#কলা_পাতায়_বাঁধিব_ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৯

নিস্তব্ধ রজনীতে চাঁদের স্নিগ্ধ হাসি, জ্বলন্ত মিটিমিটি তারা প্রাণে ভীষণ ভালোলাগার সঞ্চার করে। সূর্য বিদায় নিয়ে পৃথিবী গাঢ় থেকে গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে যায়। কিন্তু আজকের রাতটি ভিন্ন, সে মোটেও অন্ধকারকে গ্রহন করেনি। আকাশের বুকে একফালি চাঁদ নিয়ে নিজেকে মোহনীয় রূপে সাজিয়েছে। এই রাতটি কারো জন্য নব্যপ্রেমের মতোই ভালোলাগার, আবার কারো কাছে এক বিষাক্ততার নিদর্শন। কেউ দুঃখের বালুকণায় পাহাড় বানাচ্ছে, কেউবা উষ্ণ শ্বাসে একটুকরো সুখ খুঁজে নিচ্ছে।

রাতের অনেকখানি সময় শশুর-জামাই গাড়িতে বসেই কাটালো।
পুষ্পর বাবা স্নিগ্ধ হেসে প্রথমে সংলাপ শুরু করলেন।
-“তুমি হয়তো ভাবছো এতোরাতে তোমার সাথে আমার কী কথা থাকতে পারে? কিংবা কথা বলার জন্য এই রাত আর গাড়িকেই কেনো বেছে নিলাম?”

রাউফুন ঠিক এই কথাগুলোই ভাবছিলো। তবে মুখে বলল,
-“ঠিক আছে, আপনি বলুন।”

মীর হোসেন গলা পরিষ্কার করে বলা শুরু করলেন,
-“আমি এই রাত আর গাড়িতে কথাগুলো বলা উপযুক্ত মনে করেছি নিজের কম্ফোর্ট এর জন্য। দিনে তোমার কাজ থাকে। রাত ছাড়া তোমাকে পাওয়ার উপায় নেই। তাছাড়া এই মুহূর্তে কথাগুলো গাড়িতে বলাই শ্রেয়, কারণ এখানে বললে তৃতীয় কারো কান পর্যন্ত পৌঁছাবেনা কথাগুলো।”

মীর হোসেন একটু থেমে ফের বলা শুরু করলেন,
-“আমার মেয়েটাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। যখন ওর জন্ম হলো তখন ওকে দেখেই আমার মনে প্রশ্ন জাগলো “এই ভীষণরকম ফুলের মতো দেখতে মেয়েটির নাম কী দেওয়া যায়?”
আমি ওর নাম দিলাম পুষ্প। ফুলের মতোই টকটকে, কোমল মেয়েটা আমার প্রাণ ছিলো। ধীরো ধীরে সময়ের গতি বাড়লো। আমি চাকরি সূত্রে তেমন বাড়ি আসার সুযোগ পেতামনা। তখন সুযোগ পেতামনা, আর এখন সমস্ত সুযোগ পেয়েও বাড়িতে আসিনা।

পুষ্প যখন একটু বড় হলো, নাবিলের মতো সবার সাথে পাকা পাকা কথা বলতো, তখন আমি এক নারীতে আসক্ত হয়ে পড়ি। দিন দুনিয়ে ভুলে ওই নারীর পেছনে ছোটা শুরু করলাম। ভুলে গেলাম আমার বাবা মা আছেন, স্ত্রী আছে, আমার ফুল আমার পুষ্প আছে। সত্য কোনোদিন গোপন থাকেনা। বাড়িতে সবাই ব্যাপারটা জেনে গেলো। পুষ্পর মা চুপচাপ হয়ে গেলো। প্রথম প্রথম না বুঝলেও পরবর্তীতে আমি নিজের ভুলটা বুঝতে পারি। ততদিনে বাড়ি থেকে খবর পেলাম পুষ্পর মা ছাদ থেকে প’ড়ে গিয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে ও কোনো লাভ হলোনা। সেদিন পুষ্পর মায়ের মৃ’ত্যু আমি মেনে নিতে পারলামনা।”

এতটুকু বলে থামতেই চমকে উঠলো রাউফুন। অকস্মাৎ এমন কিছু শুনবে ভাবতে পারেনি। চট করেই তার মস্তিষ্ক প্রশ্ন করলো,
-“তাহলে এখন যাকে পুষ্পর মা হিসেবে জানি তিনি কে?”

মীর হোসেন মাথা নিচু করে জবাব দিলেন,
-“আমার দ্বিতীয় স্ত্রী।”

রাউফুন ইতস্তত করে প্রশ্ন করলো,
-“কিছু মনে করবেন না। উনি কি সেই নারী?”

মীর হোসেন ত্বরিত গতিতে মাথা নেড়ে বললেন,
-“নাহ্! আমি আর ওই নারীর ছায়া মাড়াইনি। এখন যাকে পুষ্পর মা বলে জানো, তাকে বিয়ে করেছি পুষ্পর মায়ের অভাব দূর করার জন্য। চাকরির জন্য আমাকে কাছে পাবেনা, অন্তত মা বলেতো একজনকে পাবে। কিন্তু পুষ্প তাকে মেনে নিতে পারলোনা। নিজের মায়ের জায়গা অন্যকাউকে সে দিলোনা।”

রাউফুন একে একে হিসেব মেলালো। সেই জন্যই কি পুষ্পকে আর তার বর্তমান মাকে কখনো ঘনিষ্ঠ ভাবে কথা বলতে দেখা যায়নি?

পুষ্পর বাবা ফের বলা শুরু করলেন,
-“পুষ্পর মা মা’রা যাওয়ার পর আমি বাড়ি আসি। মেয়েটার কান্না আমার সহ্য হয়নি। নিজেকে অপরাধী মনে হতো। কে জানে হয়তো আমার দেওয়া ব্যথা সইতে না পেরে পুষ্পর মা নিজের জীবন নিজেই দিয়েছিলো। অপরাধবোধে আমি মেয়ের কাছে যেতামনা। পুষ্প দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁদতো। বড় ভাইয়ের বউ আর মা এসে কোলে তুলে ওর কান্না থামাতো। ধীরে ধীরে আমার আর পুষ্পর মাঝে দূরত্ব বাড়লো। মেয়েটা আমার সাথে স্বল্পভাষী হয়ে উঠলো, পরবর্তীতে একেবারেই এড়িয়ে চলতো।
সবার চাপাচাপিতে আমি দ্বিতীয়বার বিয়ে করলাম। পুষ্পর আরেকটা মা আসলো, নামেমাত্র মা। সে পুষ্পর আপন মা হয়ে উঠতে পারেনি। পুষ্প তার সঙ্গ পছন্দ করতোনা। ধীরে ধীরে পুষ্পর মা ও হাল ছেড়ে দিলো। নিজের মতো করে নিজেকে নিয়ে পড়ে রইলো। পুষ্পকে এতটাই ভালোবাসতাম যে দ্বিতীয়বার আর সন্তান নেওয়ার কথা ভাবিনি।
যখন আমার মনে হলো আমার মেয়েটার কাছে যাওয়া উচিত, এতদিন ভুল করে দূরে সরে রয়েছি। ততক্ষণে আমার আর আমার মেয়ের মাঝে যোজন-যোজন দূরত্ব।

আমি বাড়ি আসলে পুষ্প সবার সাথে বসে খেতে চায়না। আমাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে। তার ছোট্ট মনে যে বিশাল অভিমান বাসা বেঁধেছে। মেয়ের অবহেলা এখন আর নিতে পারিনা। তাই সুযোগ থাকলেও বাসায় আসতে চাইনা। তোমাদের বিয়েতে আসার কথা ছিলো আমার। সেদিন আসার পথেই একটা এক্সি’ডেন্ট হলো আমার। নিজের অসুস্থতা নিয়ে বিয়ে বাড়ির আমেজ নষ্ট করতে চাইনি। তাই বাড়িতে ফোন করে ব্যস্ততার বাহানা দিলাম। এই যে তোমার সামনে যদি কখনো পুষ্প আমার সাথে কথা বলে, তখন ভেবে নেবে সে পারিবারিক বিষয়গুলো সবাইকে জানাতে চায়না। নিজের ব্যথাগুলো নিজের ভেতরই পুষে রাখে। উপরে সবার সাথে স্বাভাবিক থাকতে চায়।

এখন থেকে আমার মেয়ের বর্তমান আর ভবিষ্যত তুমি। তোমাকে কথাগুলো বলার প্রয়োজন ছিলো। কারণ মেয়েটা আমার কাছ থেকে যে কষ্টগুলো পেয়েছে, আমি চাইনা একই কষ্ট তোমার থেকে পেয়ে পাথর হয়ে যাক। এই মুহূর্তে আমি তোমাকে ভীষণ ভরসা করছি। আশা রাখছি জীবনের সব রকম পরিস্থিতিতে আমার মেয়ের পাশে থাকবে।”

রাউফুন মীর হোসেনকে আস্বস্ত করে বলল,
-“আপনি চিন্তা করবেননা। আমি আছি ওর পাশে।”

মীর হোসেন প্রসন্ন হাসলেন। ঘড়িতে সময় দেখে বললেন,
-“তোমার অনেকটা সময় লস করেছি। এবার বাড়ি ফেরা যাক।”

এরপর দুজনই দুদিকে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে গাড়িতে চড়লো।
পুষ্প যখন আজ রাউফুনের রাগ ভাঙাতে এসেছিলো, তখনই রাউফুনের রাগ উধাও হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তার আরও একটু দেখতে ইচ্ছে করছিলো, তার বউ নামক প্রেমিকাটি তার জন্য কী কী পাগলামি করে।
পুষ্প যখন ওয়েটিং রুমে বসেছিলো, তখন তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার কারণ ছিলো বটে। পুষ্প যদি একবার তাকে বের করে নিয়ে যেতে পারতো, তবে সেখানেই তার মিথ্যে রাগটাও পানি হয়ে যেতো। সেজন্যই আয়োজন করে পুষ্পকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো।

অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় এখন আর পুষ্পকে কল দিলোনা। ভেবে রাখলো আগামীকাল কাজ শেষে রাতে বউকে নিয়ে বের হবে। তাকে সারপ্রাইজ দেবে। আজ ঘুমাতে চলে গেলো।

★★★

নাস্তা শেষ করে হসপিটালের জন্য তৈরী হয়ে বাসা থেকে বের হলো রাউফুন। আজ সবাইকে কেমন ব্যস্ত দেখালো। সে অতো ভাবলোনা। এখন মূল কাজ হচ্ছে হসপিটাল যাওয়া, রোগী দেখা। পরিশেষে বউকে নিয়ে ঘুরতে বের হওয়া।

★★★

পুষ্পর মেজাজ আজ বেশ ফুরফুরে। ভার্সিটি যাওয়ার ও চিন্তা নেই। বন্ধু গুলো সব খাওয়াদাওয়ার জন্য সকাল সকাল উঠে বসেছে তার বাড়িতে।
ইমরান পেটে হাত বুলিয়ে বলল,
-“ভুটকি, তুই নিজেই খেয়ে খেয়ে আটার বস্তা, চালের বস্তা হয়ে যাবি? আমাদের কিছু খাবার দে। ক্ষুধায় পেট চৌচির হয়ে যাচ্ছে।”

পুষ্প কটমট করে বলল,
-“আলুর বস্তা সাদ্দাম, আটা চাউলের একদাম।
আর কত খাবি? নিজের দিকেও তাকা, আমার দিকেও তাকা। কোন দিক থেকে আমাকে আটার বস্তা মনে হয়?”

রিয়াদ বলল,
-“শা’লা সারাদিন খাই খাই করে। এবার খাওয়া একটু কমা। তোর এই হাতির মতো শরীর দেখলে বউ বাপ বাপ করে পালাবে।”

ইমরান পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
-“মাগোওওও দুইটা ভাত দেও, কতডা দিন খাইনা আমি।”

জুঁই একটা বালিশ ছুঁড়ে বলল,
-“এই ড্রামের পেট ফুটো করলে খাবার ছাড়া কিছু পাওয়া যাবেনা।”

ইমরান বিজ্ঞদের মতো বলল,
-“নো। শুধু খাবার নয়, সাথে গু ও পাবি।”

প্রিয়া নাকমুখ কুঁচকে বলল,
-“এই হা’লার বলদরে বাথরুমের ট্যাঙ্কিকে আধাঘন্টা চুবিয়ে রাখ। গু খেয়ে পেট ভরাক।”

ইমরান কবিতা বানালো,

ওগো প্রিয়া,
তোমারে দেখি আমি
চোক্ষু মেলিয়া, মেলিয়া।
তুমি আমার জানের জান
বাকী সব থু,
চলো দুজনে মিলিয়া
ভক্ষণ করি গু।

সবাই হো হো করে হেসে গড়াগড়ি খেলো। প্রিয়া কটমট করে বলল,
-“হা’লা ভন্ড, তুই গু খাবি খা। সাথে আমাকে নিমন্ত্রণ জানাস কেন?”

ইমরান আবার ও গানের সুরে বলল,
সাদা-সাদা, কালা-কালা
রং জমেছে সাদা-কালা,
তুমি বন্ধু মেকাপ মাখো,
আমি বলি ছিঃ!
শেষে মনে প্রশ্ন জাগে,
গুয়ের কালার কী?”

পুষ্প হেসে কুটিকুটি। সব পাগলের দেখা তার সাথে। বন্ধুরা এক পাগল, বর আরেক পাগল। হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করে পুষ্প বলল,
-“ভাই তোরা এবার থাম। আমি আর হাসতে পারছিনা। ইমরান তুই বাইরে যা। মা, চাচি কাউকে বললেই তোর ড্রাম ভর্তি করে দেবে।”

★★★

হসপিটাল থেকে বেরিয়ে বউকে সারপ্রাইজ দিতে রাউফুন সোজা শশুর বাড়িতে গেলো। সেখানে গিয়ে হতাশ হলো। তার বউ নাকি তার নানাশশুর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে। কি আশ্চর্য! বরের মান ভাঙাতে না পেরে একেবারে নানার বাড়ি গিয়ে উঠতে হবে নাকি?
নাহ্ এবার দেখছি একটা সাংঘাতিক ধোলাই দিতে হবে।
রাউফুন মলিন চেহারা নিয়েই বাড়ি ফিরলো। রাতের খাবার খেয়ে ঘরে ফিরতেই সে সারপ্রাইজড হলো। প্রচন্ড শকে তার মুখের বুলি উড়ে গেলো।

#চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here