“দেখুন,আপনাকে যে কারণে এখানে ডেকেছি।একজনের সাথে আমার দীর্ঘ তিনবছর সম্পর্ক চলতেছে।প্রচন্ড ভালোবাসি ওকে আমি।ওকে ছাড়া আমি অন্যকাউকে বিয়ে করতে পারবো না।আর অন্যকাউকে বিয়ে করলেও সে কখনোই আমার সাথে থেকে সুখী হবে না।আমার অজ্ঞাতে আপনার সাথে আমার বাবা বিয়েটা ঠিক করে ফেলেছে।যেটা আমি গত পরসু জেনেছি।পড়াশুনা শেষ করে সবে ইংল্যান্ড থেকে ফিরেছি।ভেবেছি চাকরিতে জয়েন করে তারপর আমার এবং সুর্ভীর সম্পর্কের কথা আমার পরিবারকে জানাবো।কিন্তু এরইমাঝে এরকম একটা কান্ড ঘটবে পরিবার আমার মতামত নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করে নি।”

বলেই সামনে বসা লোকটি আমার দিকে তাকায়!লোকটির নাম আবির। পুরো নাম আবির আহমেদ।বাবার থেকে নামটি শুনেছি।কারণ এই লোকটির সাথেই বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছিলো।বিয়েতে আমি রাজি ছিলাম না।ভাবছি আর একটা বছর অপেক্ষা করে পড়াশুনার পাঠটা চুকিয়ে তারপর বিয়ের পীড়িতে বসবো।কিন্তু বাবা মানলো না!আত্মহত্যার দোহাই দেখিয়ে এক প্রকারে জোরজবরদস্তি করে বাবা আমাকে বিয়েতে রাজি করালো।বিয়ের ডেটও ফাইনাল।আগামী কালকে বিয়ে।মানে আজকের রাতটা পার হলেই কালকের সূর্যের শুভ্রতার অপেক্ষা মাত্র!আর এখন উনি হঠাৎ এসব কি বলছেন!ভাবনার মাঝে উনি আবারো বলে উঠেন,

“আপনি ই একমাত্র পারবেন আমাকে বাঁচাতে,প্লিজ!”

আমি এবার লোকটির দিকে গাঢ় নয়নে তাকাই।নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে শান্ত স্বরে বলে উঠি,
“আমাকে এখন কি করতে হবে?!!”
“আপনি বাসায় যেয়ে বলবেন জাস্ট যে আপনি বিয়েটা করতে চাচ্ছেন না!দ্যাট’স ইট!”

একদন্ড চুপ থেকে মুখে একটা বৈচিত্র্যময় হাসি টেনে বলি,
“যতটা সহজ ভাবছেন। ততটা সহজ নয় ব্যাপারটা!এইটা বললে বাবা মানবে না।রিজন লাগবে।”
“তাহলে বলবেন…..!আচ্ছা?আপনার তো এখনো পড়াশুনা শেষ হয়নি,না?”
“জ্বী।”
“তাহলে বলবেন যে পড়াশানাটাা শেষ তারপর বিয়ে করবেন।এখন বিয়ের জন্যে প্রস্তুত নন।'”
“কমন রিজন!বলেছি আগে অনেকবার।লাভ হয়নি!”
“তাহলে আপনার বয়ফ্রেন্ড আছে?”
“সেটা হলে ত আরো ভালো হত!”

লোকটি আমার কথার আভাসে বুঝলো আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই!লোকটি মুখে ব্যর্থ ভাব ফুঁটিয়ে চুপ করে রইলো কিছুক্ষ সে।! তারপর মুখটা কেমন ইনোসেন্ট করে এবার বলে উঠলো,

“প্লিজ আপু?প্লিজ?দেখুন?কি করা যায়!আমার না মাথায় কিছুই আসতেছে না এই মুহূর্তে! আমিও পারতাম বাসায় একটা রিজন দেখিয়ে বিয়েটা ভেঙ্গে ফেলতে ।কিন্তু আমার বাবা নাছোড়বান্দা টাইপ লোক। মরেও যাবো যদি বলি,তাতেও মানবেন না।বিয়েটা করতেই হবে আমাকে এরকম।তাই আপনাকে এতোটা রিকুয়েষ্ট করতেছি আপনার থেকে বিয়েটা বাঁধ দিতে।”

আমার সুপ্ত মস্তিষ্কটা “আপু” শব্দটিতে ভীষণ
আত্মসম্মানে লাগলো।জ্বলেপুড়ে উঠলো ভেতরটা!ছোট্টবেলা থেকেই আমি একটু জেদি এবং ইগোটা বেশি।কেউ আমার অনাকাঙ্ক্ষিত, বা এমন কিছু বলবে যেটা আমার অবস্থানকে ছোট্ট করে আনবে তা মানতে পারি না।একদমই না!তাই মনের সব রাগ,কষ্ট একাকার করে সিদ্ধান্তহীন রুদ্ধশ্বাস কন্ঠে সামনে থাকা লোকটিকে বলে উঠি,

“মেনেছি আমি।বিয়েটা হবে না।আমি বাসায় বারণ করে দিব।যেতে পারেন এবার নিশ্চিন্তে।”
“আর রিজন?”
“সেটা আমি ভেবে নিবো!”

লোকটি কিছু আর বললো না।মিনিট একের মতন আমার দিকে বিভ্রান্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে একটু গাঢ় হেসে বললো,
“অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!কখনো যদি দেখা হয়ে যায় আবার।ভালো থাকবেন!”

বলে চলে গেলো সামনে থেকে।লোকটি অদৃশ্য হওয়ার সাথে সাথেই আমি আবার আগের জায়গায় ধপ করে বসে পড়ি!চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা অশ্রু বেরিয়ে আসে।জীবনে কখনোই এতটা কষ্ট পাইনি।আজ যতটা পেলাম মনে হচ্ছে!লোকটিকো যদিও আমিও চিনিনা।ভালো করে জানিও না।তবে এভাবে বিয়েটা ভেঙ্গে দেওয়াটা,বা দিব এটা আমার কাছে যেনো স্বপ্নের মতন লাগছে!আমি কখনো এরকম পরিস্থিতি বা এরকম কিছু আমার সাথে ঘটবে তা আমি কস্মিনকালেও ভাবিনি!

এভাবে কিছুক্ষণ রেস্টুরেন্টের একদম কোণার চেয়ারটায় চুপচাপ বসে থাকি।অনেকটা সময় অতিবাহিত হতে ঘঁড়ির দিকে তাকাই।রাত প্রায় তখন আঁটটা বেঁজে গেছে।আবির নামের ছেলেটি আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল সন্ধে সাতটার দিকে।বেশি রাত হয়ে যাবে ভেবে আর বসলাম না।একটা রিক্সা নিয়ে বাসায় চলে আসি।পেছনের দরজা দিয়ে আামার রুমে ঢুকি।আমার রুমটা পেছনের দরজার সাথে লাগোয়া।তাই অতি সন্তপর্ণে ভেতরে ঢুকতে পারি। কারো নজরে পড়িনি।রুমের দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভাবতে থাকি।কি করা যায়?বাবাকে কি বলা যায়?কি বললে ভালো হবে?এভাবে ভাবতে থাকি।কিন্তু কোনো রিজন খুঁজে পাইনি। দরজায় করাঘাত পড়ে,

“এই প্রিয়া?দরজাটা খোল তো?”

শশী খালার কন্ঠস্বর।চোখের নিচে লেগে থাকা পানিটুকু তরতর করে মুছে নিই!গাঁয়ের ওড়না ঠিক করে দরজার কাছে যাই।”
“তাড়াতাড়ি খোল!”

দরজা খুলে দিই।শশী খালা ভেতরে ঢুকেই বলে উঠেন,

“সে-কি তুই এখনো রেডি হস নি?গাঁয়ে হলুদ কখন করবো?যা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।আর সময় নেই!”

আমি নিশ্চুপ মুখে খালামণির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।খালামণি আবারো,
“শশী!”

খালামণির কথার আর কোনো উত্তর করলাম না।রুম থেকে বেরিয়ে এলাম সোঁজা।এসে চারপাশে বাবাকে খুঁজতে থাকলাম।বাবাকে ঘরের ভেতর কোথাও খুঁজে পেলাম না।অস্থির হয়ে গেলাম।হন্তদন্ত সামনে তারপর যাকে পেলাম তাকেই বাবার কথা জিজ্ঞেস করলাম।কেউই বলতে পারে নি বাবা কোথায়।অতঃপর বড় মা বললেন,
“বাজারে গিয়েছে।একটুপরই চলে আসবে।কোনো প্রয়োজন?”

আমি বড় মাকে কিছু বললাম না।মুখ ফিরিয়ে আমার রুমের দিকে চলে এলাম।খালামণি,কাকী,এবং মামিমা বিরক্ত আমার উপর।সাথে চড়া রাগও।একঘন্টা যাবৎ দাঁড়িয়ে আছে আমার কাছে আমি কোনোরকম সাজছি না, গুজছি না।জিম্মির মতন বসে আছি।কিন্তু আমি যে বাবা আসার অপেক্ষায় আছি!বড় মা আমার রুমে ঢুকেন এবার।এসেই বলেন,

“হয়েছে টা কি,প্রিয়া? সবাই যে বলাবলি করতেছে তুই সাজতেছিস না!এরকম করতেছিসা কেন তুই?তোর বাবা বাজার থেকে ফেরার অপেক্ষা করতেছিস?”

কেনজানি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না।দম বন্ধ হয়ে আসতেছে।বদ্ধ দমটা এবার উন্মুক্ত করে দিয়ে তরল গলায় বলে উঠলাম,

“বড় মা,আমি এই বিয়েটাা করতে পারবো না।দয়া করে তোমরা কেউ আমাকে জোর করবে না।আর কেনো করতে চাচ্ছি না তার কারণও জিজ্ঞেস করবে না!”
“মানে?এসব কি বলতেছিস তুই?”

উপস্থিত থাকা এখানে সবাই চরম মাত্রায় অবাক হয়ে যায়।মামিমা বলে উঠেন,

“তোর বাবা শুনলে কী অবস্থাটা হবে ভেবেছিস একবারও?”
“প্লিজ মামিমা আমি আর কিছু শুনতে চাচ্ছি না।আমি একটু একা থাকতে চাই।একা থাকতে দাও আমাকে!”

মিনিট তিনেকের মতন সবাই নিশ্চুপ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে যায় রুম থেকে।আমি জানি বাবা বাজার থেকে ফিরলেই বাবার কানে কথাটা যেতে না যেতেই বাবা রুমে এসে আমাকে কয়েকটা থাপ্পড় বসাবে।আমাকে এখন সেই মার খাওয়ার প্রস্তুতি ভালো করে নিতে হবে।মার খেয়ে ছোট্ট বাচ্চাদের মতন সব কথা টাসটাস করে গলা থেকে বের করে দিলে হবে না।এমনিতেই একটু আবেগী প্রবণ আমি।সহজে সত্যটা নিজের মাঝে চেপে রাখতে পারিনা।তবে এখন রাখতে হবে।কারণ,আমি আবির নামের ওই লোকটিকে কথা দিয়েছি!

—————————————————
প্রায় মিনিট ত্রিশেক পরই রুমের বাইরে চিল্লাপাল্লার আওয়াজ শুনি।কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে সেই আওয়াজ আমার রুমের দিকে স্পষ্ট হতে থাকে।বাবা এসে হাজির! গলার পানি শুঁকিয়ে যায়।আর আমি তরতর করে কাঁপতে থাকি।বাবার মুখের দিকে তাকানোর সাহসটুকু নাই।বাবা শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে খুবই তেঁজি কন্ঠে বলে উঠেন,

“এসব কি শুনতেছি আমি!কি শুনতেছি!”

আমি চুপ করে থাকি।
“বেয়াদব তুই একটা!আমার মানসম্মান রাখলি না আর!আজ থেকে আর আমাকে বাবা বলে ডাকবি না!”

বলেই বাবা আমার রুম থেকে বেরিয়ে যান।আর আমি বিছানার উপর গিয়ে বসে পড়ে মুখে ওড়না চেপে চেপে রাখা কান্নার বাণ উন্মুক্ত করে দিই।

#খুঁজলেই_পাবে_আমাকে
#রোকসানা_আক্তার
#পর্ব-০১

চলবে……..

(আসসালামু আলাইকুম,স্টোরিটা ছোটগল্প। কিন্তু কাহিনী-সংলাপ শেষ না হওয়ার কারণে আরো একটা পর্বে শেষ করবো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here