গল্পের নামঃ #প্রণয়
#পর্বসংখ্যা_০৫
লেখনীতেঃ #ফারিহা_জান্নাত
বাস থেকে নেমে হেঁটেই অফিসে পৌঁছালো পৃথিশা। অফিসের সামনে এসে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো পুরো বিল্ডিংটায়।গেট দিয়ে ঢুকেই সর্বপ্রথম সালাম দিলো গেটে থাকা দারোয়ানকে।পৃথিশাকে সালাম দিতে দেখে দাড়োয়ান হুড়মুড়িয়ে উঠে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকে সালামের উত্তর দিলো।
পৃথিশা হেসে জিজ্ঞেস করলো,”ভালো আছেন চাচা?”
পৃথিশার হাসি দেখে দারোয়ানও একটু সহজ হয়ে বললো,”হে আফা ভালোই আছি।আপনে কি অফিসে নতুন?”
পৃথিশা চারপাশে তাকিয়েবলল,”হে চাচা,আজই জয়েন হলাম।আমিতো এখানকার কিছুই চিনি না,আর সামনে তো দুইটা বিল্ডিংকোন বিল্ডিংয়ে যাবো চাচা আপনি বলতে পারেন?”
দারোয়ান হাসি মুখে বলল,”আপনে আমার সাথে আসেন আফা।”
পৃথিশা চুপচাপ দারোয়ানের পিছু পিছু হেটে যেতে লাগলো।প্রথম খয়েরী রং করা বিল্ডিংটায় ঢুকে দারোয়ান তাকে রিসেপশনে নিয়ে গেলো।নিজেই রিসেপশনে থাকা মেয়েটিকে বললো,”আফায় নতুন,সবকিছু একটু চিনায় দেন।”
পৃথিশাকে সালাম জানিয়ে সে চলে গেল।পৃথিশা এগিয়ে গেলো রিসেপশনে থাকা মেয়েটির দিকে।
বোরকা-নিকাব পড়িহিতা পৃথিশাকে দেখে মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, “কার সাথে দেখাকরতে এসেছেন আপনি?”
পৃথিশা জবাব দিলো,”আমি কারো সাথে দেখা করতে আসিনি।আমি এখানে এসেছি নিজের কাজের জন্য।দুইদিন আগেই আপনারা অনলাইনে ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন অনেকজনের।আর সেখানে মাত্র দুইজন সিলেক্ট হয়েছিল।আমি সেই দুইজনের মধ্যে একজন।”
মেয়েটা পৃথিশাকে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল,”সো হোয়ার ইজ ইউর জয়েনিং লেটার?”
পৃথিশা ব্যাগ থেকে জয়েনিং লেটারটা নিয়ে বলল,”হেয়ার ইট ইজ।”
জয়েনিং লেটার দেখে মেয়েটা পৃথিশাকে একটা কেবিন দেখিয়ে দিয়ে বলল,”ওখানে আমাদের বস আছে।আপনি তার কাছ থেকে আপনার কাজ বুঝে আসুন তিনি সব বলে দেবে।”
পৃথিশা কোন কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। তবে তার কানে মেয়েটির বলা কথাটা ঠিকই গেলো,”বিদেশ থেকে এসে কেউ এরকম ব্যাকডেটেড হয়ে থাকে নাকি!”
মানুষের কথার গুরুত্ব পৃথিশা কোনদিনই দেয়নি,তাই আজকেও মেয়েটিকে এটেনশন দেওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না!
___
দেখিয়ে দেওয়া কেবিনে ঢুকার আগে গ্লাস দিয়ে পৃথিশা দেখতে পেলো এক মাঝবয়সী লোক চেয়ারে বসে ফাইল দেখছে।কেবিনে নক করে রুমে ঢুকলো সে।কেঁশে দৃষ্টি আর্কষণ করার চেষ্টা করলো সে।লোকটি হেসে তাকে বসতে বললো।
তারপর গম্ভীর স্বরে বলল, “আপনি মনে হয় আমাদের নতুন একজন কর্মী।আপনার এডুকেশনাল ডকুমেন্টস গুলো একটু দিন। আর হ্যাঁ,এই মূহুর্তে আপনার ভাইভা নেওয়া হবে।”
পৃথিশা অবাক হয়ে বলল,”কিন্তু আমাকে তো এমন কোন মেসেজ দেওয়া হয়নি!”
লোকটি আবারো গম্ভীর স্বরে বলল, “ধরুন আপনি হুট করে কোন ঝামেলায় পড়েছেন কিংবা কম্পানি ঝামেলায় পড়েছে।এখন আপনাকে ওই মূহুর্তেই বিষয়টি সমাধান করতে হবে এবং তা পড়াশোনা নয় কমনসেন্স দিয়ে।বিপদ কখনো বলে আসেনা,তাই আপনার বুদ্ধি পরিক্ষার জন্যই এটা নেওয়া হচ্ছে।”
পৃথিশা মৃদু স্বরে বলল,”আচ্ছা,আমি প্রস্তুত।”
তিনি পৃথিশাকে প্রথম প্রশ্ন করলেন,”what will you choose,career or partnar?”
পৃথিশা কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিল, “A partner who will motivate me to successful my career.”
লোকটা আবারো প্রশ্ন করলো,”ইগো আর আত্নসম্মানের মধ্যে পার্থক্য কি?”
পৃথিশা উত্তর দিলো,”ইগো হলো অনেকটা অহংকারের মতো।ধরুন আপনি যদি আপনার বাড়ির কাজের লোককে সম্মান করতে না পারেন সেটার কারন হলো আপনার ইগো।আর আত্নসম্মান হলো নিজের প্রতি সম্মান।আপনাকে কেউ গুরুত্ব দেয়না,কিংবা আপনার কথার কদর করেনা।তাই আপনি সেখান থেকে সরে আসলেন, সেটা হলো আপনার আত্মসম্মান।”
লোকটা এবার নড়েচড়ে বসে বলল,”আচ্ছা আপনার জন্য শেষ প্রশ্ন। আমরা সাধারণত দেখি অফিসে প্রথম দিন সবাই মোটামুটি সাজগোজ করে আসে।কিন্তু আপনি সাধারণভাবে সাদা রং পড়ে এসেছেন, এর কারনে আপনি কি বলবেন।”
পৃথিশা নিজের নিকাবটা ভালো করে টেনে নিয়ে বললো,”সাদা রং কিন্তু সাতটা রং নিয়েই তৈরী হয় কিন্তু সাতটা রং দেখা যায় না।তেমনি আমি সাধারণভাবে এসেছি বলে এই মানে নয় যে আমি প্রতিভাহীন।”
লোকটা এবার পৃথিশাকে বলল,”কংগ্রেস আপনি আমাদের কম্পিউটার ইন্জিনিয়ারিং পোস্টে নতুন ইন্জিনিয়ার।আপনার কেবিন ম্যানেজার বলে দেবে।আপনি আসতে পারেন।আর হ্যাঁ আজ আপনার কোন কাজ নেই,আগামীকাল নয়টা থেকে অফিসে আসবেন”
পৃথিশা উত্তেজিত স্বরে ধন্যবাদ বলে বেরিয়ে গেল।
ম্যানেজারের কাছে যেতেই তিনি পৃথিশাকে তার কেবিনে নিয়ে গেল।ছিমছাম গোছের সুন্দর একটা কেবিন।তারসাথে রিফ্রেশমেন্টের জন্য একটা ছোট বারান্দার মতো জায়গাও আছে।
পৃথিশা কেবিনের প্রত্যেকটা জিনিস ঘুরে ঘুরে দেখছে।ছোট থেকে দেখা স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে।অনেক কথা শুনেছিল যখন মেয়ে হয়ে ইন্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়েছে।এটা নাকি ছেলেদের সাবজেক্ট,মেয়েরা বাংলা-ভূগোল নিয়ে পড়বে।সেদিন পৃথিশা বুঝেছিল সমাজ সাদা-কালোর মতো ছেলেদের সাবজেক্ট-মেয়েদের সাবজেক্ট নিয়েও বিভেদ তৈরি করে।
পৃথিশার মনে পড়ে যখন সে কলেজ পাশ করার পর বলেছিল আরও পড়াশোনা করবে তখনই তার ছোট চাচী আর দাদী তাকে কড়াকড়িভাবে নিষেধ করে দিয়েছিল।তাকে বুঝানো হয়েছিল,’মেয়েদের এতো পড়তে নেই,তাদের ধর্ম স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার করা।’
পড়ালেখাটা যখন বন্ধ হবার পথে তখনই তার বাবা তাকে পড়াশোনা করার অনুমতি দেন।পৃথিশা এডমিশনের জন্য পড়তে শুরু করে।বাড়িতে এ নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছিল বটে।তার ছোট চাচীরা আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল,পরে অনেক কিছু বলার পর তারা মেনে নিয়েছে।
কিন্তু পৃথিশার বিদেশে যাওয়ার কথা হতেই তার দাদী তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছিল।তারা একেবারেই নিষেধ করে দিয়েছিল। পরে তো হুট করেই চলে যাওয়া হয়।
🍁
দুপুরে কড়া রোদ থাকায় বাড়ি যাওয়ার পথে রিকশা খুঁজছিলো পৃথিশা।হাতে তার মিষ্টির প্যাকেট,নিজের চাকরি হয়েছে আর বাকিদের মিষ্টি মুখ করাবে না!
একজন বৃদ্ধা মানুষকে রিকশা চালাতে দেখে পৃথিশা অবাক হলো।লোকটার বয়স কম করে ৬০ বা ৭০ তো হবেই।এই বয়সে কিভাবে রিকশা নিয়ে বের হয়েছে।
অনেকটা অবাক হয়ে তার কাছে গেলে তিনি উৎফুল্ল হয়ে জিজ্ঞেস করেন,”আম্মা কই যাইবেন,আসেন নিয়া যাই।”
বৃদ্ধার হাসিমুখ দেখে পৃথিশা কিছু বলতে পারলো না।রিকশায় উঠে পড়লো নিজের গন্তব্যস্হল বলে।যাওয়ার পথে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল লোকের ছেলে-মেয়ে নেই।তার স্ত্রী না খেতে পেরে অসুস্থ হয়ে গেছে। এখন বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমেছেন রিকশা নিয়ে। কিন্তু বৃদ্ধ বলে তার রিকশায় কেউ উঠতে চায় না।যা আয় হয় তা দিয়ে দুজনের পর্যাপ্ত খাবার হয়না।
বাসায় পৌঁছানোর পর পৃথিশা যখন বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন “ভাড়া কত নিবে?”
লোকটা হেসে বলল, “যা দিবেন আম্মা,আজকের দিনটা খেতে পারলেই হলো।”
বিশ টাকার ভেতর নিজের পার্সে থাকা পাঁচশ টাকাটি পেঁচিয়ে বিশ টাকার ভেতর ঢুকিয়ে দিলো পৃথিশা।পৃথিশাও মানুষ,তিনিও মানুষ।তারও আত্নসম্মান আছে।নিজেকে মহান দেখিয়ে অন্য একজন মানুষের সারাজীবনের আত্নসম্মান টুকু নষ্ট করার অধিকার তার নেই
চলবে,,
ভুলক্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। প্রতিক্রিয়া জানাবেন আশা করি।