#কলা_পাতায়_বাঁধিব_ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৩

পুষ্পর উপন্যাসের বই পড়ার নেশা হলেও একাডেমিক বই গুলো তেমন ছুঁয়ে দেখা হয়না। আজ একাডেমি বই নিয়েই বসলো। পড়তে পড়তেই বসার ঘর থেকে সোরগোলের শব্দ ভেসে আসলো। সবার সাথে রাউফুনের ভারী কন্ঠস্বর চিনতে অসুবিধে হলোনা পুষ্পর। লজ্জায় তার মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে। রাউফুনের এত আসা যাওয়াতে সবাই কি ভাববে? সে কি এখনও একবারও শশুর বাড়ি গিয়েছে? অথচ বিয়ের পর এ নিয়ে দুবার শশুর বাড়ী আসলো রাউফুন। পুষ্পর আর পড়ায় মন বসলোনা। ঘরেই পায়চারি করলো কিছুক্ষণ।

রোগী দেখা শেষ করেই রাউফুন এখানে চলে এসেছে। একটিবারও পুষ্পর কথা জিজ্ঞেস করেনি। ভাবখানা এমন, যেন সে পুষ্পকে চেনেই না। এবাড়িতে এমনিতেই আসা। অথচ ভেতরে ভেতরে লাফিয়ে ওঠা হৃদযন্ত্রটাকে চেপে ধরে বলছে ‘ভাই একটু থাম, আর একটু! আর একটু অপেক্ষা কর’। রাউফুন মনে মনে সবার উপর রাগ হলো। কি আশ্চর্য! কেউ একবারও তাকে পুষ্পর ঘরে যেতে বললোনা কিংবা পুষ্পকে ডেকে দিলোনা।
অথচ কেউ এতটা ফর্মালিটির আশায় বসে নেই। সবাই ভাবছে বাড়ির জামাই যখন ইচ্ছে আসবে, যখন ইচ্ছে তার বউয়ের সাথে দেখা করবে।
এদিকে আতঙ্ক বাড়াতে নাবিল এসে হাজির। এই কৌতুহলের বাচ্চাকে বিশ্বাস নেই। কখন কৌতুহলের জোরে উল্টোপাল্টা কিছু জানতে চায়। সে এসেই দুলাভাইয়া বলে গলায় ঝুলে পড়েছে।
খাবার সময়ে পুষ্পর সাথে দেখা হলেও কথা হলোনা। গোলাপি রঙের থ্রিপিসে পুষ্পকে বড্ড মানিয়েছে। খাবার শেষে পুষ্পর সাথে কথা হলো। তার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-“এখানে তোমার হাত খরচের টাকা আছে। এখন থেকে এই দায়িত্বটা ও আমার। আজ আসি।”

পুষ্পকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলোনা রাউফুন। বেরিয়ে পড়লো। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হলো। সবাই থাকার জন্য আজ জোরাজোরি করলেও রাউফুন থাকলোনা। যেকাজে এসেছে সেটা শেষ। এখন এখানে থেকে লাভ নেই বরং বাড়তি বিপদ। রাউফুন বাসায় ফিরে গেলো।

মাঝখানে সপ্তাহখানেক সময় পেরুলো। রাউফুন আর আসলোনা। সে হুটহাট গুম হয়ে যায় আবার বিনা বার্তায় হাজির হয়ে যায়। আজ আবার রাউফুনের নাম্বার থেকে কল আসলো। এবার আর নাম্বারটি আনসেইভ নয় বরং ‘ডাক্তার’ দিয়ে সেইভ করা ছিলো। সালাম দিয়েই দুজনে কথা শুরু করলো।

পুষ্পর এলার্জি বেড়ে হাঁচি শুরু হয়েছে। একের পর এক হাঁচির চোটে কথা বলতে পারছেনা।
রাউফুনের দুশ্চিন্তা হলো। পুষ্পকে কিছু উপদেশ দিয়ে বলল ঠিকমতো ঔষধ নিতে। পুষ্প কথা বাড়ালোনা। রাউফুন নিজ থেকেই কল কে’টে দিলো। তার আগে বলল,
-“ঔষধ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”

পুষ্প তাই করলো। ঔষধ নিয়েই শুয়ে পড়লো। সকালে উঠলো বেশ দেরি করে। ভার্সিটি গেলোনা। আজ বসার ঘরে আপনাআপনি চোখ গেলো। সে ভেবেছিলো রাউফুন হয়তো প্রথমবার ওর জ্বরের কথা শুনে যেভাবে এসেছিলো, সেভাবে আজও আসবে। কিন্তু নাহ্! তাকে ভুল প্রমাণিত করতেই বোধহয় রাউফুন এলোনা। নাস্তা করে নাবিলকে নিয়ে বসে পড়লো পুষ্প। সে ঘুরে ঘুরে একশটা প্রশ্ন করছে আর পুষ্প উত্তর দিচ্ছে। এবার আসলো রাউফুনের প্রসঙ্গে। বলল,

-“আপু দুলাভাইয়া আসেনা কেনো?”

পুষ্প নিচের ঠোঁট বের করে বলল,
-“সেটা তো জানিনা। তোমার দুলাভাইয়া আসেনা কেনো?”

নাবিল বলল,
-“এবার আসলে দুলাভাইয়ার ঘাড় থেকে নামবোনা। জানো? দুলাভাইয়া আমাকে কৌতুহলের বাচ্চা বলে।”

পুষ্প বিড়বিড় করে বলল,
-“এর চাইতে ভালো নাম আর তোর সাথে যায়না। সব কিছুতেই তোর কৌতুহল।”

নাবিল পুষ্পর গালে হাত দিয়ে বলল,
-“তুমি কি বলো? আমি শুনতে পাচ্ছিনা কেনো?”

পুষ্প মিষ্টি হেসে বলল,
-“বলছিলাম তোর মতো মিষ্টি বাচ্চাকে কেনো এই নামে ডাকলো? এটা কি তোর সাথে যায়?”

নাবিল এবার মিষ্টি নিয়ে পড়লো।
-“আমাদের বাসায় কি মিষ্টি আছে? আচ্ছা মিষ্টি কি দিয়ে বানায়? কেনো বানায়?”

পুষ্প এবার উঠে পড়লো। এবার এই ছেলে হাজারটা প্রশ্ন শুরু করবে। রেহানা খালা এসে হেলেদুলে জিজ্ঞেস করলো,
-“আম্মাজান, জামাই বাবা আসেনা কেন? তুমি কি আইতে না মানা করছো?”

পুষ্প তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে জবাব দিলো,
-“আশ্চর্য! আমি কেনো না করবো?”

রেহানা খালা মুখ ভেটকি দিয়ে চলে গেলেন। তিনি সেদিন শুনেছেন পুষ্প রাউফুনকে জিজ্ঞেস করলো,”আপনি এখন কেনো এসেছেন?”
এখন আবার সাধু সাজার চেষ্টা করে।
আমার জামাই যদি আমার জন্য এত মায়া দেখাইতো তয় সারাদিন তারে নিয়াই বইসা থাকতাম। অথচ এরা গুরুত্ব পায় বইলা অবহেলা দেয়। রেহানা খালা পুষ্পকে ভালোবাসেন কথাটি ঠিক, তেমনি তার সব কাজ যে ঠিক আর পছন্দ করতে হবে এমনটা নয়।

পুষ্পর অসুস্থতার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় তার মা তার ছোট চাচাকে বলল,
-“একবার পুষ্পকে হাসপাতালে নিয়ে যেও তো। জামাইকে দেখিয়ে আসবে। এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। বাড়ির কোনো মানুষ অসুস্থ হলে ভালোলাগেনা।”

নাবিলের বাবা জোর করেই পুষ্পকে নিয়ে গেলো হাসপাতালে। তবে পুষ্প শর্ত জুড়ে দিলো।
-“আমি ডঃ এর স্ত্রী বলে কোনো এডভান্টেজ নেবোনা। সবাই যেমন অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে ডঃ দেখায়, আমিও তেমনি দেখাবো।”

ছোট চাচা বেশ সুবিধা করতে পারলেননা পুষ্পর সাথে। অগত্যা তাকে পুষ্পর শর্ত মেনে নিতে হলো। অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েই রাউফুনের চেম্বারে ঢুকলো। রাউফুন আগে থেকেই অবগত ছিলো তার বউ তার কাছে চিকিৎসা নিতে আসছে। অপেক্ষা করার পর পুষ্পর সিরিয়াল আসলো। সাথে নাবিলের বাবা ও প্রবেশ করলেন। পুষ্পকে বসিয়ে দিয়ে তিনি বাইরে চলে গেলেন। হাসপাতালের কাছেই উনার একজন বন্ধু আছেন। তার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।

রাউফুন বলল,
-“তুমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসতে গেলে কেনো? তুমি যখন তখন এসেই এখানে প্রবেশ করতে পারো। এত কষ্ট করার কি দরকার ছিলো?”

পুষ্প বলল,
-“অন্য ডাঃ দেখালেও আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হতো। নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক থাকলেই কি এডভান্টেজ নিতে হবে?”

রাউফুন নিঃশব্দে হাসলো। পুষ্পর থুতনিতে হাত রেখে নাকের ভেতর আলো দিয়ে পজিশন দেখার চেষ্টা করলো। এমন সময় আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে পুষ্পর হাঁচি আসলো। রাউফুনের হাতের আলো জ্বালানো যন্ত্রটা নিচে পড়ে গেলো ধপ করে। সে সকৌতুকে বলল,
-“তোমার হাঁচির বেশ জোর আছে দেখছি। কোনদিন আবার হাঁচি দিয়ে আমাকে উড়িয়ে ফেলো।”

লজ্জা পেয়ে হেসে দিলো পুষ্প। হাঁচি আসার আর সময় পেলোনা।
রাউফুন রগড় করে বলল,
-“বিয়ের পর আজ প্রথম বোধহয় একটু হাসলে।”

পুষ্প কিছু বললোনা। রাউফুন ফের নিজের কাজে মগ্ন হলো। নাক দেখে কিছু ঔষধ লিখে দিলো। পুষ্পকে বসিয়ে রেখেই পরপর আরও কয়েকটা রোগী দেখলো। এদিকে পুষ্পর চাচা আসার খবর নেই।
এবার রোগী হচ্ছে একটা বাচ্চা ছেলে। যার কানের পর্দা পঁচে গিয়ে দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে। অপারেশন লাগবে। তবে অপারেশনের জন্য বাচ্চাটা এখনো উপযুক্ত নয়। আরেকটু বয়স বাড়তে হবে। বাচ্চাটা যন্ত্রপাতিগুলো ঘাঁটছে আর রাউফুন বাচ্চার মা বাবার সাথে কথা বলছে। বাচ্চাটির বাবা একটা ধমক দিলো বাচ্চাকে।
রাউফুন বলল,
-“বাচ্চাদের বুঝিয়ে বলুন। অযথা ধমক দেয়া, মা’রধর করা উচিত নয়। এতে তাদের উপর মানসিক চাপ পড়ে।”

এর মাঝেই বাচ্চাটি বলল,
-“আম্মু আমাকে প্রায়ই মা’রে। আবার আব্বুকেও মা’রে। আচ্ছা আম্মুর মতো আপনার বউ ও কি আপনাকে মা’রে?”

পুষ্প ঠোঁট টিপে হাসলো। রাউফুন সেটা লক্ষ্য করে পুষ্পকে দেখিয়ে বলল,
-“তুমিই নাহয় জিজ্ঞেস করে নাও। সে আমাকে মা’রে কিনা?”

বাচ্চাটি সেটাই করলো,
-“বলল তুমিকে ডাক্তারকে মা’রো?”

পুষ্প ইনোসেন্ট ফেস করে বলল,
-“একদমই না। আমি কি পঁচা? তাহলে কেনো ডাঃ কে মা’রবো?”

বাচ্চাটি বলল,
-“তাহলে কি আমার আম্মু পঁচা?”

তাদের আর কথা বলার সুযোগ হলোনা। বাচ্চাটিকে নিয়ে তার বাবা মা বেরিয়ে গেলো। পুষ্প আড়মোড়া ভেঙে বলল,
-“সারাদিন বসে বসে রোগী দেখেন। আপনার একঘেয়েমি লাগেনা?”

রাউফুনের বলতে ইচ্ছে করলো ‘তুমি ছিলে বলে আমার একটুও একঘেয়েমি আসেনি। তুমি কি প্রতিদিন আমার চেম্বারে এসে বসে থাকবে?’
কিন্তু মুখে বলল অন্য কথা। চমৎকার এক হাসি দিয়ে বলল,
-“আমার একঘেয়েমি আসেনি। নিজে বেছে এই প্রফেশনে এসেছি। তুমি কি খাবে? ঠান্ডা টোটালি অফ।”

পুষ্প মাথা নেড়ে বলল,
-“আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছেনা।”

ততক্ষণে পুষ্পর ফোন বেজে উঠলো। চাচার ফোন। তিনি বললেন,
-“তুই নিচে নেমে আয়। আমি হসপিটালের সামনে আছি।”

রাউফুনকে বলে পুষ্প বের হতে যাচ্ছিলো। সে বাঁধা দিয়ে বলল,
-“তুমি কি একা যেতে পারবে? দাঁড়াও আমি আসছি। যদি ছেলে ধরা এসে নিয়ে যায়?”

এবার পুষ্পর শরীর কাঁপিয়ে হাসি আসলেও তা চেপে গেলো। রাউফুন যে তার সাথে ঠাট্টা করছে এটা তার মিটিমিটি হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। লিফট পর্যন্ত এসে ভেতরে কয়েকজন পুরুষকে দেখা গেলো। তাই পুষ্পকে একা ছাড়লোনা রাউফুন। নিজে সহ ভেতরে ঢুকলো। পুষ্পকে একপাশে রেখে তাকে প্রটেকশন দিয়ে দাঁড়ালো। নিচে চাচা অপেক্ষা করছেন। লিফট থেকে বের হওয়ার সময় রাউফুন বলল,
-“পুষ্প মাঝেমধ্যে সময় বের করেই আমার চেম্বারে চলে এসোতো? সবসময় তোমাকেই কেনো চিকিৎসা দেবো? মাঝেমধ্যে তুমি ও নাহয় আমাকে চিকিৎসা দিয়ে যেও।”

পুষ্প কিছু না বলে কিছুদূর সামনে এগিয়ে গেলো। আপনাআপনি তার অধরকোনে হাসি ফুটলো।

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here