে দেয়। তারপর দরজা লক করে উনার পিছনে রান্নাঘরে ঢুকে। মেহজা তাকে জিজ্ঞেস করে,

“আপনার নাম কী?”

“মিতালি বেগম। হেই আপনে মিতালি আফা কইলেও সাইরবো।”

“সাইরবো!”

“হইবো আর কী!”

“ওহ্। আচ্ছ মিতালি আপা আপনি কতদিন ধরে এই বাসায় রান্নার কাজ করেন!”

“এমনে তো এক্ষন টানা ছয় হাত মাস করছি কিন্তু মূলত দুই বছর আগেই আমি এখানে কাম শুরু করছি। ভাইয়ের আব্বা আম্মা তেনারে থাকতে দিত না এক মাস থাইকা যাইতো গা। তবে ওহন আর যায়না।”

“ওহ আচ্ছা।”

“জ্বি।”

“তো আজ কী রান্না করবেন!”

“ইমা আফা সকালে ফোন দিয়া কইছে আজকে গরুর গোস্ত রান্না কইত্ত। আর ভাইজানের সালাদ তো হে নিজেই বানাইবো। তাছাড়া রুই মাছ, ইলিশ আর চিংড়ী মাছ ও করতে। মোরগ পোলাও করতে কইছে কিন্তু আমি পারিনা তাই আফা কইছে ভাত কইল্লেই ওইবো।”

“এত কিছু করবেন? কেন! এক পদ রান্না করলেই তো হয়। সর্বোচ্চ দুই পদ।”

“ভাইয়ে তো দুই পদ এ খায় কিন্তু ছোড আফাও আইবো আবার আমনে আছেন না!”

“ওহ্ ভুলেই তো গেছি। আপা আমি মোরগ পোলাও করতে পারি। আমি বরং রান্না করে নেই সেটি। আর ইলিশ মাছ আর চিংড়ী মাছটাও আমি করব। আর গরুর মাংস আর রুই মাছটাও না হয় আমিই করে নেই। মানে আজকের সব রান্না আমিই করি। আপনি শুধু ভাতটাই করেন।”

“না না। কি কন! আমি আছি কেন?”

“আমি ছিলাম না তাই তো আপনি ছিলেন। এখন আমি আছি তাই আমি রান্না করব। আর আপনিও তো আছেন আমার সাথে। আমাকে না হয় হেল্প করবেন। আপনি এক কাজ করুন আমাকে সব কিছু কেটে কুটে দিন আর সব দরকারি জিনিস দিন আমি শুধু রাঁধব। তাহলেই তো হয়।”

“আমি….

“প্লিজ!”

মিতালি হেসে সব কিছু কেটে মসলা পাতি সব যোগাড় করে দেয়। আর মেহজাও পাক্কা গিন্নির মত রান্নাবান্না করা শুরু করে।

বেলা একটায় সব রান্না শেষ বাকি আছে শুধু গরুর মাংস। প্রেশার কুকারে বসিয়েছে নরম করার জন্য। প্রথম সিটি বেজে উঠতেই সেখানে ইকরা হাজির। মেহজাকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে বলে ওঠে,

“বাহ্!রান্নাও করছিস দেখছি। তো এত ঢং করলি কেন? সেই তো আমার ভাইয়ের ভাত-ই রাঁধছিস। নিজেও কষ্ট পাস ওকেও কষ্ট দিস।”

মেহজা ইকরার সেইসব কথা পাত্তা না দিয়ে উচ্ছাসিত কন্ঠে বলে ওঠে,

“আপু তুমি কখন এলে? কেমন আছো!”

“এই তো এখন এলাম। এখন আর কেমন আছি জিজ্ঞেস করে কী হবে। হুহ!”

মেহজা হেসে ওঠে। তারপর ইকরাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে সরি বলতে থাকতে। এক পর্যায়ে ইকরা হেসে বলে,

“থাম থাম! হয়েছে অনেক। আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি তুইও গোসল সেড়ে আয়। রান্না কমপ্লিট!”

“হ্যাঁ অলরেডী!”

“জলদি কর। মিতালি আপা তুমি কিন্তু খেয়ে যাবে। আমাদের ঘরের বউয়ের হাতের রান্না না খেয়ে যাবেনা।”

“হো খামু। ভাবিজানেও কইছে না খাই জাইতেনা।”

“আচ্ছা। আমি আসছি ফ্রেশ হয়ে।”

মেহজাও নিজের ক্জে মনোযোগ দেয়। তারপর বাকিটা কমপ্লিট করে। মিতালিকে খেতে দিয়ে সে উপরে চলে যায়। মিতালির তাড়া আছে অন্য জায়গায়ও যেতে হবে। মেহজা নীল রঙের একটি সফ্ট জর্জেটের থ্রি পিস পড়ে
নামায ও পড়ে নেয়। তারপর ইকরার রুমে যায়। দেখে ইকরা শুয়ে আছে মাথায় হিজাব। বোধ হয় নামায পড়েই শুয়েছে। মেহজা ইকরাকে ডাকতেই সে উঠে বসে। তারপর মেহজাকে বলে,

“নামায পড়েছিস?”

“হ্যাঁ আপু।”

“এখন নিয়মিত পড়িস তো?”

“হোস্টেলে পাঁচ ওয়াক্ত মিস যায়না। আজ ফজরটা ….

“কাল থেকে যেন আর মিস না যায়।”

“আচ্ছা।”

“ইয়াজ এখনও আসেনি!”

“না।”

“কোথায় ও?”

“জানিনা তখন শুধু ইমা আপুকে পার্কিং পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসবে বলেছিল। এখ….

“ধোঁকাবাজ নাম্বার ওয়ান। অফিসেই গেছে ও আর তা না হলে কোনো জায়গায় গিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে।”

“আড্ডা!”

“রাজনীতি করে তো। একবার এক সম্মেলনে যায়।”

“তাই বলে আড্ডা বলবে!”

“আড্ডাই তো। চল লিভিং এ যাই। আমার ভিষণ ক্ষুদা পেয়েছেরে। সেই কখন বেরিয়েছি বাসা থেকে।”

“তাহলে সোজা ডাইনিং এ চলো।”

“না না। ইয়াজ আসুক। একসাথেই খাবো।”

মেহজা মাথা নাঁড়িয়ে সায় দেয়। এরা সামনা সামনি তো একজন আরেকজনকে দেখতেই পারেনা কিন্তু ভেতরে ভেতরে কত আদর, মায়া, স্নেহ আর ভালোবাসা! দুজনে নিচে গিয়ে বসে কিছুক্ষণ গল্প করতে থাকে। ইরফান এখনো আসেনি দেখে সে কল দেয়। বারবার কল কেটে দেওয়াতে ইকরা রাগ করে। আজ এলে খবর আছে এই সেই নানান কথা বলতে থাকে। তখনিই ইরফান সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল,

“বারবার কল কেটে দিচ্ছি এরপরেও কল দিচ্ছিস কেন?”

আকস্মিক ইরফানের আওয়াজে মেহজা ও ইকরা দুজনেই ভয় পেয়ে যায়। পেছনে ইরফানকে দেখে ইকরা চেঁচিয়ে বলে,

“এমন ভয় পাইয়ে দিলি কেন বেয়াদব! কখন এলি তুই? দেখলাম না তো!”

“দেখবি কীভাবে! তোরা মেয়েরা যখন রুমে বসে ফুসুর ফাসুর করিস তখন পাশ দিয়ে বাঘ হেটে গেলেও টের পাবিনা।”

ইকরা কিছু বলতে যাবে তার আগে ইরফান বলে ওঠে,

“খুব ক্ষিদা পেয়েছে। অভুক্ত ও অসুস্থ শরীরটা নিয়ে এখন তোরসাথে ঝগড়া করতে পারবো না।”

ইকরা আর মেহজা এই কথাতেই হুড়মড়িয়ে উঠে গেল। ইরফান যে অসুস্থ তা কারো খেয়ালই ছিল না। এমন শক্ত হয়ে থাকে যে বোঝা দায়! ইরফান চেয়ারে বসলে মেহজা ইকরাকেও বসতে বলে খাবার পরিবেশন করে দেয়। মোরগ পোলাও দেখে ইরফান ভ্রু কুঁচকে বলে,

“মোরগ পোলাও! মিতালি আপু করেছে নাকি?”

“না। তোর বউ করেছে আজ সব রান্না।”

“আমার বউ?”

“হ্যাঁ তোর বউ। এই যে তোর পাশে জলজ্যান্ত মানুষটি দাঁড়িয়ে আছে সে তোর বউ।”

“জানি আমি। তবে ও রান্না করতে জানে নাকি!”

মেহজা কথাটা শুনে ক্ষেপে উঠে বলে,

“জানিনা মানে? আমি আরো একবছর আগে থেকেই সব রান্না করা শিখেছি। আপনার মত আকামা না আমি।”

“আমি আকামা মানে!”

“খাবার টেবিলে ঝগড়া কীসের ইরফান?”

ইমা এসেছে। বেসিনে গিয়ে হাত মুখ ধুঁয়ে সেও প্লেট নিয়ে বসে। ইমাকে দেখে পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়ে পড়ে মুহূর্তেই। ইকরা তো রান্নার প্রশংসা করতে করতে শেষ। ইমারও খুব ভালো লেগেছে। শুধু ইরফানই বলল,

“ক্ষুদার সময় বিস্বাদকর খাবারও মজা।”

মেহজা তাতেই রেগে গেল। রাগের চেয়ে অভিমানটা বেশি হলো। প্রিয় মানুষটার জন্য সেই সকাল থেকে কষ্ট করে এতকিছু করল আর সে কিনা এমন একটি মন্তব্য করেছে! কিশোরী মনটা মুহূর্তেই কান্নায় চেপে বসল। কিন্তু কান্নাটা সবার দৃষ্টিগোচরেই থেকে গেল।

#চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here