||কৈশোরে প্রেম|| ||অংশ: ১৪||

প্রহেলির হাত দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। ব্লেড দিয়ে কেটে অন্য হাতে চেপে ধরে আছে। দিব্যের হাত থেকে ব্যাগটা মেঝেতে পড়ে যায়। দৌড়ে এসে প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে পেচিয়ে বেঁধে দেয় তার হাত। প্রহেলির সাহস হয়নি খুব বেশি জোরে ব্লেডের আঘাত করতে। একটু চামড়া কাটতেই ভয়ে একাকার অবস্থা। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। কেবল প্রহেলির নয় দিব্যেরও।

“এসব কী করেছ তুমি! জীবন কী এতই সস্তা হয়ে গেল তোমার কাছে! এতবড় পদক্ষেপ কীভাবে নিতে পারলে! একবার পরিবারের কথা ভাবলে না? একবার নিজের স্বপ্নের কথা ভাবলে না? আমার কথা না হয় নাই ভাবলে কিন্তু একবার তো নিজেকে পরিবর্তন করার কথা ভাবতে পারতে। যে নাহিয়ান তোমাকে ছেড়ে গিয়েছে তাকে কী তোমার জবাব দেওয়ার একটুও ইচ্ছে নেই। ঘুরে দাঁড়ানোটা কী জরুরি মনে হলো না তোমার? এত ভেঙে পড়লে কীভাবে? তুমি তো এমন ছিলে না রে! চলো, এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে চলো।”

প্রহেলি উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, “শিল্পী! তুই এখানে কীভাবে এলি? ভাইয়া দেখলে তোর কপালে খারাপ আছে। তুই তাকে একটুও চিনিস না।”

রাগান্বিত হয়ে সে বলল, “বেশি কথা বলবে না, চুপচাপ ডাক্তারের কাছে চলো।”

“শোন, আমার সাথে এত ভাব দেখাবি না। আর আমার বেশি কিছু হয়নি। যাব না আমি। আম্মু ভাইয়া যদি জানে আমি সুইসাইড করার চেষ্টা করেছি তারা না জানি কীভাবে রিয়েক্ট করবে। মা তো কেঁদেকুটে পাগল হয়ে যাবে। আমার সাহস নেই তাদের সামনে যাওয়ার।”

“ঠিকাছে তোমার কিছুই করতে হবে না, যা করার আমি করবো।”, বলেই সে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

প্রহেলি পেছন থেকে বারবার ডাকে তকে কিন্তু কে শুনে কার কথা! আরফা খাতুনের সামনে এসে ইতস্তত করে বলল, “আন্টি, আমার মা কল দিয়েছিল। ব্লাউজের মাপ দিতে আপনার মেয়েকে একটু আধাঘন্টার জন্য নিয়ে যেতে হবে। যদি আপনি অনুমতি দেন তবেই নিয়ে যাব।”

আরফা খাতুন কিছু বলার আগেই প্রান্ত এগিয়ে এসে বলল, “আরে এখানে অনুমতির কী আছে! তো সে তোমারই হবু বউ। যখন তখন নিয়ে যেতে পারো।”

আরফা খাতুন চাচ্ছিলেন না এই রাতে মেয়েকে বাইরে যেতে দিতে। কিন্তু ছেলে এভাবে তার মুখের উপর অনুমতি দিয়ে দিল তিনি হ্যাঁ বা না কিছুই বলতে পারলেন না।। দিব্য প্রহেলি রুমে এসে তার একটা হাত ধরে ওভাবেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

প্রহেলি ভ্রু কুঁচকে বলে, “কী করছিস তুই? এভাবে টানছিস কেন? শিল্পী থাম বলতেছি।”

দিব্য তার কোনো কথাতেই কান দেয় না। প্রান্ত আর আরফা খাতুনের সামনে দিয়ে প্রহেলিকে নিয়ে গাড়িতে তুলে। সে কেবল চোখ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয়। মা, ভাই কিছুই বলছে না। আশ্চর্যের সপ্তম আকাশে উঠে গেছে। এই ছেলে কী এমন কথার যাদুতে ভুলিয়েছে তাদেরকে! প্রহেলিকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পরিচিত ডাক্তারকে কল করে তার চেম্বারে নিয়ে যায়।

ডাক্তার হাতের ক্ষত দেখে বলল, “একটুর জন্য বেঁচে গেছেন। বেশ গভীরে যায়নি ব্লেডটা। শিরা কেটে গেলে এতক্ষণে হয়তো অনেক রক্ত ঝরেই মারা যেতেন তিনি। লাকী গার্ল!”

ব্যান্ডেজ লাগিয়ে কয়টা ওষুধ লিখে দেন তিনি। দিব্য প্রহেলিকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে ফার্মেসি থেকে ওষুধগুলো নিয়ে আসে। বেশকিছু ফলমূল আর স্যালাইনও নিয়ে আসে। গাড়িতে ঢুকে পেছনের সিটে সব রেখে চুপচাপ বসে থাকে। প্রহেলি কিছু বলার বা জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। দিব্যকে অনেক অনেক বিষন্ন লাগছে। এখন কিছু বললে হয়তো তাকে কথা শুনতে হতে পারে। চুপ করে বসে আছে তাই। দাঁত দিয়ে হাতের নখ কাটছে। দিব্য কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। ইচ্ছে করছে কষে একটা থাপ্পড় মারতে কিন্তু সে তা পারবে না। রাগটা তাকে দিয়ে হয় না। যতটুকু রাগ আসে তাও কয়েক মিনিটে হারিয়ে যায়।

“ভাইয়া আর আম্মুকে কীভাবে ম্যানেজ করলি তুই?”

“তুমি আমাকে তুই করে বলা বন্ধ করবে না কোনোদিন?”

“এটা তো আমার প্রশ্নের উত্তর না। আগে উত্তর দে।”

দিব্য গাড়ির জানালায় চেয়ে থাকে। আজ যদি আসলেই প্রহেলি কিছু করে ফেলতো তবে তার কী হতো! চোখ ভেঙে কান্না বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। কিন্তু এখন সে কাঁদতে চাচ্ছে না। নিজেকে শক্ত করে গাড়ি স্টার্ট দেয়। প্রহেলি আবার জিজ্ঞেস করে, “বলবি না?”

দিব্য সামনের দিকে তাকিয়েই বলল, “কাল টের পেয়ে যাবে।”

মনের মধ্যে সন্দেহ জাগে প্রহেলির। ভ্রু কুঁচকে ভাবনায় পড়ে যায়। কাল কী এমন হবে যে টের পেয়ে যাবে!

“শুনলাম বিয়ে করছিস! তা বউটা কে রে? দেখালিও না! ছবি অন্তত দেখা।”

“এখন চুপচাপ বসে থাকো। কাল তোমার সামনে নিয়ে আসবো তাকে। ছবিতে দেখে কী করবে। সরাসরি দেখে নিও। তার সৌন্দর্য ছবির চেয়ে বাস্তবে বেশি।”

প্রহেলি অবাক হয়! না জানি কত সুন্দর মেয়েটা! একটা সময় সেও কত সুন্দর ছিল! দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। শরীরের যে সৌন্দর্য নিয়ে মানুষ বড়াই করে সেটা ছিনিয়ে নিতে উপরওয়ালার জন্য দুই মিনিট যথেষ্ট। অথচ মানুষ এই সৌন্দর্য নিয়েই কতই না অহংকার করে! দিব্য ফাঁকা রাস্তায় এসে জানালার কাঁচ খুলে দেয়। প্রহেলি মাথাটা এলিয়ে দেয় জানালার উপর। দমকা বাতাস এসে তার মুখমণ্ডল ছুঁয়ে দিচ্ছে। চোখ খুলে রাখা মুশকিল। ক্ষুদ্র চোখে রাতের প্রকৃতি দেখছে সে। কী সুন্দর এই রাত! কত শান্ত! এই না রাতের শহরে, কেউ ঘুমাচ্ছে আর কেউবা নির্ঘুম কাটিয়ে দিবে সারা রাত। মাঝপিঠ বিস্তৃত খোলা চুলগুলো হাতাসে উড়ছে। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে দিব্য। এই পরিটাকে কাল অর্ধেকটা নিজের করে পাবে সে। পুরোটা পাওয়ার জন্য একটা সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। তবে এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করে নিতে হবে।

হঠাৎ গাড়ি ব্রেক কষে দিব্য। ঘুমুঘুমু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে প্রহেলি, “আমরা কী এসে পড়েছি?”

“হ্যাঁ, নামো তুমি।”

প্রহেলি নেমে যায়। কিন্তু গাড়ি তার ঘর থেকে অনেকটা দূরে দাঁড় করিয়েছে দিব্য। অথচ ভেতরেও নিতে পারতো সে। কৌতুহল ধরে রাখতে না পেরে সে জিজ্ঞেস করে, “এতদূরে কেন থামালি গাড়ি? ঘরের সামনেও তো রাখতে পারতি।”

দিব্য তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোমার সাথে এই চাঁদনী রাতে কিছু দূর হাঁটতে চাই। এটুকু খুব বেশি চাওয়া? আমার আরেকটা চাওয়া আছে। চলতে চলতে যদি আমি তোমার হাতটা ধরি, তুমি ছেড়ে দিও না প্লিজ। ভালো নাই বাসো, বন্ধু হিসেবে এটুকু অন্তত করতেই পারো।”

দিব্যের এই চাহনি ঘায়েল করার কতো। মাথাটা ঈষৎ হেলিয়ে ক্ষুদ্র চোখে তাকিয়ে কথা বলে সে। কোনো মানুষকে কথা বলার সময় এতটা আকর্ষণীয় লাগে বলে জানা নেই প্রহেলির। তার সবকিছুতেই যেন একটা আকর্ষণ লুকিয়ে আছে। এই যেমন কথা শেষে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা টেনে দেওয়া। তারপর মাথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেওয়া। পকেটে হাত রেখে কোনো কিছুতে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। কিছুক্ষণ পরপর বৃদ্ধাঙুলি উল্টোপাশের সাহায্যে নিচের ঠোঁট চুলকানো। কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফেলা। আবার মুহূর্তেই ভ্রুজোড়া প্রশস্ত করা। বৃথা চুলগুলোকে উপরের দিকে উলটে দেওয়া। কারণ পরক্ষণেই তা আবারো তার কপাল জুড়ে বসে। বেশিরভাগই শার্টের উপর জ্যাকেট পরে, হাত ফোল্ড করে রাখে। এর থেকেও হয়তো বেশি কিছু। যা প্রহেলির চোখে পড়েনি এখনো।

দু’জনে হাঁটছে সরু রাস্তায়। রাস্তাটা একটু ভেতরের দিক হওয়ায় এই সময় একদম ফাঁকা। মাঝেমধ্যে দুই-একজন মানুষ দেখা যাচ্ছে। রাস্তায় কিছুটা দূরে দূরে কুকুর শুয়ে আছে। মাঝেমধ্যে বিড়াল ছুটে যাচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় প্রহেলির মুখ আরো রাঙা হয়ে আসে। চোখের নিচ কালো হয়ে এসেছে তার। সামনের ছোট ছোট চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে হাত খোঁপা করে নিয়েছে। কাঁচা হলুদ রঙের ড্রেসে কী যে অসাধারণ লাগছে তাকে। দিব্য আরেকবার তার প্রেমে পড়ে যায়। এই প্রথম সে তার সৌন্দর্যের প্রেমে পড়েছে। ছোটবেলায় তার আদরের প্রেমে পড়েছিল। প্রহেলি যখন কলেজের প্রথম বর্ষে সেদিন সে দ্বিতীয়বারের মতো তার ভালো ব্যবহারের প্রেমে পড়েছিল। দিব্যের এখনো মনে আছে, প্রহেলি নিজের টিফিন না খেয়ে সেই টাকা দিয়ে ছোট্ট মেয়েটার থেকে কয়েকটা বকুল ফুলের মালা কিনেছিল কেবল মেয়েটাকে একটু সাহায্য করার জন্য।

চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

[বিঃদ্রঃ যারা আমার কথনিকা নামক ছোট্ট গ্রুপে এড হোননি এখনই হয়ে যান। গল্পের সকল আপডেট সেখানেই পাবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here