#কলা_পাতায়_বাঁধিব_ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৫

সেদিন হাসপাতালে পুষ্পকে দেখে আসার পর ইমরান, রিয়াদ, জুঁই, প্রিয়া এদের কারোরই পুষ্পর সাথে দেখা হয়নি। রাউফুন, পুষ্পর সুন্দর মুহূর্তের বিঘ্ন ঘটাতে তাদের ফোন এলো। পুষ্পর ফোন রাউফুনের পকেটে ছিলো। আসার সময় সাথে করে নিয়ে এসেছে সে। গ্রুপ কলে সব বন্ধুরা এটেন্ড করে কিছুক্ষণ কথা বলল।
বাড়িতে ফোন করার পর পুষ্প নাবিলকে জিজ্ঞেস করলো,
-“নাবিল তোর জন্য আপু কি আনবো?”

নাবিল বলল,
-“দুলাভাইয়াকে বলবে আমার জন্য বি’ষ আনতে।”

পুষ্প ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
-“আচ্ছা, তোর জন্য একগাদা বিষ নিয়ে আসবো।”

নাবিল খুশিতে ফোনেই পুষ্পকে পাপ্পি দিলো। বাড়িতে সবার সাথে কথা বলে দুজনেই হোটেলে ফিরে গেলো। পুষ্প বলল,
-“শীতকালে আসলে বেশি ভালোলাগতো।”

-“আচ্ছা, শীতকালে আবার আসবো।”

★★★

কক্সবাজার থেকে ফিরে পুরোদমে পড়ালেখায় মন দিলো পুষ্প। রাউফুন হসপিটালের কাজ নিয়ে বেশ তাড়াহুড়োয় আছে।
তারা কক্সবাজার থেকে ফেরার দু’মাস পরই রিশার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসে। কথাবার্তায় বোঝা গেলো তাদের দুজনের মধ্যে আগে থেকেই আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে। উপরে শুধু পরিবারকে জানিয়ে রাখছে। দুই পরিবারের মতের ভিত্তিতেই রিশার এনগেজমেন্ট করে রাখা হলো।
নাবিল চুপচাপ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। সবার মুখে মুখে যখন শুনলো রিশার বিয়ে হবে রিশার মতোই বড় একটা ছেলের সাথে, তখন নাবিল মায়ের পেটে মুখ লুকিয়ে কঁদে ফেললো।
-“আম্মু, রিশা আপু আমাকে বিয়ে করবেনা?”

সবাই নাবিলের কথায় হেসে ফেললো।

★★★

এইমাসে পিরিয়ড মিস গিয়ে দুদিন ওভার হয়েছে পষ্পর। এবারে রাউফুন বেশ সতর্ক থাকলো। প্রথমবারের মতো কোনো রিস্ক নিতে চাইলোনা।
আরও কিছুদিন যাওয়ার পরই পুষ্পর হাতে একটা প্রেগন্যান্সি কিট ধরিয়ে দিলো।
একরাশ ভালোলাগা, শিরশিরে অনুভূতি, উৎফুল্লভাব নিয়ে কিট নিয়ে বেরিয়ে আসলো পুষ্প। রাউফুনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিকে পাশ কাটিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আবেগটুকু দমিয়ে রাখতে পারলোনা।

রাউফুনের ঠোঁটে চওড়া হাসি ফোটে উঠলো। পরম আবেশে প্রিয়াতমাকে বাহুবন্ধনীতে আগলে নিলো। বুক থেকে মুখ তুলে আলহামদুলিল্লাহ বলে ললাটে দীর্ঘসময় নিয়ে চুমু খেলো।

পরিবারে নতুন সদস্যের আগমনে দু’বাড়ির লোকজনের মাঝে হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেলো। নাবিল লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। ছোট্ট বাবুকে সে কারো সাথে খেলতে দেবেনা। বাবুর আজগুবি নাম ঠিক করছে।
পুষ্প কি খাবে? কি করবে? সব নিয়েই সবার মাতামাতির শেষ নেই। রাউফুন চেকআপ এর জন্য ডঃ হাফসা সানজিদাকে বেছে নিলো। ডেলিভারি পর্যন্ত তিনিই পুষ্পর চিকিৎসা করবেন।
সিঁড়ি বেয়ে উপরনিচ ওঠানামায় রিস্ক আছে বলে পুষ্পকে নিচে নামতে দেওয়া হয়না। বেশিরভাগ সময় সবাই উপরেই কাটায়। খুব বেশি দরকার পড়লে রাউফুন কোলে তুলে নিচে নামায়। তখন বাবা-মা আড়ালে থাকেন।

রোকসানা বললেন,
-“এতটা ঝামেলা না করে তোরা আপাতত নিচের একটা রুমে শিফট হয়ে গেলেই পারিস। এতে সুবিধা হবে।”

রাউফুন মায়ের কথা অনুযায়ী নিচের ঘরে থাকার ব্যবস্থা করলো।
কয়েকমাস একেবারে ফুল রেস্টে ছিলো পুষ্প। যা পেরেছিলো পাড়াগুলো কিছুটা ঘরে বসেই আয়ত্ত করে নিয়েছে।
পরীক্ষা একেবারে নাকের ডগায় এসে থেমেছে।

আগের তুলনায় পুষ্পর শরীর বেশ মুটিয়ে গিয়েছে। দেখতে ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে, গুলুমুলু টাইপ। রাউফুন মাঝমাঝে নাক টিপে দিয়ে বলে,
-“দিনদিন ভীষণ সুন্দরী হয়ে যাচ্ছো।”

পুষ্প হাসে। মাতৃত্বের ছোঁয়া পেয়ে মাঝেমাঝে তার নিজেরই নিজেকে ভালোলাগে। আয়নার সামনে গিয়ে সামান্য উঁচু পেট নিয়ে দাঁড়ায়।
প্রেগন্যান্সির পর থেকেই পুষ্পর রান্না করতে ইচ্ছে করে। যখন তখন মন চাইলে পছন্দমতো রান্না করে। রান্না করেই ঠিক, কিন্তু নিজে খেতে পারেনা। রান্না করার পর কেমন জানি খেতে আর ভালোলাগেনা। বাকীরাই খায়।
রাউফুন পুষ্প সাবধান হয়েছে, তবে রাউফুন বলে দিয়েছে “একেবারে শুয়ে থাকলে চলবেনা। একটু হাঁটাহাঁটি করবে। নয়তো হাত পা ফুলে যাবে।”

পুষ্প রুমের ভেতর, রুমের বাহিরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে। রাউফুনের আসার অপেক্ষা করে।
সবার এত এত ভালোবাসা পেয়ে নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষের তকমা দিলো।
প্রেগ্ন্যান্সি সময়ই একে একে সব পরীক্ষা কমপ্লিট করলো। বেশিরভাগ সময়ে রাউফুন দিয়ে আসতো। আসার সময় রাউফুন সময় না পেলে তার বাবা নিয়ে আসতো।
ব্যথা হজম করার পাশাপাশি বাবুর কিক করা, নড়াচড়া করার আনন্দ ও বেশ উপভোগ করেছে। রাউফুন আগের তুলনায় এখন আরও বেশিই কেয়ারিং হয়েছে। তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার চেষ্টা করে।
দুজনের খুনসুটিতে রাত কাটে। দিনের অর্ধেক সময় রিশার পাগলামোতে কাটে। বাবু আসার কথা শোনার পর থেকে মেয়েটা বড্ড পাগলামি করছে। সময় অসময়ে এসে পুষ্পর পাশে বসে থাকে। নিজে নিজে বাবুর সাথে কথা বলে। পুষ্প হাসে। ভীষণ প্রশান্তির হাসি। তার কোনো গ্লানি নেই, ক্লান্তির ছাপ নেই।

★★★

রাতে হাসপাতাল থেকে ফিরে ওয়াশরুমে গেলো রাউফুন। একেবারে নোংরা জামাকাপড় ছাড়িয়ে গোসল নিয়ে বেরিয়েছে। পুষ্প তার বেড়ে ওঠা উঁচু পেট নিয়ে চুলে বেনি পাকাচ্ছে।
চুল মোছা বাদ দিয়ে রাউফুন পেছনে এসে দাঁড়ালো। শক্তপোক্ত হাতজোড়া দিয়ে আলতো ছুঁয়ে দিলো পুষ্পর গোলগাল উদর। ঘাড়ে থুতনি রেখে কানের লতিতে চুমু দিলো।
পুষ্প আদরে নুইয়ে গিলো। মিইয়ে যাওয়া গলায় শুধালো,
-“বাবু কার মতো হবে? আমার মতো? নাকি তোমার মতো?”

সম্পর্কের উন্নতিতে আপনি থেকে তুমি সম্বোধন এ এসেছে। পুষ্পকে খাটে বসিয়ে দিয়ে সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসলো রাউফুন। বলল,
-“যার মতোই হোক না কেন? আল্লাহ তাকে সুস্থভাবে দুনিয়াতে পাঠাক। যাতে মা বাবু দুজনেই সুস্থ থাকে।”

পেটে চুমু খেয়ে পুষ্পর চুলের অবশিষ্ট বেনি পাকানোর চেষ্টায় বসে পড়লো রাউফুন। তার যত্নে কোনো ত্রুটি রাখতে চায়না। সন্তান তাদের দুজনের ফল। একজন তো কষ্ট করছেই, বাকীজনের দায়িত্ব এই মানুষটার যত্ন নেওয়া, তাকে ভালোবাসা।”

বেনি পাকানো শেষে রাউফুন পাশে বসে বালিশ ঠিক করলো। পুষ্পর পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে ইশারা করলো ঠিক হয়ে বসতে। শুক্রবার দিন সুযোগ পেলেই ধরে বেঁধে পুষ্পর হাত পায়ের নখ কে’টে দেওয়া, তেল দিতে না চাইলেও উষ্কখুষ্ক চুলে একটু খানি তেল লাগিয়ে দেওয়া রাউফুন সপ্তাহিক কাজের মধ্যে পড়ে।
শুধু প্রেগন্যান্সি সময় নয়। মেয়েরা সবসময়ই স্বামীর ভালোবাসা, যত্ন প্রত্যাশা করে। স্বামীকে নিজের একজন প্রেমিক রূপে চায়। তবে স্বামীকে প্রেমিক রূপে চাইলেই হবেনা। নিজেকেও হতে হবে একজন দায়িত্ববান, আদর্শ স্ত্রী। একজন পাগলাটে প্রেমিকা।

ডেলিভারি সময় ঘনিয়ে আসলো।
শরীর অনেকটাই ভার দিয়ে যাওয়ায় চলাফেরায় আগের তুলনায় ইদানীং একটু সমস্যা হচ্ছে। তবুও পুষ্প যতটা পারছে হাঁটাহাঁটি করে নিজেকে ঠিক রাখছে।

★★★

দুপুর থেকেই সামান্য সামান্য ব্যথা হচ্ছে। রোকসানা আবার এসব বিষয়ে বেশ খেয়াল রাখেন। একটু পর পর পুষ্পকে শরীরের হালচালের কথা জিজ্ঞেস করেন। পুষ্প সামান্য সামান্য ব্যথা হওয়ার কথা জানালো।
কালক্রমে এই ব্যথা একটু থেকে অনেকখানি হলো। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা হজম করছে।
রোকসানা পরিস্থিতি দেখে ঠান্ডামাথায় ছেলেকে ফোন দিলেন। রাউফুনের সামনে রোগী৷ রিশা আর মাকে বলল পুষ্পকে নিয়ে আসতে৷ সে ডঃ হাফসা সানজিদার সাথে কথা বলে সব ব্যবস্থা করছে।

হাঁসফাঁস অবস্থায় পুষ্প চাইলোনা আওয়াজ করতে। তবুও মরন ব্যথায় আৎকে উঠে ক্ষণে ক্ষণে গুঙ্গিয়ে উঠছে। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসার পর প্রথমেই চেকআপ করা হলো। আল্ট্রাসনোগ্রাফির পর ডঃ সানজিদা আস্বস্ত করলেন সব ঠিক আছে।

পুষ্পকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হলো। নরমাল ডেলিভারির বন্দোবস্ত করা হয়েছে। রাউফুন পুষ্পর পাশে আছে। সে শক্ত রয়েছে। অনবরত পুষ্পর হাতে গালে মালিশ করে বিভিন্ন মোটিভেশনাল কথা বলে তাকে সাহস জুগিয়েছে।
তীব্র ব্যথায় চোখমুখ খিঁচিয়ে বারবার রাউফুনের হাত খামচে ধরছে।

-“আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

কথা বলার শক্তিটুকু নেই। গলা ছিঁড়ে শব্দগুচ্ছ বের হলোনা। দু’চোখ ভরে নোনাজল গড়িয়ে কর্ণ স্পর্শ করলো। এক টুকরো সুখের ছোঁয়া পেতে অসহনীয় ব্যথায় কাতরে উঠছে মেয়েটা।
দশমাসে অন্ধকারের বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে এলো এক ফুটফুটে নবজাতক। লম্বা শ্বাসে মুদে এলো পুষ্পর চোখজোড়া।
ক্রন্দনরত বাচ্চাটির দিকে হাস্যজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে ডঃ সানজিদা বললেন,
-“আলোকিত জগতকে আরেকটুখানি আলোকিত করে ধরার বুকে জন্ম নেওয়ায় আপনাকে অভিনন্দন জানাই মিস্টার।”

রাউফুন ছেলেকে কোলে তুলেই সর্বপ্রথম আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলো। আল্লাহ সুস্থভাবে তাদের সন্তান দান করেছেন। চওড়া হেসে ছেলের কপালে চুমু খেয়ে পুষ্পর পাশে দাঁড়ালো। তার কপালেও একইভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
-“আমার সুখের সংসারে আল্লাহ প্রদত্ত উপহারকে সুস্থভাবে দুনিয়াতে আনার জন্য তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ আমি।”

পুষ্পর অধরকোন প্রসারিত হলো। পাশ ফিরে নিজের ছেলেকে দেখলো। নরম, কচি, তুলতুলে হাতখানি ছুঁয়ে দিতেই যেনো পুষ্পর সমস্ত কষ্ট পইপই করে পালিয়ে গেলো। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে মা ভুলে যায় কতরাত তীব্র ব্যথায় ঘুমাতে পারেনি, মা ভুলে যায় সে মৃ’ত্যুর সাথে লড়াই করে এসেছে। যদি এসব মনে রাখতো, তবে কোনো নারী দ্বিতীয়বার মা হওয়ার কথা ভাবতোনা। পূনরায় নিজেকে যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতিতে ফেলার কথা ভাবতোনা। যন্ত্রণার কথা মনে করেই ভয়ে সিটিয়ে থাকতো।

★★★

পুষ্পকে কেবিনে শিফট করা হলো। নবজাতককে নিয়ে সবার মাতামাতি। নাবিল বাবুকে বাড়িতে নিয়ে যাবে। তার সাথে বসিয়ে বসিয়ে ভাত খাওয়াবে, কোলে নিয়ে হাঁটবে, ঘুম পাড়িয়ে দেবে।
রিশা বলল,
-“যদি বাবু তোমার কোলে হিসু করে দেয়?”

নাবিল বলল,
-“বাবু আমার কোলে হিসু করবেনা। যদি করে, তাহলে আমি তোমার কোলে হিসু করে দেবো।”

-“যাব্বাবা, এখন সব দোষ আমার?”

পুষ্পর বাবা একমাত্র নাতিকে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছেন, কথা বলছেন। তিনি যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। নাতিকে কোলে নিয়ে মেয়ের কাছে যাচ্ছেন, আবার এমাথায় আসছেন। পুষ্প তাকিয়ে দেখলো তার বাবাকে। এখন আর আগের মতো বাবাকে এড়িয়ে চলেনা। কেউ সঠিক পথে আসতে চাইলে তাকে সুযোগ দেওয়া উচিত।
বাবু নিয়ে মাতামাতি করতে গিয়ে সবাই বাবুর ফিডিং করার কথা ভুলে বসলো। রাউফুন সাথে একজন নার্স নিয়ে এলো। সবাই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। রাউফুনের আর পুষ্পর মা রইলো নার্সের সাথে।

★★★

হসপিটালে শুধু রাউফুন রইলো। বাকীদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো পুষ্প। রাউফুন মা-ছেলের এই সুন্দর মুহূর্তটিকে ক্যামেরা বন্দী করলো।

জীবন বদলায়। কে জানে এমন সুখী মুহূর্তগুলো খুব বেশি আপন নয়। সুখের পরেই দুঃখ আসে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। হয়তো রাউফুন, পুষ্প কেউই জানেনা তাদের জীবনের আসন্ন বিপর্যয়ের কথা। অনাকাঙ্ক্ষিত বিপ’দ নাড়িয়ে দিতে পারে তাদের সুন্দর জীবনের ভিত।

#চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here