একা_বেঁচে_থাকতে_শেখো_প্রিয়
#পর্ব_১৫
#Adharer_Musafir (ইফ্ফাত)
#
ওয়াশরুমের দরজার ছিটকিনিটা আস্তে আস্তে খুলে এক চোখ দিয়ে খুব গোপনে দেখার চেষ্টা করছি উনি এখনও আমার রুমে আছেন কিনা।
বিছানার দিকে তাকাতেই চোখ আমার কপালে উঠার উপক্রম।
এক দৌড়ে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে বিছানার পাশে এসে দাঁড়াতেই দেখি উনি আমার ফোন হাতে নিয়ে বসে আছেন।
এই রে, রাতে উনার আইডি ঘাটতে ঘাটতেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও জানিনা।
ফোন ওপেন করতেই উনি কি দেখেছেন কে জানে!
ধ্যাৎ কেনো যে ফোন লক করিনা আমি কে জানে!
এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমার।

উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি রেহান ভাইয়া আমার ফোনে কি দেখছেন।
কিন্তু না, জনাব এমন ভাবে আমাকে আড়াল করে আমারই ফোন ঘাটছেন যেনো আমি উনার কোনো গুপ্তধন চুরি করে নিয়ে যাবো।
অস্বস্তিকর একটা মুহূর্ত পার করছি আমি।
একে তো হুট করে আমার রুমে চলে এলেন তার উপর বলা নেই কওয়া নেই আমার ফোন ঘাটছেন, কি সাংঘাতিক।

🥀
🥀

ডাইনিং টেবিলে বসে সবাই একসাথে খাবার খাচ্ছি।
যদিও আমাদের বাসার কেউই এ সময় কথা বলে না, কিন্তু আজ মহলটাই ভিন্ন রকম।
ঠিক যেনো কোনো উৎসব শুরু হয়ে গেছে, আমান ভাইয়া এসেছে বলে কথা।
আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হলেও বাকি আট দশটা পরিবারে বহুদিন পর বড় ভাই এসে বোনের কুশল বিনিময়টুকুও করবে না এটা কেউই মানতে পারবেনা হয়তো।
সে যাই হোক, বোন হিসেবে ‘কেমন আছো’ দুই শব্দের বাক্যটা যে আমি আমান ভাইয়াকে আগ বাড়িয়ে বলতে পেরেছে এতেই আমি হাফ ছেড়ে বেঁচেছি।

রেনু আপু ছাড়া রেহান ভাইয়ারা সবাই আজকে এ’বাড়িতে এসেছেন।
আমান ভাইয়া এসেছে, তাই খালামনিদের কেউ একজন সবাই মিলে নানু বাড়ি যাওয়ার কথা বলতেই সবাই এক পায়ে খাড়া হয়ে যায়।
রাফি ভাইয়াও এসেছেন তবে আমার সামনে এখন অবদি পড়েন নি।
সেদিন রাফি ভাইয়াকে এড়িয়ে চলে আসার পর উনি একবারের জন্যও আমার সামনে আসেন নি।
যাক গে, তাতে আমারও যে খুব ক্ষতি হয়েছে এমনটাও না।

আজ কতগুলো বছর পর মায়ের বাড়ির সব কাজিনরা এক হবো।
বাবার সরকারি চাকরির জন্য ক’মাস পরেই হয়তো বদলি হতে হবে আমাদের, এর আগেই একবার নানু বাড়ি ঘুরে আসাটাই বোধহয় ভালো।
স্বপরিবারে ঘুরতে যাওয়ার কথা উঠলেই রেহান ভাইয়ারা আমাদের বাড়ি এসে হাজির হবেই হবে।
উনাকে চুপি চুপি দেখার জন্য এটা অবশ্য একটা ভালো দিক।

এসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতেই সামনে তাকিয়ে দেখি রেহান ভাইয়া সহ টেবিলের সবাই আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
সবাই আমার দিকে তাকিয়ে থাকার কোনো কারন আমি দেখছিনা।
এবার আমিও তাদের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি এখানে কি হয়েছে!

— কি হলো উপমা, তোমার খালামনি জিজ্ঞেস করছে তোমার পরীক্ষা কেমন হয়েছে।
চুপ করে আছো কেনো!

মায়ের তীক্ষ্ণ নজরে বলা কথা শুনে আমি খালামনির দিকে একবার তাকালাম।
উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
আড় চোখে একবার রেহান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি উনিও মুচকি হাসছেন।
মুহূর্তেই খাবার গলায় আটকে গেলো আমার।
কাশছিলাম তখনই পাশ থেকে উম্মি পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো।
পানি খেয়ে খালামনির দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করেই বললাম–

হ্যাঁ হ্যাঁ সব ভা..ভালো হয়েছে।

বলেই নিচের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ খাবার খেয়ে যাচ্ছি আমি।
এমনিতেও আমি চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে তারউপর এভাবে রেহান ভাইয়ার সামনে হাসির মাত্র হবো জানলে সবার সাথে একসাথে বসে খেতেই আসতাম না।

🥀
🥀
🥀

রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছি কাল সত্যিই নানু বাড়ি যাবো।
এত মানুষের ভিড়ে রেহান ভাইয়াকে দেখার সুযোগটাই পাবো না হয়তো।
এত এত মানুষ, সবাই রেহান ভাইয়াকে দেখবে।
কত্ত মেয়ে মানুষ থাকবে সেখানে, তারা কি আর লোক লজ্জা বোঝে!
ঘৃণা করি আমি সেসব চোখ, আমি ছাড়া যে চোখ উনাকে দেখে তৃপ্তি পায় সেসব চোখকে ঘৃণা করি আমি।
খুব কষ্ট হয়, হবেই তো।
পছন্দের মানুষটাকে অন্য কারো সাথে দেখলে তো কষ্ট হবেই।
হতে পারে উনার সাথে আমার তেমন কথা হয়না, তেমন একটা ভাবও নেই, কোনো দিন ভালোবাসি বলতেও পারিনি তাও কষ্ট হয়।
রেহান ভাইয়া আপনি কি বোঝেন এই কষ্ট কাউকে বলতে যাওয়া কতটা বোকামির কাজ!
ওগুলো যে নিজের মধ্যে রেখে দিতে হয় আমার।
নাহয় আমি যে হাসির পাত্র হয়ে যাবো।
অনুভূতি কি বলে বোঝানো যায়?

🥀

সকাল হয়েছে, ঘাসে ঘাসে পৌঁছে গেছে শিশিরের আলিঙ্গন।
সময় হয়েছে আরো একটি নতুন সূর্যের আলোয় ভেসে যাওয়ার।
দ্রুত তৈরি হয়ে ব্যাগ পত্র নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম আমি।
আমার অপেক্ষায়ই ছিলো সবাই।
রেহান ভাইয়া এগিয়ে এসেছিলো আমার ব্যাগ ধরতে।
এবার আমি নিজের বিবেকের কাছে আর নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেইনি।
আর বাকি সবাই কি করেছে জানিনা, জানতেও চাইনা।
জেনে গেলেই বোধহয় আগের বারের মতো এবারও কষ্ট হবে আমার।
নিজের ব্যাগ নিজেই বয়ে নিয়ে উঠেছি গাড়িতে।
তবে কৃতজ্ঞতা বোধ রেহান ভাইয়ার জন্য আমার বরাবরই ছিলো এবারও হলো তাই।
উনি মানুষটাই এমন, অন্য কিছু নাইবা থাকুক অন্তত কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে হলেও আমার উনাকে নিঃস্বার্থে ভালোবেসে যাওয়া উচিত।

🥀

গাড়িতে বসে আছি আর লুকিয়ে লুকিয়ে রেহান ভাইয়াকে দেখছি।
কিন্তু কি আশ্চর্য উনি একবারও আমার দিকে তাকালেন না!
অবশ্য তাকালে খুশি থেকে বরং লজ্জাই পেতাম বেশি।
তাই বলে একবারও তাকাচ্ছেন না কেনো!
আমার দেখার অধিকার উনার আছে কিনা জানিনা।
কিন্তু উনাকে দেখার পূর্ণ অধিকার আমার আছে, জোড় করেই অধিকার নিয়ে নিয়েছি অবশ্য।
সে যাই হোক, খুব অভিমান করেছি আমি উনার সাথে।
পাহাড় সমান অভিমান নিয়ে জানালার গ্লাস ভেদ করে বাহিরে তাকিয়ে আছি আমি।
অভিমান করতেও যে অধিকার লাগে।
একবার চোখা চোখি হয়ে গেলে কি খুব ক্ষতি হতো?

বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে।
মেঘেরাও বুঝি আমার মতো অভিমান করে বসে আছে!
তবে আর যাই হোক, একই গাড়িতে সামনা সামনি না হয়েও উনাকে ঢের অনুভব করতে পারছি আমি।
একদম আমার পাশে।
বাতাসের হালকা শীতল ঝাপটা আপনার আর আমার চোখে মুখে বাড়ি খাচ্ছে।
মন ঠান্ডা করা বৃষ্টির ফোঁটাতো সাথে আছেই।
গাড়ি চলছে ফুল স্পিডে, আমি বার বার আড় চোখে লুকিং গ্লাসে আপনাকে দেখছি।
এর চেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত আর কি হতে পারে বলুন তো!
ওমম মনে করুন এখন বর্ষা, অঝর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে।
বৃষ্টির মাঝেই তুলোর মতো এক টুকরো কালো মেঘ।
বাকি সব মেঘ উধাও হয়ে গেলো।
আমি ভাসছি ঘুম আর আপনার ঠিক মাঝামাঝি।
নিজেকে ছেড়ে দিয়েছি জীবনের হাতে।
না না জীবন তো নয়, একটা গোটা হতাশা বলা যেতে পারে।
যে হতাশায় বর্ষায় ভিজলে মাথা ভেজেনা, হাঁটলে আলো চেখো পরে না, জীবনটা ঠিক তেমনই।
ধূলোর মাঝে এক রাশ ঘৃণা, মনের মাঝে রাজ্যের ঘুম না হওয়া বিষাদ।
এক পৃথিবীতে হিসাবহীন জীবন্ত লাশ, আর চোখে একা বেঁচে থাকার তীব্র ভয়।

🥀

দেখতে দেখতে কখন যে নানু বাড়ি এসে পৌছেছি সে খবর আমার অজানা।
অজানা বলছি কারন, সেই যে চোখ বন্ধ করে এক ঘুম দিলাম একেবারে নানু বাড়ি এসে চোখ খুলেছি।
এই এক সমস্যা আমার, জার্নির নাম শুনলে চোখে ঘুম চলে আসবেই।

🥀

গাড়ি থেকে সবাই খুব সাবধানে নেমে গেছে।
পেছনে থাকায় আমিই সবার পরে নামছি।
বৃষ্টির পানিতে গ্রামের মাটির রাস্তাগুলো কাঁদায় পরিনত হয়েছে।
মাটির তীব্র ঘ্রানেই শরীরটা যেনো কেঁপে উঠলো।

🥀

কাঁধের ব্যাগ হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে খুব সাবধানে নামলাম আমি।
একটু উঁচু হিল পরেছি তবে পিচ্ছিল রাস্তা হিল জুতোকে কাবু করতে এক সেকেন্ড সময়ও নেবে না।
খুব সাবধানে এক পা এক পা করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি।
এই কর্দমাক্ত রাস্তায় পরে গেলে মান সম্মান যে আমার কানা কুড়িও থাকবে না।
বাম হাতে জামার এক সাইড ধরে সামনে পা ফেলতেই আমি পেছনে হেলে পড়লাম।
এক নেনো সেকেন্ডের মধ্যেই বুঝতে পারলাম এখনই আমি পা পিছলে পরে যাবো।
হাত থেকে ব্যাগ ফেলে কোনো মাধ্যম খোঁজার আগেই….

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here