একা_বেঁচে_থাকতে_শেখো_প্রিয়
#পর্ব_১০
#Adharer_Musafir (ইফ্ফাত)
#
রক্তিম আকাশের নিচে ছাঁদের কার্ণিশে এসে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যের আলো আঁধারের খেলায় যখন আমি মনের জমানো সব আবেগ বিসর্জন দিতে ব্যস্ত, তখনই ছাঁদে কোনো মানবের অস্তিত্ত অনুভব করি।
মনে হচ্ছে কেউ একজন খুব ধিরে ধিরে পা ফেলে আমার কাছে আসার চেষ্টায় মনোযোগী।
যদিও ব্যস্ত শহর, তবুও সন্ধ্যে নামার পরের একটা ক্ষীণ ভয় মনে এসে ক্ষনিকের জন্য বাসা বাঁধলো।
দ্রুত ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য আমি চমকে উঠলাম।
যাকে আশা করেছিলাম সে তো নয় বরং যাকে দেখলেই অস্বস্তি হয় স্বয়ং সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে।

রাফি ভাইয়া আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন পাক্কা পাঁচ মিনিট হবে।
উনি আমার পাশে থাকলে আমার বরাবরই কেমন অস্বস্তি হয়; এখনও এর ব্যতিক্রম কিছু হচ্ছে না।
উনার উপস্থিতিতে আমি আমার আকাশ দেখায় খুব একটা মন দিতে পারছি না।
অথচ উনি দিব্যি দাঁড়িয়ে আছেন।
কিছু একটা বলার জন্য খুব উশ খুশ করছেন উনি।
আড় চোখে একবার উনার দিকে তাকিয়ে নিলাম আমি।
উনার কোনো নড়চর নেই, আজকে বোধয়হ পন করে এসেছেন এখান থেকে উনি নড়বেন না।
কি আর করা, বাধ্য হয়ে আমি চলে আসার প্রস্তুতি নেবো ঠিক তখনই উনি আমার হাত ধরে বসলেন।

খুব অবাক হয়ে আমি একবার রাফি ভাইয়ার দিকে তাকাচ্ছি আরেকবার উনার হাতের দিকে।
কিছু যদি বলারই থাকে তবে বললেই তো হয়, হাত ধরার তো আমি কোনো কারনই দেখছি না।
আমাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাফি ভাইয়া আমার হাত ছেড়ে দিলেন।
আমি কিছু বলার আগেই উনি বললেন–

— উপ..উপমা তোমাকে আমার কিছু বলার ছিলো।

যদিও এই মুহূর্তে আমার কোনো তাড়া নেই, কিন্তু উনার কোনো কথা শুনতে আমার মোটেও ইচ্ছে করছে না।
অস্বস্তি নিয়েই বললাম–

হ্যাঁ বলুন কি বলবেন, একটু জলদি বলুন আসলে সন্ধ্যে হয়ে গেছে আমাকে নিচে যেতে হবে।

উনি কিছুক্ষন চুপ থেকে নড়েচড়ে দাঁড়ালেন।
পকেটে দু’হাত রেখে আমাকে বললেন–

— আসলে কি.. কিভাবে বলবো কথাটা সেটাই বুঝতে পারছি না।
মানে তুমি… দেখো উপমা আমি এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি।
পড়াশোনার পাশাপাশি পার্টটাইম ভার্সিটির প্রফেসরের জবটা করছি তাতে আমার নিজের দিব্যি চলে যায়।
মানে আমি যদি চাই নিজের পাশাপাশি আরো একজনের দায়িত্বও নিতে পারি।
তুমি চাইলে আমার ব্যাংক একাউন্টে কত টাকা আছে সেটাও আমি দেখাতে পারি।
তাছাড়া আমার পড়াশোনা কেমন সেটা তো তুমি জানোই।

রাফি ভাইয়া এমন উদভ্রান্তের মতো কথা কেনো বলছেন?
উনি আসলে আমাকে কি বোঝাতে চান আমার মাথায় সেটাই বুঝে আসছেনা।
উনার পার্সোনাল লাইফ সম্পর্কে জানার আগ্রহ আমার মোটেও নেই, যদিও আমি মোটামুটি উনার সম্পর্কে জানি।
কিন্তু ব্যাংক ব্যালেন্স, প্রতি মাসের স্যালারি কত পান এ সম্পর্কে তো আমি কখনই জানতে চাইনি।
বিরক্ত হলেও আমি শান্ত গলায় উনাকে বললাম–

এসব কথা আমাকে কেনো বলছেন?

উনি যেনো আমার এ প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিলেন।
সূর্যাস্ত হয়েছে প্রায় বিশ মিনিট হবে, তবে উনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেনো মাত্র সূর্যোদয় হলো।
মুখে খুশির রেশ টেনে আমাকে বললেন–

আসলে উপমা আমি চাই তুমি আমাকে মানে…
আমি তোমাকে পছন্দ করি।
আর এটা এখন থেকে না আরো বছর খানিক আগে থেকেই পছন্দ করি।
পড়াশোনা আর কাজের চাপে তোমাকে বলাই হয়ে উঠেনি।
তুমি যদি রাজি থাকো আমি আমার বাবা মায়ের কাছে তোমার ব্যাপারে বলবো।

রাফি ভাইয়ার কথা শুনে আমি শুধু অবাকই হয়নি বরং চুরান্ত পর্যায়ের শকড্ হয়েছি।
উনি কিনা আমাকে ভালোবাসেন, কিন্তু কেনো?
গত এক বছরে তো উনার সাথে আমার কখনই দেখা হয়নি!
প্রথমে তো শুধু অবাক হয়েছি কিন্তু এবার বড্ড হাসি পাচ্ছে আমার।
আমি ভালোবাসি রেহান ভাইয়াকে আর রাফি ভাইয়া ভালোবাসেন আমাকে।
প্রকৃতির কি হাস্যকর খেলা, যাকে আমি ভালোবাসি সে আমাকে বোঝেনা অথচ যাকে আমি কোনোদিন ভালোবাসার চোখে দেখিইনি সে কিনা আজ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে নিজের জন্য চাইছে।
সত্যিই প্রকৃতি তুমি যে কি খেলা দেখাও তুমিই ভালো জানো।

রাফি ভাইয়া হয়তো আমার জবাবের আশায় অধির আগ্রহে ছিলেন।
প্রথমে লজ্জা পেলেও পরে আমার দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে ছিলেন।
কিন্তু আমি উনাকে কোনো জবাব দেইনি।
কি জবাব দেবো আমি উনাকে?
আমি আপনার ভাইকে ভালোবাসি, আপনাকে না।
এ কথা শুনলে এখন রেহান ভাইয়ার উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে যাবে সেটা আমি ভালোই বুঝতে পারছি।
আর আমার কথা নাহয় বাদই দিলাম!
কাল বাবার মুখের কথা শুনে আমি অনেক কিছুই বুঝে নিয়েছি।
এক প্রকার ঘৃণা নিয়েই আমি দ্রুত চলে এলাম ছাঁদ থেকে।
উনি হয়তো আমার যাওয়ার পথে চেয়েই ছিলেন।

🥀
🥀
🥀

রাতে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলাম, কালই বাড়ি ফিরে যাবো।
ডিনার শেষে ঘুমোতে চলে এলাম, কিন্তু ঘুম কি আর এতো সহসায় আমার কাছে ধরা দেয়।
এ আর নতুন কি, প্রতিদিন তো প্রায় অর্ধ রাত জেগেই কাটাতে হয়।
এখন আমার অভ্যেস হয়ে গেছে।
নিজেকে এখন কেমন ছন্নছাড়া অনূভুতি শূণ্য নির্জীব প্রাণী মনে হয়।
দিন দিন ইনসমনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছি।

আজ সারাদিন একবারও রেহান ভাইয়ার দেখা পাইনি আমি।
খুব করে চাইছিলাম চোখের দেখা হলেও একবার যেনো উনার দেখা পাই।
কিন্তু না, জনাব আজকে রুম থেকেই বের হননি।
খুব বেশিই বোধয়হ কষ্ট পেয়েছেন উনি বাবার কথায়।
কিন্তু এতে আমার কি দোষ?
উনাকে লুকিয়ে দেখার অধিকারটুকু উনি আমার কাছ থেকে কেনো কেড়ে নিচ্ছেন!
শুধু একটু চোখের দেখাইতো দেখতে চাই।
উনি জানেন, প্রতিদিন দিন কিংবা রাত প্রতিটি মুহূর্তে মগ্ন থাকি আমি উনার ভাবনায়।
উনাকে নিয়ে কতো কি ভাবি আমি।
শিশির ভেজা নগ্ন পায়ে, আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজে হাঁটছি আমরা দু’জন।
পরম আদরে আমি আটকে রেখেছি উনাকে হৃদয়ের গহিন কুঠোরে, আরো কতো কি ভাবি।
বেলা ফুরিয়ে যায়, সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত প্রায় শেষের পথে
তবু উনি আমার কল্পনায় থাকেন।
নিস্তব্ধ রাতের এলোমেলো হাওয়া উনাকে ভাবতে আমায় বাধ্য করে।

🥀

আপনি সেদিন আমায় কিছু বলতে চেয়েছিলেন, বলবেন না?

খুব সাহস করে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে রেহান ভাইয়ার রুমে প্রবেশ করে আমতা আমতা করেই বলে ফেললাম আমি।
বলেই নিচের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।
খুব লজ্জা লাগছে আমার; ভেবেছিলাম সেদিনের বাকি থাকা কথাটা উনি নিজে এসেই আমাকে বলবেন।
কিন্তু কই, রুম থেকেই বের হননি।
তাই বাধ্য হয়ে আমাকেই উনার কাছে আসতে হলো।

উনিও বোধয়হ আমাকে এই মুহূর্তে উনার রুমে আশা করেন নি।
বিছানা থেকে এক প্রকার লাফিয়ে উঠে বসে বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, জেগেই ছিলেন অবশ্য।
বালিশের পাশে ফোন রেখে পা গুটিয়ে বসলেন।
আমি তখনও দরজায় দাঁড়িয়ে আছি।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে উনি বললেন–

— নাস্তা করেছিস?

চোখ ঘুরিয়ে একবার উনার দিকে তাকালাম।
কি শীতল দৃষ্টি উনার, দেখে মনেই হয়না উনি মন খারাপ করে আছেন।
এই মানুষটাকে কেউ কিভাবে কথা শোনাতে পারে আমার কল্পনায় আসে না।
কি মাসুম চেহারা উনার, দেখলেই মায়া হয়।

মাথা নেড়ে বললাম নাস্তা করেছি।

উনি মুচকি হেসে বললেন–

— তোরা কি আজই চলে যাবি?

এ প্রশ্নের উত্তর মুখে বলার সাধ্য নেই আমার।
আচ্ছা উনি কি চান আমরা চলে যাই?
একবার থেকে যাওয়ার কথা তো বলতে পারেন।
এই যাহ্ আমার প্রশ্নের উত্তরই তো দিলেন না উনি।

— আমার অধিকার নেই বলার, তবুও তোরা আজ থেকে গেলে খুশি হতাম।
তুই যা, আমি আসছি।

আমার আসল প্রশ্নের উত্তরটাই তো উনি দিলেন না।
যে জন্য উনার রুমে এলাম সেটাই জানা হলো না।
মন খারাপ করেই চলে এলাম উনার রুম থেকে।

🥀

সেদিনের মতো দু’হাতে ভারি ব্যাগ নিয়ে তিনতলা থেকে নিচে নেমে এলেন রেহান ভাইয়া।
মনে তো চাইছে উনার হাত থেকে কেড়ে নেই ভারি ব্যাগগুলো।
কিন্তু সেটা যে সম্ভব না তা আমি নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছি।
প্রায় আমার ওজনের সমান একেকটা ব্যাগ, তাছাড়া বাবাও সিড়ি ভেঙ্গে নিচে নামছেন।

গাড়ির পেছনে ব্যাগ রেখে রেহান ভাইয়া সামনে এলেন।
আমি জানালার কাঁচটা সম্পূর্ণ নামিয়ে দিলাম।
উনার মুখে স্পষ্ট কষ্টের ছাপ দেখতে পাচ্ছি আমি।
কে জানে, আমার চোখটাও এখন ভারি হয়ে আসছে।
গলা ধরে আসছে, মুখ থেকে কোনো কথাই বের হচ্ছে না।

আমি আড় চোখে উনার দিকে তাকাতেই দেখি উনি এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
চোখ নামিয়ে নিলাম আমি।
ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরি।
জড়িয়ে ধরে বলি, ভালোবাসি আপনাকে আমি।
খুব ভালোবাসি আপনাকে।
না আর তাকাবোনা ঐ চোখের দিকে।
উনার ঐ চোখের মায়া আমাকে ভষ্ম করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।

গাড়ি স্টার্ট দিতেই উনি দৌড়ে এসে…..

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here