গল্পের নামঃ #প্রণয়
#পর্বসংখ্যা_০৩
লেখনীতেঃ #ফারিহা_জান্নাত
পৃথিশার ঘোমটা ফেলে তার চুল হাতিয়ে হাতিয়ে দেখতে লাগলেন।কিছুক্ষণ এটা-সেটা দেখা আর জিজ্ঞেস করার পর বলল,
-“মেয়ের গায়ের রং তো শ্যামলা,এমন মেয়েকে কি আমাদের ছেলের পাশে মানাবে নাকি?তবে আপনারা যদি কিছু উপহার-সামগ্রীর ব্যবস্হা করতে পারেন তাহলে আমরা কথা আগাতে পারি!”
পৃথিশার মুখ রাগে-অপমানে মুখ লাল হয়ে গেলো।কড়া কন্ঠে পাত্রে মাকে জিজ্ঞেস করলো,”তা আন্টি আপনার ছেলে কি করে,কোথায় করেছে তা বললেন না?”
পৃথিশার ছোট চাচী সুমিতা বেগমের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালেন।সুমিতা বেগম পৃথিশাকে ইশারায় থামতে বললেন।পৃথিশা তার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো।ছেলেপক্ষের কিছু মহিলা ইতিমধ্যে কানাঘুষা শুরু করেছে।ছোট টেবিল থেকে একটা মিষ্টি মুখে পুড়ে ছেলের মামা বললো,”আমার ভাগ্নি ক্যাডেটের ছাত্র ছিল।তারপর সেখান থেকে ব্যবসা শুরু করেছে।”
পৃথিশা ভ্রু কুঁচকে বলল, কোন ক্যাডেট?ক্যাডেট থেকে এসে ব্যবসা করে!”
ছেলের মা এবার ফট করে বলে উঠল, “ময়মনসিংহ ক্যাডেট কলেজ!”
পৃথিয়া হেসে বলল,”ময়মনসিংহ ক্যাডেট তো মেয়েদের।আপনি আপনার ছেলেকে মেয়েদের কলেজে পড়িয়েছেন।”
ছেলের মামা রাগী চোখে পৃথিশার দিকে তাকিয়ে বললো,”মেয়েমানুষের এত কথা বলতে হয়না।আর ছেলেদের টাকা থাকলেই হয়,এত যোগ্যতা থাকার দরকার কি!”
পৃথিশা মাথায় ওড়না তুলে বললো, “আমার কথায় আসি।মূলত আপনাদের সাথে আমার স্ট্যাটাসটা না ঠিক যায়না।আমি স্কুলে ভালো রেজাল্ট করেছি,বৃত্তি পেয়ে ভালো কলেজে পড়াশোনা করেছি।স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে গিয়ে ইন্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছি।নানানধরনের মানুষের সাথে আমার কথা,দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে।স্কুল-কলেজের টিচারদের সাথে দেখা হলে আমাকে ডাকে।সেই সাথে ঘরের কাজও আমি মোটামুটি ভালোই পারি।সেখানে আপনারাই বলুন আমার মতো বিদেশ ফেরত মেয়ের সাথে কি আপনাদের ছেলের যায়?সে কি আদৌ আমার যোগ্য!”
ছেলের মা ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে বললেন,”মেয়ে মানুষের এতো তেজ থাকা ভালো না!”
পৃথিশা নিজের বাবার দিকে একবার তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,”কিন্তু আমার আছে।আমার অনেক সাহস আছে বলেই আমি আপনাকে কথাগুলো বলছি।নিজের দিকে দেখুন তো একবার,আপনি তো এতটাও ফর্সা না।আমি কি আপনাকে একবারো বলেছি আপনি তো কালো।তাহলেআপনি কোন সাহসেআমার বাড়িতে এসে আমাকে বলছেন আমি কালো,আপনার ছেলের সাথে মানাবে না!”
জোরে শ্বাস নিয়ে পৃথিশা আবারো বলে উঠল, “আর কি যেন বললেন তখন, ও হ্যাঁ মনে পড়েছে।আপনাদের উপহার-সামগ্রী লাগবে বিয়ের জন্য তাই তো?মানে এককথায় যৌতুক বলা যায়।বিয়ের সময় মেয়েদের পরিবার থেকে আপনাকে খাট,ডাইনিং টেবিল,ফ্রিজ নানা জিনিস দেওয়া লাগবে। আমাকে দেখে আপনার পণ্য মনে হয় যে আপনারা এসব যৌতুকের বিনিময়ে আমাকে নিজের বাড়ির বউ করবেন!”
ছেলরের মামা কিছু বলতে নিলে পৃথিশা দরজার দিকে হাত দেখিয়ে বলে,”দরজা ওদিকে,আপনারা আসতে পারেন।আর হ্যাঁ আমাদের বাড়িতে এতকিছু খেয়েছেন তাতে আমরা কিছু মনে করিনি।আমার বিয়ে হলে জামাই নিয়ে আপনাদের বাড়িতে গিয়ে একদিন খেয়ে আজকের খাওয়াটা উসুল করে দেব।”
ছেলে পক্ষরা অপমানে মুখে থমথমে ভাব নিয়ে এক এক করে বেরিয়ে যেতে থাকলো।তারা যেতেই পৃথিশার ছোট চাচী তার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিলেই পৃথিশা হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দেয়।নিজের মা-বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমাদের কিছু বলার আছে?”
পৃথিশার বাবা কিছু বলে না।পৃথিশার মা তার দিকে হতভম্বি ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে।তার মেয়ে শান্ত প্রকৃতির হলেও রেগে গেলে তুলকালাম কান্ড করে ফেলে এটা তিনি জানতেন।কিন্তু আজকে তো অতিরিক্ত রাগ ছিল!
পৃথিশা বড় একটা শ্বাস নিয়ে বলে,”ছোট চাচী আপনাকে বলছি।পাঁচ বছর আগে আমি যখন বিদেশে যাওয়ার জন্য স্কলারশিপ পেয়েছিলাম তখন আপনি দাদীকে মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন মেয়েদের বিদেশে পড়তেনেই।সেই কারনে আমার বিদেশে যাওয়া আটকে গেল।তারপর আমি যখন হুট করে চলে গেলাম তখনও আপনি মাকে চাপ দিয়েঋিলেন আমাকে ফিরে আসার জন্য।তার কারন কি ছিলে?আপনার ছেলে বিদেশে পড়ার সুযোগ পায়নি,তাই আপনি আমাকেও পড়তে দেবেন না।তারপর আপনি কি করলেন?দেশে আসার ছয়মাস পরেও আমাকে চাকরি করে দিলেননা।দাদীর কানে আমার নামে বিষ ঢেলে দিয়েছেন আমি নাকি বাহিরে গিয়ে ছেলের সাথে ফুর্তি করি।তারজন্য আমায় আমায় বাড়িতে আটকে রাখা হলো।এখন আবার কোথা থেকে ছেলে ধরে এনেছেন বিয়ের জন্য।ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, আমার মা-বাবা এখনো বেঁচে আছে।আপনাকে আমার জন্য এত ভাবতে হবেনা।আর সবচেয়ে বড় কথা আমার জন্য ‘আমি’ আছি।খেয়ে-দেয়ে বেঁচে থাকার আমার জন্য আমি-ই যথেষ্ট,আপনাদের এত ভাবতে হবে না।”
কথাগুলো বলেই পৃথিশা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।বসার ঘরের রুমের পরিবেশ স্তব্ধ হয়ে আছে।শান্ত মেয়েটা হুট করে এভাবে মুখের উপর কথা বলে দিবে তা কেও ভাবতে পারেনি।পৃথিশার ছোট চাচী রাগে গজগজ করতে করতে বলে,”বলেছিলাম না বিদেশে গিয়ে পাল্টয়ি যাবে।বেশি ভাব বেড়ে গেছে।”
তারপর পৃথিশার মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”দেখবেন বুড়া হয়ে গেলে আপনাদের বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে আসবে।”
পৃথিশার বাবা বিরক্তি নিয়ে বলল,”সেটা আমরা ভালো বুঝব।”
পৃথিশার বাবা তাদের ঘরে চলে গেল।পৃথিশার ছোট চাচী নিজের মনে বকতে বকতে রুমে চলে যায়।পৃথিশার মা খাবার-দাবারগুলো গুছাতে থাকে।
🍁
দিনের বেলাও ঘরটা অন্ধকার হয়ে আছে।ছোট জানালা দিয়ে পাতলা পর্দাগুলোর ভেদ করে হালকা আলো আসছে।ঘরের ভেতর হাটুতে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে পৃথিশা।ড্রয়ার ভিতর থেকে মারুফের দেওয়া চিঠিটা আর বের করে অসহায় স্বরে বলে উঠল,
-“আমায় কেনো ছেড়ে গেলেন মারুফ ভাই।আপনাকে ছাড়া এখানে থাকলে আমার অনেক কষ্ট হয়,অনেক।আমি চিৎকার করে কাঁদতে চাই,কিন্তু গলা দিয়ে কান্না বের হয় না।আমি শান্তিতে কাঁদতে পারি না মারুফ ভাই।আমার খুব কষ্ট হয় একা একা থাকতে।আমাকর সাথে কেউ এখন আর ঝগড়া করে না।জানেন আমি না পেয়ারা গাছে উঠা বন্ধ করে দিয়েছি।আমি তো গাছে উঠতে পারি কিন্তু নামতে পারি না,আপনি তো নেই তাহলে এখন আমাকে কে নামিয়ে দেবে?আপনি আসলে আবার উঠব।জানেন অনেকদিন ধরে আমি আপনার সেই বরফ চা বানাই না।আপনি আসলে আবার বানাবো।
মারুফ ভাই জানেন,আমি শাড়ি পড়া বন্ধ করে দিয়েছি।আপনি তো নেই,তাহলে কে আমাকে শাড়ি পড়িহিতা দেখে প্রশংসা করবে!অপেক্ষা অনেক কষ্টের মারুফ ভাই,অনেক কষ্টের!কিন্তু তাও আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।মানুষটা যদি সঠিক হয়,তাহলে অপেক্ষাটা তো স্বার্থক!
চলবে,