#ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব ১২
গোধূলী বেলা। আমার আর মামনির একটা প্রিয় সময়। এসময়টা একান্ত আমাদের। সকল কাজ থেকে ছুটি নিয়ে আমি আর মামনি গল্প করতে বসি। সারাদিনের সমস্ত কথা শেয়ার করি একে অপরের সাথে। আর আমাদের সঙ্গি হয় দু কাপ গরম চা। চায়ের অভ্যাস মামনির থাকলেও আমার ছিল না। তবে ইদানিং মামনির পাল্লায় পড়ে অভ্যাসটা আমারও হয়েছে। মামনির রুমের বারান্দায় বসে ব্যস্ত পাখিদের নীড়ে ফেরা দেখতে দেখতে চাপের কাপে এক চুমুক দিয়ে মামনি বলল,
“কথা হয়েছে ওর সাথে? ”
“না, মামনি। ”
“এতটা রাগ কেন করলো? কি করেছিস সত্যি করে বল তো?”
“মামনি তুৃমিও। ”
এমন সময় মামনির ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রিনে কাঙ্ক্ষিত মানুষটার নাম্বার দেখে বুক কেঁপে উঠে। মামনি মৃদু হেসে ফোনটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“যা কথা বলে আয়।”
আমিও আর কিছু না বলে ফোন নিয়ে আমাদের রুমে চলে আসি। রিসিভ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো মানুষটার ক্লান্ত মুখটি। আমাকে দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। আমি বলে উঠলাম,
“আর কতদিন রাগ করে থাকবা? দুদিন তো হলো। এবার তো কথা বলো।”
“দেখ প্রিয়তা, ফোনটা মাকে দে। তুই কেন ফোনটা রিসিভ করেছিস? মা কই?”
“ঠিক আছে দিচ্ছি আমি। আর ফোন দিবে না আমাকে। কখনোই না।”
বলে ফোন কাটতে নিলেই ও পাশ থেকে প্রিয়ক বলল,
“সাহস বেশি হয়ছে তাই না। এবার আসি। দেখবো কোথায় আছে এতো সাহস? ”
আমি শুধু মৃদু হাসলাম। প্রিয়ক তা দেখে বলল,
“একদম হাসবি না। জানে মে*রে ফেলব।”
আমি হাসি চেপে রেখে বললাম,
“আসছো কবে?”
“খুব শীগ্রই। কলেজে গিয়েছিলি? ক্লাস কেমন চলছে?”
“গিয়েছিলাম। আর সামনের মাসে এক্সাম। ”
“চিন্তা করিস না। তার আগেই চলে আসবো। ”
এরপর বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে নিচে মামনির কাছে চলে আসি। ততক্ষণে মামনি রাতের রান্নার ব্যবস্থা করছে। আমিও কিচেনে যেয়ে মামনিকে সাহায্য করতে লাগলাম। গল্প কথায় রাতের রান্না শেষ করে ফ্রেস হয়ে পুনমকে পড়াতে বসি আমি। পুনমকে পড়ানো শেষ হলে রাতের খাবার সবাই একসাথে খেয়ে যে যার রুমে চলে যায়। একসময় প্রকৃতিতে নেমে আসে নিরবতা।
এতগুলো বছর ধরে যে দিনটার অপেক্ষায় থেকেছি, প্রতিটি প্রহর গুনেছি আজ সেই অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটেছে। ছোট পুতুলটাকে আজ কনের সাজে সজ্জিত করা হয়েছে। কনের সাজে কাউকে এতোটা মোহময়ী লাগে তা আগে জানা ছিল না আমার। মনে হচ্ছিল চোখের পলকে পুতুলটা বড় হয়ে গিয়েছে৷ কাজল কালো আখিতে যেন ভর করেছে রাজ্যের সব মায়া। এই মায়ার সাগরের অতল গহ্বরে প্রতিনিয়তই নিমজ্জিত হচ্ছি আমি। এতটা মায়া কি আসলেই থাকতে আছে কারো? না নেই৷ তবে তা আমার প্রেয়সীর আছে৷ পুরোটাই মায়ায় জড়ানো আমার প্রেয়সী। যাকে ভালোবেসে মরতেও রাজি আমি। তার মিষ্টি কন্ঠে যখন তিন অক্ষরের একটি শব্দ পরপর তিনবার উচ্চারিত হল তখন মনে হচ্ছিল আমার ভালোবাসা সার্থক। আমার প্রেয়সী শুধুই আমার। ছোট পুতুলটা সারা জীবন আমার বুকের মাঝে নিজেকে লুকিয়ে রাখবে। আর আমি তাকে আগলে রাখবো সারাজীবন। তার মায়াভরা আঁখিতে পেতে দেব না কোনো কষ্টের ছোয়া। পৃথিবীর সমস্ত সুখ তাকে এনে দিতে না পারলেও তার ভাগ্যের সবটুকু সুখ তাকে দিবো। আমি আর কিছু চাই না। শুধু আমার প্রেয়সীকে বলতে চাই, ‘#ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি’। একবার নয়, বারবার। হাজার বার।
গভীর রাত। প্রতিটা মানুষ ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালেও কিছু রাতজাগা পাখির মতো জেগে আছি আমিও। আর আমার সঙ্গি প্রিয়কের ডায়েরি। ডায়েরীর প্রতিটা পাতায় রয়েছে আমার প্রতি তার সমস্ত অনুভুতি। এই ডায়েরী পড়েই জেনেছিলাম প্রিয়কের সেদিনের বলা কথাগুলো মিথ্যা। আমার বিয়ে ভাঙার যে কারন প্রিয়ক আমাকে এবং বাকিদের বলেছিল তা ছিল অসম্পূর্ণ। কিছুটা সত্য থাকলেও বেশিরভাগটাই ছিল মিথ্যা। এই ডায়েরীরই একটা পাতায় খুব সুন্দর করে লেখা ছিল দুবছর আগের সেই রাতের কথা।
“জানিস প্রজাপতি। আজ একটা মজার ব্যাপার হয়েছে। তোকে সবসময় যে পুতুলটার গল্প বলি সেই পুতুলটার নাকি বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। অথচ আমি জানিই না। এই এটা ভাবিস না আমার সাথে হয়েছে। অন্য কারো সাথে হয়েছে। যেই পুতুলটাকে ছোট থেকে ভালোবেসে আসলাম, সেই পুতুলটা নাকি অন্যকারো বুকের মাঝে নিজের লজ্জা লুকাবে? ভাবতে পারছিস? যাকে নিয়ে হাজারও স্বপ্ন সাজিয়েছি আমি, সে আমার স্বপ্ন ভেঙে অন্যকারোর স্বপ্নচারিনী হবে। বুঝতেই পারলাম না কবে পুতুলটা এতো বড় হয়ে গেল যে তাকে আমার কাছ থেকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমার ভালোবাসার মানুষটার উপর আমার আর কোনো অধিকার থাকবে না৷ তার উপর নাকি অন্য কারো অধিকার থাকবে। এই প্রজাপতি, এমনটা হলে আমি বাঁচবো কী করে বলতে পারিস? ওকে ছাড়া নিঃশ্বাস নিবো কি করে? আমার তো এখনি এসব ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে৷ কি করে সইবো ওকে অন্য কারো সাথে? বল না রে প্রজাপতি। তুই কেন কথা বলতে পারিস না হ্যা৷ তাহলে ওকে বলত পারতিস। জানিস পাগলীটা কখনই নিজের বাবা মায়ের অবাধ্য হয় না। আচ্ছা যদি পাগলীটা জানে যে তার প্রিয়ক ভাইয়া তাকে কতটা ভালোবাসে, কতটা পাগল তার জন্য তাহলে কি সে তার বাবা মায়ের অবাধ্য হবে? আমি না আর কিছু ভাবতে পারছি না। আচ্ছা যদি পাগলীটা অন্য কারোরই হবে তাহলে আমার মনে এতটা জায়গা কেন দখল করে নিলো? কেন নিলো কেন?”
নিজের অজান্তেই চোখের কোনে এসে ভীর করে কিছু নোনাপানি। কয়েক ফোঁটা চোখের কোণ বেয়ে ঝরে পড়ে। এটা ওই দিন লেখা যেদিন প্রিয়ক আমার বিয়ের কথা জেনেছিল। ঠিক কতটা ভালোবাসতো আমাকে তা হয়তো সে নিজেও জানতো না। কতটা কষ্ট পেয়েছিল তা একমাত্র সে আর সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত অন্য কেউ হয়তো জানতেও পারেনি। কিন্তু এখন বুজতে পারি তার ভালোবাসার গভীরতা। তবে তাকে হারিয়ে নয়, বরং পেয়ে বুঝেছি। না সেদিন আমাদের বিয়ে ভাঙে নি। ভাঙতে দেয়নি প্রিয়ক। তবে সেদিনের পর থেকে দুবাড়ির সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। বাবা মায়ের সাথে খুব কম কথা হয় আমার। বাবার প্রতি অভিমানের পাহাড় জন্ম নিয়েছে মনের মাঝে। বাবানামক ব্যক্তিটার কাছে কখনই প্রিয় ছিলাম না আমি। বাবা সবসময় চাইতেন তার একটা ছেলে হোক। কিন্তু জন্ম নিলাম আমি। আমার জন্মের পর বাবা নাকি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু আমার জন্মের পর পাঁচটি বছর কেটে যাওয়ার পরও যখন আম্মি আর কনসিভ করলেন না তখন বাবার চিন্তা হয়। আম্মিকে ডাক্তার দেখালে জানা যায় আম্মি আর কখনই সন্তান ধারন করতে পারবেন না। তখন জানা আমাকে জন্ম দেওয়ার সময় মায়ের অসুস্থতার আরো একটি কারন ছিল আম্মি তার পরবর্তী সন্তান ধারনের ক্ষমতা হারিয়েছিল। সেই থেকেই বাবার রাগ আমার আর মায়ের উপর। ছোট থেকেই দেখতাম বাবা মায়ের মনোমালিন্য। তবে তা কেন তখন বুঝতে না পারলেও এখন জানি। আমার প্রতি বাধ্য হয়ে যতটা ভালোবাসা যাই ততটাই বাসতেন তিনি। সবার সামনে বাবার ব্যক্তিত্ব ছিল কঠোর। যার ফলে কেউ কিছু বলার সাহস পেত না। শুধু বাবা নয়, আমার বড় চাচ্চুও কঠোর প্রকৃতির মানুষ৷ ছোট চাচ্চুই কেবল নরম মনের। যার ফলে বাবা বা বড় চাচ্চুর কথার পিঠে কেউ কথা বলতে সাহস পেত না। আমাকে করা অবহেলা সবার চোখে পড়লেও তারা ভাবত বাবা তো এমনি। তাই খুব বেশি কিছু মনে করতেন না।
বাবা তার বন্ধুর ছেলে রায়ানের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছিল ও শুধুমাত্র নিজের স্বার্থের জন্য। উনারা শুধু যে বন্ধু ছিল তা নয়, বরং ছিল ব্যবসায়ের অংশীদার। যার ফলস্বরূপ বড় একটা প্রোজেক্ট পেতে চলেছিল বাবা। সেটাও আমার আর রায়ানের বিয়ের মাধ্যমে। তাই তো সবকিছু ঠিক করার পর বাবা বাসায় জানায়। আম্মিকে কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত দেন নি। আর পরিবারের বাকিরাও বাবার উপর কথা বলেন না, তাই তারাও মত দিয়ে দেয়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পরই রায়ানের সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রিয়কের কারনে তা হয়নি। ওই মিথ্যা বদনামে তারা ভেঙে দেয় তাদের ছেলের সাথে আমার বিয়ে। তারা কোনো ধর্ষিতা মেয়েকে নিজের বাড়ির বউ করতে রাজি না। ফলে বাবার কাছ থেকেও প্রোজেক্টটা হাতছাড়া হয়ে যায়। বাবার সাথে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে দেয় তারা। যার ফলস্বরূপ বিশাল বড় ক্ষতি হয় আমাদের ব্যবসায়ের। যার জন্য বাবার রাগ আমার উপর আরো বেড়ে যায়। তাই তো সেদিন বাবা আমার গায়ে হাত পর্যন্ত উঠিয়েছিল। আমার জন্য সব হারানোই আমার একটি কথাও সেদিন তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। আর যখন জানতে পারল এতকিছু হয়েছিল প্রিয়কের জন্য। তখন আমার উপর জমানো সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল প্রিয়কের উপর। তাই সেদিন সবটা জানার পর পুরোনো সমস্ত ক্ষতির কারন প্রিয়ককে করে তা থেকেই আমাদের ডিভোর্স। মা এক্ষেত্রে বাঁধা দিলে অত্যন্ত কঠোর কন্ঠে বাবা আম্মিকে বলেছিল,
“হয় ওদের ডিভোর্স হবে এবং তোমার মেয়ে তোমার কোলে থাকবে। নয়তো তোমাকে আমি তালাক দেবো আর তোমার মেয়েকে মে*রে ফেলবো। আর তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি যা বলি তাই করি। তোমার ওই মেয়েকে মারতে আমার হাত একটুও কাঁপবে না। তাই যেকোনো একটা বেঁচে নেও।”
আর এটা সত্যি। বাবার আমাকে মা’র’তে খুব বেশি কষ্ট হতো না। খুব বেশি কেন হয়তো একটুও হতো না। কারন শুনেছিলাম আমার জন্মের আগে আম্মি আরো একবার কনসিভ করেছিল। কিন্তু আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে যখন জানতে পারে সেটা মেয়ে ছিল, তখন বাবা আম্মিকে জোর করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে এবোর্শন করিয়ে এনেছিল। তাছাড়া বাবার নির্মমতার শিকার আরো একজন হয়েছিল। সে হলো আমার ছোট ফুফি। তাকে দেখেনি আমি। এবাড়িতে আসার পর মামনির কাছে শুনেছিলাম, ছোট ফুফি আমাদের এলাকার একটি ছেলেকে ভালোবাসত। কিন্তু আমার দাদা ছোট ফুফির বিয়ে অন্যত্র ঠিক করে। তাতে ছোট ফুফি রাজি হয় না। এবং সবাইকে তার পছন্দের কথা জানায়। রাগে ফেটে পড়ে আমার দাদা, বড়চাচ্চু আর বাবা। নিজের সম্মান রক্ষা করতে ফুফিকে মে*রে ফেলে। খুবই নির্মম মৃত্যু হয়েছিল ফুফির। অথচ সবাই জানে ফুফি দূর্ঘটনায় মা*রা গিয়েছে। সেটা বাড়ির বড়রা জানলেও জানা ছিল না আমাদের। তাই আম্মির ভয় ছিল সত্যিই যদি আমাকে মে*রে ফেলে। সে জন্য বাধ্য হয়েই আম্মি আমাকে দিয়ে ডিভোর্সের কথা বলায়। নিজের সংসার বাঁচাতে নয়, বরং আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে মায়ের কঠিন রুপ ছিল আমার প্রতি।
.
.
চলবে..??