#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-১১)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

ছয়টি মাস দেখতে দেখতে কেটে গেছে। এরই মাঝে হোস্টেলে মেহজার দুইটি খুবই ভালো বান্ধবী জুটেছে। অনা আর প্রথি। প্রথি মুজমদার আর অনা রহমান দুজনেই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারীনি। মেহজা যেমন তাদের চোখে হারায় তারাও মেহজাকে চোখে হারায়। এই ছয়মাসে বদলেছে অনেক কিছু কিন্তু বদলায়নি মেহজার মনের অবস্থা। ইরফানের প্রতি একতরফা ভালোবাসা তাকে পুঁড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। এই ছয়মাসে সে মাত্র দুইবার বাসায় যায়। দুদিনের বেশি থাকেই না। ইরফান নেই তাও সে কেন থাকতে চায়না তা নিয়ে মায়ের সাথে কয়েক দফা লেগেছে সে। প্রতিবারই রাগ করে হোস্টেলে ফিরে। বাবা মঈনুল কয়েকবার এসে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু সে যায়না। রাদিফের সাথে আর রাফসানের সাথে প্রতি সপ্তাহে সে ঘুরতে বের হয়। কখনো রেস্টুরেন্ট, তো কখনো পার্ক, এই ফাঁকে তো তারা তিন ভাই বোন কক্সবাজার আর সিলেট ঘুরেও এসেছিল। এখন আর সেইসবের ছিঁটেফোঁটাও নেই কারণ ইয়ার চেন্জ পরীক্ষা সামনে। দম ফেলার সময়টুকুও নেই যেন! ইমা তো স্পষ্ট বলে দিয়েছে

“এবার যদি এক থেকে তিনের পজিশনে না আসতে পারো তাহলে আমার কাছে আর এসো না। আমি বুঝে নিব আমি ব্যার্থ শিক্ষিকা।”

এই একটি কথা মেহজাকে নাঁড়িয়ে দিয়ে গেল। নিজের ইচ্ছে তো ছিল তার সাথে তার প্রিয় গুরুরও তা চাওয়া। এই একটি মানুষের জন্য তার হৃদয়ে অনেক সম্মান জমা আছে। সে যখন ঘর ছেড়ে হোস্টেলে উঠেছিল সবাই তাকে বাধা দেয়, তার সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই মানতে চায়নি। ইমা একমাত্র মানুষ যে তাকে সঙ্গ দেয়। আরো উৎসাহিত করে এই বলে
“চিন্তা নেই। আমি সবসময় তোমার পাশে আছি। একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছো। এইসব পারিবারিক ঝামেলায় থেকে তো হাতে ধরেই ক্যারিয়ার বরবাদ করতে যাচ্ছিলে। এবার যা সিদ্ধান্ত নিয়েছো একদম যথার্থ। আমি এখন থেকে দুঘন্টা সময় দিব তোমাকে কলেজ শেষে। মনে রাখবে কিন্তু! আমি পড়াশোনার ব্যাপারে গাফিলতি একদমই পছন্দ করিনা। বায়োলজি টিচার আর ম্যাথ টিচারও ঠিক করে দিব আমি। সব মনোযোগ শুধুই পড়াশোনায়। বুঝতে পেরেছো?” মেহজা তখন মাথা নাঁড়িয়ে শুধুই “হ্যাঁ” বলেছে আর তা বলাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, কাজেও করে দেখিয়েছে।

ইরফানকে সে এই কয়মাসে একটিবারও দেখেনি। এমনটা নয় সে দেখতে চায়নি, আসলে দেখা পায়নি সে। কাজের মধ্যে নাকি সে এতোটাই আটকা পড়েছে যে বাবা মায়ের সাথেও এসে দেখা করেনি। সবই শোনা কথা। ইকরাও রাগ করে তার সাথে আগের মতো কথা বলেনা। প্রথম প্রথম কষ্ট পেলেও এখন মানিয়ে নিচ্ছে। কারণ কিছুই তো করার নেই।

বাহিরের কোলাহলে মেহজার কান বোঁধ হয় ফেটে যাচ্ছে। বইয়ের মধ্যে এতক্ষণ মুখ গুজে ছিল সে কিন্তু এখন আর তা সম্ভব হচ্ছেনা। পড়াতে মনই বসছেনা। পাশে ফিরে দেখে প্রথি আর অনারও একই অবস্থা। কেমন একটা অখুশি চেহারা তাদের। মেহজার তাদের উপর বড্ড মায়া হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই মেহজাকে দুজনে বনানীর একটি নতুন রেস্টুরেন্টে যেতে বলে। মেহজা জবাবে শুধুই শক্ত চাহনি নিক্ষেপ করে তাদের উপর। এখন তো তারও ভালো লাগছেনা আর ওদের চেহারাতেও মন খারাপ স্পষ্ট। মেহজা উঠে ড্রয়ার থেকে একটি কালো রঙের শাড়ি বের করে বলে

” শাড়ি পড়ে গেলে কেমন হয় গার্লস!”
দুজনেই চকিত নয়নে কিছুক্ষণ চেয়ে চিৎকার করে বলে উঠে

“সুপ্পার!”

মেহজা হেসে উঠে। তার বাচ্চামো স্বভাবটা নিস্তেজ হয়ে গেলেও প্রথি আর অনার বাচ্চামোতে তার আনন্দ হয়। তিন বান্ধবীই একসাথে শাড়ি মিলিয়ে পড়ে। সবই এক কিন্তু রং আলাদা। যেমন মেহজার শাড়ি কালো, প্রথির শাড়ি নীল, অনার শাড়ি গোলাপী। তিনজনেই একইরকম সাজ দেয়। তারপর একটি ক্যাব বুক করে বেরিয়ে পড়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

——————————————-

“কাঠফাটা রোদের মধ্যে না বেরিয়ে আসলেই হতো। তাই নারে অনু!”
মেহজার এমন কথায় ভ্রু কুঁচকে অনা বলে

“একদমই না। কাঠফাটা রোদ কোথায় দেখছিস? এখন বিকেল হয়ে গেছে। তাপমাত্রা কমে গেছে। সূর্য নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। তুইও না!”

“হু ঠিক বলেছিস। চল চল! ভেতরে গিয়ে দেখবি ভালো লাগছে। এসি আছে তো!”

লিফ্টে উঠে যায় সবাই। মেহজার একটু অস্বস্তি লাগছে এভাবে শাড়ি পড়ে বের হওয়াতে কিন্তু মানিয়ে নিচ্ছে। এখন থেকে সব অবস্থাতেই তাকে মানিয়ে নিতে হয়। সাত নম্বর ফ্লোরে গিয়ে মেহজার কিছুটা স্বস্তি লাগে। চারিদিকে ঠান্ডা পরিবেশ। যে যার মতো ব্যস্ত। প্রথি গিয়ে কর্ণারের একটি টেবিলে বসে পড়ে। তারপর অনা আর মেহজাকে হাত উঁচিয়ে ডাকতেই তারা গিয়ে বসে পড়ে। সফ্ট মিউজিকে সবকিছু আরো ভালো লাগছে। মেহজার হুট করে মনে পড়লো অনেকদিন সে গান শুনেনা! আবার এটাও খেয়াল করেছে এখন যেই গানটি বাজছে সেটি তার প্রিয় গান। একসময় এতো বেশিই শুনতো যে রাফসান বিরক্ত হয়ে বলতো,
“এই ফকিন্নি! আর গান নাই তোর ঝুলিতে! এই একটা গানই কেন শুনিস সারাক্ষণ!”
রাফসানের কথা মনে পড়তেই ফিক করে হেসে দেয় মেহজা। হুট করে হেসে ফেলায় অনা আর প্রথি কিছুটা বিস্মিত হয়। প্রথি জিজ্ঞেস করে,

“কীরে! কী হলো? হাসছিস কেন হুট করে! পেত্নী ধরেছে নাকি!”

“আরে কী বলছিস! রাফসানের জোক্স মনে পড়ে গেল তাই হেসে ফেলেছি।”

“হঠাৎ কীসের জোক্স মনে পড়লো তোর!”

মেহজা অনার কথার জবাব দিতে যাবে তখনিই একজন ওয়েটার এসে বলে

“কী নিবেন ম্যাম!”

অনা আর প্রথিও দেরী না করে অর্ডার দিয়ে দেয়। মেহজাকে জিজ্ঞেস করাতে বলে সে ক্রিম অব্ মাশরুম স্যুপ খাবে। ব্যাস! আর বাকিসব অর্ডার ওরা দুজনই দেয়। মেহজারও বাকি খাবার গুলোতে কোনো অসুবিধা নেই তাই।
খাবার ফাঁকে মেহজা আশপাশটা একবার চোখ বুলায়। আবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয় সে। কিছুক্ষণ পরেই একটি সুমিষ্ট পুরুষালী কন্ঠ মেহজাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“মেহজা যে? কেমন আছো?”
পাশে ফিরে সিনানকে দেখে মেহজা অবাক হয়ে বলল,

“সিনান ভাইয়া যে! আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। তোমার কি খবর! আর এখানে কী করছো?”

“আমিও ভালো আছি। আর তুমি যা করতে এসেছো আমিও তা-ই করতে এসেছি। বন্ধুদের সাথে খেতে এসেছি।”

“ওহ তাই নাকি! কোথায় আপনার বন্ধুরা?”

“ঐ তো তোমাদের পাশের টেবিলের গ্যাংটাই।”

“ওহ্!”

“কী অর্ডার করলে? মাশরুম স্যুপ! তোমার প্রিয় এটা তাই না!”

“হ্যাঁ ভাইয়া। আচ্ছা তাহলে আমিও একটা নেই।”

সিনান ওয়েটারকে ডাক দিয়ে নিজেও একটি স্যুপ অর্ডার করে। তারপর মেহজাকে উদ্দেশ্য করে বলে

“ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড! আমি তোমাদের সাথে জয়েন করতে পারি?”

অনা তো না বলতেই নেয় প্রথি তাকে থামিয়ে বলে

“কেন নয়! বসুন না ভাইয়া!”

“থ্যাংকস্ সুইট গার্ল!”

প্রথি তো এমনিতেও ক্রাশ খেয়ে বসেই ছিল তার উপর এমন প্রশংসা শুনে সে রীতিমতো হাবুডুবু খাচ্ছে। মেহজারও ভালোই লাগছে। অনেকদিন পর সিনানের সাথে দেখা হয়েছে। এখন কথা বার্তা বললে খারাপ হয়না। অনার কাছে বিরক্ত লাগছে। একজন অচেনা, অজানা মানুষের সামনে খাওয়া যায় নাকি! তাছাড়া তাদের মেয়েলি আলাপ, হাসি – মজায় লোকটি কেন থাকবে? প্রথম দেখাতেই অনা তাকে ম্যানারলেস আখ্যায়িত করে নেয় মনে মনে।

সিনানকে পাশের টেবিল থেকে তার বন্ধুরা টিপ্পনি কেটে কথা বলছে। বদৌলতে তাদেরকে আবার মেহজা আর প্রথি কথা শুনাচ্ছে। দুই টেবিলেই হাসি মজা হই হুল্লোরে খাওয়া দাওয়া আরো জমে উঠছে। সিনানের বন্ধু তামিমের জোক্স শুনে মেহজার এতোটাই হাসি পায় যে চোখের কোণে পানি জমে যায়। পরে তো কাঁশিই উঠে গেল। সিনান পানি এগিয়ে দিয়ে তার মাথায় বারি দেয় আলতো করে। কাঁশি থেমে গেলে মেহজার মনে হয় একটা চেনাপরিচিত পারফিউমের গন্ধ পায় সে। তখনিই তাদের টেবিলের সামনে দিয়ে সশব্দে কেউ একজন হেটে যায়। মেহজা লোকটির চেহারা দেখতে তার মুখের দিকে তাঁকালে দেখে লোকটি তার স্বামী! ইরফান ইয়াজিদ! অনার কথায় মুহূর্তেই মেহজার রাগ উঠে যায়। অনা বলছে,

“ইশ! আমি যদি ইরফান ইয়াজিদের বউ হতাম!”

সিনান কিছুটা আক্ষেপের সুরে বলে

“আর আপনি যদি আমার বউ হতেন!”

কথাটি শুনে অনার বুকটা ধক করে উঠে। লোকটি এটা কেমন কথা বলল!

#চলবে।

(ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কেমন হয়েছে অবশ্যই জানাবেন। তাহলে বোনাস পর্ব পাবেন। দয়া করে নেক্সট, অসাধারণ, সুন্দর, ইন্টারেস্টিং না বলে দুই লাইনের গ্রহণ যোগ্য মন্তব্য করবেন। ধন্যবাদ আগেই দিয়ে দিলাম।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here