#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_১৫
অহি উঠে দাঁড়ালো।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে বার কয়েক আঙুল চালালো।তারপর মাথায় কাপড় দিয়ে হাঁটা ধরলো।দরজার কাছে পৌঁছাতে রোদেলা ভেতরে ঢুকে বলল,
—“কই যাস রে অহি?”
রোদেলার বিধ্বস্ত চেহারা অহির নজর এড়ালো না।মেয়েটা এত কেন পরিশ্রম করে?মুখটা কেমন চুপসে আছে।রাত বারোটার কাছাকাছি।এখনো ঘুমানোর কোনো তাড়াহুড়ো নেই।আবার তো ভোরবেলা উঠতে হবে!
অহি হাঁটতে হাঁটতে বলল,
—“আপু তুমি বসে রেস্ট নাও একটু।আমি চা করে আনছি।”
বলে সে সিঁড়ি দিয়ে নামলো।
ড্রয়িং রুম অন্ধকার।কুটি হয়তো লাইট বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে।এ বাসায় কুটি আর ফজিলা খালা রান্নাঘরের সাথের রুমটাতে থাকে।এর আগে রুমে একটা বড় খাট ছিল।সেখাতে দুজন একসাথে ঘুমাতো।কিন্তু মাঝে একদিন বাগড়া ধরে কুটি।ফজিলা খালার ঘুমানোর নাকি শ্রী নাই।বুকের আঁচল টাচল ঠিক থাকে না।একত্রে ঘুমাতে পারবে না।সেজন্য সে খালুকে আলাদা বিছানার কথা বলে!পরে অনেক ভেবে স্টিলের দুটো সিঙ্গেল খাটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।এখন দুজন একই রুমে দু বিছানায় ঘুমায়।
অহি রান্নাঘরে সুইচ টিপে লাইট অন করলো।সাবধানে ডেকচিতে পানি দিয়ে চুলায় বসালো।সে শব্দ করতে চাচ্ছে না।কারো ঘুম যেন ভেঙে না যায়।ডিনারের পরপরই কুটি আর ফজিলা খালা ঘুমের অতলে হারিয়ে যায়!
কিছুক্ষণ পর গরম চা ছেঁকে তিনটা কাপে ঢাললো অহি।রং চা!রোদেলার আপুর কাপে এক চামচ চিনি,রোদ্দুর ভাইয়ের কাপে দেড় চামচ চিনি আর নিচের কাপে দু চামচ চিনি দিয়ে টুংটাং আওয়াজ তুলে নাড়াচাড়া করলো।
রান্নাঘরের লাইট বন্ধ করে ফোনের আলো জ্বলাল।তারপর ট্রে টা হাতে নিয়ে বাইরে কয়েক পা এগুতে কেউ পেছন থেকে ঝাপটে ধরলো।
অহি কিছু বলার আগেই কুটির কন্ঠ কানে আসলো।কম্পিত কন্ঠে বলছে,
—“ভূত ধরছি।হিম দাদার রুমের ছায়ার মতন ভূতটা ধরছি।আইজ ভূতের রক্ষে নাইক্কা!ওঝা ডাইক্যা ভূত বোতলে ভরমু!”
অহির ফোনটা ফ্ল্যাশ জ্বালানোর পর মুখে আটকানো ছিল।সে একহাতে ট্রে ধরে আরেক হাতে ফোন হাতে নিয়ে মুখ মুক্ত করে বলল,
—“কুটি!ছাড়ো তো আমায়।আমি অহি!”
—“অ্যা?”
—“ছাড়ো কুটি!আমাকে বোতলে ভরতে পারবে না।”
কুটি অহিকে ছেড়ে দিল।অহি ঘুরে নিজের মুখে ফোনের আলো ধরে বলল,
—” কুটি,চিনতে পেরেছো আমাকে?আমি কুঁজো ভূত নই!”
কুটি কিছু বললো না।লজ্জিত মুখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।অহি এক কাপ চা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
—“ভূত দেখলে তো!এখন সহজে ঘুম আসবে না।তার চেয়ে চা খাও রুমে গিয়ে।”
কুটি খুশি হয়ে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসলো।অহি বলল,
—“কুটি লাইট জ্বালিয়ে আরাম করে খাও।সাথে অল্প সাউন্ড দিয়ে টিভিও দেখতে পারো।কুঁজো ভূত ফের ডিস্টার্ব করলে তোমার কাপে থেকে তাকেও এক চুমুক চা দিয়ো।”
—“আফা,আপনে যান।আমার অন্ধকারে বইসা চা খাইতে অনেক মজা লাগে।কিন্তু আলিস্যার জন্যি বানান অয় না।”
অহি মুচকি হেসে উপরে উঠে গেল।।সে বেশ বুঝতে পেরেছে কুটি ইচ্ছে কৃত ভাবে তাকে ভূত ভেবে আটকেছিল।তার মূল উদ্দেশ্য ছিল চা খাওয়া।
রোদ্দুরের দরজায় হালকা টোকা দিয়ে অহি ভেতরে ঢুকল।রোদ্দুর ভাইও রুম অন্ধকার করে শুয়ে আছে।তার রুমে বেলকনিতে সবুজ বাতি জ্বালানো থাকে রাতের বেলা।কারণ বেলকনিতে চারটে কোয়েল পাখি আর দুটো লাভ বার্ডস আছে।
বেলকনির আলোর কিছুটা অংশ রুমে এসেছে।অন্ধকার হলেও সব বোঝা যাচ্ছে।অহি তবুও সুইচ টিপে বলল,
—“রোদ্দুর ভাই, আপনার জন্য চা করেছি!”
রোদ্দুর এক হাত কপালে আর এক হাত মাথার নিচে রেখে শুয়ে আছে।তার চোখ বন্ধ।অহির ডাক সে শুনতে পেয়েছে।বন্ধ চোখে বলল,
—“তুই চৌদ্দ মিনিট বত্রিশ সেকেন্ড পর রুমে এসেছিস!অথচ রোদ আপুর রুম থেকে আমার রুমে আসতে সাতচল্লিশ সেকেন্ড লাগে।”
—“আপনার জন্য চা করছিলাম রোদ্দুর ভাই।”
—“ভালো করেছিস।নিজেই চুমুক দিয়ে খেয়ে নে।”
—“আপনি কি রাগ করেছেন?”
রোদ্দুর পাশ ফিরে শুলো।শান্ত কন্ঠে বলল,
—“না!”
অহি চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রাখলো।সে চলে যাবে কি না বুঝতে পারছে না।রুমে আসার পর রোদ্দুর ভাই এক পলকের জন্যও তার দিকে তাকায়নি।চোখই খুলেনি!তাছাড়া অহির মনে চিন্তা হচ্ছে।খালামণি খালু ঘুমিয়ে পড়েছে।যদি কোনোভাবে তাদের মনে সন্দেহ জাগে?শুধু রোদেলা আপু জানে সে রোদ্দুর ভাইয়ের রুমে!
—“রোদ্দুর ভাই, আমি তাহলে যাই।”
রোদ্দুর চোখ খুলল।কিন্তু পাশ ফিরে অহির দিকে তাকালো না।সে আগে থেকে শপথ করে রেখেছে অহির দিকে তাকাবে না।এবার যদি অহির মতো সেও উল্টা পাল্টা কিছু করে ফেলে?
সে দেয়ালের দিকে চেয়ে বলল,
—“ড্রেসিং টেবিলের নিচের ড্রয়ারে দেখ মুভ আছে।পায়ে লাগিয়ে নিবি!আর গিয়ে রোদ আপুর থেকে ব্যথার ট্যাবলেট খেয়ে নিস।না হলে কিন্তু সকালে পা ফেলতে পারবি না।”
—“আমি কি আপনার পায়ে মুভ লাগিয়ে দিবো?”
রোদ্দুর চোখ বন্ধ করলো।সে অহিকে পায়ে মলম লাগিয়ে দেয়ার জন্যই ডেকেছিল।কিন্তু এখন মত চেঞ্জ করে ফেলেছে।এই মেয়ে ছুঁয়ে দিলেই সে কেমন জানি হয়ে যায়!
সে নরম গলায় বললো,
—“অজান্তা!রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।যাওয়ার সময় আমার রুমের দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে যাস!”
অহি ড্রয়ার খুলে একগাদা মেডিসিনের মধ্য থেকে মুভটা বের করলো।এক নজর রোদ্দুরের দিকে তাকালো।মৃদু স্বরে বলল,
—“শুভ রাত্রি রোদ্দুর ভাই।”
তারপর লাইট বন্ধ করে রুম থেকে বের হয়ে গেল।অহি বের হতেই রোদ্দুর এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠলো।টেনে টেনে শ্বাস নিল।মেয়ে টা আশপাশে থাকলেই সে কেম জানি হয়ে যায়।গুছিয়ে রাখা সব কথা অবিন্যস্ত হয়ে যায়।আজ অবধি অজান্তাকে তার একবারও মুখে ভালোবাসি কথাটা বলা হয়নি।ভেবে রেখেছিল আজ ফট করে বলে দিবে।কিন্তু কিছুতেই বলতে পারলো না।
টেবিলে এখনো চায়ের কাপ রয়ে গেছে।রোদ্দুর উঠে গিয়ে কাপটা হাতে নিল।তারপর বেলকনিতে গিয়ে বসলো।আজ রাতে তার ঘুম হবে না।মস্তিষ্কে অজান্তাকে নিয়ে সংসার সাজাতে সাজাতে রাত পেরিয়ে যাবে।
সামনের অন্ধকারের দিকে তাকালো রোদ্দুর।সমস্ত অন্ধকার ছাপিয়ে সে যেন সব জায়গা অজান্তার মুখটা দেখছে।চোখের সামনে শুধু একটা রমণী!
সে মুচকি হাসলো।প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে বাংলায় টাইপ করা শুরু করলো।
“আমার প্রতিটি অস্থির, দম বন্ধ করা সন্ধ্যায় তোমায় পাশে চাই!তোমার উপস্থিতি আমার অস্থিরতা দূর করে দিবে!তোমার একটুখানি পরশে আমার দমবন্ধ ভাব নিমেষে উধাও হয়ে যাবে।
হাজারো ক্লান্তি নিয়ে মন খারাপের বিকেলে অফিস থেকে ফিরেই তোমায় পাশে চাই।তুমি এগিয়ে এসে বিষণ্ণ নয়নে বুকে, বাহুতে হাত বুলিয়ে দিবে।চোখের পলকে আমার সব ক্লান্তি ফুস!
মাঝরাতে হুট করে যদি কোনো দুঃস্বপ্নে ছটফট করি,তুমি মাথাটা বুকে চেপে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে।আমাকে বুঝিয়ে দেবে যে তুমি আমার পাশে আছো!সবসময়!
রাত জেগে কাজ করতে করতে যদি শক্তি হারিয়ে ফেলি তখনো তোমায় পাশে চাই।তোমার উপস্থিতি,ঠোঁটের স্পর্শ আমায় পুনরায় শক্তি যুগিয়ে যাবে।
আমার অসুস্থের দিনগুলোতে তোমায় পাশে চাই। জ্বরে পড়লে তুমি রাত জেগে আমার সেবা করবে,আমার পাশে থাকবে।ক্ষণে ক্ষণে তাপমাত্রা পরিমাপের অজুহাতে কপালে তোমার ছোঁয়া পেতে তোমাকে পাশে চাই।ভীষণ ভাবে চাই!
পরিশেষে, আমার সমস্ত সুখে,দুঃখে,সমঝোতায়, সবকিছুতে তোমাকে পাশে চাই।যা নতুন, যা পুরাতন!সব অনুভূতির সাক্ষী হতে তোমাকে পাশে তাই।মিসেস রোদ্দুর হিম অজান্তাকে চাই!তুমি আমার রোজান্তা (রোদ্দুর + অজান্তা)ফরএভার!!”
এতটুকু লিখে আননোন নাম্বার থেকে সেন্ড করে দিল
এর আগেও এসএমএস পাঠিয়েছিল।সে সামনাসামনি অজান্তাকে তুমি করে বলতে পারে না।এভাবে বলাতেও সে শান্তি পায়।আহা!জীবন এত সুন্দর কেন?
————————–
কলেজ থেকে ফিরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল রোদেলা।বিকেলের দিকে তার ঘুম ভাঙে শাহিনুরের চিৎকারে।
গায়ে থেকে কম্বল না সরিয়েই বলে,
—“কি হয়েছে মা?কেউ হার্ট অ্যাটাক করেছে?”
শাহিনুর সমানে কাঁপছে।তার প্রেশার সত্যি সত্যি হাই হয়ে গেছে।সে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,
—“করেনি!কিন্তু এক্ষুণি করবে রে রোদু!”
রোদেলা ঝট করে চোখ খুলে বলল,
—“কে মা??”
—“আমিহ!আমি!”
—“কি সাংঘাতিক।তোমার আবার কি হলো?”
—“রোদু রে!তোর প্রিন্সিপাল আইছে বাড়িতে!”
—“অহ!”
পরক্ষণেই এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠলো রোদেলা।কম্পমান কন্ঠে বলল,
—“ক-কি বললে মা?ক- কে এসেছে?”
শাহিনুর বিছানায় বসে পড়লো।বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা সে।বসে বলল,
—“সুদর্শন,রাজপুত্তরের মতো একটা ছেলে।সাথে ফুলের মতো একটা পিচ্চি মেয়ে।আর সাথে আধ বুইড়া একটা লোক।এসে তো বলল যে তোর কলেজের প্রিন্সিপাল।তোর সাথে দেখা করতে এসেছে।তবে কোনটা প্রিন্সিপাল জানি না।”
রোদেলার মাথা শূন্য হয়ে যাচ্ছে।সাদিদ স্যার হঠাৎ ফ্যামিলি নিয়ে তার বাসায় কেন?তাও আবার কোনো আগাম খবর না দিয়ে?দুপুরেও তো রোদেলা কলেজে ছিল।তখন তো কিছু বলেনি।
শাহিনুর রোদেলাকে তাড়া দিয়ে বলল,
—“নিচে যাস না ক্যান?যাহ!ভালো মন্দ রান্না করতে হবে
প্রিন্সিপাল মানুষ বলে কথা।কি কি রান্না করা যায় বলতো?”
রোদেলা উত্তর দিল না।শাহিনুর ফিসফিস করে বলল,
—“আমার কি মনে হয় জানিস রোদু?বুইড়া প্রিন্সিপাল তার বড় ছেলেকে সাথে নিয়ে ছোট ছেলের জন্য হয়তো তোকে দেখছে আসছে।একটু সাজগোছ করে নিচে নাম।আমি যাই!রান্না চড়িয়ে দেই!”
বলেই শাহিনুর লজ্জা মিশ্রিত মুখে রুম থেকে বের হয়ে গেল।যেন রোদেলাকে নয়,তাকে দেখতে এসেছে!
দশ মিনিট পর রোদেলা অগোছালো মনটাকে একটু স্থবির করে নিচে নামলো।সিঁড়ির শেষ ধাপ পার হতেই সাদিদ স্যারের চোখে চোখ পড়লো।
(চলবে)
রিচেক করা হয়নি।বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।আজ বোনাস পার্ট দেয়ার চেষ্টা করবো।😍