#গল্পঃবর্ষণ_মুখর_দিন
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৩

তানিশা রান্নাঘরে জায়ের সাথে সকালের নাস্তা তৈরীতে সাহায্য করছে।
মা আমার সাদা শার্টটা পাচ্ছিনা একটু খুজে দিয়ে যাও।রোহানের ভাবি মুখ বাঁকিয়ে বললেন,যাও যাও আর কাজে হাত লাগাতে হবেনা।রান্নাঘরে আসতে না আসতেই তোমার ডাক পড়েছে।
তানিশা মুখটা ছোট করে বলল,উনিতো মাকে ডেকেছেন।
বিয়ের পর মাকে কোনো কিছুর জন্য ছেলেরা ডাকে নাকি?মায়ের উপর দিয়ে তোমাকেই ডাকছে যাও যাও আর দাঁড়িয়ে থেকো না।
রোহানের ভাবির কথাগুলো কেন জানিনা তানিশার কাছে ভালো লাগলো না তাই রান্নাঘর থেকে সোজা রুমে চলে আসে।
তানিশা চলে যেতেই রোহানের ভাবি ঘাঁড় বাকা করে তানিশাকে চলে যেতে দেখে চোখ বড় বড় করে বলল কি মেয়েরে বাবা রান্নাঘরে কাজ ফেলে ঢ্যাংঢ্যাং করে চলে গেলো।

ঘরে গিয়ে রোহানকে কি লাগবে জিজ্ঞেস করতেই রোহান তেড়ে এসে তানিশার হাত মুচড়ে ধরে বলল,তোকে কে ডেকেছে এখানে?তুই বুঝিসনা আমি তোকে সহ্য করতে পারিনা।আমার সাধ্য থাকলে তোকে এই ঘর কেনো এই বাড়ি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতাম।
ব্যাথায় তানিশার চোখে পানি চিকচিক করছে।অস্ফুট স্বরে বলল,আমার লাগছে ছাড়ুন! রোহান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,লাগুক!লাগার জন্যইতো ধরেছি।তোর জন্য আমি জারাকে বিয়ে করতে পারিনি।কেনো এত গন্ডগোল করলি?আমিতো বলে দিয়েছি বাচ্চাটা এবোরশন করিয়ে নিবি আর তোর কত টাকা লাগবে আমি তোকে দিয়ে দেবো।কিন্তু তুই কি করলি?এখন আমার কাছে থাকবি আর প্রতিনিয়ত আমার আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাঁই হয়ে যাবি।তানিশার হাত ছেড়ে ওকে ধাক্কা দিতেই তানিশা খাটের এক কোনে গিয়ে পড়ে।হাত দিয়ে খাটের কোন চেপে ধরায় পেটে আঘাত লাগেনি।মুখ চেপে ধরে কেঁদে চলেছে তানিশা।রোহান দরজা খুলে গটগট পায়ে নিচে নেমে যায়।

রাস্তায় ফুচকা দেখে রিকশাওয়ালাকে থামিয়ে জারা ফুচকা খেয়ে তারপর আবার রিকশায় উঠেছে।রিকশাওয়ালাকে বলে দিয়েছে মামা ধীরে সুস্থে গাড়ি চালাবেন।
রিকশা এসে তাসিনের দেওয়া ঠিকানায় থেমেছে।জারা রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে সামনের উঁচু দালানের দিকে তাকিয়ে ভেতরে গেলো।ইন্টারভিউ দশটায় শুরু হয়েছে আর এখন এগারোটা বাজে।জারা ভেতরে ঢুকে ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখছে।একজন ফর্মাল ড্রেস পড়া লোক এসে জারাকে জিজ্ঞেস করলো আপনি কি এখানে ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন?
জারা নিজেকে ঠিক করে অত্যন্ত ভদ্রভাবে উত্তর দিলো জ্বি আমি ইন্টারভিউ দিতেই এখানে এসেছি।
লোকটি বলল,ইন্টারভিউ দশটায় ছিলো আর আপনি এখন এসেছেন?
আসলে আমি ভেবেছিলাম সবাই ইন্টারভিউ দিতে দিতে আমি সময়মতো চলে আসতে পারবো।
আমরা সীমিত আকারে লোক নিচ্ছি আমাদের কম্পানিতে।ইন্টারভিউ ছিলো একঘন্টা।আর আপনি সেই একঘন্টা পরেই এসেছেন?
জারা চোখ পিটপিট করে বলল,তাহলে কি এখন চলে যেতে বলছেন?

আচ্ছা ঠিক আছে,আপনি ওপাশে গিয়ে বসুন।সেখানে আপনার মতো আরো তিনজন আছেন।স্যার যদি বলে তো আপনাদের ইন্টারভিউ নেওয়া হবে।নয়তো আপনাদেরকে বাসায় ফেরত যেতে হবে।
লোকটি তার বসের কাছে গিয়ে বলল,স্যার আরো চারজন ক্যান্ডিডেট আছে যারা দেরি করে এসেছে।এখন তাদেরকে কি চলে যেতে বলবো?
লোকটির বস কিছুক্ষণ ভেবে বলল,উমম এক এক করে পাঠিয়ে দিন।আমাদের আরো একজন অ্যামপ্লয়ি লাগবে।যদি এদের মধ্যে সেরকম দক্ষ কাউকে পাই তো নিয়ে নেবো।

প্রথম তিনজনের ইন্টারভিউ শেষ এখন জারার পালা।জীবনে প্রথম কোথাও ইন্টারভিউ দিচ্ছে।বুকে ফুঁ দিয়ে সাহস সঞ্চয় করে ভেতরে গেলো।
সামনে বসা লোকগুলোকে সালাম দিয়ে ভালো করে তাকাতেই জারা চমকে উঠে।এই লোক এখানে কি করছে?আচ্ছা এটা কি এই লোকের অফিস?তাহলে আমি চাকরি করবো না হুহ।
জারাকে ক্যান্ডিডেট হিসেবে দেখে নিয়াজের তেমন একটা ভাবাবেগ হলো না।সে তার নিজের জায়গায় স্থির।নিয়াজের পাশে বসে থাকা ব্যক্তি হাতে ইশারায় জারাকে বসতে বলে।জারা নিজের সার্টিফিকেট গুলো এগিয়ে দিলে নিয়াজ সেগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়।জারাকে কিছু প্রশ্ন করারপর বেশ গুছিয়েই সে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়।

নিয়াজের পাশের জন বলল,আপনি ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসুন।জারা বেরিয়ে যেতেই নিয়াজ আর তাদের বস ডিসকাস করার পর যেখানে একজন নেওয়ার কথা সেখানে দুজনকে সিলেক্ট করে।এর মধ্যে জারা একজন।
অফিসের একজন কর্মকর্তা এসে জারা আর রাফি নামের ছেলেটাকে কংগ্রাচুলেশনস জানিয়ে বলল,আপনারা আমাদের কম্পানির জন্য সিলেক্টেড।
জারাতো খুশিতে লাফিয়ে ওঠে।ও ভাবে নি প্রথমবার ইন্টারভিউ দিয়ে এভাবে টিকে যাবে।লোকটি বলল,কাল দুপুর দুইটা থেকে আপনারা জয়েন্ট করবেন।

জারা বাসায় এসে খালাকে খবরটা দিতেই উনি খুশি হয়ে বলেন,তুই গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয় আমি তোর জন্য নুডলস বানিয়ে আনছি।ঘরে গিয়ে বাবার নাম্বারে কল করে বাবাকেও চাকরির খবরটা জানিয়ে দিলো।বাবার সাথে কথা বলে মায়ের সাথেও কিছুক্ষণ কথা বলল জারা।

বিকালে বাসায় পাশের বাসার আন্টি এসে খালার সাথে কথা বলছে।জারা গিয়ে টিভি চালু করে বসলো।
পাশের বাসার মহিলা বললেন,জারার না বিয়া ছিলো সেজন্য আপনারা সবাই গ্রামে গেছেন।এখন দেখি জারা ও এই বাসায়।ছেলেরা কি বিয়ে ভেঙে দিছে নাকি?
রাজিয়া বেগম বললেন,আমরাই বিয়ে ভেঙে দিয়েছি ছেলে ভালো না।
ওহ আচ্ছা আমি তো আরো ভাবলাম ছেলেরাই বিয়ে ভেঙে দিয়েছে পাশের বাসার আন্টি মুখ বাঁকিয়ে বললেন।
উনার সব কথায় জারার কানে আসছে কিন্তু কিছুই বলছে না জারা।পাশের বাসার আন্টিদের কাজই হলো এর কথা ওর কাছে ওর কথা এর কাছে বলা।

পরেরদিন তুহিন আর জারা একসাথে ভার্সিটির উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে।তুহিন জারার একবছরের জুনিয়র।যারা অনার্স ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট।ভার্সিটিতে দুটো ক্লাস করে জারা বাসায় চলে আসে।গোসল সেরে দুপুরের খাবার খেয়ে একেবারে অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়ে।আজকে আর দেরি করা যাবেনা।বাসার সামনে থেকে রিকশা ডেকে অফিসে চলে যায়।
অফিসের নতুন পুরাতন সবাই সবার সাথে পরিচিত হচ্ছে।সবাইকেই জারার কাছে ভালো লাগলো একজন ছাড়া।মেয়েটা অফিসের সব ছেলেদের গায়ে পড়ার চেষ্টা করে।আগ থেকেই এই অফিসে কাজ করে।মুখে একগাদা মেকাপ করে অফিসে এসেছে যেন এখনে কোনো ফাংশন চলছে।
জারা নিজের কেবিনে বসে সব কিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে।এশা মেয়েটা এসে বলল,হাই!আ’ম এশা।জারা মুচকি হেসে বলল,আমি জারা হাসান।
ওয়াও তোমার ওড়নাটা জোস।কোথা থেকে কিনেছো।
এটা আমার বাবা কিনেছে।মনে মনে বলে,ওড়নার কথা জিজ্ঞেস করে তুমি কি করবে তুমিতো ওড়নাই পড়ো না।পিয়ন এসে বলল,ম্যাডাম আপনাকে বড় স্যার উনার কেবিনে ডাকে।এশাকে পাশ কাটিয়ে যারা বসের কেবিনের সামনে গিয়ে নক করে।ভেতর থেকে অনুমতি পেয়ে জারা কেবিনে প্রবেশ করে।

বস বললেন,সবাইকে তাদের কাজ বুঝিয়ে দিয়েছি।আপনি মিস্টার নিয়াজ এহসানের ডিপার্টমেন্টে কাজ করবেন।উনি আপনাকে কাজ বুঝিয়ে দেবে।আমি রহিমকে বলে দিচ্ছি আপনাকে মিস্টার নিয়াজের কেবিনে নিয়ে যেতে।
জারা বলল,স্যার আপনি আমার বাবার সমান তাই আমাকে আপনি করে না বলে তুমি বলতে পারেন।বস মুচকি হেসে বলল,ঠিক আছে এখন থেকে তুমি বলবো।
রহিমকে ডেকে জারাকে নিয়াজের কেবিনে পাঠিয়ে দিলো।

মে আই কাম ইন স্যার!দরজা দিয়ে হালকা মুখ বাড়িয়ে বলল জারা।
নিয়াজ ল্যাপটপে মুখ রেখেই বলল,কাম।
জারাকে কিছু ফাইল এগিয়ে দিয়ে বলল,আপনার আজকের কাজ ফাইল গুলো চেইক করা।অফিস টাইম শেষ হওয়ার আগে ফাইলগুলো দিয়ে যাবেন।জারা চোখ বড় বড় করে ফাইলগুলো গুনছে।প্রথমদিনেই এত কাজ?
নিয়াজ শক্ত কন্ঠে বলল,এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে কাজে লেগে পড়ুন।গো!
একগাদা ফাইল হাতে নিয়ে নিজের কেবিনে এসে ধপ করে বসে পড়ে জারা।ছটপট কাজে লেগে পড়ে।রহিম এসে এক কাপ কফি দিয়ে য়ায়।কাজের ফাঁকে ফাঁকে কফিতে চুমুক দিচ্ছে।নিয়াজ এসে হেঁটে হেঁটে সবার কাজ দেখছে।ও আসতেই সবাই দাঁড়িয়ে যায়।জারার সেদিকে খেয়াল নেই।সে একমনে ফাইল দেখে চলেছে।এশাতো নিয়াজকে দেখেই বিভিন্নরকম অঙ্গভঙ্গি শুরু করে দিয়েছে।
জারার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে নিয়াজ।পাশ থেকে একজন ফিসফিস করে জারাকে বলছে বস এসেছে দাঁড়াও কিন্তু জারা শুনতে পায়নি।আরেক পাক সবার কেবিনের সামনে ঘুরে নিয়াজ নিজের কেবিনে চলে যায়।
পাশের কেবিনের মেয়েটা জারাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,বস এসেছিলো তোমাকে এতবার ডাকলাম কিন্তু তোমার মনযোগ কাজে ছিলো।

জারা অবাক হয়ে বলে,বস কখন এসেছে?
মেয়েটা বলল,মাত্রই উনি এখান থেকে গেছেন।জারা বলল,আসলে আমি খেয়াল করিনি।আপনার নামটা যেন কি?
মেয়েটা হেসে দিয়ে বলল,ভুলে গেলে?আমার নাম রিহা।আমি তোমাকে তুমি করে বলছি আর তুমি আপনি করে বলছো?
জারা হেসে বলল,আচ্ছা তুমি করে বলবো।এখন একটু কাজ করি অনেকগুলো ফাইল চেইক করতে হবে।
রিহা বলল হ্যাঁ আমার ও কাজ আছে।

অফিস শেষ হয়েছে সন্ধ্যা সাতটায়।সবাই বেরিয়ে পড়েছে।জারা ফাইলগুলো নিয়াজের কাছে জমা দিয়ে অফিস থেকে বের হয়।বাইরে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কোনো রিকশার হদিস পাচ্ছেনা।নিয়াজ বাসায় যাওয়ার পথে জারাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাথা বের করে বলল,বাসায় না গিয়ে এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

জারা একবার নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,রিকশা পাচ্ছিনা।
নিয়াজ একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,ড্রপ করে দিচ্ছি আসুন।
জারা সৌজন্যের হাসি দিয়ে বলল,আমি চলে যেতে পারবো।
নিয়াজ আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো।জারা বলল,কি লোকরে বাবা একবার বলেছি আমি যেতে পারবো আর ওই লোক দ্বিতীয়বার গাড়িতে ওঠার কথা বললো না?
আরো কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর একটা রিকশা পেয়ে জারা বাসায় চলে আসে।
#চলবে…..।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here