#গল্পঃবর্ষণ_মুখর_দিন
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৯
নিয়াজের খুব অভিমান হলো জারার উপর।মেয়েটা একটাবার খোঁজ নিলোনা আমি কেমন আছি?হসপিটালে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ওর দায়িত্ব শেষ?একবার অন্তত ফোন করতে পারতো।যতবার নিজেকে বুঝানোর চেষ্টা করছে অভিমান গুলো যেন মাথাচাড়া দিয়ে পাহাড়সম হচ্ছে।হুট করে মনে পড়লো জারার কাছে আমার নাম্বার আছেতো?সেদিনতো কল দিলাম এই মেয়ে মনে হয়না আমাকে চিনতে পেরেছে।
নিয়াজ নিজেই জারার নাম্বারে ডায়াল করে।ওমা বারবার বিজি শোনাচ্ছে।নিয়াজের মেজাজটাই বিগড়ে গেলো।এই মেয়ে এতক্ষণ ধরে কার সাথে কথা বলছে?
যতবার কল দিচ্ছে ততবারই বিজি দেখাচ্ছে।আচ্ছা নাম্বারটা কোনোভাবে ব্লক করে রাখেনিতো?নিয়াজ অন্য নাম্বার থেকে কল করতেই রিং হয়।নিয়াজ বুঝতে পারে জারা নাম্বারটা ব্লক করে রেখেছে।
জারা এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিয়াজের কথাই ভাবছিলো।কার কাছ থেকে মানুষটার খোঁজ নিবে?জ্বর কি খুব বেশি?বেশি না হলে নিশ্চয়ই অফিসে আসতো।খালার কাছ থেকে নিয়াজের বাড়ির ফোন নাম্বার নিতেও লজ্জা লাগছে।ব্যাপারটা কেমন দেখায়?জারার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে ফোনের তীব্র আওয়াজে।স্ক্রিনে চোখ রেখে জারা ভ্রু কুচকায়।এটা কার নাম্বার?সেদিনও একটা অপরিচিত লোকের নাম্বার ব্লক করেছে।জারা ভাবতে ভাবতেই কল কেটে গেলো।দ্বিতীয় বার কল আসতেই জারা রিসিভ করে সালাম দেয়।
ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতে দেখে নিয়াজ চাপা স্বরে ধমক দিয়ে বলে,ফোন তুলছোনা কেনো?
জারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।চোখ ছোট করে ঠোঁট খানিক বেঁকিয়ে বলল,কে ভাই আপনি?
নিয়াজ তেতে উঠে বলল,হোয়াট ভাই?
জারা কপালে ভাঁজ ফেলার চেষ্টা করে বলল,তো কি চাচা-জেঠা বলতাম?চোখ দুটো হালকা বড় করে বলল,নো নো নো আপনাকে আফা কিংবা খালা বলা উচিত ছিলো আমার রাইট?
নিয়াজ দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল,স্টপ!আমি না তোমার ভাই না চাচা-জেঠা আর না আফা-খালা।আমি নিয়াজ।
হ্যাঁ তো আমি কি কর….বলতে গিয়ে থেমে যায় জারা।কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিনমিন করে বলল,সরি!এই নাম্বারটা কার?
নিয়াজ বিরক্তি সূচক শব্দ করে বলল,তোমাকে নিয়াজ কল দিয়েছে তাহলে নাম্বারটা ও নিশ্চয়ই নিয়াজের।
জারা জিবে কামড় দিয়ে আমতা আমতা করে বলল,কেমন আছেন?
নিয়াজ একটু অভিমান করেই বলল,সেটা কি তোমার জানার দরকার আছে?
জারা চুপ করে রইলো কিছুই বলল না।
নিয়াজ রাগ দেখিয়ে বলল,মানলাম তোমার কাছে নাম্বার নেই বাসায়তো আসতে পারতে।
জারা চোখ বড় বড় করে বলল,বিয়ের আগেই শশুর বাড়ী?
দিদার রোহানকে নিয়ে তার গ্রামে ফিরে এসেছে।তানিশাকে সব কিছুই জানিয়ে দিয়েছে দিদার।রোহানের পরিবারের সবাই জানে রোহান এক্সিডেন্ট করে হাত ভেঙেছে।রোহানের ভাবি মেয়েটা এই ভালো তো এই খারাপ।মানে যখন যেমন ইচ্ছা হবে তানিশার সাথে তেমন ব্যবহার করে।এখন তানিশাও ছাড় দেয়না ফাঁকে ফাঁকে খোঁচা মেরে কথা বলে ফেলে রোহানের ভাবির সাথে।
তানিশা রোহানের সব রকম খেয়াল রাখছে।কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কথা বলছেনা।রোহান দিন দিন তানিশাকে দেখে অবাক হয়।মেয়েটা কিভাবে এত অবহেলা টর্চার সহ্য করে আবার রোহানের সেবা করছে।
দেখতে দেখতে নিয়াজ আর জারার বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো।আর মাত্র দুদিন অপেক্ষা।তারপরই নিয়াজের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে জারাকে নববধূ হিসেবে নিজের ঘরে তুলবে।জারার খালা,খালু,তাসিন,তুহিন,জারা সবাই মিলে বাস কাউন্টারে বসে আছে।বাস আসলেই সবাই জারার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিবে।জারার আরো আগেই গ্রামে যাওয়ার কথা ছিলো।কিন্তু নিয়াজ ছুটি দেয়নি।জারা যত তাড়াতাড়ি চলে যাবে নিয়াজের প্রেয়সীকে দেখার আকাঙ্খা আরো তীব্র হবে।
বাসে যে যার সিটে বসে পড়েছে।তুহিন জারার সাথেই বসেছে।তাসিন অন্য একটা ছেলের সাথে বসেছে।জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ঢাকা শহরটাকে পরোখ করে চলেছে জারা।আজ এই শহর ছেড়ে যাচ্ছে দুদিন পর পার্মানেন্টলি এই শহরে চলে আসবে।তখন বাবার বাড়ীর জন্য অতিথি হয়ে যাবে।
নিয়াজের পুরো বাড়ি এখন থেকেই লাইটিং করা হচ্ছে।বাড়ির কানায় কানায় ফুলের সমারোহ।অফিসের সব স্টাফকে ও ছুটি দিয়ে দিয়েছে।নিয়াজের বাবা সব কিছুর তদারকি করছেন।একমাত্র ছেলের বিয়েতে উনি কোনো কমতি রাখতে চান না।
এদিকে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির আঙ্গিনায় পা রাখতেই সবাই এসে জারাকে ঘিরে ধরেছে।কোনোরকম সবাইকে পাশ কাটিয়ে জারা মাকে এসে ঝাপটে ধরে।জারার মা ও মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দেন।পুরো বাড়ির চেহারাটাই পালটে গেছে।জারা ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই কেউ ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।জারা পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে কায়াকে দেখে নিজেও কায়াকে জড়িয়ে ধরলো।
কায়া মিষ্টি হেসে বলল,কেমন আছিস আপু?
জারা চোখ দুটো কিঞ্চিৎ ছোট করে বলল,তোর বিয়ের খবর শুনে আপাতত ভালো আছি।
কায়া কোমরে হাত দিয়ে বলল,বারে তোমার বুঝি বিয়ে না খালি আমার একার বিয়ে?
কায়ার কথায় জারা ফিক করে হেসে দেয়।সাথে কায়া ও হেসে দেয়।
হলুদের সব আয়োজন জাঁকজমকভাবে করা হয়েছে।কায়া আর জারার জন্য আলাদা আলাদা হলুদ শাড়ী শশুর বাড়ী থেকে এসেছে।কিন্তু মুহিত হাসান চাইছেন উনাদের মেয়ে বাবার বাড়ি থেকে দেওয়া শাড়ীটাই হলুদে পড়ুক।পার্লার থেকে মেয়ে এসে জারা আর কায়াকে সাজিয়ে দিয়ে গেলো।বিয়েতে জারার দুটো বান্ধবী এসেছে।তানিশা জারার স্কুল লাইফের বান্ধবী ছিলো।জারা ঢাকায় চলে যাওয়ার পরেও ওদের মধ্যে মাঝেমাঝে যোগাযোগ হতো।তুহিনকে মিমি ক্রমাগত কল,মেসেজ দিয়ে জ্বালিয়ে মারছে।তুহিন মনে মনে মিমিকে শ’খানেক গালি দিলো সাথে নিজেকেও গালি দিলো কেনো এই মেয়ের সাথে প্রেম করতে গেলো।
রাহি বিয়ের দিন রাজের সাথেই আসবে একেবারে বরযাত্রী হয়ে।
জারা আর কায়াকে সাজিয়ে একটা রুমে বসিয়ে দিয়ে গেলো।দুজনে কথা বলছে।
নিয়াজ হলুদের জন্য একেবারে তৈরি হয়ে হোয়াটস অ্যাপে জারাকে ভিডিও কল দিলো।কথার মাঝেই জারার ফোন বেজে উঠতেই কায়া ফোন হাতে নিয়ে দেখলো স্ক্রিনে স্যার লিখা।কায়া ভ্রু কুচকে বলল,এই স্যারটা আবার কেরে?
জারা ছো মেরে কায়ার হাত থেকে ফোন নিয়ে বলল,কেউ না।
কায়া ভ্রু নাচিয়ে বলল,কেউ না?নাকি আমার জিজু কোনটা?
জারা চোখ পাকিয়ে বলল,তুই থামবি?
ওদের কথার মাঝেই কল কেটে গেলো।দ্বিতীয় বার কল আসতেই কায়া ছো মেরে ফোন নিয়ে রিসিভ করে।
কল রিসিভ হতেই নিয়াজ হাসি মুখে স্ক্রিনে তাকাতেই সব হাসি গায়েব হয়ে গিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো।
কায়া হাত নাড়িয়ে বলল,হাই জিজু।বউকে দেখতে কল দিয়েছেন?কিন্তু এখনতো দেখা যাবে না।
জারা হাত বাড়িয়ে ফোনটা নেওয়ার চেষ্টা করছে কায়া বারবার হাত সরিয়ে নিচ্ছে।
নিয়াজ হাসি মুখে বলল,শালিকা নিজের বরের সাথে গিয়ে প্রেম করো আর বোনকে ও তার বরের সাথে প্রেম করতে দাও।
নিয়াজের কথা শুনে জারা লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো।কায়া মুখ বেঁকিয়ে বলল,জিজু যে এতটা বউ পাগল তা তো জানতাম না।
নিয়াজ দাঁত কেলিয়ে বলল,বরের কাজ বউয়ের প্রেমে পাগল হওয়া।কায়া ক্যামেরা ঘুরিয়ে জারার দিকে ধরলো।নিয়াজকে বলল,এই নিন বউকে দেখে নিন কিন্তু কথা বলা যাবে না।নিয়াজ ফোনের স্ক্রিনে জারাকে দেখতে দেখতে বলল,আমার বউকে ফোনটা দিয়ে এই ঘর থেকে বিদায় হও।
কায়া ভেংচি কেটে বলল,দেবো না ফোন আপনার বউকে হুহ।জারা খাটের উপর ধপ করে বসে পড়েছে।কায়া মেয়েটা চিকনি কিন্তু শক্তি বেশি।এর সাথে যুদ্ধ করে জারার পক্ষে মোবাইল নেওয়া সম্ভব না।
পাঁচ-ছয় জন মেয়ে এসে জারা আর কায়াকে ছাদে স্টেজে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছে।কায়া নিয়াজকে বায় জানিয়ে ফোন রেখে জারার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো।হলুদের অনুষ্ঠান খুব সুন্দরভাবেই কেটেছে।কায়া সবার সাথে তাল মিলিয়ে নেচেছে।জারাকে অনেক জোরাজোরি করেও কেউ নাচাতে পারলোনা।জারা স্টেজে বসে সবার আনন্দ দেখে চলেছে।
রাতে শাড়ী পাল্টে মেকাপ তুলে একটা সুতি জামা পড়ে জারা শুয়ে পড়েছে।কায়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওর হবু বরের সাথে কথা বলছে।ক্লান্ত চোখ দুটো বুজে আসতেই জারার ফোন বেজে ওঠে।ফোনটা সুইচ অফ করে জারা ঘুমিয়ে পড়েছে।বাইরে সোরগোল শুনে জারার ঘুম ভাঙে।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে উঠে গেছে।সকাল দশটা বাজে আর ও কিনা এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলো।পাশে তাকিয়ে দেখলো কায়া ও পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।কায়াকে ডেকে দিয়ে জারা ওয়াশরুমে চলে যায়।
বিয়ের কনে রূপে লাল লেহেঙ্গাতে নিজেকে মুড়িয়ে নিয়েছে জারা।পার্লারের মেয়েরা বাকি সাজ কমপ্লিট করে দিয়েছে।নিজেকে আয়নায় দেখে জারা নিজেকেই যেনো চিনতে পারছেনা।এখন মনে হচ্ছে আয়নায় একটা চোখ ধাধানো সুন্দরী দাঁড়িয়ে আছে।এই সুন্দরীর সাথে জারার কোনো মিল নেই।
বরযাত্রী অনেক আগেই এসে পড়েছে।নিয়ম মতে জারা আর নিয়াজের বিয়েটা আগে সম্পন্ন হলো এরপর কায়ার বিয়ে সম্পন্ন হলো।
বিদায় বেলায় সবার চোখে পানি।একসাথে বাড়ির দুই মেয়েকে বিদায় দিতে হচ্ছে।জারা বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে চলেছে।মুহিত হাসানের চোখে ও পানি।মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।জারার মা ও জারাকে ধরে কেঁদে দিলেন।তুহিন জারাকে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিলো।কত দুষ্টুমি করেছে দুজনে।এখন সব শেষ করে জারা পরের ঘরে যাচ্ছে।
কাঁদতে কাঁদতে জারার লেহেঙ্গার ওড়না দিয়ে তুহিন নাক মুছতে গেলেই নিয়াজ তুহিনের হাতের মুঠোয় টিস্যু পুড়ে দিয়ে বলে সালাবাবু টিস্যু দিয়ে নাক মুছো আমার বউয়ের ওড়না দিয়ে নয়।কাঁদার মাঝেই তুহিন ফিক করে হেসে দিলো।কায়া আর জারাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে আছে।তাসিন দূরে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতেছে।রাহি পেছন থেকে সেভেন আপের বোতল দিয়ে তাসিনের মাথায় বাড়ি মারলো।তাসিন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রাহি ভ্রু নাচিয়ে বলল,জারার বিয়ে তাই ও কাঁদতেছে।তোমার কি বিয়ে লাগছে যে তুমিও মেয়েদের মতো কাঁদতেছো।
রাহির কথা শুনে তাসিন ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো।রাহি হেসে কুটিকুটি।এই মানুষটা নাকি ওর বর হবে।
#চলবে…….।