#কুয়াশায়_ঘেরা
#অন্তিম_পাতা
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
বাড়িতে শোকের ছায়া বিরাজমান। সাইফা মুখে খাবার তুলছেনা। সারাদিন তার সময় কা’টে চোখের পানি ফে’লে। মিসক্যারেজ হওয়ায় বাচ্চাটা বাঁচানো গেলোনা। কারো মুখে হাসি নেই। সাইফার মুখ শুকিয়ে চোখদুটো যেনো তিনহাত ডেবে গিয়েছে। এই বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্য আশরাফুল মা আর স্ত্রীকে আলাদা রেখেছিলো। পারলোনা সে, সে একজন দায়িত্ববান বাবা হতে পারলোনা। সাইফার সামনে সে শক্ত থাকে। নয়তো মেয়েটাকে বাঁচানো যাবেনা। প্রভাতি কাকে সামলাবে? ভাই নাকি ভাবিকে? দুজনই যে ভেতর থেকে ভে’ঙে চুরমার হয়ে আছে। আনোয়ারা জাহান একসময় অসুস্থতার দরুন যেই বউকে অপ’বাদ দিয়েছে, আজ তাকে বুকে আগলে শান্তনা দিচ্ছে।
আশরাফুলের মানসপটে ভেসে উঠলো সেই বীভ’ৎস দৃশ্য।
ড্রাইভার ছিলোনা আজ। নিজে ড্রাইভ করে সাইফাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলো। সাইফার চোখেমুখে খুশির ফোয়ারা। এতদিন পর শশুর বাড়ী যাচ্ছে, আবার সেই পুরোনো শাশুড়ীর ভালোবাসা পাবে। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেলো? একটা ট্রাক আসলো সামনে। আশরাফুল তৎক্ষনাৎ গাড়ি পাশ কা’টিয়ে নিতে গেলো। সজোরে শব্দ হলো আর সব শেষ।
হসপিটালে ইলানের সাথে কথা বলতে চাইছিলোনা আশরাফুল। কিন্তু বন্ধুত্বের কাছে তার রা’গ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা। ইলান সব শুনে যতটুকু বুঝতে পারলো এটা আকস্মিক দু’র্ঘটনা নয়, এটা একটা চ’ক্রান্ত।
—————
ক্লু অনুযায়ী এগোতে হলে মিহানের ব্যাপারটা সামনে আনতেই হবে। সব অফিসারদের সাথে নিয়ে মিহানের বলা ধানমন্ডির ঠিকানায় পৌঁছে গেলো সবাই। সাথে মিহান ও ছিলো।
চারপাশ থেকে আড়াল হয়ে অফিসাররা ট্রহল দিচ্ছে। মিহান ঠিক জায়গা মতো দাঁড়িয়ে রইলো। আগামীকাল তাদের ফ্লাইট। কথা ছিলো ফ্লাইটের আগের রাতে তারা এখানে মিলিত হবে। দূর থেকে কালো পোশাকে আবৃত দুজন যুবককে এদিকে আসতে দেখা গেলো। দুজন এগিয়ে এসে মিহানের সাথে কোলাকুলি সেরে গন্তব্যে পা বাড়াবে এমন সময় চারদিক থেকে অফিসাররা সবাইকে ঘিরে ধরলো। ফরহাদ আর তুলন দুজনেই বিস্ফোরিত নেত্রে মিহানের দিকে চাইলো। মিহানের ঠোঁটে বাঁকা হাসি। ইলান তাকে অফার করেছিলো যদি সে ফরহাদ আর তুলনকে ধরতে সাহায্য করে তবে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে সাথে ইন্ডিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। নয়তো সবার মতো তাকেও ফাঁ’সির দড়িতে ঝুলতে হবে।
মিহান একবাক্যে লুফে নিলো লোভনীয় অফারটি। বিশ্বাসঘা’তকতা করলো মিহান। ফরহাদ আর তুলনের চোখে অবিশ্বাস।
মিহান একপাশে সরে যেতে চাইলেই অফিসাররা তাকে সহ একযোগে ঘিরে ধরলো। মিহানের চোখে আতঙ্ক। ইলানের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো ভাইয়ের অধরে সূক্ষ্ম হাসি। তার মানে সে ইলানের পাতানো ফাঁদে পা দিয়েছে।
সাথে সাথে ফরহাদ আর তুলনের ঠোঁটে ও হাসি ফুটলো।
—————
তুলন, মিহান, ফরহাদ তিনজনকেই স্পেশাল ট্রিটমেন্ট দিয়ে জিজ্ঞেস করা হলো,
-“তুর্শির কী দোষ ছিলো? মেয়েটাকে কেনো মা’রলে? সাথে তার বান্ধবী মনি’র কি দোষ ছিলো। নিষ্পাপ দুটো মেয়েকে কেনো জীবনের স্বাদ নেওয়া থেকে বঞ্চিত করলে?”
মুখ খুললোনা একজনও। দ্বিতীয়বার রডের আ’ঘাতে জর্জরিত হয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হলো ফরহাদ।
-“তুর্শি আমার আপন বোন নয়, ওকে আমার ছোট থেকেই ভালোলাগতো। আমি ওর সঙ্গ চাইতাম, কিন্তু সে আমাকে ভাইয়ের নজরে রাখতো। পরবর্তীতে তাকে আমি সরাসরি বুঝিয়ে বললাম তুই আমার বোন না। আমরা চাইলে নিজেদের মধ্যে সম্পর্কে জড়াতে পারি। কিন্তু সে আমাকে চ’ড় মেরে দিলো? টগবগে যুবকের শরীরের র’ক্ত গরম থাকে। সেদিন আমার মাথায় র’ক্ত চড়ে যায়। পরিকল্পনা সাজিয়ে নিই মস্তিষ্কে। আমাদের বাড়ির সারভেন্ট জাকিয়া তুর্শির সব রকম কাজের দায়িত্বে ছিলো। তাকে দিয়ে তুর্শির খাবারে ঘুমের ঔষধ মেশাতাম। রাতের আঁধারে নিজের হিং’স্রতা ঢেলে দিতাম তুর্শির ওপর। রাত হলেই মত্ত হয়ে যেতাম ওর শরীরে।
সকাল হলেই হয়তো তুর্শি বুঝতে পারতো তার সাথে কি হচ্ছে? কিন্তু মানুষটিকে চিহ্নিত করতে পারতোনা। পরে একদিন তুর্শি রাতে খাবার না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। আমি টের পাইনি। সেই রাতে তুর্শির ঘরে গিয়ে ওর শরীর স্পর্শ করতেই চোখ খুলে তাকালো তুর্শি। প্রচন্ড অবিশ্বাস আর ঘৃ’ণা নিয়ে তাকিয়ে ছিলো। চেঁচিয়ে সবাইকে ডাকার আগেই ওকে ওয়াশরুমে টে’নে নিয়ে যাই। দেয়ালের সাথে সজোরে মাথায় আ’ঘাত করি। ভ’য় দেখিয়েছিলাম যদি আমার নাম কাউকে বলে তাহলে ওর সাথে সাথে পরিবারের সাবাইকে শেষ করে দেবো।
সেদিন ওয়াশরুমের র’ক্তে পানি ঢেলে দিলেও কোনায় কয়েক ফোঁটা র’ক্ত থেকে যায়। পরদিন তুর্শি সবাইকে বলে ছাদ থেকে নামতে গিয়ে সিঁড়িতে পড়ে মাথায় আ’ঘাত পায়।”
ফরহাদ থামলো। ইলান পূনরায় প্রশ্ন করলো,
-“তাহলে মেয়েটাকে মা’রলে কেনো? আর ওর বিছানার নিচে প্রটেকশন কোথা থেকে আসলো?”
ফরহাদ আবার ও বলা শুরু করলে,
-“প্রটেকশন আমিই রেখেছিলাম। তুর্শি কখনো বিছানার নিচ দেখতে যাবেনা। জিনিসটা প্রতিদিন না নিয়ে এসে নিজের সুবিধার্থে ওর বিছানার নিচেই রেখেছিলাম।
এরপর তুলন একদিন আমাদের বাড়িতে আসে। একদিনেই সবার সাথে বন্ধুত্ব করে নেয়। তুর্শি খুব ভালো আর্ট জানে। ওর পেইন্টিং রুমে একটা ছবিতে চোখ আটকে যায় তুলনের। সে তুর্শির কাছ থেকে পেইন্টিং টি কিনতে চায়। তুর্শি কিছুতেই পেইন্টিং টি দেবেনা। এটা ওর সবচেয়ে প্রিয় পেইন্টিং। শুধু তুলননা আর অনেকেই তুর্শির পেইন্টিং টি পছন্দ করে। পেইন্টিং টির বিশেষত্ব ছিলো এটি চারকোন থেকে আর কোনাকুনি দৃষ্টি রাখলে একবার একটি মেয়ের ছবি ভেসে ওঠে। তুলন আমাকে জানালো পেইন্টিং টি তার লাগবে। এটা বিদেশে বিক্রি করলে প্রচুর টাকা পাবে।
আমার মনে মনে তুর্শিকে নিয়ে ভ’য় ছিলো। যখন তখন ও আমার নাম সবার সামনে বলে দিতে পারে। তাই তুলনের সাথে পরিকল্পনা করলাম। তুলনের লাগবে পেইন্টিং আর আমার লাগবে তুর্শির মৃ’ত্যু। সেটাই করলাম আমরা। কিন্তু তুর্শি যে কথাগুলো তার বান্ধবী মনি’কে পূর্বেই বলে রেখেছিলো আমি জানতামনা। মনি মেয়েটা একটা বড় বোকামি করে বসলো। বাসা থেকে আমার নাম্বার নিয়ে আমাকে কল করলো। থ্রেট করে বললো তুর্শির খু’ন যে আপনি করেছেন সেটা আমি শতভাগ নিশ্চিত। আমি সবাইকে সবটা বলে দেবো, এমনকি পুলিশকে ও বলবো।
ব্যস মনির বোকামির শাস্তি হিসেবে সে উধাও হলো। তাকেই তুর্শির মতো জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি সব কিছুর পরিকল্পনা করলেও খু’ন আমি করিনি। খু’নের দায়িত্ব নিয়েছিলো তুলন। তুর্শি আর মনি দুজনকেই ও কু’পিয়ে মেরেছে।
ওদের খু’নের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে মিহান সব শুনে ফেলে। ওকে বিস্তারিত কিছুই জানাইনি। আমরা জানতাম মিহান ইন্ডিয়া যাওয়ার জন্য কতটা উদগ্রীব। তাই ওকে সেটারই লো’ভ দেখালাম। বিনিময়ে মুখ বন্ধ রাখতে হবে।
পরে জানতে পারলাম প্রভাতি মেয়েটার বর্ণনা অনুযায়ী স্কেচ তৈরি করা হবে। তখন তো তুলন ধরা পড়তো সাথে আমিও। তাই মিহানকে পাঠালাম বাড়িতে। প্রভাতি মেয়েটাকে নিয়ে বের হলো আর আমরা ও ঝোপ বুঝে কো’প মারলাম। যাতে প্রভাতি বর্ণনা দিতে না পারে, তাই ওর গলায় আ’ঘাত করলাম। সেদিন ছদ্মবেশ নিয়েই শপিংমলে প্রবেশ করেছিলাম আমরা।
মিহান আপনার কাছে ধরা পড়ার আগেই বলেছিলো আপনার কাছে ধরা পড়লে ওকে বাঁচিয়ে রাখবেননা। তাই প্রতিশোধ হিসেবে সে চাইলো প্রভাতির ভাই যাতে আপনাকে আরও খা’রাপ ভাবে। সব কিছুর জন্য আপনাকে দায়ী করে,আপনাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করে দেয়। সেই অনুযায়ী আমরা কাজ করলাম। মিহান বলে দিয়েছিলো প্রভাতির ভাবিকে আক্র’মণ করতে হবে। বোন আর স্ত্রী-সন্তানের ক্ষ’তি হলে মিঃ আশরাফুল সবকিছুর জন্য কে’সটাকে আর আপনাকে দায়ী করবে। আমরা মিহানকে বাঁচানোর জন্য সব করলাম। কিন্তু সে আপনার দেওয়া অফার লুফে বিশ্বাসঘা’তকতা করে। ”
সব শুনে স্থির হয়ে রইলো ইলান। মিহান এতবড় চাল চাললো? তারমানে আশরাফুল আর সাইফার এক্সি’ডেন্ট, বেবি মিসক্যারেজ সব মিহানের চাল?
বাকি অফিসাররা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। অবশেষে কে’স নিষ্পত্তি হলো।
মিহান বা তুলন কেউই রা করলোনা।
হাই কোর্টে তোলা হলো তিনজনকেই। খু’ন ও তার সাথে জড়িত থাকার অপরাধে তিনজনকেই ফাঁ’সির রায় দিলো। আগামীকালই পৃথিবীতে তাদের শেষ দিন।
————
তুর্শি ও মনি’র খু’নের অপরাধে তিনজন আসামির মধ্যে মিহান নামের আসামি পলাতক।
মিহান দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একটা গাড়ির সামনে পড়লো। তার ডেড বডি সিটকে পড়লো দূরে। গাড়ির লুকিং মিররে একজোড়া চোখ দৃশ্যমান।মাথায় আর বামহাতে ব্যান্ডেজ, ডান হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরা। চোখদুটো শান্ত। মনে আত্মতৃপ্তি।
পরেরদিনই নিউজ হলো মিহান নামক পলাতক আসামির কার দু’র্ঘটনায় মৃ’ত্যু। কে’সটি এখানেই শেষ।
———
মাস তিনেক পরের ঘটনা। প্রভাতি ইলানের দিকে কিছুটা ঝুঁকলেও এবার আশরাফুল কিছুতেই বোনকে ইলানের হাতে তুলে দিতে রাজি নয়। তার ধারণা ইলানের জীবনে জড়ালে প্রভাতির জীবন রিস্কে পড়বে। একমাত্র আদরের বোনকে সে কিছুতেই বি’পদের মুখে ঠে’লে দিতে পারেনা।
আশরাফুলের আপত্তি শুনে ইলান প্রভাতিকে একবার জিজ্ঞেস করলো,
-“বাকি জীবনটা আমার সাথে কা’টাতে চাও?”
প্রভাতির চোখে আজ কোনো জড়তা নেই। সে জানে তার মন এখন কী চায়? ইলানের চোখে চোখ রেখে বলল,
-“নাকফুলের ব্যবস্থা করুন।”
ইলানের অধর কোনে হাসি ফুটলো।
পরদিন আশরাফুল পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও প্রভাতিকে পেলোনা। ইলান ও বাসায় নেই। সাইফা কেমন ভেজা বেড়ালের মতো চুপটি করে আছে।
আশরাফুল চোয়াল শক্ত করে নিলো। রা’গে হাতের পাতা মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো। সাইফার দিকে ক্রুর দৃষ্টি ফেলে বলল,
-“তুমিই প্রভাকে সাহায্য করেছো?”
সেদিন খবর আসলো ঢাকা থেকে কুমিল্লার পথে দুটি বাসে সংঘর্ষ হয়। অনেকের চেহারা থে’তলে গিয়েছে। টিকিট দেখে জানানো হয় বাস যাত্রীদের পরিচয়। ইলান মুনতাসীর আর প্রভাতি জামান নাম দুটি শুনে কলিজা মুচড়ে আসে আশরাফুলের। পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে যায় বাড়ী থেকে। মাঝপথে যেতেই তার ফোনের মেসেজ টিউন বেজে ওঠে। ওপেন করতেই লিখাগুলো দৃষ্টিগোচর হলো,
“ফিরবো কোনো এক নতুন ভোরে, যে ভোরে ঘন কুয়াশা কে’টে আকাশে রোদ্দুরের দেখা মিলবে।”
আশরাফুল দুর্বোধ্য হাসলো। ফিরতি মেসেজ করলো,”কুয়াশা কে’টে রোদ ওঠা উচিত, অপেক্ষায় আছি আমি। কিন্তু সকল রোদ সুফল বয়ে আনেনা। বাঁচার তাগিদে কিছুকাল কুয়াশায় থেকে যেতে হয়।”
#সমাপ্ত